এ বছর অন্যদিন তার রৌপ্যজয়ন্তী, অর্থাৎ তার ২৫তম বার্ষিকী পালন করছে। যে দেশে একটি সাহিত্য বা ফ্যাশন অথবা জীবনশৈলী ম্যাগাজিনের আয়ু অল্পদিনেই ফুরিয়ে যায়—কুড়ি-পঁচিশ বছরের নাগাল পাওয়া তো দূরের কথা—সেখানে এই ম্যাগাজিনটি আড়াই দশক ধরে তার আয়ু শুধু ধরে রাখে নি, তাতে যৌবনের শক্তি আর সৌন্দর্যের সমাবেশ ঘটিয়েছে। এর পথচলা খুব সহজ ছিল না, নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, অনেক প্রতিকূলতাকে জয় করে তার সামনে পা ফেলা। গত বছরের মার্চ থেকে যে মহামারি এক মহা বিপর্যয় সৃষ্টি করে অর্থনীতি থেকে শিক্ষা এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন, সব কিছুকেই অনিশ্চিত করে ফেলেছে, সেখানে অন্যদিন ধারাবাহিকভাবে তার প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছে। কাজটি যে সহজ ছিল না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু অন্যদিন পরিবারের ধৈর্য, সাহস আর নিষ্ঠার কাছে মহামারীর জারিজুরি পরাজিত হয়েছে। এর পর যখন রৌপ্য জয়ন্তীর মুহূর্তটি এল, এই ম্যাগাজিনটি গর্ব নিয়েই পেছন ফিরে তাকিয়ে বলতে পারে, আমি এসেছি, দেখেছি এবং জয় করেছি।
কিন্তু এই উচ্চারণটি করার জন্য যে প্রত্যয়ের দরকার, তার যোগান অন্যদিন পরিবারের প্রতিটি সদস্য দিয়েছে। তাদের জন্য প্রতিটি বছর, প্রতিটি মাস এবং দিন ছিল খেটে খাওয়া মানুষের নিত্যদিনের পরিশ্রমের। এই পরিবার সময়, নিষ্ঠা ও মেধার সমাবেশ ঘটিয়ে ম্যাগাজিনটাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। তারা সহযোগী এবং পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পেয়েছেন দেশের খ্যাতিমান লেখক, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, সংস্কৃতির নানা অঞ্চলের মানুষজন এবং কিছু সংবেদী বিজ্ঞাপনদাতাকে।
অন্যদিন-এর শুরু থেকেই এর সঙ্গে আমি যুক্ত। সত্যি বলতে কী, নিজেকে অন্যদিন পরিবারের একজন হিসেবেই ভাবি, তবে অলস একজন হিসেবে। আমার সক্রিয়তা মাঝেমধ্যে লেখা দেওয়ার এবং অনুরুদ্ধ হয়ে টুকটাক কিছু কাজ করে দেওয়ার ক্ষেত্রেই। একবার হুমায়ূন আহমদের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম—বিরল সাক্ষাৎকার, যেহেতু তিনি এই কাজটি তেমন পছন্দ করতেন না। আরেকবার রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালনা করেছিলাম, যার পুরো বিবরণ ঈদসংখ্যা অন্যদিন ২০১০-এ ছাপা হয়েছিল। এর বাইরে এই ম্যাগাজিনটি যে কিছু বিষয়ে পুরস্কার দিয়েছে সেই প্রক্রিয়ার কিছুটা সংযুক্তি।
শুরু থেকেই অন্যদিন-এর প্রতি আমার একটি পক্ষপাতিত্ব ও ভালোলাগা রয়েছে, এবং এর অনেকগুলি কারণ আছে। প্রথমত এই ম্যাগাজিনটি পূর্ণাঙ্গ (এবং বেশ বিপুলায়তনের) ঈদসংখ্যা প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। সবগুলি ঈদসংখ্যারই (দু’একটি বাদ পড়েছে কিনা, বলতে পারব না) প্রচ্ছদ এঁকে দেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন, যা তিনি শুধু অন্যদিন-এর জন্যই করে আসছেন। ঈদসংখ্যাতে বাংলাদেশি লেখকদের উপস্থিতিই প্রবল। আরও প্রবল ছিল হুমায়ূন আহমদের উপস্থিতি। প্রতিটি ঈদসংখ্যা বেরুনো মাত্র মানুষ কিনে নিত।
দ্বিতীয়ত, অন্যদিন তার দুই মলাটের মধ্যেই বহু বিচিত্র অনেক সম্ভারের সমাহার ঘটায়। সাধারণ সংখ্যাগুলি খুব যে স্ফীতকায় তা নয়, কিন্তু বিষয় বৈচিত্র্যে অনুপম। পরিবারের সকলের জন্য এতে কিছু না কিছু থাকে, এজন্য পরিবারগুলো পঁচিশ বছর ধরে এই ম্যাগাজিনের সঙ্গে আছেন। তৃতীয়ত, অন্যদিন-এর লেখাগুলি সুসম্পাদিত। সম্পাদনার দায়িত্বটি কয়েকজন মিলেই করেন, ফলে হাতে হাতে ঘুরে প্রতিটি লেখার ব্যাকরণ, বানান ইত্যাদি বিশুদ্ধ রূপে আসে। অনেক চকচকে ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে বানান আর বাক্যনির্মাণ বিভ্রাটে কয়েক পাতার পর এগুনো যায় না। অন্যদিন-এর ক্ষেত্রে তা হয় না। চতুর্থত, এই ম্যাগাজিনে ছাপানো ছবিগুলি (তা ফ্যাশন মডেলের হোক, রান্নার উপাদানের হোক অথবা কোনো ব্যক্তির হোক) সবসময়ই থাকে ঝকঝকে এবং উজ্জ্বল। ছবির মানও ভালো। ফলে পাঠকের চোখ ও মন একইসঙ্গে তৃপ্ত হয়।
এসব কারণের বাইরেও কাগজের মান, বাঁধাই এবং মুদ্রণের বিষয় আসে। সকল ক্ষেত্রেই অন্যদিন একটি মান ধরে রেখেছে। আমরা জানি সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দৃশ্যমাধ্যম ছাপামাধ্যমের জায়গা অনেকখানি দখল করে নিয়েছে। অনেক নামি ম্যাগাজিন হয় বন্ধ হয়ে গেছে, নয়তো সংগ্রাম করে টিকে আছে। এই সংগ্রাম অন্যদিন-কেও করতে হচ্ছে। ম্যাগাজিনের দাম বাড়ানো ঠিক হবে না, এই যুক্তি অন্যদিন পরিবার মেনে নিয়েছে, ফলে পৃষ্ঠপোষকদের সহযোগিতা তারা চেয়েছেন। আমি আনন্দিত যে, অন্যদিন-এর দীর্ঘদিনের পৃষ্ঠপোষকেরা এখনো এর সঙ্গে আছেন। এই সুযোগে আমি এর বিজ্ঞাপনদাতা পৃষ্ঠপোষকদের ধন্যবাদ জানাই।
২
অন্যদিনকে আমি শুধু যে একটি ম্যাগাজিন হিসেবে দেখি, তা নয়, আমাদের সংস্কৃতির একটি ধারার ধারক হিসেবেও দেখি, যে ধারাটি তরুণদের কাছে অনেক পরিচ্ছন্ন বার্তা এবং নান্দনিকতার কিছু ধারণা পৌঁছে দেয়। অন্যদিন যেসময় আত্মপ্রকাশ করে, তখন দৃশ্যমাধ্যম প্রবল ছিল না, ছাপা মাধ্যমের জনপ্রিয়তা ছিল। সেই সময়ে তরুণদের মধ্যে ম্যাগাজিনটি যে সাড়া ফেলে, যে অভিঘাত তৈরি করে, এ সময় পর্যন্ত তা ধরে রেখেছে।
সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অন্যদিন-এর একটি অবদান হলো এই যে, ম্যাগাজিনটি নিয়মিত বিরতিতে বাংলাদেশের একটি সংস্কৃতিচিত্র পাঠকদের কাছে তুলে ধরে যা প্রাগ্রসর, গতিশীল, বহুত্ববাদী এবং গণমুখী। এই ম্যাগাজিনে সকলের সমান প্রবেশাধিকার, সমান অংশগ্রহণ। লেখালেখির ক্ষেত্রে অনেক তরুণকে অন্যদিন একটি সৃষ্টিশীল পাটাতন দিয়েছে, অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এই ম্যাগাজিনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অন্যপ্রকাশ এরকম অনেক তরুণের বই ছেপে তাদের একটা বৃহত্তর পরিচিতি দিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ প্রতি ঈদসংখ্যায় একটি উপন্যাস দেওয়ার পাশাপাশি গল্প ও অন্যান্য লেখাও মাঝে মধ্যে অন্যদিন-কে দিতেন। তাঁর কারণে ম্যাগাজিনটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু তিনি অকালে চলে গেলেও অন্যদিন সেই পাঠকদের ধরে রেখেছে, কারণ তাদের জন্য এটি একটি সাংস্কৃতিক ঠিকানা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৯৯ সাল থেকে পরপর তিন বছর ইমপ্রেস টেলিফিল্মের সঙ্গে বাংলাদেশের পারফরমিং আর্টের মানুষদের পুরস্কৃত করেছিল অন্যদিন। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের কিছু সময় পর পরে চ্যানেল আই কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু ইমপ্রেসের অফিসটি ছোট পরিসরের হওয়ায় অন্যদিন-এর কার্যালয়ে পুরস্কার কমিটির জুরি বোর্ডের সভা হতো, নাটক-চলচ্চিত্র—এসব দেখা হতো। আমি শুরুতে দুবার এই জুরিসভায় ছিলাম। জুরিসভার স্মৃতি আমার মনে এখনো উজ্জ্বল। আতিকুল হক চৌধুরী, মুস্তাফা মনোয়ার, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং জুয়েল আইচের সঙ্গে চমৎকার একটা সময় আমি তখন কাটিয়েছি। জুয়েল আইচের সঙ্গে তখনই আমার বন্ধুত্বের সূচনা। তার জাদুকরি প্রতিভা ও তার প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্ব প্রথম দেখাতেই আমাকে মুগ্ধ করেছিল। পুরস্কার দেওয়া হতো শেরাটন (বর্তমান ইন্টারকন্টিনেন্টাল) হোটেলে। জাঁকজমকের একটা অনুষ্ঠান হতো। এই অনুষ্ঠানে প্রবেশাধিকার পাওয়ার জন্য অনেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগও করেছে। এরকম অনুষ্ঠান সম্ভবত অন্যদিনই প্রথম শুরু করে—পারফরমেন্স পুরস্কারও।
আমি দেখেছি, ভালো ও সুস্থ টেলিভিশন নাটক নির্মাণে ম্যাগাজিনটি প্রচুর উৎসাহ দিত। এর পাতায় নিয়মিত ভিত্তিতে নাটক নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে, নাটকের খবর পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।
এর পর ২০১৫ সাল থেকে অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কারের প্রচলন করলে এর বিচারকম-লীতে আমাকে থাকার জন্য অনুরোধ করলে আনন্দের সঙ্গে তা গ্রহণ করি। আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন বিচারক সভার সভাপতি। শুরুর বিচারকদের মধ্যে আমি ছাড়া আর কেঊ নেই, কেউ বিদেশে, কেউ চলে গেছেন লোকান্তরে। এক্সিম ব্যাংক এই পুরস্কারের সহযোগী। তরুণ কথাসাহিত্যিকদের পুরস্কৃত করার পাশাপাশি একজন প্রখ্যাত প্রবীণ কথাসাহিত্যিক-কে সম্মাননা জানানো হয়। পুরস্কৃত অনেক তরুণ এখন প্রতিষ্ঠিত ।
অন্যদিন-এর অফিসে শুরুতে অনেক যাওয়া হতো, কিন্তু গত কয়েক বছর তেমন যাওয়া হয় না, কারণ মাজহার, নাসির, কমল, মোমিন, বিশ্বজিৎ, নাসরীন এবং অন্যদের সঙ্গে অনেক সময় যে আড্ডা হয়েছে, তা এখন ছোট পরিসরে অন্য জায়গাতেও হয়, যদিও প্রথম তিনজন ছাড়া বাকিদের সেসব আড্ডায় পাই না। দুএক দুপুরে অন্যদিন অফিসে গিয়েছি লাঞ্চ খেতে। কমল খাদ্যরসিক মানুষ, মেনু সব সময়ই লোভনীয়। এক চমৎকার পরিবেশ বিরাজ করে এই অফিসে। ঈদসংখ্যা প্রকাশের আগে, আর ফেব্রুয়ারির বইমেলা ঘনিয়ে এলে, এই অফিসের রক্তচাপ বেড়ে যায়। সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে কাজ নিয়ে। আমি দেখেছি প্রত্যেকের কাজই খুব ছিমছাম, যেন ঘড়ি ধরে, নিয়ম করে প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাজটি করে যান। এই নিয়মনিষ্ঠতা পাক্ষিকটির অবিচ্ছিন্ন ও নিয়মিত প্রকাশনার পেছনে একটা কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে।
৩
পাঠকদের কাছে এবং অন্যদিন পরিবারের এক অলস এবং নিষ্ক্রিয় সদস্যের কাছে, ২৫টি বছর যেন দেখতে দেখতেই চলে গেল। যেরকম দেখতে দেখতে বৃহত্তর পরিবারের সন্তানরা বড় হয়। অন্যদিন এখন ‘সম্ভ্রান্ত’ ‘প্রতিষ্ঠিত’ ‘অগ্রগণ্য’ এরকম অনেক বিশেষণে ভূষিত। অথচ শুরুতে এটিকে দাঁড় করাতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে এর সম্পাদক ও অন্যদের, অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কিন্তু এদের নিষ্ঠা ছিল, অবিচল উদ্দেশ্য ছিল এবং লেগে থাকার শক্তিটা ছিল প্রবল। অন্যদিন প্রমাণ করেছে, চেষ্টা করলে পাথুরে জমিতেও ফসল ফলানো যায়।
আশা করি অন্যদিন-এর পথচলা অব্যাহত থাকবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে যখন তরুণরা ভার্চ্যুয়াল পৃথিবীতে ঢুকে থাকে, অন্যদিন তাদের প্রকৃত-র স্বাদ দিচ্ছে। এই ‘প্রকৃত’ জীবনের, সংস্কৃতির, বাঙালির চিরন্তন জীবন যাপনের।
আরও ২৫টি বছর যেন দেখতে দেখতে চলে যায়। এরপর আরও অনেক বছর। আমরা অনেকেই থাকব না। অন্যদিন থাকবে।
অন্যদিন পরিবারকে শুভেচ্ছা, এবং এর মুগ্ধ পাঠকদের ধন্যবাদ, এই ব্যতিক্রমী ম্যাগাজিনটার অন্তরের টানটি ধরে রাখার জন্য।
Leave a Reply
Your identity will not be published.