এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭

এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭

দেখতে দেখতে তিনটি বছর কেটে গেল ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’-এর। এক্সিম ব্যাংকের সহযোগিতায় পাক্ষিক অন্যদিন-এর এই উদ্যোগ। ২০১৫ সাল থেকে এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। মাত্র তিন বছরেই এই পুরস্কারটি দেশের কথাসাহিত্যিকদের মাঝে সাড়া ফেলতে সমর্থ হয়েছে। এবার এই পুরস্কারটি পেয়েছেন প্রবীণ কথাশিল্পী জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং প্রতিশ্রুতিশীল কথাসাহিত্যিক মোজাফফর হোসেন। এই পুরস্কারের কথাই তুলে ধরা হয়েছে এবারের প্রচ্ছদ রচনায়।

বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাস খুব বেশি পুরোনো নয়। ১২৮০ বঙ্গাব্দের (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ) জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় বঙ্কিম সহোদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মধুমতী’ গল্প দিয়েই বাংলা গল্পের যাত্রা শুরু। অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল' (১৮৫৭)। তবে উপন্যাসে নবযুগের সূত্রপাত ঘটে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫) প্রকাশের মধ্য দিয়ে।... কল্লোল যুগে বাংলা কথাসাহিত্য নতুন মাত্রা পায়। এই মাধ্যমটির মানচিত্র প্রসারিত হয়। নিচুতলার মানুষদের জীবন উঠে আসে কথাসাহিত্যে। ...বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের প্রসঙ্গে বলা যায়, পঞ্চাশের দশকে কথাসাহিত্য হয়ে ওঠে মৃত্তিকাস্পর্শী ও জাতিসত্তার শিকড় সন্ধানী। ষাট দশকে এ দেশের কথাসাহিত্যে সূচিত হয় নতুন স্রোত। আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক কল্লোল আর সংঘাতের পটে রচিত হয় গল্প-উপন্যাস। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কথাসাহিত্যে লক্ষ করা যায় নতুন নতুন নিরীক্ষা আর বাঁক।

এই পটভূমিতে ২০১৫ সালে প্রবর্তিত হয় ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, এই পুরস্কার এদেশের প্রবীণ এবং নবীন— এই দুই শ্রেণির কথাসাহিত্যিকদেরই অনুপ্রাণিত করবে। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো এ পুরস্কার পান দুজন লেখক— সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য প্রবীণ কথাশিল্পী শওকত আলী এবং নবীন সাহিত্যশ্রেণিতে (অনূর্ধ্ব পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্ক লেখক) সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম। ২০১৬ সালে এই পুরস্কার পেয়েছেন প্রবীণ কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক (সাহিত্যে সামগ্রিক অবদান) এবং প্রতিশ্রুতিশীল লেখক স্বকৃত নোমান (নবীন সাহিত্যশ্রেণি)। এ বছর এই পুরস্কার পেয়েছেন প্রবীণ কথাশিল্পী জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং প্রতিশ্রুতিশীল কথাসাহিত্যিক মোজাফফর হোসেন। কথাসাহিত্যে এই পুরস্কার প্রদান করা হয় এবং হচ্ছে। কেননা একদা অবিভক্ত বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আর এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হচ্ছেন হুমায়ুন আহমেদ, যার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের মাধ্যমে। পরের চার দশক আপন সৃষ্টিশীলতায় আচ্ছন্ন রেখেছিলেন তিনি কোটি বাঙালিকে। তাঁর একটি নিজস্ব কণ্ঠস্বর আছে। পড়ামাত্রই তাঁর লেখা চেনা যায়। পরিস্থিতি নির্মাণ, বর্ণনা ভঙ্গি, সংলাপে তিনি এমন এক শৈলীর উদ্ভাবন করেছেন, যা বাংলা কথাসাহিত্যে অদ্বিতীয়।

পিছন ফিরে দেখা

‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’ প্রবর্তিত হয় ২০১৫ সালের ১৭ মে, বিকেলে। সেদিন বাংলা একাডেমির শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন নতুন এই সাহিত্য পুরস্কারের। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গর্ভনর এস কে সুর চৌধুরী বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। বক্তব্য দেন এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া, হুমায়ূন আহমেদের অনুজ আহসান হাবীব ও স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। এই সাহিত্য পুরস্কারের প্রবর্তনালগ্নে জানানো হয়েছিল, কথাসাহিত্যে প্রদান করা হবে এই পুরস্কার। দুটি ক্যাটাগরিতে।

পূর্ববর্তী বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত কথাসাহিত্যের জন্য অথবা কথাসাহিত্যের সার্বিক অবদানের জন্য প্রথম পুরস্কারটি প্রদান করা হবে। এর অর্থমূল্য হলো পাঁচ লাখ টাকা। অন্যদিকে পূর্ববর্তী বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকাশিত কথাসাহিত্যের জন্য অনূর্ধ্ব পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্ক লেখককে দ্বিতীয় পুরস্কারটি দেওয়া হবে। এর অর্থমূল্য ১ লাখ টাকা। এ ছাড়া পুরস্কার হিসেবে প্রত্যেকে পাবেন ক্রেস্ট, উত্তরীয় ও সার্টিফিকেট। সেদিন আরও জানানো হয়েছিল, প্রতি বছর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনকে সামনে রেখে ১২ নভেম্বর প্রদান করা হবে এই পুরস্কার। শুধু বাংলাদেশের জীবিত নাগরিকই এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হবেন। মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়া হবে না। তবে পুরস্কার সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পরে যদি দুর্ভাগ্যক্রমে মনােনীত সাহিতিক মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে এই বিধি তাঁর সম্পর্কে প্রযোজ্য হবে না।

আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ও পাক্ষিক অন্যদিন-এ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছিল এই পুরস্কার ও পুরস্কার সম্পর্কিত তথ্যাদি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘পাক্ষিক অন্যদিন’-এর সম্পাদকীয় কার্যালয়ে জমা পড়েছিল নবীন ও প্রবীণ লেখকদের বহু বই। ৩০ জুন ২০১৫ ছিল বই জমা দেওয়ার শেষ দিন।

জমাকৃত বইগুলো থেকে প্রাথমিক বাছাই কমিটির সম্মানিত তিন সদস্য (অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, অধ্যাপক খালেদ হোসাইন এবং আবদুল্লাহ্ নাসের) নবীন সাহিত্যশ্রেণিতে (অনূর্ধ্ব পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্ক লেখক) পুরস্কারের জন্য বিবেচনার জন্য বেশ কিছু বই নির্বাচন করেন এবং সেগুলো বিচারকমণ্ডলীর সামনে উপস্থাপন করেন।

পাঁচ সদস্যের বিচারকমণ্ডলী (সভাপতি আনিসুজ্জামান, সদস্য হায়াৎ মামুদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আবুল হাসনাত এবং পূরবী বসু) প্রথম ক্যাটাগরির জন্য নির্বাচিত করেন প্রবীণ কথাসাহিত্যিক শওকত আলীকে। বাংলা কথাসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য এই পুরস্কার তাঁকে প্রদান করা হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে বাছাই কমিটির নির্বাচিত গ্রন্থসমূহ থেকে ‘পা’ গল্পগ্রন্থকে নির্বাচিত করেন বিচারকমণ্ডলী। ফলে নবীন সাহিত্যশ্রেণিতে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হন সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম। ‘পা’-এর লেখক তিনিই।

 

২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর বিকেলে বাংলা একাডেমির সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম জানান অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম। এই সময় বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এবং এক্সিম ব্যাংকের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ব্র্যান্ডিং সঞ্জীব চ্যাটার্জি।

শওকত আলী এবং সাদিয়া মাহজাবীন ইমামের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে এ পুরস্কার তুলে দেওয়া হয় ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, বিকেলে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে। তারা পুরস্কার হিসেবে পান যথাক্রমে পাঁচ লাখ এবং এক লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রদান করা হয়। ক্রেস্ট, উত্তরীয় এবং সার্টিফিকেট।

২০১৬ সালেও বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে এই পুরস্কারের দুটি ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত হন হাসান আজিজুল হক (বাংলা কথাসাহিত্যের সামগ্রিক অবদান) এবং স্বকৃত নোমান (নবীন সাহিত্যশ্রেণি, উপন্যাস ‘কালকেউটের সুখ')। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে এই পুরস্কারের নবীন সাহিত্যশ্রেণি ক্যাটাগরিতে লেখকের বয়সের সীমা ছিল অনূর্ধ্ব পঁয়ত্রিশ। ২০১৬ সালে এটি পরিবর্তন করে অনূর্ধ্ব চল্লিশ বছর করা হয়। যেভাবে নির্বাচিত হলেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও মোজাফফর হােসেন। এবারের পুরস্কারের কার্যক্রম শুরু হয় এ বছরের জুলাই মাসে। তখন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছিল এই পুরস্কার ও পুরস্কার সম্পর্কিত বিষয়াদি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ‘পাক্ষিক অন্যদিন’-এর সম্পাদকীয় কার্যালয়ে জমা পড়েছিল প্রবীণ এবং নবীন লেখকদের বহু বই। গত ১০ আগস্ট ছিল বই জমা দেওয়ার শেষ দিন।

জমাকৃত বইগুলো দেখার পর প্রাথমিক বাছাই কমিটির সম্মানিত তিন সদস্য (অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, হামিদ কায়সার এবং আবদুল্লাহ্ নাসের) নবীন সাহিত্যশ্রেণিতে (অনূর্ধ্ব চল্লিশ বছর বয়স্ক লেখক) পুরস্কারের জন্য বিবেচনার জন্য বেশ কিছু বই নির্বাচন করেন এবং সেগুলো বিচারকমণ্ডলীর সামনে উপস্থাপন করেন।

চার সদস্যের বিচারকমণ্ডলী (সভাপতি আনিসুজ্জামান, সদস্য সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আবুল হাসনাত এবং মঈনুল আহসান সাবের) প্রথম ক্যাটাগরির জন্য নির্বাচিত করেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্তকে। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, বাংলা কথাসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হবে। অন্যদিকে বাছাই কমিটির নির্বাচিত গ্রন্থ থেকে ‘অতীত একটা ভিনদেশ’কে নির্বাচিত করেন বিচারকরা। ফলে নবীন সাহিত্যশ্রেণিতে এই বছর পুরস্কার পেয়েছেন প্রতিশ্রুতিশীল লেখক মোজাফফর হোসেন।

বিজয়ীদের নাম ঘোষণা

গত ২ নভেম্বর, বিকেলে, বাংলা একাডেমির সভাকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭'-এর বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম। এই সময় উপস্থিত ছিলেন স্পন্সর প্রতিষ্ঠান এক্সিম ব্যাংকের সিনিয়র অ্যাসিস্টান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ব্র্যান্ডিং ডিভিশনের প্রধান সঞ্জীব চ্যাটার্জি, অন্যদিন-এর নির্বাহী সম্পাদক আবদুল্লাহ্ নাসের প্রমুখ।

মাজহারুল ইসলাম ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’ প্রবর্তনের পটভূমি বর্ণনা করে বলেন, হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিশীল কর্ম রয়ে গেছে। যুগ যুগ ধরে তাঁর স্মৃতি সমুজ্জ্বল রাখার লক্ষ্যেই এ পুরস্কার চালু করা হয়েছে। এবার তৃতীয়বারের মতো দেওয়া হচ্ছে এ পুরস্কার। সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কথাসাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্তকে এবং নবীন সাহিত্যেশ্রেণিতে মোজাফফর হোসেনকে এ পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। পুরস্কার হিসেবে তারা পাবেন যথাক্রমে পাঁচ লাখ এবং এক লাখ টাকা। এ ছাড়াও দেওয়া হবে একটি ক্রেস্ট, উত্তরীয় ও সনদ| সঞ্জীব চ্যাটার্জি বলেন, এক্সিম ব্যাংক সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। এমনই একটি কার্যক্রম হলো এই পুরস্কার। এই পুরস্কারের সঙ্গে এক্সিম ব্যাংক সম্পৃক্ত থাকতে পেরে খুবই আনন্দিত। কেননা বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদের নামে এ পুরস্কারটি প্রদান করা হচ্ছে।

এক প্রশ্নের জবাবে অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম জানান যে, এই পুরস্কারের প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত স্বচ্ছ। বিচারকরা স্বাধীনভাবে কাজ করে থাকেন।

অন্যদিন কিংবা এক্সিম ব্যাংক কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করে না। সত্যি কথা বলতে কী, বিচারকাজ শেষেই আমরা জানতে পারি যে, এই পুরস্কারের দুটি ক্যাটাগরিতে কারা পুরস্কার পাচ্ছেন।

ডেটলাইন ১২ নভেম্বর, ২০১৭

তারপর এলো সেই কাঙ্ক্ষিত দিন, ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’ বিজয়ীদের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেওয়ার বিরল মুহূর্ত। গত ১২ নভেম্বর, রোববার, বিকেলে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে এ পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সভাপতিত্ব করেন এই পুরস্কারের জন্য গঠিত| বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি ইমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। উল্লেখ্য, এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু অনিবার্য কারণবশত তিনি আসতে পারেন নি।

হুমায়ুন আহমেদের স্ত্রী এবং স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী ও নির্মাতা মেহের আফরোজ শাওনের গানের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটে। তিনি দুটি গান পরিবেশন করেন— ‘যে থাকে আঁখি পল্লবে’ এবং ‘যদি মন কাঁদে’| অতঃপর স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, হুমায়ুন আহমেদ স্মরণে এবং এ দেশের নবীন-প্রবীণ কথাসাহিত্যিকদের শিল্পসৃষ্টিতে প্রেরণা জোগাতে ২০১৫ সাল থেকে প্রবর্তিত হয়েছে ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’। আমাদের এই উদ্যোগে সহায়তার জন্য এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তিনি আরও বলেন, হুমায়ুন আহমেদ অন্যভুবনে পাড়ি জমালেও আমাদের জন্য রেখে গেছেন অনন্ত প্রেরণার উৎস তাঁর সৃষ্টিসম্ভার। আমরা বারবার ফিরে যাই তাঁর সৃষ্টির কাছে। একই সঙ্গে আমরা ভাবতে থাকি এমন কোনো উদ্যোগের কথা যার মধ্য দিয়ে তাঁকে প্রণতি জানাতে পারি। আমার বিশ্বাস, আমাদের এই উদ্যোগ, ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’, আমাদের সে বাসনা পূর্ণ করেছে।

এরপর বক্তব্য রাখেন স্পন্সর প্রতিষ্ঠান এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া। তিনি বলেন, কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নামে একটি সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তনের অংশীদার হতে পেরে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করছি। এক্সিম ব্যাংক এদেশের শিল্প-সাহিত্যের বিকাশে বরাবরই এগিয়ে এসেছে। আমরা বিশ্বাস করি, যে জাতি তার গুণীজনদের সম্মান দিতে জানে না, সে জাতিতে কোনো গুণীজন জন্মলাভ করে না। এই পুরস্কারের মাধ্যমে আমরা যেমন হুমায়ূন আহমেদকে সম্মান জানাব তেমনি নিজেরাও সম্মানিত হব। তিনি হুমায়ূন আহমেদের গল্প-উপন্যাস, টিভি নাটক, চলচ্চিত্র, গান রচনার কথা উল্লেখ করে বলেন যে, কথাসাহিত্যিক হিসেবে তিনি শরৎচন্দ্রের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় ছিলেন।

শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ও মেহের আফরোজ শাওন। শংসাবচন পাঠ করেন মঈনুল আহসান সাবের এবং সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

শামসুজ্জামান খান স্মৃতিচারণ করেন হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে। তিনি হুমায়ূন-সাহিত্যের ওপর আলোকপাত করেন। ব্যক্তি হুমায়ুন আহমেদের রসবোধের উল্লেখ করেন। অতঃপর তিনি দুটি ক্যাটাগরিতে এ বছর এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার যারা পেয়েছেন তাদের কথা উল্লেখ করেন। বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য পুরস্কারপাপ্ত প্রবীণ কথাসাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের সঙ্গে তার হৃদ্যতার কথা তিনি উল্লেখ করেন; তিনি যে একজন উঁচু মানের গল্পকার সেই কথাটিও বিশেষভাবে তুলে ধরেন। এটাও জানান যে স্বাধীনতার আগেই জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন, গল্প লেখার সূত্রে। এরপর তিনি বলেন মোজাফফর হোসেনের কথা, যিনি নবীন সাহিত্যশ্রেণিতে পুরস্কার পেয়েছেন। মোজাফফর যে বাংলা একাডেমিতে কর্মরত এবং সেই তিনি এই পুরস্কার পেয়েছেন— এ জন্য তিনি গর্ববোধ করছেন, এমন অনুভূতিও ব্যক্ত করেন। এই সময় পাশ থেকে উপস্থাপক এবং অন্যদিনএর নির্বাহী সম্পাদক আবদুল্লাহ্ নাসের বলে উঠেন যে, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তও একদা বাংলা একাডেমিতে কাজ করেছেন। তাঁর কর্মজীবন শুরুই হয়েছিল বাংলা একাডেমিতে।

মেহের আফরোজ শাওন বলেন, মাত্র তিন বছরে হুমায়ুন আহমেদের নামাঙ্কিত এই পুরস্কার যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা সত্যি আনন্দের। আশা করা যায় যে খুব দ্রুত এটি এদেশের কথাসাহিত্যিকদের কাঙ্ক্ষিত পুরস্কারে পরিণত হবে। একজন সাহিত্যিকের নামে যখন পুরস্কার ঘােষিত হয়, তখন তিনি যে একজন সার্থক সাহিত্যিক ছিলেন, সেটি প্রমাণিত হয়। হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজ খুবই খুশি হতেন, যদি তাঁর জীবদ্দশায় এই পুরস্কারটি প্রবর্তিত হতো। তিনি পুরস্কারপ্রাপ্ত দুই সাহিত্যিককে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন যে, হুমায়ুন আহমেদ জীবনের শেষ দিনগুলি কাটিয়েছেন নিউইয়র্কে। তখন তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং তার  স্ত্রী পূরবী বসু। তাঁরা যে গভীর ভালোবাসায় সিক্ত করেছেন হুমায়ুনকে তা অবিস্মরণীয়।

বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য পুরস্কারপ্রাপ্ত জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন যে, কাজের জন্য পুরস্কার পেলে যে কোনো মানুষই আনন্দিত হয়, আমিও হয়েছি। তবে এই পুরস্কারটি যার নাম ধারণ করছে, সেই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে অনেক আন্তরিক মুহূর্ত কাটিয়েছি আমি। যদিও তার সঙ্গে আমার আগে শুধু ‘হাই-হ্যালো’ সম্পর্ক ছিল। দেখা হলে কুশল বিনিময় করতাম। একবার একটি কাজে অবশ্য তার বাসায়ও গিয়েছিলাম। হুমায়ূনের সঙ্গে আসলে আমার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক শুরু হয়| আমেরিকায়, যখন তিনি চিকিৎসার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন।...আমাকে বলা হয় আধুনিক ছোটগল্পের কবি। হ্যা, আমার গল্পের একটি আলাদা ভাষা আছে। আলাদা শৈলী আছে। এটি আমি সচেতনভাবেই সৃষ্টি করেছি। অবশ্য শুরুতে আমি প্রথাগত গল্পই লিখেছি। কয়েক বছর পর অন্য ধরনের গল্প লিখতে শুরু করি। যেমন ‘একজন পুরুষ চাই’। এই গল্পটিতে প্রতীকীভাবে আমি গত শতকের ষাট দশকে এ দেশের পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেছি। তখন এ দেশে আইয়ুব খানের শাসন চলছে। তখন উচিত কথা বলা সহজ ছিল না। আজ তো অনেকেই জাদু বাস্তবতার কথা বলেন। তারা আরও বলেন যে, সাহিত্যে এই শৈলীটি চালু করেছে ল্যাতিন আমেরিকার সাহিত্যিকরা। এ প্রসঙ্গে আমি সবিনয়ে জানাচ্ছি যে, ‘একজন পুরুষ চাই’তে একজন সচেতন পাঠক জাদু বাস্তবতা খুঁজে পাবেন, যা আমি ষাট দশকেই এদেশের সাহিত্যে তুলে ধরেছিলাম।

নবীন সাহিত্যশ্রেণিতে পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিশ্রুতিশীল লেখক মোজাফফর হোসেন তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, আমি লিখতে শুরু করেছি লেখক হওয়ার মোহ থেকে নয়। সে সুযোগ আমার ছিল না। কারণ লেখালেখির সংস্কৃতির একেবারে বাইরের মানুষ আমি। এমন একটা গ্রামীণ পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছি, যেখানে সাহিত্য সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না। যতটুকু ছিল তাও নেতিবাচক।...আমি গল্প লিখতে অনুপ্রেরণা পেয়েছি ‘গল্পগুচ্ছ' পড়ার পর। তারপর দেশি-বিদেশি আরও কয়েকজনের লেখা পড়ি। যখন যে বই পেয়েছি, পড়েছি।...আমার গল্পে সব সময় বাস্তব ঘটনা নয়, কী ঘটতে পারত সেটি লেখার চেষ্টা করেছি। তাই গল্পগুলো বাস্তবতানির্ভর না হয়ে সম্ভাবনানির্ভর হয়ে উঠেছে।...আমার কিছু বলার আছে বলেই আমি গল্প লিখছি। যেদিন মনে হবে যে আমার আর কোনো বক্তব্য নেই, সেদিনই আমি গল্প লেখা বন্ধ করে দেব।...এ পুরস্কার পেয়ে আমি অবশ্যই আনন্দিত আর হুমায়ূন আহমেদের প্রভাব রয়েছে আমার ওপর।’

বিশেষ অতিথি আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ১৩ নভেম্বর হুমায়ুনের জন্মদিন। ওই দিন নানা জায়গায় ওর জন্মদিন উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠান হয়, বিভিন্ন চ্যানেলে থাকে নানা অনুষ্ঠান ও টকশো। আমি কোথাও যাই না। যেতে পারি না। শুধু আমি না, আমরা কেউই হুমায়ূনের মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারি নি।

একটি ধাক্কার মতো সেই মৃত্যু, যা এখনো আমরা সামলাতে পারি নি। তাই তো হুমায়ূনের জন্মদিনে আমরা উৎসব করতে পারছি না।...আজ একটা কথা স্বীকার করছি, আমি যে আসাদুজ্জামান নূর হয়েছি, জনপ্রিয়তা পেয়েছি, এ ক্ষেত্রে হুমায়ূনের অবদান রয়েছে।...হুমায়ূন ছিল খুবই খুঁতখুঁতে একজন মানুষ। মনে পড়ে, তের পর্বের একটি ধারাবাহিক নাটকের পুরোটা শুট করার পর হুমায়ুন আমার কাছে একদিন এসে হাজির। কী ব্যাপার? না, ওই ধারাবাহিকে যিনি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তার অভিনয় ওর ভালো লাগছে না। তাই আমাকে নিয়ে আবার নতুন করে নির্মাণ করতে চায় ধারাবাহিকটি। হুমায়ূনের কথায় আমি ধারাবাহিকটিতে অভিনয় করতে বাধ্য হয়েছিলাম।...আজ যে দুজন পুরস্কৃত হলেন, তাদের একজন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, তাঁর লেখা আমি পড়েছি। আমার একজন প্রিয় লেখক তিনি। অন্যজন মোজাফফর হোসেন। তার লেখা আমি পড়ি নি। তবে তিনি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, সেই সূত্রে তার বই সংগ্রহ করা আমার জন্য অত্যন্ত সহজ। কাজেই তার বই সংগ্রহ করে আমি পড়ব। আমি জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং মোজাফফর হোসেন দুজনকেই অভিনন্দন জানাচ্ছি।

সভাপতির বক্তব্যে আনিসুজ্জামান বলেন, আমি হুমায়ুন আহমেদের একজন গুণগ্রাহী। আগেও আমি এ পুরস্কারের বিচারক ছিলাম।... বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য পুরস্কার পেয়েছেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। সে আমার ছাত্র। যখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়ত, তখন আমি ছিলাম সেই বিভাগের একজন শিক্ষক।... আমি যখন হাসপাতালে শয্যাশায়ী, জ্যোতি তখন আমার হাতে তুলে দিয়েছিল তাঁর গল্পসমগ্র। সেটি উৎসর্গ করা হয়েছিল আমাকে। আমি যে তাকে ‘গল্পগুচ্ছ' পড়িয়েছিলাম, সেটা সেখানে লেখা হয়েছে। একজন সম্মানিত লেখক হয়েও সে ব্যাপারটি মনে রেখেছে দেখে আমি আবেগাপ্লুত হয়েছিলাম।

উল্লেখ্য, অনুষ্ঠানে বড়পর্দায় পুরস্কারপ্রাপ্তদের নিয়ে তৈরি দুটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়। তথ্যচিত্র দুটির চিত্রনাট্য লিখেছেন মোমিন রহমান এবং নির্মাণ করেছেন আবদুল্লাহ্ নাসের।

শেষ কথা

কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের নামাঙ্কিত এ পুরস্কারের পথচলা অল্প দিনের। তৃতীয়বারের মতো এই পুরস্কার প্রদান করা হলো মাত্র। সংগত কারণেই এ পুরস্কার সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা বলার সময় আসে নি। এখন দুটি ক্যাটাগরিতে এ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। আগামীতে হয়তো ক্যাটাগরির সংখ্যা আরও বাড়বে। তবে এ পুরস্কার সব সময়ই প্রবীণ এবং নবীন— দুই শ্রেণির কথাসাহিত্যিকদেরই অনুপ্রাণিত করবে। আর এর পরোক্ষ প্রভাবে এ দেশের কথাসাহিত্যের আরও উৎকর্ষ সাধিত হবে নিঃসন্দেহে।

আলোকচিত্রঃ এস এম নাসির

Leave a Reply

Your identity will not be published.