অন্যদিন, পথের রেখায় নতুন আলো: সেলিনা হোসেন

অন্যদিন, পথের রেখায় নতুন আলো: সেলিনা হোসেন

‘অন্যদিন’ পত্রিকার প্রকাশ পত্রিকার মাত্রায় নতুন সংযোজন। প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে। পত্রিকাটি হাতে পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল নতুন পত্রিকার এই সংযোজন বাংলাদেশের সামাজিকমাত্রার পরিসর বাড়াবে। পরের বছর ১৯৯৭ সালে চমৎকার একটি ঈদসংখ্যা প্রকাশিত হয়। আমি এই সংখ্যায় একটি উপন্যাস লিখেছিলাম। আমার উপন্যাসের নাম ‘স্বপ্নের কুয়াশায় হেঁটে যাওয়া’। অন্য যারা লিখেছিলেন তারা হলেন, রাহাত খান, রাবেয়া খাতুন, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রিজিয়া রহমান, মঈনুল আহসান সাবের, নাসরীন জাহান এবং রেজানুর রহমান। 

ঈদসংখ্যাটি হাতে পেয়ে অনেককে প্রশংসা করতে শুনেছি। ভালোলাগার মাত্রায় তারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। কাউকে কাউকে বললাম, সম্পাদককে অভিনন্দন জানান। তারা হেসে বললেন, আমাদের সঙ্গে তো পরিচয় নাই। বললাম, আমি ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি। ফোন করুন। তারা ফোন নম্বর নিলেন। ফোন করলেন সম্পাদককে। পাঠকের এই প্রতিক্রিয়া কাছ থেকে দেখেছি। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলে সেটা অর্জনের মাত্রায় টিকে যায়। এভাবে ‘অন্যদিন’ দীর্ঘ সময় ধরে প্রকাশিত হয়ে আসছে। সাংস্কৃতিক পরিচর্যায় এটি একটি বড় দিক। এই পত্রিকার আর একটি দিক ছিল যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা ঈদসংখ্যায় লেখার সুযোগ পান। এভাবে বাংলা ভাষার বিস্তার ঘটে। পাঠক ভিন্ন দেশের উপন্যাস পড়ে আনন্দ পান। লিখেছেন অনেকে। যেমন—শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, বুদ্ধদেব গুহ, দিব্যেন্দু পালিত, সমরেশ মজুমদার...।

সাংস্কৃতিক জগতটাকে ধারণ করার জন্য ‘অন্যদিন’পত্রিকায় নানাদিক তুলে ধরতেন সম্পাদক। ঈদসংখ্যা প্রকাশ করে যেমন সাহিত্যের ভান্ডার ভরিয়েছেন, তেমনি আমাদের অনন্য চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদকে দিয়ে ঈদসংখ্যার প্রচ্ছদ করিয়েছেন। শিল্পী শাহাবুদ্দিন প্যারিসে থাকেন। এই অসাধারণ শিল্পীর মাত্রাটি ‘অন্যদিন’ পত্রিকার প্রচ্ছদে তুলে ধরা হয়েছে, যা সাংস্কৃতিক চেতনার একটি বড় দিক পাঠকের কাছে। সাহিত্যের পাশাপাশি তাঁরা শিল্পীর কাজের স্বীকৃতিও দেখে পত্রিকার প্রচ্ছদে। এটা সাংস্কৃতিক জগতের বড় প্রেরণা। 

এই পত্রিকার আর একটি দিক হলো দেশের প্রয়াত লেখকদের নিয়ে প্রকাশ। ‘শিকড়ের সন্ধানে’ শিরোনামে প্রকাশ করা হয়েছে লেখকদের নিয়ে প্রতিবেদন। এভাবে প্রয়াত লেখকদের পাঠকের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। তাঁদের জীবনভিত্তিক তথ্য এবং রচনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্ধ শতাধিক লেখক এখানে উঠে এসেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন—মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মীর মশাররফ হোসেন, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মোহাম্মদ নজিবর রহমান, উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, বেগম রোকেয়া, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, সত্যেন সেন, জীবনানন্দ দাশ, আহসান হাবীব, শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হান, হুমায়ুন আজাদসহ আরও অনেকে। এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। একটি পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

‘বৈশাখী’ সংখ্যা প্রকাশ ‘অন্যদিন’ পত্রিকার আর একটি সাংস্কৃতিক বহিরাবরণ। বেশ বড় কলেবরে বাংলা বর্ষ বরণ করেছে ‘অন্যদিন’-এর সম্পাদক। বাংলা বর্ষ বরণ বাঙালি সংস্কৃতির বড়দিক। একবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন ১লা বৈশাখ উদ্যাপনের প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন, এই উৎসব আয়োজন আমার খুব ভালো লাগে। বাংলা-বাঙালি বিশ^ জুড়ে এই আয়োজন বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছে। সম্পাদক ‘অন্যদিন’-এর চারটি বৈশাখী সংখ্যা করার পরে আর করেন নি। আমার মনে হয় এই সংখ্যাটির প্রকাশ অব্যাহত রাখা জরুরি। আমাদের প্রত্যাশা ভবিষ্যতে এমন সংখ্যা প্রকাশ করে এই প্রজন্মের কাছে সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরবে। প্রজন্ম এগিয়ে যাবে শেকড়ের টান বুকে নিয়ে। বাঙালি জাতিসত্তায় তারা যেন নিজের পরিচয়ের জায়গাটি পূর্ণ রাখে। বিশে^র দরবারে আমাদের অর্জন নানাভাবে পৌঁছেছে। আগামী প্রজন্মকে এই অর্জন ধরে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি করতে হবে। 

‘অন্যদিন’ পত্রিকা সামাজিক বাতাবরণে নানা দিকের নানা মাত্রা ধারণ করে পাঠকের জানার আগ্রহে সঞ্চায়িত করেছে নানা দিক। যেমন ১৯৯৭ থেকে ঈদ-ফ্যাশন প্রতিযোগিতা শুরু করে। অন্যদিকে রান্না, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে পত্রিকার পৃষ্ঠা ভরিয়ে সামাজিক দিক চর্চা করেছে। পাশাপাশি খেলাবিষয়ক প্রতিবেদন নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বিশ^কাপ ক্রিকেট ও ফুটবলকে ঘিরে বিশ^কাপ অ্যালবাম প্রকাশ করে পাঠককে খেলার আনন্দ দিয়েছে। এসব নিয়ে কুইজ প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হতো। খেলা-প্রিয় পাঠকের আনন্দের সীমা ছিল না এইসব সংখ্যা হাতে নিয়ে। পড়ার আনন্দ ভিন্ন মাত্রায় চলে যেত। এটিও সামাজিক বাতাবরণের আর এক দিক। ভ্রমণের ওপরও সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছে ‘অন্যদিনে’। আমি নিজেও ভ্রমণের পাঠক। নতুন জায়গা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠি। ‘স্বাস্থ্য’ বিষয়টিরও আমি আগ্রহী পাঠক। ‘রান্না’ বিভাগে রান্নার রেসিপি পড়ে এবং খাবারের উপাদান বিষয়ে নানা ধারণা লাভ করতে পারি। এভাবে ‘অন্যদিন’ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পাঠকের আনন্দের সূত্র। 

এমন একটি পত্রিকায় সাহিত্যসহ সামাজিক চেতনাবোধের রং উজ্জ্বল করে প্রকাশিত হতে থাকলে সে পত্রিকা হবে পাঠকের পথের দিশারি। অভিনন্দন জানাই পত্রিকার সম্পাদকসহ সবাইকে, যারা এর প্রকাশের মাত্রাকে দিগন্ত বিথারী করে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.