সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (পর্ব ১৯)

সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (পর্ব ১৯)

[কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা বা ঘোরাঘুরি— এসব ক্ষেত্রে ভ্রমণপিপাসু বেশির ভাগ মানুষের ঝোঁক পশ্চিম ইউরোপের দিকে। অথচ পাহাড়-নদী-প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিখ্যাত পূর্ব ইউরোপও। যেখানে রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবধর্মী পাঠ। এমনই এক দেশ সার্বিয়া। ভ্রমণের বহুরৈখিক পথে লেখকের কাছে নতুন উপজীব্য হয়ে ওঠে সার্বিয়ান এক তরুণী। ঠিক প্রেম নয়, প্রেমের চেয়ে কম কিছুও নয়। পার্থিব দৃশ্যপটের সঙ্গে উঠে এসেছে রোমান্সের হৃদয় ছোঁয়া-না ছোঁয়ার গল্পও। যার পুরো বর্ণনা থাকছে ইমদাদ হকের এই ভ্রমণকাহিনিতে। আজ পড়ুন ১৯তম পর্ব।]

 

প্রথম পর্ব  দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব  চতুর্থ পর্ব  পঞ্চম পর্ব  ষষ্ঠ পর্ব 

সপ্তম পর্ব  অষ্টম পর্ব  নবম পর্ব  দশম পর্ব 

পর্ব ১১  পর্ব ১২  পর্ব ১৩  পর্ব ১৪  পর্ব ১৫  পর্ব ১৬ পর্ব ১৭ পর্ব ১৮ 

জোসিপ ব্রজ টিটো ১৮৯২ সালের সাত মে বর্তমান ক্রোয়েশিয়ার কমরোভেচ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সেই সময়ে জায়গাটি ছিল অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির অংশ হিসেবে। তার মা ছিলেন স্লোভাক, বাবা ক্রোয়েশীয় গ্রামীণ কৃষক। শৈশব থেকেই স্লোভেনীয় আর ক্রোয়েশীয়—দুটি ভাষা একই সঙ্গে শিখতে থাকেন টিটো। তার বাবার সম্পত্তি ছিল ভালোই। কিন্তু অলস বলে সেগুলোর যথার্থ ব্যবহার করতে পারছিলেন না। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনার জন্য পরিবারের সবাইকে নিয়ে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন, তাতেও ভাগ্য পাল্টায় নি।

অর্থের অভাবে শিশু টিটোর চিকিৎসা হবে না—এমন শঙ্কা থেকে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নানাবাড়িতে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার বয়সে উপনীত হওয়া পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন তিনি।

আট বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হন টিটো। কিন্তু আর্থিক সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। পড়ালেখার প্রতি ছিল তাঁর প্রচণ্ড অনীহা। মাত্র চার বছর পরই চুকাতে হয় শিক্ষাপাঠ। ফলে ঠিক মতো পড়তে শিখলেও, লেখাটা পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেন নি তিনি। বানান নিয়ে তাঁর সমস্যা থেকে যায় আমৃত্যুই। পড়ালেখা ছাড়ার পর প্রাথমিকভাবে বাবার কৃষিজমিতে কাজ শুরু করেন। পরে তিনি চাচাতো ভাইয়ের কাছে ক্রোয়েশিয়ার সিসাক শহরে চলে যান। রেস্টুরেন্টে ঝাড় দেওয়া, দারোয়ানগিরি, বাবুর্চির রান্নার সহযোগী হিসেবে কাজ করতে থাকেন। তাঁর অভিজ্ঞতা হয় গাড়ি মেরামতের কারখানার সহযোগী ও সংবাদপত্রের হকার হিসেবেও। ‘ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ নামে সমাজতান্ত্রিক পত্রিকা নিয়মিত পড়তে থাকেন। সমাজতন্ত্রের প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ১৯১০ সালে শ্রমিক ইউনিয়নে যোগ দেন। পরবর্তী তিন বছরে টিটো অন্তত ১০ বার চাকরি ও বাসস্থান পরিবর্তন করেন। প্রায় সময়ই তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠের ভয়ে মালিকরা তাঁকে ছাঁটাই করে দিত। প্রথম প্রথম কিছুটা ভীত হলেও, ধীরে ধীরে সাহস সঞ্চয় করেন টিটো। প্রায় সব ধরনের শ্রমিক আন্দোলনে প্রথম সারিতে তাঁকে দেখা যেত নিয়মিত।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দুই বছর আগে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তেজি মনোভাব, দক্ষতা আর সাহসিকতার কল্যাণে ক্রোয়েশীয় হোম গার্ড রেজিমেন্টের সার্জেন্ট মেজর পদ পেতে বেশি দিন লাগে নি তাঁর। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। সার্বিয়ান সীমান্তে যুদ্ধে অংশ নেয় তাঁর হোম গার্ড রেজিমেন্ট। সাহসী টিটো তাঁর প্লাটুন নিয়ে ৮০ জনের বেশি রাশিয়ান সৈন্য বন্দি করেন। এর কয়েক দিন পরই রোমানিয়া ও ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী বুকোভিনার যুদ্ধে আহত হন। তিনি রাশিয়ানদের হাতে ধরা পড়েন। যুদ্ধবন্দি হিসেবে কাজানে পাঠানো হয় তাঁকে। সেখানে প্রায় ১৩ মাস হাসপাতালে কাটাতে হয়। এ সময় তৃতীয় ভাষা হিসেবে রাশিয়ান ভাষা আয়ত্ত করেন টিটো, যা পরবর্তী সময়ে তাঁর প্রাণ রক্ষা করতে বিরাট সাহায্য করে।

সুস্থ হয়ে উঠলে টিটোর স্থান হয় রাশিয়ার কুঙ্গারে বন্দিশিবিরে। এই ক্যাম্পের বন্দিদের দিয়ে ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করানো হতো। টিটোর জীবনের কুঙ্গার ক্যাম্প পর্ব অনেকটা সিনেমার মতো হয়ে ওঠে। নেতৃত্বের গুণাবলির কারণে অন্য বন্দিদের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ দেওয়া হয় তাঁকে। রেডক্রসের ত্রাণসামগ্রী ক্যাম্পের কর্মকর্তারা আত্মসাৎ করলে তিনি এর প্রতিবাদ করেন। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়। আবারও জেলে বন্দি করা হয় তাঁকে। এক মাস পর তাঁকে মুক্ত করা হয় জেল থেকে। এবার এখান থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন টিটো। বন্দিশিবিরের এক বলশেভিক আন্দোলনকারীর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। নিয়মমাফিক কাজে বেরিয়ে কয়লার ট্রেনে চেপে পেট্রোগার্ডের উদ্দেশে চম্পট দেন দুজনে।

ফিনল্যান্ড সীমান্তের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছেও গিয়েছিলেন দুজনে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ ছিল। সেখানে ধরা পড়ে যান তাঁরা। তাঁদের পুলিশি হেফাজতে ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। মাঝপথে দ্বিতীয় বারের মতো পুলিশের ভ্যান থেকে পালিয়ে দুজন দুদিকে রওনা দেন। টিটো রওনা দেন সাইবেরিয়ার দিকে। চেপে বসেন ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের একটি ট্রেনে। পথে পুলিশ ট্রেন সার্চ করতে এসে তাঁকে ধরে ফেলে। কিন্তু টিটো কথা বলছিলেন অনর্গল রাশিয়ান ভাষায়। ফলে পুলিশ তাঁকে রাশিয়ান মনে করে ছেড়ে দেয়। এবার ধরা পড়লে মৃত্যু ছিল অবধারিত। স্বদেশে ফিরে ‘কমিউনিস্ট পার্টি অব যুগোস্লাভ’ তথা সিপিওয়াইতে যোগ দেন তিনি। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির এক সদস্যের হাতে সেই সময়ের সরকারের এক মন্ত্রীর মৃত্যু হয়। সিপিওয়াইকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আর নিষিদ্ধ দলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় টিটোকেও চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।

সিপিওয়াইয়ের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। দল ভাগ হয় দুভাগে। একাংশের ইচ্ছা ছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিবাদ জানানো। কিন্তু অন্য ভাগটি ছিল সহিংস আন্দোলনের পক্ষে। এই উগ্রবাদী অংশের নেতারা টিটোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। টিটোও রাজি হন। সরকারবিরোধী লিফলেট বিতরণ, সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগঠিত করাসহ নানা অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। বারবার আটক হন, মুক্তিও পান বারবার। একবার পুলিশ তাঁর বাড়িতে বোমা রাখার নাটক সাজিয়ে গ্রেপ্তার করে। আদালতে তোলার আগে প্রায় তিন মাস তাঁকে জেলে রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। আদালতে তাঁর পাঁচ বছরের সাজা হয়। ১৯৩৪ সালে তিনি মুক্তি পান। অসুস্থ টিটোর এই সাজা পাওয়া তাঁকে সাধারণের কাছে নায়কে পরিণত করে।

একাধিক নকল পাসপোর্ট বানিয়ে ফিনল্যান্ড, ভিয়েনা, সার্বিয়া, জাগরেবে ভ্রমণ করেন টিটো। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আন্দোলনের কাজ করেন তিনি। এই সময়েই তিনি ছদ্মনাম হিসেবে টিটো নাম ব্যবহার করেন।

১৯৩৬ সালে তিনি যুগোস্লাভিয়ায় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করেন। পরের বছর নিযুক্ত হন যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব হিসেবে। কোমিনটার্ন নীতির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন তিনি। সর্বদলীয় যুগোস্লাভ সামরিক বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। আগ্রাসীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেন। প্রাথমিকভাবে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিমায় জার্মানির বিপক্ষে যুদ্ধ করে তাঁর বাহিনী। ১৯৪২ সালে তিনি সমাজতান্ত্রিক শাসিত আঞ্চলিক সরকার গঠন করেন। এর ফলে তাঁকে সার্বীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সেন্টিক দলের সঙ্গে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হতে হয়।

প্রথমদিকে টিটো জোসেফ স্ট্যালিনের একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত নেতা স্ট্যালিন তাঁর প্রতি বিরক্ত হন। টিটোও স্ট্যালিনের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। যুগোস্লাভ দল কোমিনফর্ম থেকে বহিষ্কৃত হয়। সোভিয়েতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা অথবা যুগোস্লাভিয়ার আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন স্ট্যালিন। ফলে যুগোস্লাভিয়া স্বাধীন দেশ হিসেবে নতুন যাত্রা শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্র টিটোকে সমর্থন দেয়।

এ সময় বিশ্বে চলছিল ঠান্ডা যুদ্ধ। টিটো মার্কসবাদের মানবতা দিক বিবেচনায় এনে শ্রমিকদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনার প্রতি জোর দেন। উদার অর্থনৈতিক নীতি গঠনের প্রস্তাব আনেন। দলীয় কার্যকলাপকে বিকেন্দ্রীয়করণ করে দেন। প্রজাতন্ত্রে জাতীয়তাবাদী প্রবণতা নতুনভাবে বেগ পেতে থাকে।

১৯৪৫ সালের মার্চে টিটো যুগোস্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন। এ বছরের শেষদিকে জার্মানরা যুদ্ধে পরাজিত হয়। ১৯৪৫-১৯৬৩ মেয়াদকালে যুগোস্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন টিটো। ১৯৬০-এর দশকে এশীয় ও আফ্রিকার দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের বিষয়ে কাজ শুরু করেন। ভারত ও মিশরের রাজনীতিবিদরাও এই উদ্যোগের সঙ্গে ছিলেন। এ দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন জোটের বাইরে ছিল। প্রত্যেক দেশই নিজস্ব ধ্যানধারণা ও সিদ্ধান্ত নিতে পারত। যথাসাধ্য ঠান্ডা যুদ্ধ থেকে তারা নিজেদের মুক্ত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছিল।

স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ‘সোশ্যালিস্ট ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়া’,  ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অন্য সংগঠনগুলোর সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রেও সহযোগিতা ছিল যুগোস্লাভিয়ার। ১৯৭২ সালের মে মাসে বাংলাদেশ বেলগ্রেডে দূতাবাস স্থাপন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে যুগোস্লাভিয়া সফর করেন। প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান এ সময়। সেদিনের সেই ঘটনা আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন এভাবে, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়া আমাদের সার্বিক সমর্থন জুগিয়েছিল।...বঙ্গবন্ধু যুগোস্লাভিয়া সফরে গিয়েছিলেন। সফরসঙ্গী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দেখেছি যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো প্রটোকল ভঙ্গ করে বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। কারণ, সেদিন বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রধানমন্ত্রী আর মার্শাল টিটো প্রেসিডেন্ট।’

১৯৭৪ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে দুই ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট টিটো বাংলাদেশ সফর করেন। এই সফরে দ্বিপক্ষীয় বেশকিছু বিষয়ে আলোচনা হয়। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও সম্পর্ক ছিল আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এ দুই বিশ্ব নেতা ছিলেন জোটনিরপেক্ষ নীতির সমর্থক। এই আলোচনাতেও তাঁরা এই নীতির পক্ষে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতেও এ দুই নেতার মতামত ছিল কাছাকাছি। তাঁরা একমত হয়েছিলেন যে, বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে অনেক হুমকি রয়েছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক নীতির প্রয়োগ ও মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও অব্যাহত আছে। এ রকম বিশ্ব পরিস্থিতিতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে নতুন নতুন দেশের যুক্ত হওয়ার ঘটনায় তাঁরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।

আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর চতুর্থ সম্মেলনে নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জোসেফ টিটো তাঁদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বৃদ্ধি করতে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে তাঁরা জোর দেন। সদস্য দেশগুলোর একটি সভা ডাকার ব্যাপারেও তাঁরা একমত হন। বঙ্গবন্ধু দক্ষিণ এশিয়ার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে জোসেফ টিটোকে অবহিত করেন। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে তাঁর সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের কথাও বঙ্গবন্ধু তাঁকে জানান। প্রেসিডেন্ট টিটো বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের প্রশংসা করেন। উপমহাদেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে তাঁর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ বলে মত দেন।

এ সফরে ১৯৭৪ সালের ৩১ জানুয়ারি যুগোস্লাভ প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ভাষণ দেন। জোসেফ টিটো সেদিন তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে খুব বেশি দিন হয় নি। কিন্তু এর মধ্যেই আমাদের দু’ দেশের মধ্যে আন্তরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমরা আপনাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ মনোভাব পোষণ করেছি। আপনারা স্বাধীনতার জন্য যে বিপুল ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তার জন্য আমরা আপনাদের প্রতি দরদ অনুভব করি। স্বাধীনতা অর্জনের পর যুদ্ধের ক্ষত ও ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আপনাদের প্রচেষ্টার প্রতিও আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’

জোসেফ টিটো সেদিন আরও বলেছিলেন, ‘স্বাধিকার ও সমতার জন্য সংগ্রাম এবং সব দেশ ও গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহযোগিতার নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ শান্তি ও স্থিতিশীলতার এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠেছে।’

৩০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট টিটোর সম্মানে এক প্রীতিভোজের আয়োজন করেন। ভোজে জোসেফ টিটো ও তাঁর সফরসঙ্গীদের স্বাগত জানিয়ে দেওয়া বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনার (মার্শাল টিটো) এ সফর বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশে আপনার প্রথম সফর। বলাই বাহুল্য, বিশেষত আপনার উপস্থিতিতে, যে দুই শতাব্দীর ঔপনিবেশিক শাসনের পর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমাদের জনগণ কেবল ঔপনিবেশিক শাসনের জোয়াল ছুঁড়ে ফেলে নি, তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তাদের ইচ্ছা ও প্রেরণা অনুসারে একটি শোষণমুক্ত নতুন সমাজ গঠনের প্রথম পদক্ষেপও নিয়ে ফেলেছে।’

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে যুগোস্লাভিয়ার জনগণ ও সরকারের বস্তুগত ও নৈতিক সমর্থনের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। পাকিস্তানের ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে তাঁর জীবন রক্ষায় অন্য বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আওয়াজ তোলায় প্রেসিডেন্ট টিটোকে ধন্যবাদ জানান বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি মার্শাল টিটোর আস্থার নিদর্শন ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে তাঁর মন্তব্যেও পাওয়া যায়, ‘৭ই মার্চের ভাষণের তাৎপর্য হচ্ছে, এ ভাষণের মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রমাণ করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিদের কোনো রকম বৈধতা নেই। পূর্ব-পাকিস্তান আসলে বাংলাদেশ।’

বঙ্গবন্ধুর প্রতি ইউরোপীয় মানুষ মার্শাল টিটোর এ শ্রদ্ধার কারণ, টিটো নিজেই ছিলেন বিপ্লবী নেতা। ১৯১৭ সালে দুনিয়া কাঁপানো রুশ বলশেভিক বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.