অন্যদিন-এর ২৫ বছর, ফ্যাশন শিল্পের সোনালি সময়: শেখ সাইফুর রহমান

অন্যদিন-এর ২৫ বছর, ফ্যাশন শিল্পের সোনালি সময়: শেখ সাইফুর রহমান

বাংলাদেশের ফ্যাশন খাতকে ইন্ডাস্ট্রির অবকাঠামো দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু আশির দশকে, প্রয়াত শাহাদত চৌধুরীর হাত ধরে। বলতে গেলে তাঁর উদ্যোগ পরে ডানা মেলে। প্রথম দিকে বিচিত্রায় বাংলাদেশের বয়নশিল্প এবং পোশাক-আশাক নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হয়েছে। সেই রেশ ধরে ১৯৮৬ সালে শুরু হয় বিচিত্রা ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতা। বছর দুয়েকের ব্যবধানে শুরু হয় আনন্দবিচিত্রা ফটোসুন্দরী প্রতিযোগিতা।

ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতা যেমন ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য সহায়ক হয়েছে তেমনি মডেলিং ইন্ডাস্ট্রিকে ভিত দিয়েছে ফটোসুন্দরী প্রতিযোগিতা। এরপর উভয় সাময়িকপত্রের চলমানতায় যতি পড়লে ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্টরা কিছুটা দোদুল্যমান হয়ে পড়েন।

এই পরিস্থিতিতে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় পাক্ষিক অন্যদিন। এই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটু বলে রাখা ভালো বিচিত্রা বন্ধের আগেই যাত্রা শুরু করে পাক্ষিক অন্যদিন। ১৯৯৬ সালে। ততদিনে উন্নত প্রযুক্তির স্পর্শ প্রকাশনা শিল্পকে নতুনতর মাত্রা দিয়েছে। ঠিক এই সময়ে অন্যদিনও নান্দনিকতার বিভা ছড়িয়ে আত্মপ্রকাশ করে। দৃষ্টিনন্দন বর্ণবিন্যাস, অনবদ্য গ্রাফিক্স, অসাধারণ ছবি, হৃদয়গ্রাহী বিষয়বৈচিত্র্য আর আকর্ষণীয় মুদ্রণ সবমিলিয়ে পরিপাটি এক প্যাকেজ; দুই মলাটের ভিতর। আর এটাই ছিল অন্যদিন-এর ইউএসপি। ফলে পাঠকপ্রিয়তা পেতে সময় লাগে নি। সূচনা থেকেই যাপন এবং যাপননিষ্ঠ নানা বিষয় অন্যদিন-এর পাতায় স্থান পেয়েছে সমান গুরুত্বে। ফ্যাশন নিয়ে ফিচার কিংবা সংবাদও অতএব পাঠকরা পেয়েছেন নিয়মিতভাবে।

শুরুর মাত্র দু’বছরের মাথায় বড় ধরনের একটি পদক্ষেপ ছিল ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতা আয়োজন। এতে যে ঝুঁকি ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঝুঁকি বলছি এজন্যই যে এই ধরনের একটি আসরের সফল আয়োজনের ক্ষেত্রে আগপিছ অনেক কিছু ভাবতে হয়। যেখানে ব্যয়ও একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু নতুন পথচলায় প্রত্যয়ী অন্যদিন-এর কুশীলবরা এসব বিষয়কে প্রশ্রয় দিতে রাজি ছিলেন না। বরং ইন্ডাস্ট্রির পাশে দাঁড়ানো, পুরোনোদের পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহী করা ও সমর্থন আর তাদের সৃজনকে উৎসাহ প্রদানই ছিল এই আয়োজনের মূল লক্ষ্য। ফলে ব্যয় তাদের কাছে গৌণ বিবেচিত হয়েছে। তাঁরা বরং বেশি আগ্রহী ছিলেন আয়োজনের ব্যাপ্তি, বৈচিত্র্য আর বৈভব নিয়ে।

প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে প্রথম আসর আয়োজনের কথা। সেবার যে ক্যাটালগ বের হয়েছিল তাতে কয়েকটি বিষয় পষ্ট করেই উল্লেখ করা ছিল; তা থেকে ধারণা মেলে আয়োজকদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য; সেটা উল্লেখ করলে মন্দ হয় না:  “নতুন সংযোজন—‘লাক্স অন্যদিন ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতা ’৯৮’। লক্ষ্য- এদেশের ফ্যাশন সচেতন মানুষের ঈদ উৎসবকে বৈচিত্র্যময় করা এবং দেশীয় ঐতিহ্যের বিকাশ ও পোশাকশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা। পাশাপাশি দৃষ্টি রাখা হয়েছে—এই ফ্যাশন প্রতিযোগিতা নিছক ফ্যাশন-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে একটি প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি করে, যেন আগামীতে ডিজাইনার, সংস্থা, তাঁতি, টেক্সটাইল মিল-এর ক্রমউত্তরণে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।”

অন্যদিন-এর বিশাল, বর্ণাঢ্য আর ব্যতিক্রমী আয়োজনের স্বাক্ষর মেলে সেই সংখ্যার প্রতি পাতায়। যে সময়ে অর্থাৎ আজ থেকে ২৩ বছর আগের সেই আয়োজনে যারা অংশ নিয়েছেন কিংবা পাঠক হিসেবে পাতা উল্টেছেন তারা নিশ্চয়ই স্মরণ করতে পারবেন। সেই স্মৃতি রোমন্থনে স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠবেন আপনারা অনেকেই। প্রথম বছরের প্রতিযোগিতায় শাড়ির ছিল চারটি বিভাগ। একইভাবে মেয়েদের পোশাকের ছিল চারটি বিভাগ। এছাড়া আরও ছিল ছেলেদের পোশাক ও শিশুদের পোশাকের দুটি করে বিভাগ।

পাঁচতারকা হোটেল সোনারগাঁয় আয়োজিত সেই সূচনা আয়োজন, যাকে বলে, ছিল টক অব দ্য টাউন। আর ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য, কোনো সন্দেহ নেই, সেটা মহানন্দের। প্রথম আয়োজনের পুরস্কার বিতরণের সাড়ম্বর আসর অনুষ্ঠিত হয় সাতানব্বই সালের ডিসেম্বর মাসে। সেবার সর্বাধিক দশটি বিভাগে পুরস্কার জিতে শ্রেষ্ঠ ফ্যাশন হাউজের সম্মান পায় কে ক্র্যাফট।

প্রথম বছর পৃষ্ঠপোষক পাওয়া গেলেও পরের টানা তিন বছর পৃষ্ঠপোষকের সরাসরি আনুকূল্য ছাড়াই আসর আয়োজন হয়েছে। কিন্তু তাতে হতোদ্যম হন নি আয়োজকরা। এরপর অবশ্য ২০০২ সালে এসে বেক্সিফেব্রিক্স্ অনন্য এই আয়োজনে সম্পৃক্ত হয়; ২০১০ সালে সময়ের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এই প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দেওয়া পর্যন্ত বেক্সিফেব্রিক্স্ ছিল অন্যদিন-এর সঙ্গে। তথ্য আরও আছে। কারণ প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে গেলেও অন্যদিন-এর সঙ্গে বেক্সিফেব্রিক্স্-এর গাঁটছড়া অটুট ছিল আরও ছয় বছর। কারণ তখন প্রতি ঈদে ফ্যাশন ক্যাটালগ বের হয়েছে। এই উদ্যোগেও পৃষ্ঠপোষক হিসাবে সম্পৃক্ত ছিল বেক্সিফেব্রিক্স্। সবমিলিয়ে এই সম্পর্ক টিকে ছিল টানা দেড় দশক।

বিচিত্রার ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতার একটা ধরন ছিল। সেখানে একটা কাঠামো অনুসরণ করা হয়েছে। এমনকি শুরুতে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতাও ছিল। মডেল সংগ্রহ, ফটোশুট, ছাপা ইত্যাদি। কিন্তু অন্যদিন-এর ক্ষেত্রে সেটা হয় নি। বরং সমসময়ের প্রযুক্তির উৎকর্ষকে অন্যদিন যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছে। সৃষ্টির স্বাধীনতাকে উপভোগ করে, নিজেদের মতো করেই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। ফলে তাদের আয়োজন টইটম্বুর ছিল জাঁক আর জমকে। গ্ল্যামার তো ছিলই। বলাই বাহুল্য ব্যাপ্তি ছিল বিশাল। ফ্যাশন উদ্যোক্তাদের আগ্রহ আর অংশগ্রহণের উৎসাহ ছিল উল্লেখযোগ্য।

বলা যেতে পারে বিচিত্রার লেগাসি অন্যদিন বহন করেছে তাদের মতো করে। এই আসর পরিণত হয় বছরের আলোচিত ঘটনায়। অন্যদিন ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতা শুরুর পর থেকে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্টদের তো বটেই, দেশের ফ্যাশন অনুরাগীদেরও অপেক্ষা থাকত ভর বছর। প্রসঙ্গত উল্লেখ প্রয়োজন, বিচিত্রা বন্ধের পর প্রয়াত শাহাদত চৌধুরীর নেতৃত্বে অন্য উদ্যোক্তাদের সহায়তায় নতুন সহস্রাব্দের সূচনায় সাপ্তাহিক ২০০০ এবং আনন্দধারার প্রকাশনা শুরু হয়। সাপ্তাহিক ২০০০-এর আয়োজনেও ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়েছে। কিন্তু সবিনয়ে বলি, সেটা অন্যদিন-এর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে নি।

কেবল ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতাই নয় বরং অন্যদিন-এর পাতায় প্রতিপক্ষেই থেকেছে ফ্যাশন এবং লাইফস্টাইলেরর নানা কিছু; যা পাঠকদের কৌতূহল নিরসন করেছে, নিজেকে পরিপাটি রাখতে সহায়ক হয়েছে।

অন্যদিকে ঈদ ফ্যাশনের পাশাপাশি প্রতি বৈশাখে প্রতিযোগিতার আয়োজন না করলেও ফ্যাশন ক্যাটলগ প্রকাশ করেছে অন্যদিন; এই ক্যাটালগও হয়েছে একেকটা একেক রকম। ডিজাইনে, বিন্যাসে, মুদ্রণে। আর ছবি আর তথ্যের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০০৬ সালে প্রথম সংখ্যা বের হওয়ার পর প্রতি বছর এই ক্যাটালগের জন্য ফ্যাশনপ্রিয়রা অপেক্ষায় থেকেছে। কারণ এটা তো কেবল একখানা ছবির বই নয় বরং তথ্যে ঠাসা শপিং-সহায়িকা ছিল।

এমন ক্যাটালগ বস্তুত উদ্যোক্তা এবং ক্রেতা উভয়ের জন্যই ছিল বিশেষ কাজের। প্রতি বছর বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজ নতুন নতুন সংগ্রহ তৈরি করেছে। এই সব সংগ্রহের সেরাটা তোলা থাকত অন্যদিন-এর জন্য। ফলে বিভিন্ন হাউজের সেরা সংগ্রহের হদিশ সহজেই পেয়ে যেতেন পাঠকরা।

প্রতি বছর নতুন মাইফলক ছোঁয়ার, নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপনের বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়েছে অন্যদিন। ফলে বিভাগের সংখ্যা বেড়েছে। হাউজের অংশগ্রহণ বেড়েছে সমান্তরালে। অবশ্য এই সংখ্যার তারতম্য যে ঘটে নি তাও নয়।

অন্যদিন ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতাকে ঋদ্ধ করতে ২০০৫ সালে সংযোজিত হয় নতুন বিষয়: আজীবন সম্মাননা। সন্দেহাতীতভাবেই এই উদ্যোগ সবিশেষ প্রশংসার। কারণ দেশের বস্ত্রবয়ন থেকে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন ক্ষেত্রে জীবনব্যাপী অবদান রাখা ব্যক্তিত্বদের সিংহভাগই সবসময়ে থেকেছেন নেপথ্যে, থেকেছেন স্বীকৃতিহীন। তাঁদের খুঁজে বের করে সম্মানিত করার প্রয়াস পেয়েছে অন্যদিন। এই প্রচেষ্টা কেবল তাদের গর্বিতই করে নি বরং অগ্রজদের সম্মান প্রদর্শনের মধ্যে দিয়ে নিজেরাও সম্মানিত হয়েছেন।

একটা বিষয় উল্লেখের দাবি রাখে, ২০০০ পরবর্তী এক দশকে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের মেট্রোপলিসগুলোতে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে নতুন নতুন ফ্যাশন হ্উাজের। এই সংখ্যাটা অবশ্যই বেশি ছিল ঢাকায়। এরপর চট্টগ্রামে। এসব হ্উাজ স্বকীয়তা নিয়েই বাংলাদেশের ফ্যাশন ভুবনে তাদের অবস্থান করে নেয়। পাশাপাশি পুরোনো হাউজগুলোও তাদের সৃজনধারা অব্যাহত রাখে। উভয়ে মিলে ফ্যাশনপ্রিয়দের চাহিদা যেমন পূরণ করেছে তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির এই জোয়ারের কারণে বিভিন্ন উপখাত তৈরি হয়েছে। প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই শিল্প খাতের প্রসারে নারীর স্বয়ম্ভরতা অর্জনের পথ সুগম হয়েছে। তারা স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন।

অন্যদিন-এর এই আড়াই দশক সময়কে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য স্বর্ণসময় বললে অত্যুক্তি হবে না। কারণ এই সময়ে নতুন হাউজ যেমন হয়েছে, তেমনি এসেছে নতুন এবং তরুণ উদ্যোক্তা। উদ্ভাবনের দিক থেকেও এই সময়টা ছিল সমৃদ্ধ। জমিন অলঙ্করণের নানা ধরনের মাধ্যম নিয়ে নিরীক্ষা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের কাপড় নিয়েও ছিল পোশাক তৈরির প্রয়াস। বিভিন্ন ফ্যাশন ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করা ডিজাইনাররা এই সময়েই ইন্ডাস্ট্রিতে আসা শুরু করে।

এজন্য এই আড়াই দশক বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণও। যেখানে দৈনিক পত্রিকাগুলোর চেয়ে অন্যদিন-এর ভূমিকা কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বরং ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতার নিরীখে বোধ করি এগিয়ে ছিল অন্যদিন। কারণ ওই মাপের এবং মানের কোনো আসর আয়োজনের কথা দৈনিকগুলো ভাবে নি বা সাহস করে নি। ফলে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে নেতৃত্ব দেওয়ার অবস্থানে ছিল।

উল্লেখ্য, বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি অন্যদিন-এর আরও একটি ঈর্ষণীয় প্রয়াস ঈদসংখ্যা। চিরচরিত বিষয় যেমন গল্প, কবিতা, নিবন্ধ ইত্যাদির পাশাপাশি এই ঈদসংখ্যায় সমান গুরুত্ব আর যত্নে স্থান পেয়েছে ফ্যাশনবিষয়ক ফিচার এবং সাক্ষাৎকার। পাঠক পেয়েছে নতুন নতুন বিষয়।

এতক্ষণ ধরে ফ্যাশনের কথা বলা হলেও এই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে গলাগলি করে চলা আরেকটি খাত ‘বিউটি ইন্ডাস্ট্রি’ কখনোই উপেক্ষিত ছিল না। বরং অভিন্ন গুরুত্বে এই ইন্ডাস্ট্রি যেমন বিবেচিত হয়েছে তেমনি এর সঙ্গে সম্পৃক্তরাও পেয়েছেন যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা। একইভাবে মডেল, কোরিওগ্রাফারসহ এই ভুবনের সবাই এই বার্ষিক মহাযজ্ঞের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছেন।

উল্লেখ প্রয়োজন, ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে দীর্ঘ বন্ধন অন্যদিন কর্তৃপক্ষকে প্রাণিত করে একটি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠার। ফলে ফ্যাশন ব্র্যান্ড হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে অন্যমেলা। আরও একটি বিষয় ফ্যাশনের সঙ্গে সম্পর্কিত না হলেও জানানোর লোভ সংবরণ করতে পারছি না। অন্যদিন প্রকাশনা নিয়ে নানা ধরনের নিরীক্ষা করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে তারা যেমন সাময়িকপত্র বের করেছে তেমনি প্রকাশ করেছে খেলা বিষয়ক পাক্ষিক অন্যদিন-এর খেলা। শেষের প্রকাশনার সঙ্গেও ছিল আমার সক্রিয় যোগ। ফলে বলতে পারি, এই মানের ক্রীড়াপত্রিকা বাংলাদেশে প্রকাশিত হয় নি। প্রথম সংখ্যাই কেবল নয়, একের পর এক সংখ্যার জন্য পাঠকদের যে উন্মাদনা দেখেছি তা অবিস্মরণীয়। একটি সংখ্যার কাড়াকাড়িতে হকারের পাঞ্জাবি ছিঁড়েছে। সে দৃশ্য এখনো সজীব। 

যাহোক, ফ্যাশনকে নিয়ে অন্যদিন-এর দেড় দশকের এই জার্নিটা ছিল অনবদ্য। এরপর অপসৃয়মান সময়ধারায় অতীত হয়েছে আরও এক দশক। ফলে ২৫ বছরকে তাই মনে হচ্ছে যেন ২৫টা পলক। বিভিন্ন ভূমিকায় সংশ্লিষ্টতার কারণে অন্যদিন-এর ফ্যাশনসংক্রান্ত কর্মকাণ্ডকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। অসংখ্য স্মৃতি তাই ভিড় করে আসছে। এই ফিরে দেখা যেমন আনন্দের তেমনি বিষাদেরও বটে। কারণ সেই ট্রাডিশনের সমানে চলার ধারা অব্যাহত থাকে নি। এক সময় রুদ্ধ হয়েছে গতিপথ। আর সেটা যে হতে পারে সেই আঁচও পাওয়া গেছে। সেসব নিয়ে অন্যদিন-এর কুশীলবদের সঙ্গেও নানা সময়ে মত বিনিময় হয়েছে। তারাও যে সেটা ভাবেন নি তা নয়; কিন্তু কেন যেন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় নি। তবে হ্যাঁ পারলে তাদের পক্ষেই যে সম্ভব ছিল সেটা বিলক্ষণ সত্যি। অন্তত এটা আমার দীর্ঘদিন এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আর অন্যদিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সুদীর্ঘ সম্পর্কের প্রতীতি থেকে বলতে পারি।

তবে গেছে যেদিন সেটা কিন্তু সব সময়ে একেবারেই চলে যায় না। বরং সেদিনকে ফিরিয়ে আনাও অসম্ভব নয়। অন্যদিন-এর থিংকট্যাঙ্কের কাছে তাই অনুরোধ থাকবে সেইদিনকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণের। এ নিয়ে নানা কথা হতে পারে, আলোচনা হতে পারে, চলতে পারে বিশ্লেষণ কিংবা তর্কও। তবে অসম্ভব নয় কিছুই। উপরন্তু খতিয়ে দেখা যেতে পারে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ। সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে এরই সঙ্গে বিশ্বের বদলতি তসবির। কারণ অনেক হয়েছে পরিবর্তন। পৃথিবীর পটবদল অভাবনীয়। বিশেষত প্রযুক্তির শনৈ উন্নতি পাল্টে দিয়েছে সব ধ্যানধারণা। এমনকি এই করোনা অতিমারীও অনুঘটক হয়েছে এই বদলের। এরই মধ্যে আগামীর ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির দিকবদলও সূচিত হচ্ছে, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে অতিমারীকালের অভিজ্ঞতা, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, ফ্যাশন দূষণের মতো নানা বিষয়। বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতেও কিন্তু পটবদলের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। নতুন ধারার উদ্ভব হচ্ছে; ভুবনায়ন আর মুক্তবাজারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যত-নির্দেশনা হিসাবেই বিবেচিত হবে। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে প্রজন্মান্তর হয়েছে। বদলেছে পঠনরুচি, চাহিদারস্বরূপ; এই প্রজন্ম প্রকৃতার্থেই ভুবনগ্রামের বাসিন্দা। বাংলাদেশে এরাই এখন সংখ্যাগুরু। অবশ্য এসব আদপে সীমাবদ্ধতা নয়, বরং অনিঃশেষ সম্ভাবনা। একে কাজে লাগানোর সময়ও কিন্তু এখন। তবে সমসময়ের দাবি, প্রজন্মের চাহিদাই এখানে মুখ্য।

আরও একটা বিষয়, নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দশকটি আমরা পেরিয়ে এসেছি। এ বছর পা রেখেছি দ্বিতীয় দশকে। একটি দশকের সমাপ্তি, আরেকটির দশকের শুরু হয়েছে অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে যুজতে যুজতে। তবে সময় যত যাবে উভয় দশকের মধ্যেকার পার্থক্য ক্রমেই দৃষ্টিগোচর হবে। প্রকাশনার সিকি শতক পেরিয়ে অন্যদিনও নিশ্চয়ই নতুন করে ভাবছে। সেই ভাবনার প্রতিফলন প্রতীয়মান হবে অন্যদিন-এর পাতায় পাতায়। আর অবশ্যই তাদের ওয়েবসাইটে। সেখানেই উপ্ত হবে নতুন নতুন স্বপ্নের বীজ। মুদ্রিত পত্র-পত্রিকা বিমুখতার প্রতিকূল সময়ে অন্যদিনকেও উজানে নাও বাইতে হবে তা বলাই যায়। আবার মুদ্রিত পত্রিকার সমান্তরালের অন্তর্জাল সংস্করণও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা নিযুত বাঙালির কাছে পৌঁছে যাওয়ার অনন্য সুযোগ করে দিচ্ছে। যেটা মুদ্রিত পত্রিকার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অতএব এটাও বা কম কী! এজন্য প্রযুক্তি একটা বাহবা পেতেই পারে।

পরিশেষে বলি, বাংলাদেশে সাময়িকপত্র রয়েছে ভাটার টানে। এর কারণ কেবল প্রযুক্তির অনুঘটন নয়; আছে অযুত কারণ। সেসব আলোচনার জায়গা এটা নয়; তবে সব বিপত্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অন্যদিনই পারবে এগিয়ে যেতে। আর সেটা তাদের যেতেই হবে। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে একটা সময়, দীর্ঘ সময় যে ভূমিকা তারা পালন করেছে, সেই ভূমিকায় নতুন করে অবতীর্ণ হওয়াটাও কিন্তু সমসময়ের চাহিদা। অন্যদিন সংশ্লিষ্টরা নিশ্চয়ই বিষয়টি অনুধাবন করবেন। পরিকল্পনা করবেন। আর বাস্তবায়নে বরাবরের মতো উদ্যোগী হবেন।

সিকি শতকের মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলেছে অন্যদিন। এই ঘটনাময় পথচলায় অভিনন্দন। নতুন সময়ফলক স্পর্শের প্রত্যয়ে যে অভিযাত্রার শুরু, তার জন্য শুভকামনা।

Leave a Reply

Your identity will not be published.