খেলা।। মাহবুব ময়ূখ রিশাদ

খেলা।। মাহবুব ময়ূখ রিশাদ

শীর্ণকায় একটা ছেলে গোল করে লাফ দিয়েই উঠে পড়ল রোনালদিনহোর কোলে। ধারাভাষ্যকার বললেন, রিমেম্বার দ্য নেইম লিওনেল মেসি। 
তাহিরও গোলটা দেখে লাফ দিয়ে উঠল। শুয়ে ছিল ড্রয়িংরুমে, মনের একটা অংশ চেষ্টা করছিল ঘুমানোর, তবে চোখ ছিল টিভিতে। বাসায় ডিশ এসেছে বেশিদিন হয় নি। রাত ১২টা পার হয়েছে। টিভির ভলিউম কমিয়ে ঘুমহীন চোখেই দেখছিল খেলা।
 

মেসিকে নিয়ে কয়েকদিন ধরেই লেখালেখি হচ্ছে পত্রিকায়। আর্জেন্টিনার প্লেয়ার। অনেকে বলছে নতুন ম্যারাডোনা। তাহির অবশ্য এসব বিশ্বাস করে না। কত ম্যারাডোনার কথা শোনা যায় এমন। ওর্তেগা ঢুঁস মেরে যে ’৯৮-এর বিশ্বকাপটা ফেলে দিল তারপরের বিশ্বকাপেও বিয়েলসা এসেও আর্জেন্টিনা বাদ পড়ল প্রথম রাউন্ড থেকে, সেই কথা তাহির ভুলতেই পারে না। ওই ছোট বয়সেই কত অপমান দেখা হয়ে গিয়েছিল ওর। 
মেসির খেলা আজ দেখেছে প্রথমবারের মতো। দেখে স্বপ্ন জেগে উঠেছে। ভালো লেগেছে। ঘুম যাও ছিল তাও সরে গেছে দূরে। লিকলিকে একটা ছেলে। বয়সে আর কত-বা বড় হবে ওর? রোনালদিনহোর কোলে আসলে মেসি নয়, তাহির নিজেই যেন উঠে পড়েছে, এ কথা ভাবতেই মুখে ফুুটে উঠল হাসি। মনে হচ্ছে, সামনে কিছু একটা হবে। কেবল আর্জেন্টিনার নয়, তার নিজেরও অনেক কিছু পাওয়ার আছে। এতদিন ধরে যে বাতিস্তুতা হতে চাচ্ছে, সেই স্বপ্ন তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

বাসা থেকে তাকে খুব একটা আটকায় এমন না। কিন্তু দেশের ফুুটবলের অবস্থা ভাবতেই কান্না পায় তার। না হয় হলো খুব ভালো একটা স্ট্রাইকার, তারপর? মফস্বলের গণ্ডি পার হয়ে ঢাকার কোনো ক্লাবে সুযোগ পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়, আবার যদি কোনোভাবে সুযোগ পেয়েও যায় লীগও হয় না ঠিকঠাকভাবে। পাতানো খেলা, পলিটিক্স, কত কী শোনা যায়! দিন দিন দেশের ফুুটবলটা কেবল পিছিয়ে যাচ্ছে। কই মোনেম-মুন্নাদের সময় ১১০ র‌্যাংকিংয়ে চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ। এই দেশে সুযোগ পেলেও কি সাফ গেমসের দু একটা ম্যাচ খেলে তার বাতিস্তুতা হওয়া হবে ? তাহির ভেবে রেখেছে যেভাবেই হোক তাকে ইংল্যান্ড অথবা ইটালি না হলে স্পেনের কোনো একটা ছোট শহরে চলে যেতে হবে। গিয়ে ছোট কোনো ক্লাবে আগে ট্রায়াল দেবে। তাকে নেবে এই বিশ্বাস তাহির রাখে। ইংল্যান্ডে যাওয়া তার জন্য একটু সোজা হবে। ওখানে তার মামা থাকে। এমনকি সে ঠিক করে রেখেছে বাবাকে বলবে যেন বাবাও চলে যায়। তাহিরের বাবা ব্যবসা করে, আয়-রোজগার মন্দ নয়, চাইলে তো যেতেই পারে। এমন কী আর!  তক্কে তক্কে আছে, সুযোগ পেলেই বলবে। বাবা খুব রাগী হলেও এই কথা নিশ্চয় হেসে উড়িয়ে দিতে পারবে না। 

এসব নানা ভাবনার ভেতরে তাহিরের মনে পড়ল স্যার সাবধান করে দিয়েছিলেন রাত জাগার ব্যাপারে। অথচ সে ইংল্যান্ডের বরফঠান্ডা দিনে সবুজ মাঠে রানিং প্র্যাকটিস করছে, কিছুক্ষণ পর ট্রায়াল। ওর পাশে দৌড়াচ্ছে মেসির মতো দেখতে লিকলিকে শরীরের লাতিন আমেরিকান এক কিশোর। 
স্যার বলতে তাহিরদের কোচ হারুন, যার মাথায় একটা চুলও নেই, কিন্তু ভুরু ঘন ভীষণ, তারচেয়েও ঘন তার গোঁফ। দেখেই ভয় লাগে এমন। স্যারের কথা ও অমান্য করে না। আজ করছে। স্যার দেখলেই বুঝে যাবেন তাহির জেগেই ছিল। আর এটা বুঝে গেলে স্টার্টিং ইলেভেনে নাও নামাতে পারে। ইন্টার স্কুল ফুটবলের সেমিফাইনাল খেলা, নিশ্চয় তাহির বেঞ্চে বসে কাটাতে চাইবে না। এমনিতেও মাথায় ওপরে চাপ। একটা মাত্র গোল করেছে পুরো টুর্নামেন্টে। গত খেলায় পেনাল্টি মিস করে তো গালি খেতে খেতে শেষ। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা ছিলেন বাবা। খেলা সাধারণত দেখতে যান না, সেদিন যে কী মনে করে মাঠে গেলেন, কে জানে!
বাড়ি ফেরার পর খাওয়ার টেবিলে বললেন, পড়াশোনা বাদ দিয়া ফুটবল খেললে ওই চান্দের দেশেই যাওয়া লাগবে। তাও খেলো যখন মন দিয়ে খেলো। সেটাও তো পারো না। 
কোনোমতে খাওয়া শেষ করে শোবারঘরে সে পালিয়েছিল সেদিন। 

মা প্রেগন্যান্ট। নতুন মানুষ আসবে ঘরে। এটা নিয়েও উত্তেজনার শেষ নেই। সেদিন বাবার কথায় মন খারাপ হয়েছিল তার। মনে হচ্ছিল, সত্যি তো। কী এমন হাতি ঘোড়া খেলি! না, এবার টুর্নামেন্ট শেষ হলে মন দেবে পড়ায়। তার আগে আর দুটো ম্যাচ। দুটো ম্যাচেই তাকে ভালো খেলতে হবে। কে জানে বাবাকে হয়তো ইংল্যান্ড যেতে রাজি করিয়েও ফেলতে পারে। উত্তেজনায় মাহিরের ঘুম আরও চলে যায়। টিভির খেলাও ততক্ষণে শেষ হলে টের পায় এই মশারিবিহীন ঘরে আপাতত মশারা তাকে নিয়ে ফুটবল খেলছে। 
ওদের বাসাটা বড়। তিনজন মানুষের তুলনায় তো বটেই। তাহির উঠে নিজের ঘরে যায়। ঘর লাগোয়া বারান্দা। দরজা খোলা। মা প্রতিদিন বলে দেয় লাগাতে। সে প্রতিদিন ভুলে যায়। বারান্দার সামনেই জংলামতোন পুকুর। মশা ঘরে ঢুকতে দুই মিনিট সময় নেয় না। মশারিটা টাঙানো আছে। সে সুরুত করে ভেতরে ঢুকে যায়, তবে দরজাটা লাগায় না। বামকাত হয়ে শুলে আকাশ দেখা যায়, অন্ধকার আকাশ। কয়েকটা তারা ফুটে আছে। স্বপ্নাতুর হয়ে সে ভাবতে থাকে কতকিছু। যেমন সে ভাবছিল রেনিওর কথা, যে রেনিওর সাথে তার এখনো দেখা হয় নাই। কিন্তু তার মনে হয় রেনিও নামের কেউ একজন, তার বয়সী কোনো এক কিশোরী, গোল একটা চশমা, মাথায় বেণি করা খোঁপা নিয়ে তার মতোই উচ্ছ্বাস নিয়ে খেলা দেখতে আসবে এবং যে মুহূর্তে তাহির বাইসাইকেল কিকে বলটা জড়িয়ে দেবে গোলে, রেনিও পাঠিয়ে দেবে ফ্লাইং কিস, যে চুমু বাতাসে লাফিয়ে উঠে আদায় করে নেবে তাহির।  

তাহির টের পায় শরীরে একটা পরিবর্তন। অস্থিরতা। এই অস্থিরতা অন্যরকম। ইদানীং প্রায় হচ্ছে। অস্থিরতার শুরুটা তাকে আনন্দ দেয়, এতটাই আনন্দ সেই কাল্পনিক রেনিও বয়সে বড় হয়ে, তরুণীর অবয়বে হাজির হয় তার কাছে, নিঃশ্বাসও সে শুনতে পায় আর সেই সঙ্গে বুঝতে পারে কিশোর শরীরটা মুহূর্তেই হয়ে উঠেছে যুবক। তখন তার হাত একাই চলে যায় নিচে, খুব সতর্কভাবে খুলতে চেষ্টা করে জিপার, তারপর ধীরে ধীরে সব শান্ত হয়ে আসে, তাহির ঘুমিয়ে পড়ে। 
সকালবেলা সে আর নিজের দিকে তাকাতে পারে না, একটা লজ্জা, একটা অবসাদ তাকে ঘিরে রাখে। অথচ আজ  খেলা, ভালো খেলতে না পারলে পেছনের কারণ হিসেবে এমন লজ্জার কথা কি কাউকে সে বলতে পারবে ?
বেশিক্ষণ অবশ্য ভাবনার ভেতরে থাকতে পারল না। নয়টা বেজে গেছে। এগারোটা থেকে খেলা। আর ত্রিশ মিনিটের ভেতরেই থাকতে হবে মাঠে। ওয়ার্ম আপ। রেডি হয়ে বের হতেই দেখল টেবিলে নাস্তা নেই, ঘরও লাগছে শূন্য। মায়ের ঘরে কেউ নেই, বাবার ঘরে কেউ নেই। বাসার কাজের মানুষ মিনুকেও দেখল না।  চাচাকে দেখতে পেল কিছু একটা খুঁজছেন। কোথাও যাচ্ছেন। ঘামে ভিজে শেষ। 
কী হয়েছে চাচা? তাহির জানতে চাইল শঙ্কিত স্বরে। 
তোর আম্মাকে নিয়ে হাসপাতালে গেল বড়ভাই। আমিও যাচ্ছি। তুই বাসাতেই থাকিস। 
হাসপাতাল!
চাচা যেন তাহিরের কথা শুনতেই পেলেন না। বের হয়ে গেলেন আর কিছু না বলেই। 

দুই
রাইট উইং-এ বলটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাহির বডি ডজে মার্কারকে ছিটকে ফেলে কাট ইন করে ডি বক্সের ঠিক বাইরে থেকে একটা শট নিল। লেফট আপার কর্নারের বারে লেগে বল জালে ঢুকে পড়ল। গোল! খেলার এক মিনিট বাকি থাকতে তাহিরের গোল। পুরো ম্যাচটা এত বাজে খেলছিল যে গোল যে দিতে পারবে এটা নিজেই আসলে বিশ্বাস করতে পারছে না তাহির। কিছুক্ষণ বোধহয় তাকিয়ে থাকল। এরপর আর পারল না। দলের বাকি সবাই মিলে ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাহিরদের স্কুল ফাইনালে! এই প্রথমবার! যা কোনোদিন হয় নি, তাই এবার হচ্ছে। উল্লাস আর আটকায় কে!
সেলিব্রেশন শেষ হতে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। খেলা আবার শুরু করতে না করতেই বেজে উঠল শেষ বাঁশি। এবার মাঠে ছুটে এল স্কুলের সবাই। হারুন স্যারও এলেন। অনেক হইচই-এর ভেতরে তাহির এটা শুনতে পেল, ওয়েল প্লেইড। কে বলল, কথাটা ? 
ভিড়ের ভেতরে কোনোমতে ঘাড় বাঁকিয়ে তাহির দেখতে পেল হারুন স্যারকে। স্যার, সত্যি প্রশংসা করছেন তার? 

এর ভেতরেই আচমকা ওর মনে পড়ে গেল মা হাসপাতালে। আর তাকে বাসায় থাকতে বলেছিলেন চাচা। দুপুর পার হয়ে গেছে। রোদ খুব কড়া। সহসা এখান থেকে যেতে পারবে বলে মনে হয় না। যদিও মায়ের কথা বলে খুব সহজেই চলে যেতে পারে সে কিন্তু আদৌ আসলে যেতে চাচ্ছে না। সবার মনোযোগের কেন্দ্রে থাকার যে আনন্দ তা কি এত সহজেই আড়াল করে চলে যাওয়া যায় ? অবশ্য কারণটা সহজ কিছু নয়। মা হাসপাতালে! তাহিরদের জীবনে আসছে নতুন কেউ, পরিবারে নতুন মানুষ। একদিনে দুইটা আনন্দের খবর, যেখানে বছরে একটাও পাওয়া যায় না। আপাতত মাঠের আনন্দ বেছে তাহির বলতে পারল না চলে যাওয়ার কথা। যদি বাসায় কেউ ফিরে আসে আর দেখে সে নাই তাহলে তুলকালাম হবে সেই ব্যাপারে সন্দেহ নাই। 
খাওয়াদাওয়া, উল্লাস শেষে কে যেন বলল, চল বিদ্যাময়ীর সামনে থেকে ঘুরে আসি।  বিদ্যাময়ী শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত মেয়েদের স্কুল। অবশ্য তাহির নিজেই ভেটো দিল। বলল, এখন স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। গিয়ে কী করবি ? এরচেয়ে ফাইনাল জিতেই আমরা যাব।

সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে সমস্ত উত্তেজনা থিতিয়ে এল। তাহির বাড়ির পথ ধরল। স্কুলের মাঠের উল্টোদিকে ছোট একটা গলি। সেই গলি ধরে চলতে শুরু করল। এখানেই সিদ্দিক স্যারের বাসা। পড়তে আসে। স্যারের বাসার তিনতলায় ওর বয়েসের যে মেয়েটা বিদ্যাময়ীতে পড়ে সে কি জানতে পেরেছে তাহিরের গোলের কথা ? মেয়েটা কি খেলা দেখতে গিয়েছিল আজ ? অস্থির লাগতে থাকে। কেননা খুব দ্রুত তার মস্তিষ্কের মেমোরি সেলগুলো নড়াচড়া করছিল। এই সেটা চলে যাচ্ছে খেলার মাঠে, আবার মায়ের কাছে হাসপাতালে, আবার নতুন তারকা মেসির পায়ের কাছে, কখনো কল্পনার রেনিও কিংবা বাস্তবের সিদ্দিক স্যারের বাসার প্রতিবেশী যার নাম এখনো তাহির জানে না। দেখতে দেখতে পথটা শেষ হলো।  একটা ট্রেনলাইন যেটা বহুদিন ধরে অচল, আশেপাশে বাজার। বাজারের ওপাশে আরেকটা রাস্তা। রাস্তার পূর্বদিকে শেষবিদায় স্টোর। তার একটু সামনেই তাহিরদের বাসা। 

তিন
হামাগুড়ি দিতে দিতেই তাহিরের ছোটভাই মাহিরের জন্মদিন এসে পড়ল। সেদিনই তাহির আরেকটা সুখবর পেল। মামা এসেছেন কয়েকদিন আগেই। মামা যে সত্যি সত্যি বাসায় রাজি করিয়ে ফেলবে, এটা আসলে স্বপ্নে ভেবেছে ঠিকই তাহির কিন্তু বাস্তবে একেবারেই নয়। 
আপা তোমার ছেলেটা কিন্তু ভালো খেলে। শরীরটাও ফিট কিন্তু। আমার কাছে দিয়ে দাও ওকে। ওখানে গেলে তাও কিছু একটা করার সুযোগ থাকবে। আর পড়াশোনা করতে চাইলে সেটাও কিন্তু পারবে। 
আপা মানে তাহিরের আম্মা রাজি হয়ে গেলেন। ছেলের ওপর রাগ থেকে নয়। চিন্তা থেকে। ছোট বাচ্চাটার জন্মের সময় তাহির যে ফুটবল খেলতে গিয়ে গায়েব হয়ে গিয়েছিল, রক্ত দেওয়ার সময় কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, সেই কথা কি চাইলেই ভুলে যাওয়া যায় ? আবার একজন মা কতক্ষণ রাগ করে থাকতে পারে!
তাহিরের বাবা কয়েকদিন আগে বলছিলেন, দেশের অবস্থা ভালো না। ছেলেটাকে তোমার ভাইয়ের কাছে দিয়ে দিই। 
কেন তাহিরের বাবা আসলে কথাগুলো বলেছিলেন তার নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। হয়তো অন্য সব বাবা-মায়ের মতো ছেলের ভবিষ্যৎ তাকে চিন্তিত করে তুলছিল। 
বললেই নিয়ে যাওয়া যাবে এমন নয়, কথাটা শুনে তাহির কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে বসে থাকল। সত্যি সে লন্ডনের কোনো ক্লাবে ট্রায়াল দেওয়ার সুযোগ পাবে ? ওরা অনেক কম বয়স থেকে স্কাউট করে। সেই অনুযায়ী ওর বয়স তো বেশি। স্কুল ফুটবলের সেমিফাইনালে এবং ফাইনালে গোল করার পর গত এক বছর লোকাল একটা ক্লাবে খেলছে বটে কিন্তু সেটা গোনায় আসার কথা নয়। আনন্দের চূড়ায় গিয়ে তাহির আবার বিষণœ হয়ে ওঠে। ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসে। আর তখনই দেখতে পায় একটা ট্রাক ছুটে আসছে এবং কীভাবে যেন মাহির মানে তাহিরের ছোট্ট ভাইটা রাস্তার মাঝখানে। 

চার
১৮ ডিসেম্বর, ২০২২। 
ঝাপসা চোখে খেলা দেখছে তাহির। বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল। একা। ঘরের ভেতরে। একটু পর টাইব্রেকার। টিভিটা বন্ধ করে দিল। এমিলিয়ানো মার্টিনেজ যেভাবে পা ঠেকিয়ে একদম শেষ মুহূর্তে মেসিকে বাঁচিয়ে রাখলেন ঠিক সেভাবেই কি মাহিরকে বাঁচিয়েছিল তাহির ? এজন্য কি চোখ ঝাপসা কিনা বুঝতে পারছে না। নাকি মেসি আবারও শেষ বেলায় গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে দেখে কাঁদছে এখনই ? পাশের ঘরে বাবা, মা, মাহির খেলা দেখছে। 
তাহির চিৎকার করে বলল, টিভিটা বন্ধ করো। 

শব্দ কমে এল। মাহির সম্ভবত ভলিউম কমিয়ে দিয়েছে। তবে একটু পর পরই আশপাশের শব্দে বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা হচ্ছে। এত হইচই করবে কারা? আর্জেন্টিনার সমর্থকরাই তো। নাকি বিপক্ষ দল? তাহির চায় তার কান যেন বন্ধ হয়ে আসে। তাহিরের মনে হচ্ছে সে দাঁড়িয়ে আছে তার সেই স্কুল মাঠে। বলটা বাঁক নিচ্ছে। ঢুকছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না এখনো। 
ধুপধাপ শব্দ শুরু হলো। বাইরে আতশবাজির উল্লাস। দরজা খুলে মাহির ঢুকল। কাঁদছে, কাঁপছে। বলল, ভাইয়া টিভিটা ছাড়ো। 
মেসি বসে আছে মাঠের মধ্যখানে। পিটার ড্ররু বলছেন, লিওনেল মেসি উইল বি সেইন্টেড। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ছে মেসির ওপরে। ওদিকে জিলা স্কুলের মাঠে যেন বসে আছে তাহির। হারুন স্যার তাকে বলছেন, ওয়েল প্লেইড। 
দুই ভাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। পনেরো বছর আগের দুর্ঘটনার পর এই প্রথম তাহির পারল ভাইকে জড়িয়ে ধরতে। দুজনই কাঁদছে। পনেরো বছর পর তাহিরের জন্য কান্নাটাও প্রথম।  
 

Leave a Reply

Your identity will not be published.