অন্যদিন বইসংখ্যা, ফিরে দেখা: মোজাফ্ফর হোসেন

অন্যদিন বইসংখ্যা, ফিরে দেখা: মোজাফ্ফর হোসেন

১৯৯৬-এর ১৬ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে ‘পাক্ষিক অন্যদিন’-এর পঁচিশ বছর পূর্তি হলো। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতি ও লাইফস্টাইল ভিত্তিক একটি পত্রিকার জন্য এটি একটি বিরল ঘটনা। অন্যদিন টিকে থাকার অন্যতম কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাটি কখনো ‘পুরাতন’ হয় নি। সব সময় নতুন কিছুর সন্ধান করেছে। কন্টেন্টে যেমন বিষয়বৈচিত্র্য তেমনি নানা ধরনের সময়োপযোগী ইভেন্টের আয়োজন, তারুণ্যের স্পন্দন বুঝে এগিয়ে চলা, এসবই অন্যদিনকে নিয়ত নতুন করে তুলেছে। ঈদসংখ্যা, বৈশাখী সংখ্যা, ফ্যাশন সংখ্যা, রেসিপি সংখ্যা, সাহিত্যের নানা বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা অন্যদিন-এর পাঠকদের চমকে দিয়েছে। সাহিত্যের সিরিয়াস পাঠকদের জন্য অন্যরকমের অনন্য আয়োজন বইসংখ্যা। বাংলাদেশে বই নিয়ে উল্লেখ করার মতো আয়োজন অন্যান্য পত্রিকায় চোখে পড়ে না। অথচ সাহিত্যের সব ধরনের বিকাশ, উন্নয়ন ও প্রচারে বইবিষয়ক আয়োজনের কোনো বিকল্প হয় না।

বই নিয়ে নিয়মিত আয়োজনের পাশাপাশি অন্যদিন বিশেষভাবে চারটি বইসংখ্যা প্রকাশ করেছে। অন্যদিন-এর বইসংখ্যাও বিষয়বৈচিত্র্যে অনন্য। বইয়ের রিভিউ, সমালোচনা, প্রিয় বই নিয়ে কথা, নিজের বই নিয়ে কথা, দেশি বিদেশি উল্লেখযোগ্য বইয়ের রচনার নানা প্রেক্ষাপট প্রভৃতি লেখা প্রতিটি বইসংখ্যাকে চমকপ্রদ করে তুলেছে। বই নিয়ে যে-কোনো আয়োজন এখানে খুব দুরূহ কাজ। কেননা বই নিয়ে আমাদের দেশে লেখার মানুষ খুব কম। তারওপর শঙ্কা থাকে একঘেয়ে হয়ে ওঠার। অন্যদিন-এর বইসংখ্যা দেখলে সেটা বোঝা যাবে না। 

প্রথম বইসংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। সংখ্যার প্রথম গদ্যটি লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ, তাঁর প্রিয় বই নিয়ে। লেখক এখানে তাঁর প্রিয় বইয়ের তালিকায় রেখেছেন মাক্সিম গোর্কির ‘আমার ছেলেবেলা’। তিনি জানিয়েছেন, ‘প্রথমবার মোটামুটি ভালো লেগেছে। দ্বিতীয়বার অসম্ভব ভালো লেগেছে। তৃতীয়বার পড়ার পর মনে হয়েছে অসাধারণ।’ ভালোলাগা থেকে কখনো কখনো তিনি অনুবাদ করার তাগাদা অনুভব করেন। যেমন জন স্টেইনবেকের ‘সুইট থার্সড ডে’ তিনি অনুবাদ শুরু করেছিলেন। দস্তয়েভস্কির হোয়াইট নাইট গল্পটি পড়ে লেখক হুমায়ূন আহমেদ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। গল্পটি তিনি ‘রূপালী রাত্রি’ নামে অনুবাদ করে একটা পত্রিকাতে পাঠান কিন্তু তারা প্রকাশ করে নি। পরে হারিয়ে যায় কপি। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নিজের লেখা বইয়ের মধ্য থেকে প্রিয় হিসেবে আলাদা করেছেন ‘কালো যাদুকর’ বইটিকে। সাহিত্যের বাইরে হুমায়ূন আহমেদের অত্যন্ত প্রিয় বই ‘ফান উইথ ম্যাথ অ্যান্ড ফিজিক্স’।

এরপরেই নিজের বইপড়া নিয়ে লিখেছেন আনিসুজ্জামান। তিনি কৈশোরে বইপাঠের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানাতে গিয়ে উল্লেখ করেন: ‘নাটক-নভেল পড়াটা যে ভালো কাজ নয়— এই নৈতিকতার হাওয়া তখনো চারপাশে বয়ে চলেছিল। সুতরাং খুব সচেতনভাবে নাটক-নভেল পরিহার করে চলেছি। শুনে তো অগ্রজস্থানীয় এক বন্ধু হেসে অস্থির। বলেন, সিনেমা দেখতে পারো, নাটক দেখতে পারো, আর নাটক-নভেল পড়লেই যত বাধা!’ প্রিয় লেখক গুন্টার গ্রাসের বই ও সাহিত্যজীবন নিয়ে লিখেছেন কবি বেলাল চৌধুরী। সুফিয়া কামালের ‘সাঁঝের মায়া’ নিয়ে লিখেছেন কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন। বইটি ১৯৩৮ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। সেলিনা হোসেন জানাচ্ছেন, ‘সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই বইটি ছিল একজন বাঙালি মুসলিম নারীর সামাজিক অবস্থানের বিপরীতে তাঁর সৃজনশীলতার পরিশুদ্ধি।’ 

মনে দাগকাটা চারটি বই নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। বই চারটি হলো হার্টা মুলারের দ্য পাসপোর্ট, রহিনতন মিস্ত্রির ফ্যামিলি ম্যাটারস, শহীদুল জহিরের আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু ও হুমায়ূন আহমেদের জোছনা ও জননীর গল্প। বিমল করের উপন্যাস খড়কুটো নিয়ে লিখেছেন ইমদাদুল হক মিলন। নিজের পড়া প্রিয় বই নিয়ে লিখেছেন হাসনাত আবদুল হাই। যাযাবরের দৃষ্টিপাত নিয়ে তিনি অসাধারণভাবে তাঁর ভালোলাগা তুলে ধরেছেন। খ্যাতিমান ইংরেজির অধ্যাপক বুদ্ধিজীবী ও নিউ ভ্যালুজ পত্রিকার সম্পাদক খান সারওয়ার মুরশিদের গদ্যগ্রন্থ কালের কথা নিয়ে লিখেছেন আবদুশ শাকুর। রশীদ হায়দার লিখেছেন বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী নিয়ে। আতোয়া দ্য সাঁ এক্সুপেরির শিশুতোষগ্রন্থ দ্য লিটল প্রিন্স নিয়ে লিখেছেন দ্বিজেন শর্মা। ওরহান পামুকের জনপ্রিয় উপন্যাস মাই নেইম ইজ রেড নিয়ে লিখেছেন খোন্দকার আশরাফ হোসেন। হাসান ফেরদৌস লিখেছেন উইলিয়াম বি মাইলামের বাংলাদেশ অ্যান্ড পাকিস্তান: ফ্লার্টিং উইথ ফেইলিয়র ইন সাউথ এশিয়া শীর্ষক গ্রন্থটি নিয়ে। সলিমুল্লাহ খান লিখেছেন আহমদ ছফার উপন্যাস ওঙ্কার নিয়ে।

এই সংখ্যায় খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি গদ্য লিখেছেন দাউদ হায়দার। পছন্দের বইয়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি বইবিষয়ক আরও কিছু প্রসঙ্গ ছুঁয়ে গেছেন। তিনি শুরুতেই খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বই সমালোচনার কোনো ধারা তৈরি হয় নি। কোনো দৈনিক সাপ্তাহিক বই নিয়ে এক পৃষ্ঠা খরচ করতে নারাজ।’ এরপর তিনি বলছেন, ‘বই নিয়ে যত তর্কবিতর্ক, আলোচনা সমালোচনা হবে, লেখকের জন্যই মঙ্গলজনক। পাঠকের জন্যও। সাহিত্যের জন্যেও।’ প্রিয় বই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি পঙ্কজ মিশ্র, রোহিনতন মিস্ত্রি, গুলজার, মোহাম্মদ হানিফ, কামিলা শামসি, নুরুদ্দিন ফারাহ, ফাদহিল আল-আজায়ি প্রভৃতি লেখকের বই ও তাঁদের প্রসঙ্গে চলে এসেছেন।

আন্তিগোনে ও নোরা নিয়ে লিখেছেন শফি আহমেদ। বুদ্ধদেব বসুর কালের পুতুল নিয়ে লিখেছেন পারভেজ হোসেন। সেলিনা হোসেনের গায়ত্রী সন্ধ্যা নিয়ে লিখেছেন মোমিন রহমান, বেশকিছু নিষিদ্ধ বই নিয়ে লিখেছেন নুরুল করিম নাসিম। বিশ্বে কোন বই কোন কারণে নিষিদ্ধ হয়েছে তা তিনি সবিস্তারে তুলে ধরেছেন। আফসোস, এই করোনার মধ্যেই অনুবাদক-লেখক নুরুল করিম নাসিমকে আমরা হারিয়েছি।  

মফিদুল হকের আলোচনায় আমি নতুন একটি বইয়ের সন্ধান পেলাম। এই বইটির নাম আগে কোথাও শুনি নি। লেখক আবদুল্লাহ আল-হারুন। বইয়ের নাম জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে। বইটির বিষয় মৃত্যুদর্শন। আলোচক জানাচ্ছেন, ‘লেখক দীর্ঘকাল জার্মানি-প্রবাসী, কাজ থেকে অবসর নিয়ে তিনি হদিশ করে ফিরেছেন জীবনের নিগূঢ় অর্থ। সেই তাড়না থেকে তাঁকে নিয়ে গেছে হজপিস আন্দোলনের কাছে, যা জুগিয়েছে মৃত্যুপথযাত্রীর শয্যাপাশে অবস্থান করে কাল থেকে মহাকালের উদ্দেশ্যে ভেলা ভাসাবার মানবীয় অনেকখানেক দৃশ্য অবলোকনের।’ এই সংখ্যায় আরও কিছু লেখার সঙ্গে বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে ধ্রুব এষের লেখাটিও স্মরণে রাখার মতো।

অন্যদিন-এর দ্বিতীয় বই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। শুরুতেই সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’ প্রবন্ধটি মুদ্রিত হয়েছে। রশীদ হায়দার লিখেছেন বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর সম্পাদনায় সিরিজ আকারে প্রকাশিত গ্রন্থ স্মৃতি: ১৯৭১ নিয়ে। সেলিনা হোসেন চর্যাপদের পটভূমিতে লিখেছেন উপন্যাস নীল ময়ূরের যৌবন। সেই উপন্যাস লেখার চিন্তা ও ভাবনার কথা তিনি জানিয়েছেন এই গদ্যে। ইমদাদুল হক মিলন লিখেছেন তাঁর বৃহৎ কলেবরে প্রকাশিত উপন্যাস ‘নূরজাহান’ লেখার পেছনের গল্প নিয়ে। আনিসুল হক লিখেছেন তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস ‘মা’ লেখার কাহিনি নিয়ে। এভাবে বেশ কয়েকজন লেখকের কাছ থেকে তাঁর নিজের লেখা একটি পাঠকপ্রিয় বই লেখার পেছনের নানা ঘটনা আমরা জানতে পারি।

এই সংখ্যায় হাসনাত আবদুল হাই কনরাডের হার্ট অব ডার্কনেস নিয়ে লিখেছেন। সুনন্দা সিকদারের পাঠকপ্রিয় বই দয়াময়ীর কথা নিয়ে লিখেছেন পাপড়ি রহমান। অজন্তা মিত্রের লোকসাহিত্য-বিষয়ক গ্রন্থ বাংলা গীতিকার রূপতাত্ত্বিক ও গঠনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে লিখেছেন আবদুশ শাকুর। জীবনানন্দ দাশের উপন্যাস মাল্যবান নিয়ে লিখেছেন পারভেজ হোসেন। শেষের কবিতা নিয়ে লিখেছেন মনি হায়দার। মন্মথনাথ ঘোষের জাপান-প্রবাস নিয়ে লিখেছেন সুব্রত কুমার দাস। হুমায়ূন আহমেদের হলুদ হিমু কালো র‌্যাব বইটি নিয়ে লিখেছেন নুরুল করিম নাসিম। আরও কয়েকটি সুখপাঠ্য গদ্য এ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

তৃতীয় বইসংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। শুরুতেই প্রকাশিত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের ধূসর পা-ুলিপির ওপর আহমদ রফিকের গদ্য। ওকাম্পো ও গ্যাব্রিয়েলার পত্রাবলির উপর লিখেছেন পূরবী বসু। সালেহ চৌধুরী লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদের বাদশাহ নামদার উপন্যাস নিয়ে। শাহাবুদ্দীন নাগরী লিখেছেন এবিএম মূসার মুজিব ভাই বই নিয়ে। বইবিষয়ক অন্যরকম একটি গদ্য লিখেছেন মুম রহমান। বই পড়ার নানারকম ফায়দা তিনি এখানে বাতলে দিয়েছেন। ওরহান পামুকের ইস্তাম্বুল নিয়ে লিখেছেন শফি আহমেদ। আগে প্রথম বইসংখ্যায় তাঁর মাই নেইম ইজ রেড সম্পর্কে পাঠকরা জানার সুযোগ পেয়েছেন। সৈয়দ হকের সবচেয়ে আলোচিত বই খেলারাম খেলে যা নিয়ে লিখেছেন আহমাদ মোস্তফা কামাল।

বই নিয়ে অন্যদিন চতুর্থ সংখ্যাটি প্রকাশ করে ২০১৮ সালে এসে। সংখ্যাটিতে অধিকাংশ লেখা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বইসংখ্যা থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে। ভালো লেখা পুনর্মুদ্রণের প্রয়োজন আছে, কিন্তু অধিকাংশ লেখা পুনর্মুদ্রণ করা হলে একটি নতুন লেখা থেকে বঞ্চিত হন নিয়মিত পাঠক। তাছাড়া, সম্পাদকীয়তে এ সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ থাকলে ভালো হতো। এই সংখ্যায় আমি নিজেও লিখেছি মার্গারেট অ্যাটউডের নারীবাদী ডিসটোপিয়ান উপন্যাস দ্য হ্যান্ড মেইড’স টেল নিয়ে।  

বই নিয়ে অন্যদিন-এর এই চারটি সংখ্যার আলোচ্য পাঠ থেকে পাঠক আন্দাজ করতে পারছেন সংখ্যাগুলো কতটা ঋদ্ধ। দেশের খুব অগ্রগণ্য লেখকরা তাদের প্রিয় বই নিয়ে লিখেছেন, কখনো কখনো লেখক নিজেই তাঁর পাঠকপ্রিয় বইটি লেখার পেছনের গল্প তুলে ধরেছেন। আলোচনার জন্য নির্বাচিত বইয়েও সর্বোচ্চ বৈচিত্র্য চোখে পড়ে। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণা, শিশুসাহিত্য, অনুবাদ, নাটক, কল্পকাহিনি কোনো ধরনের বই-ই বাদ পড়ে নি আলোচনা থেকে। বোঝা যায় সুচিন্তিত সম্পাদনার ফসল প্রতিটি সংখ্যা।  

অন্যদিন বইসংখ্যায় বাড়তি প্রাপ্তি হলো বই এবং লেখকের ছবিসহ চমৎকার উপস্থাপনা। নান্দনিকতার দিক থেকেও অন্যদিন অনন্য। ১৯৯৯ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে এই পত্রিকার ঈদসংখ্যার প্রচ্ছদ করে আসছেন প্যারিস প্রবাসী বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। এটা একটি পত্রিকার জন্য বিরাট ঘটনা।

Leave a Reply

Your identity will not be published.