‘একটি কাজের জন্য পুরস্কার পাওয়ার মানেই আরেকটি কাজে হাত দেওয়ার উৎসাহ লাভ করা'-এ হলো হেনরী ক্লে’র ভাষ্য। তার এই কথাটি যে খুবই সত্যি তা তো বলাই বাহুল্য। এ দেশের নবীন-প্রবীণ কথাসাহিত্যকদের উৎসাহিত করার জন্য, তাদের কাজের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য ২০১৫ সালে প্রবর্তিত হয়েছিল ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’। এক্সিম ব্যাংকের সহযোগিতায় পাক্ষিক অন্যদিন-এর এই উদ্যোগ। চতুর্থ বছরে পদার্পণ করা এই পুরস্কারটি ইতিমধ্যে এ দেশের কথাসাহিত্যিকদের মাঝে সাড়া ফেলতে সমর্থ হয়েছে। এবার এই পুরস্কারটি পেয়েছেন প্রবীণ কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান এবং নবীন কথাশিল্পী ফাতিমা রুমি। এই পুরস্কারকে ঘিরেই রচিত হয়েছে এবারের প্রচ্ছদ রচনা।
বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাস খুব বেশি পুরোনো নয়। ১২৮০ বঙ্গাব্দের (১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ) জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় ‘বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় বঙ্কিম সহোদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মধুমতী’ গল্প দিয়েই বাংলা গল্পের যাত্রা শুরু। অন্যদিকে বাংলা। সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস প্যারীচাদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৭)। তবে উপন্যাসে নবযুগের সূত্রপাত ঘটে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫) প্রকাশের মধ্য দিয়ে।...কল্লোল যুগে বাংলা কথাসাহিত্য নতুন মাত্রা পায়। এই মাধ্যমটির মানচিত্র প্রসারিত হয়। নিচুতলার মানুষদের জীবন উঠে আসে কথাসাহিত্যে।...বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের প্রসঙ্গে বলা যায়, পঞ্চাশের দশকে কথাসাহিত্য হয়ে ওঠে মৃত্তিকাস্পর্শী ও জাতিসত্তার শিকড় সন্ধানী। ষাট দশকে এদেশের কথাসাহিত্যে সূচিত হয় নতুন স্রোত। আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক কল্লোল আর সংঘাতের পটে রচিত হয় গল্প-উপন্যাস। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কথাসাহিত্যে লক্ষ করা যায় নতুন নতুন নিরীক্ষা আর বাঁক।
এই পটভূমিতে গত বছর প্রবর্তিত হয় ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’। প্রত্যাশা করা হচ্ছে, এই পুরস্কার এদেশের প্রবীণ এবং নবীন-এই দুই শ্রেণির কথাসাহিত্যিকদেরই অনুপ্রাণিত করবে।
আপন দ্যুতিতে উল্লসিত প্রয়াত এই লেখকের স্মরণে এবং এদেশের নবীন-প্রবীণ কথাসাহিত্যিকদের প্রেরণা জোগাতে ২০১৫ সালে প্রবর্তিত হয় এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার| দুটি শ্রেণিতে এই পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। বিশেষ কোনো শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে কথাসাহিত্যে অবদান রাখার জন্য অধী কথাসাহিত্যে সার্বিক অবদানের জন্য একটি পুরস্কার। এর অর্থমূল্য পাঁচ লাখ টাকা।
অনুর্ধব চল্লিশ বছর বয়সী লেখককে পুর্ববর্তী বছর প্রকাশিত তার নির্দিষ্ট গ্রহের জন্য আরেকটি পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। এর অর্থমূল্য এক লাখ টাকা। এছাড়া দুই ক্যাটাগরিতেই বিজয়ীরা পাচ্ছেন ক্রেস্ট, উত্তরীয় ও সার্টিফিকেট। ২০১৫ সালে এই দুটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পেয়েছিলেন যথাক্রমে শওকত আলী ও সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম; ২০১৬ সালে পেয়েছিলেন হাসান আজিজুল হক ও স্বকৃত নোমান এবং ২০১৭ সালে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও মোজাফফর হোসেন।
কথাসাহিত্যে এই পুরস্কার প্রদান করা হয় এবং হচ্ছে। কেননা একদা অবিভক্ত বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আর এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হচ্ছেন হুমায়ুন আহমেদ, যার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে| ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের মাধ্যমে। পরের চার দশক আপন সৃষ্টিশীলতায় আচ্ছন্ন রেখেছিলেন তিনি কোটি বাঙালিকে। তাঁর একটি নিজস্ব কণ্ঠস্বর আছে। পড়ামাত্রই তাঁর লেখা চেনা যায়। পরিস্থিতি নির্মাণ, বর্ণনা ভঙ্গি, সংলাপে তিনি এমন এক শৈলীর উদ্ভাবন করেছেন, যা বাংলা কথাসাহিত্যে অদ্বিতীয়।
পিছন ফিরে দেখা
‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’ প্রবর্তিত হয় গত বছর, ২০১৫ সালের ১৭ মে, বিকেলে। সেদিন বাংলা একাডেমির শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন নতুন এই সাহিত্যে পুরস্কারের। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির| আসন গ্রহণ করেছিলেন এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গর্ভনর এস কে সুর চৌধুরী বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। বক্তব্য দেন এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া, হুমায়ূন আহমেদের অনুজ আহসান হাবীব ও স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন।
এই সাহিত্য পুরস্কারের প্রবর্তনালগ্নে জানানো হয়েছিল, কথাসাহিত্যে প্রদান করা হবে এই পুরস্কার। দুটি ক্যাটাগরিতে।
পূর্ববর্তী বছরের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকাশিত কথাসাহিত্যের জন্য অথবা কথাসাহিত্যের সার্বিক অবদানের জন্য প্রথম পুরস্কারটি প্রদান করা হবে। এর অর্থমূল্য হলো পাঁচ লাখ টাকা। অন্যদিকে পূর্ববর্তী বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকাশিত কথাসাহিত্যের জন্য অনূর্ধ্ব পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্ক লেখককে দ্বিতীয় পুরস্কারটি দেওয়া হবে। এর অর্থমূল্য ১ লাখ টাকা। এ ছাড়া পুরস্কার হিসেবে প্রত্যেকে পাবেন ক্রেস্ট, উত্তরীয় ও সার্টিফিকেট। সেদিন আরও জানানো হয়েছিল, প্রতি বছর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনকে সামনে রেখে ১২ নভেম্বর প্রদান করা হবে এই পুরস্কার। শুধু বাংলাদেশের জীবিত নাগরিকই এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হবেন। মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়া হবে না। তবে পুরস্কার সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পরে যদি দুর্ভাগ্যক্রমে মনোনীত সাহিতিক মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে এই বিধি তাঁর সম্পর্কে প্রযোজ্য হবে না।
আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ও পাক্ষিক অন্যদিন-এ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছিল এই পুরস্কার ও পুরস্কার সম্পর্কিত তথ্যাদি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘পাক্ষিক অন্যদিন’-এর সম্পাদকীয় কার্যালয়ে জমা পড়েছিল নবীন সাহিত্যশ্রেণির বহু বই। ৩০ জুন ২০১৫ ছিল বই জমা দেওয়ার শেষ দিন।।
জমাকৃত বইগুলো থেকে প্রাথমিক বাছাই কমিটির সম্মানিত তিন সদস্য (অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, অধ্যাপক খালেদ হোসাইন এবং আবদুল্লাহ্ নাসের) নবীন সাহিত্যশ্রেণিতে (অনুর্ধ্ব পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্ক লেখক) পুরস্কারের জন্য বিবেচনার জন্য বেশ কিছু বই নির্বাচন করেন এবং সেগুলো বিচারকমণ্ডলীর সামনে উপস্থাপন করেন।
পাঁচ সদস্যের বিচারকমণ্ডলী (সভাপতি আনিসুজ্জামান, সদস্য হায়াৎ মামুদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আবুল হাসনাত এবং পূরবী বসু) প্রথম ক্যাটাগরির জন্য নির্বাচিত করেন প্রবীণ কথাসাহিত্যিক শওকত আলীকে। বাংলা কথাসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য এই পুরস্কার তাঁকে প্রদান করা হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে বাছাই কমিটির নির্বাচিত গ্রন্থসমূহ থেকে ‘পা’ গল্পগ্রন্থকে নির্বাচিত করেন বিচারকমণ্ডলী। ফলে নবীন সাহিত্যশ্রেণিতে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হন সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম। পা এর লেখক তিনিই।
২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর বিকেলে বাংলা একাডেমির সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম জানান অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম। এই সময় বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এবং এক্সিম ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স সঞ্জীব চ্যাটার্জি।
পুরস্কারপ্রাপ্তদের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে এ পুরস্কার তুলে দেওয়া হয় ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, বিকেলে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে। তারা পুরস্কার হিসেবে পান যথাক্রমে পাঁচ লাখ এবং এক লাখ টাকা। এ ছাড়া প্রদান করা হয় ক্রেস্ট, উত্তরীয় এবং সার্টিফিকেট।
২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর বিকেলে বাংলা একাডেমির সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পুরস্কারপ্রাদের নাম জানান অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম। এই সময় বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এবং এক্সিম ব্যাংকের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ব্র্যান্ডিংসঞ্জীব চ্যাটার্জি।
শওকত আলী এবং সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমামের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে এ পুরস্কার তুলে দেওয়া হয় ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে।
২০১৬ সালেও বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে এই পুরস্কারের দুটি ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত হন হাসান আজিজুল হক (বাংলা কথাসাহিত্যের সামগ্রিক অবদান) এবং স্বকৃত নোমান (নবীন সাহিত্যশ্রেণি, উপন্যাস 'কালকেউটের সুখ)। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে এই পুরস্কারের নবীন সাহিত্যশ্রেণি ক্যাটাগরিতে লেখকের বয়সের সীমা ছিল অনুর্ধব পয়ত্রিশ। ২০১৬ সালে এটি পরিবর্তন করে অনুর্ধ্ব চল্লিশ বছর করা হয়।
২০১৭ সালে এই পুরস্কারের প্রক্রিয়া শুরু হয় দুই বছরের জুলাই মাসে। নানা ধাপ শেষে চার সদস্যের বিচারকমণ্ডলী দুই ক্যাটাগরিতে বিজয়ী হিসেবে নির্বাচিত করেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও মোজাফ্ফর হোসেনকে। উল্লেখ্য, মোজাফফর হোসেন এ পুরস্কার পান ‘অতীত একটা ভিনদেশ গ্রন্থের জন্য।
যেভাবে নির্বাচিত হলেন রিজিয়া রহমান ও ফাতিমা রুমি
এবারের পুরস্কারের কার্যক্রম শুরু হয় এ বছরের জুলাই মাসে। তখন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানা্নো হয়েছিল এই পুরস্কার ও পুরস্কার সম্পর্কিত বিষয়াদি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ‘পাক্ষিক অন্যদিন'-এর সম্পাদকীয় কার্যালয়ে জমা পড়েছিল প্রবীণ এবং নবীন লেখকদের বহুবই। গত ১২ আগস্ট ছিল বই জমা দেওয়ার শেষ দিন। জমাকৃত বইগুলো দেখার পর প্রাথমিক বাছাই কমিটির সম্মানিত তিন সদস্য (অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, পারভেজ হোসেন এবং আবদুল্লাহ নামের নবীন) সাহিত্যশ্রেণিতে (অনুর্ধব চল্লিশ বছর বয়স্ক লেখক) পুরস্কারের জন্য বিবেচনার জন্য বেশ কিছু বই নির্বাচন করেন এবং সেগুলো বিচারকমণ্ডলীর সামনে উপস্থাপন করেন।
চার সদস্যের বিচারকমণ্ডলী (সভাপতি আনিসুজ্জামান, সদস্য সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আবুল হাসনাত এবং মইনুল আহসান সাবের) প্রথম ক্যাটাগরির জন্য নির্বাচিত করেন রিজিয়া রহমানকে। তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, বাংলা কথাসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য তাকে এই পুরস্কার দেওয়া হবে। অন্যদিকে বাছাই কমিটির নির্বাচিত গ্রন্থ থেকে ‘সাঁঝবেলা’কে নির্বাচিত করেন বিচারক। ফলে নবীন সাহিত্যশ্রেণিতে এই বছর পুরস্কার পেয়েছেন কথাসাহিত্যিক ফাতিমা রুমি।
বিজয়ীদের নাম ঘোষণা
গত ৩ নভেম্বর, বিকেলে, শাহবাগস্থ জাতীয় জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টি সভাকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৮’-এর বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম। এই সময় উপস্থিত ছিলেন স্পন্সর প্রতিষ্ঠান এক্সিম ব্যাংকের সিনিয়র অ্যাসিস্টান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ব্র্যান্ডিং ডিভিশনের প্রধান সঞ্জীব চ্যাটার্জি, অন্যদিন-এর নির্বাহী সম্পাদক আবদুল্লাহু নাসের প্রমুখ।
মাজহারুল ইসলাম এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তনের পটভূমি বর্ণনা করে বলেন, হুমায়ুন আহমেদ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিশীল কর্ম রয়ে গেছে। যুগ যুগ ধরে তাঁর স্মৃতি সমুজ্জ্বল রাখার লক্ষ্যেই এ পুরস্কার চালু করা হয়েছে। এবার চতুর্থবারের মতো দেওয়া হচ্ছে এ পুরস্কার। সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান এবং নবীন সাহিত্যেপিতে ফাতিমা রুমিকে এ পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। পুরস্কার হিসেবে তারা পাবেন যথাক্রমে পাঁচ লাখ এবং এক লাখ টাকা। এ ছাড়াও দেওয়া হবে একটি ক্রেস্ট, উত্তরীয় ও সনদ।
সঞ্জীব চ্যাটার্জি বলেন, এক্সিম ব্যাংক সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। এমনই একটি কার্যক্রম হলো এই পুরস্কার। এই পুরস্কারের সঙ্গে এক্সিম ব্যাংক সম্পৃক্ত থাকতে পেরে খুবই আনন্দিত। কেননা বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি লেখক হুমায়ুন আহমেদের নামে এ পুরস্কারটি প্রদান করা হচ্ছে।
ডেটলাইন ১২ নভেম্বর, ২০১৮
তারপর এল সেই কাক্ষিত দিন, ‘এক্সিম ব্যাংকঅন্যদিন হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’ বিজয়ীদের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেওয়ার বিরল মুহূর্ত।
গত ১২ নভেম্বর, সোমবার, বিকেলে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে এ পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি ছিলেন মাননীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর। সভাপত্বি করেন এই পুঙ্কারের জন্য গঠিত বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি জাষ্ট্রীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গানের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটে। তিনি দুটি গান পরিবেশন করেন— ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’, ‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’।
অতঃপর স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, হূমায়ুন আহমেদ স্মরণে এবং নবীন-প্রবীণ কথাসাহিত্যিকদের শিল্পসৃষ্টিতে প্রেরণা জোগাতে ২০১৫ সালে প্রবর্তিত হয়েছে ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’। আমাদের উদ্যোপের সহায়তার জন্য এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তিনি প্রাথমিক ও চুড়ান্ত পর্যায়ের বিচারকমণীর সম্মানিত সদস্যসহ বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মাঝে ছিলেন, আমাদের মাঝে আছেন, হুমায়ুন আহমেদ অন্যদিন পরিবারের একজন হিসেবে আছেন। হুমায়ুন আহমেদ বাংলা একাডেমিতে আছেন। হুমায়ূন আহমেদ তার নুহাশপল্লীতে আছেন, হুমায়ূন আহমেদ সারা পৃথিবীতে যেখানে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ছড়িয়ে আছে, যেখানে বাংলা ভাষায় লেখা হবে, যেখানে বাংলা ভাষা পঠিত হবে যতদিন, ততদিন হুমায়ূন আহমেদ থাকবেন। তার স্মরণে এই পুরস্কারের প্রবর্তন। আমাদের অঙ্গীকার ও প্রচেষ্টা এই পুরস্কার যেন হুমায়ূন আহমেদ নামটির মধ্যেই সাহিত্যপ্রেমীদের হৃদয়ে সুদৃঢ় অবস্থান করে নিতে পারে।
এরপর বক্তব্য দেন হুমায়ুন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। তিনি বলেন, একজন সাহিত্যিকের জীবন পরিপূর্ণতা পায় যখন তার নামে পুরস্কার প্রষ্ঠিত হয়। এ পুরস্কার প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্য জীবন পরিপূর্ণ হয়েছে। তিনি প্রত্যাশা করেন, নবীন কথাসাহিত্যিকদের জন্য এ পুরস্কার তীব্র কামনার পুরস্কার হবে একদিন।
শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন এক্সিম ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, কথাসাহিত্যিক হিসেবে শরশ্চন্দ্রের চেয়েও বেশি জনপ্রিয় ছিলেন হুমায়ুন আহমেদ। তাঁর নামে প্রবর্তিত এই পুরস্কারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে আমি আনন্দিত। এই পর্যায়ে নবীন সাহিত্যশ্রেণিতে এর ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’ যিনি পেয়েছেন, সেই ফাতিমা রুমির ওপর নির্মিত একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। তারপর পোডিয়ামে এসে ফাতিমা রুমির উদ্দেশে শংসাবচন পাঠ করেন বিচারকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য কালি ও কলম' সম্পাদক ও সাহিত্য সমালোচক আবুল হাসনাত।
ফাতিমা রুমিকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন সিরাজুল ইসলাম। তার হাতে সার্টিফিকেট ও শংসাবচন তুলে দেন আসাদুজ্জামান নূর এবং ক্রেস্ট প্রদান করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। অতঃপর সম্মিলিতভাবে সবাই চেক তুলে দেন ফাতিমা রুমির হাতে। পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে ফাতেমা রুমি বলেন, হুমায়ূন আহমেদের নামাঙ্কিত এ পুরস্কার একজন নবীন লেখকের জন্য অনেক বড় পাওয়া। সেই সঙ্গে অনেক বেশি উৎসাহের, যা একজন তরুণ লেখকই উপলব্ধি করতে পারেন। ফাতিমা রুমি জানান, হুমায়ুন আহমেদের প্রায় সব বইই সংগ্রহে রয়েছে। একেকটি বই চার-পাঁচবার পড়েছেন তিনি। তার মনে হচ্ছে যে, হুমায়ূন আহমেদ যেন এখানে উপস্থিত আছেন। তিনিই সস্নেহে এই পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন তার হাতে।
তারপর সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য রিজিয়া রহমানেল্প হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার পালা। শুরুতে তার ওপর নির্মিত একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। উল্লেখ্য, প্রবীণ ও নবীন দুই কথাসাহিত্যিককে নিয়ে নির্মিত দুটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন সূচনা কবির এবং চিত্রনাট্য লিখেছেন মোমিন রহমান।...রিজিয়া রহমানের উদ্দেশে শংসাবচন পাঠ করেন বিচারকমণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তারপর প্রধান অতিথি এবং বিশেষ অতিথি মিলে রিজিয়া রহমানের হাতে তুলে দেন সার্টিফিকেট, শংসাবচন এবং ক্রেস্ট। এক্সিম ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিয়ে দেন উত্তরীয়। সম্মিলিতভাবে তাঁর হাতে চেকও তুলে দেওয়া হয়।
পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে রিজিয়া রহমান জানান, এ পুরস্কার প্রাপ্তি তার জন্য সম্মানের, গর্বে, দুঃখের ও বেদনার। কারণ হুমায়ুন আহমেদ তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। তাঁর স্মৃতি হয়ে যাওয়ার কথা আর হুমায়ুন আহমেদের বেঁচে থাকার কথা। হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতির স্মারক হিসেবে পাওয়া এ পুরস্কার পাওয়া তাঁর কাছে অনেক গর্বের ও সম্মানের। বিশেষ অতিথি মাননীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, প্রিয় মানুষেরা চলে গেলেও তাঁকে প্রিয়জনেরা স্মরণ করলে চিরকাল বেঁচে থাকেন। হুমায়ূন আহমেদ তেমনই একজন। তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন।...একটু অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তার মধ্যে একটা আধ্যাত্মিক ব্যাপার ছিল। তিনি অনেক কিছুই বলতেন যা ঘটত। এটা ব্যাখ্যাতীত।...রিজিয়া রহমানের একুশে পদক না পাওয়ার বিষয়ে আক্ষেপ করে আসাদুজ্জামান নুর বলেন, তার মতো লেখকের একুশে পদক নাপাওয়া আমাদের জন্য লজ্জার। ভবিষ্যতে আমরা সেই লজ্জা মোচনের চেষ্টা করব।
প্রধান অতিথি মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, অনেক সময় অনেক পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু যাকে দেওয়া হয় তিনি তখন বেঁচেই থাকেন না। কিন্তু আজ যাদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে তারা দুজনই সশরীরে উপস্থিত রয়েছেন। একজন বয়সে বৃদ্ধ হলেও লেখনিতে তরুণী। তিনি পুরস্কারপ্রাপ্তদের অভিনন্দন জানান। ...হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, তিনি যখন মারা যান তখন মনে হয়েছিল বড় দ্রুত আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তবে এখনো তিনি তার লেখার মাধ্যমে আমাদের মধ্যে বেঁচে রয়েছেন।..হুমায়ুন বাংলা সাহিত্যে একটা বিরাট পাঠক তৈরি করে গেছেন। তার সুফল আমরা এখনো ভোগ করছি। তিনি শুধু ভালো লেখকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন আধুনিক লেখক। অনুষ্ঠানের সভাপতি এবং বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, হুমায়ূন আহমেদ নেই, হুমায়ূন আহমেদ আছেন। আমরা যারা তাঁর সাহচর্য লাভ করেছিলাম, তাদের স্মৃতিতে তিনি রয়েছেন। যারা তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান নি, তারা তাঁর সাহিত্যকর্মকে ভালোবেসে তার নৈকট্য লাভ করেছেন। হুমায়ুন আহমেদ এখন সর্বত্র বিরাজিত।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে রিজিয়া রহমান ‘ঘর ভাঙা ঘর' উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে এবং এই উপন্যাসে ছিন্নমূল মানুষের জীবনকে রূপায়ণ করে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে যে ব্যাপক স্থানা নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন তা আজও অব্যাহত আছে। তার সাহিত্যরুচি ও মানস গঠিত হয়েছিল পারিবারিক আবহে। তাঁর জীবনকে দেখার গভীর পর্যবেক্ষণশক্তি, বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব, বিষয় থেকে বিষয়ারে যাত্রা, নিরীক্ষাপ্রবণতা আর নিজেকে ক্রমশ উত্তরণের প্রয়াস কে করে তুলেছে বিশিষ্ট। বিষয়বৈচিত্র্য ও শিল্পিত উৎকর্ষে তিনি অনন্য।
প্রথম উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছিল নিচু তলার মানুষজনের ক্লেদাক্ত জীবন। এই রূপায়ণ প্ৰসাৰ্বিত হয়েছিল রক্তের অক্ষর' উপন্যাসে, নিষিদ্ধ পল্লির যন্ত্রণাদগ্ধ নারীদের জীবনরূপায়ণে। তার আরেকটি বহুল আলোচিত উপন্যাস ‘উত্তর পুরুষ’। এই উপন্যাসে বাংলাদেশে পর্তুগিজ জলদস্যুদের পীড়ন, লুট ও অত্যাচারের সঙ্গে যুক্ত হয়েহে দেশ-আত্মার মর্যাদা ও দেশচেতনা।
তিনি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে রচনা করেছেন ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাস। এই উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে শতাব্দী পরম্পরার প্রবহমান জীবনের ধারায় অবহেলিত, অনাদৃত ও উপেক্ষিত মানুষজন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে কেমন করে জাতীয় সত্তা নির্মাণ করেছে তা তিনি বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনায় তার ইতিহাসজ্ঞান, মানুষের বেঁচে থাকার আর্তি এবং সংগ্রাম সম্পর্কে গভীর পাঠ ও অনুসন্ধানী লেখকসত্তা নবীন মাত্রা অর্জন করেছে। তিনি গভীরভাবে সন্ধান করেছেন শতাব্দীর মানুষজনের জীবনযাত্রাসহ উত্থান-পতন, জীবনসংগ্রাম ও অভ্যুদয়ের ইতিবৃত্ত। তাঁর রচিত প্রায় পঞ্চাশটি গ্রহে এই চেতনার স্বাক্ষর রয়েছে।
রিজিয়া রহমান তাঁর সৃজন-উদ্যানকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে গেছেন নানাভাবে। কোনো একটি বিশেষ গণ্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ না করে, ভাবালুতা পরিহার করে যে বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছেন তা এই লেখককে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর রচিত উপন্যাসে মানুষের জীবনের বহুকৌণিক দিকের উন্মোচন এদেশের কথাসাহিত্যের ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছে।
এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার তার সামগ্রিক অবদানের এক সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি। তাঁকে অভিবাদন।
ফাতিমা রুমি গল্প বলেন সাবলীল সহজ ভঙ্গিতে, কিন্তু পাঠককে গল্পের কেন্দ্রে ধরে রাখার কৌশল তার জানা। তার ভাষা ঝকঝকে, মেদহীন; তার গল্পরেখায় থাকে অভঙ্গুর সম্পূর্ণতা, এর ওঠানামায়, বাঁক ফেরায় পাঠকের জন্য থাকে নানা চমক। রুমি তারুণ্যকে, মনস্তাত্ত্বিক ভংগুরতাকে অথবা দার্ঢ্যকে দেখেন গভীর এক অদৃষ্টি দিয়ে এবং এর জটিল-সূক্ষ্ম প্রকাশগুলিকে তুলে ধরেন এক আশ্চর্য সাবলীলতায়। তার গল্পের শৈলীতে-আঙ্গিকে কোনো আরোপিত কারুকাজ নেই, অস্পষ্টতা নেই বলা যায় শৈলী নিয়ে তাঁর কোনো উচ্চাশাও নেই। কিন্তু তাঁর পল্প ঠিকই পাঠককে স্পর্শ করে এক আশ্চর্য অন্তরংগতায়। ‘সাঁঝবেলা’ উপন্যাসের কাহিনি আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই নেওয়া, এটি একটি প্রেমের, বোঝাপড়ার ও টানাপোড়েনের গল্প। আমাদের প্রত্যাশা বা জানাবোঝার ওপর কোনো অতিরিক্ত দাবি চাপায় না এই গল্প, কিন্তু যা এই উপন্যাসটি করে, তা হচ্ছে মানুষে-মানুষে সম্পর্কে নানা রহস্য-টিলতাকে সহজভাবে তুলে ধরে। চরিত্রগুলি কতটা বিশ্বাসযোগ্য সেই প্রশ্নে না পিয়েও পাঠক ছাদের কাছে টেনে নেন। ফাতিমা রুমি এই সময়ের এক সংবেদী কাহিনিকার। হুমায়ূন আহমেদের গল্পবলার ধারায় তিনি এক শক্তিশালী সংযোজন। কুশলী এই লেখকের হাতে ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার তুলে দিতে পারাটা তাই আমাদের জন্য আনন্দের।
পুরস্কার প্রসঙ্গেঃ রিজিয়া রহমান
এ দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ এক কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান। তাঁর গল্পউপন্যাসে এদেশের মানুষের সংগ্রাম মুর্ত হয়ে ওঠে। গণমানুষের যাপিত জীবন, চারপাশের অসংগতি ও বৈষম্য ধরা পড়ে তাঁর সাহিত্য দর্পণে। সময়ের উত্তাপ, ইতিহারে নানা অধ্যায় ও মানুষের দ্রোহও অপুর্ব ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত তাঁর লেখায়। রিজিয়া রহমানের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর, কলকাতার ভবানীপুরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর। কর্মজীবনের শুরু সাহিত্য পত্রিকা ‘ত্রিভুজ’-এর সম্পাদক হিসেবে। তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন জাতীয় জাদুঘরে পরিচালনা বাের্ডের ট্রাষ্টি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কার্যপরিচালক হিসেবে। তিন বছর বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
রিজিয়া রহমানের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে: গল্পগ্রন্থ অগ্নিস্বাক্ষরা (১৯৬৭), নির্বাচিত গল্প (১৯৭৮), চার দশকের গল্প (২০১১), দূরে কোথাও...। উপন্যাস—ঘর ভাঙা ঘর (১৯৭৪), উত্তর পুরুষ (১৯৭৭), রক্তের অক্ষর (১৯৭৮),বং থেকে বাংলা (১৯৭৮), অলিখিত উপাখ্যান (১৯৮০), শিলায় শিলায় আগুন (১৯৮০), সূর্য সবুজ রজ (১৯৮১), বাঘবন্দী (২০০৬), আৰে নওয়া (২০০৬), আলবুর্জের বাজ (২০১০)। বাংলা সাহিত্যে তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে রিজিয়া রহমান পেয়েছেন বহু পুরকর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৮), হমায়ুন কাদির সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), বাংলাদেশ লেখক সংঘ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৫), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৫)।
কথাসাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ুন আহমেদ সাহিত্য পুরুষ্কার ২০১৮’ পেয়েছেন রিজিয়া রহমান।
পুরুষ্কার প্রসংগেঃ ফাতেমা রুমি
এ সময়ের প্রতিকৃতিশীল কথাসাহিত্যিক ফাতিমা রুমি। জন্ম ১৯৮৪ সালে, সিরাজ জেলার বেলকুচিয়া থানার দৌলতপুর গ্রামে। বাবা মো. গোলাম ওয়ারেছ। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। মা মনিকা বেগম বর্ণা।
ইডেন কলেজ থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। এখন তিনি রোজ হ্যাভেন গ্রামার স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করছেন। বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসেন। প্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, হুমায়ুন আহমেদ, লিও টলস্তয়, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে প্রমুখ। শীর্ষেন্দু ‘দুরবিন’ উপন্যাসের আঙ্গিক ভীষণ ভালো লাগে তার। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় একটি কবিতা লিখেন তিনি। তবে প্রকাশিত প্রথম লেখা হচ্ছে ‘আমি অনিন্দিতা’ উপন্যাস। এখানে আত্মজৈবনিক উপাদান রয়েছে।
মূলত ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেন। প্রথম উপন্যাস ‘আমি অনিন্দিতা। পরে প্রকাশিত হয়েছে আরও কয়েকটি উপন্যাস ‘অনিন্দিতা এবং একটি গল্প', এক রাতের গল্প',মেঘবালিকার মন ভালো নেই, আবছায়া। বর্তমানে ফাতিমা রুমি বড় করে একটি উপন্যাস লিখছেন। এটির নাম ‘গল্পটা তোমার আমার'। আগামীতে টিভি নাটক কিংবা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার ইচ্ছে আছে। ‘আমি অনিন্দিতা’র জন্য ফাতিমা রুমি ২০১৪ সালে কালি ও কলম পুরস্কার অর্জন করেছেন। এবার ‘সাঁঝবেলা’ উপন্যাসের জন্য নবীন সাহিত্যশ্রেণিতে এ বছরের ‘এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৮’ পেয়েছেন তিনি। উলেখ্য, ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘সাঁঝবেলা' গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে শব্দভূমি প্রকাশনা।
আলোকচিত্র এস এম নাসির।
Leave a Reply
Your identity will not be published.