সাহিত্যিকদের শিকড় সন্ধানে অন্যদিন: রওশন মোমেন

সাহিত্যিকদের শিকড় সন্ধানে অন্যদিন: রওশন মোমেন

আমরা কবি-সাহিত্যিক কিংবা প্রাবন্ধিকের লেখা পড়ি। সেইসব লেখা আমাদের মুগ্ধও করে। কিন্তু এই লেখকেরা কোথায় জন্মেছেন, তাঁদের পৈতৃক ভিটা কোথায়, কী পরিবেশে তাঁরা বড় হয়েছেন, শৈশব-কৈশোরের অম্ল-মধুর সময় কাটিয়েছেন- সেটি কি আমরা জানি? এ প্রশ্নের নেতিবাচক উত্তরই পাওয়া যাবে। অথচ তাঁদের গভীরভাবে অনুধাবনের জন্য তাঁদের পারিবারিক পরিমণ্ডল সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরি। তাঁদের লেখালেখিতে ছোটবেলার পৃথিবীর ছায়া নিশ্চয়ই পড়েছে। তাঁদের স্বজনেরাই হয়তো কোনো গল্প-উপন্যাসের চরিত্র হয়ে উঠেছেন। তাঁদের চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিকোণেও হয়তো পারিবারিক পরিম-লের প্রভাব পড়েছে। তাই এই মাটিতে, এই বাংলাদেশে, যেসব লেখক জন্মেছেনÑতাদের উৎসমূল সন্ধানে অন্যদিন প্রয়াসী হয়। ফলে ‘শেকড়ের সন্ধানে’ শীর্ষক একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে। এই পর্যন্ত অর্ধশতাধিক লেখকের ওপর এখানে  আলো ফেলা হয়েছে। তাঁদের জীবন ও পারিবারিক পরিম-লের নানা তথ্য উঠে এসেছে। এই লেখায় উল্লেখযোগ্য কয়েকজন লেখকের জন্মভূমির কথা তুলে ধরা হলো।

অন্যদিন-এর ‘শেকড়ের সন্ধানে’ বিভাগটির সূচনা ঘটে ২০০২ সালের মে মাসের প্রথমার্ধে। আর প্রথম প্রতিবেদনে মূর্ত হয়ে উঠেন মধুকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। প্রতিবেদক ছিলাম আমি। আমার সঙ্গী ছিলেন ‘অন্যদিন’-এর সাবেক আলোকচিত্রী বিশ্বজিৎ সরকার।

মনে পড়ে, কাজের সুবিধার্থে এলাকা অনুযায়ী লেখকদের শিকড় সন্ধান করা হবে, এমন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। সেই অনুযায়ী আমরা প্রথম পা রাখি যশোরের সাগরদাঁড়িতে, মধুকবির জন্মভূমিতে।

শুরুতে আমরা যাই বিদায় ঘাটে। শান বাঁধানো এ ঘাট থেকে বজরাতে চেপে তৎকালে কলকাতায় যেতেন দত্ত বাড়ির মানুষেরা। মধুকবিও ১৮৩৩ সালে এভাবে কলকাতার খিদিরপুরে গিয়েছিলেন, ভর্তি হয়েছিলেন লালবাজার গ্রামের স্কুলে। উল্লেখ্য, শেষবারের মতো কবি সাগরদাঁড়িতে এসেছিলেন ১৮৬২ সালে। তাঁর সঙ্গে ছিল দ্বিতীয় স্ত্রী এমিলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়া হোয়াইট এবং পুত্র-কন্যারা।

‘বিদায় ঘাট’-এর পাশে মধুকানন পার্ক। এর বিপরীতে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো। এখানে আছে একটি পাঠাগার- মাইকেল মধুসূদন পাঠাগার।

জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর অদূরে মধুকবির পৈতৃক আবাস- দত্তবাড়ি। এখন এই বাড়িটির নাম ‘মধুপল্লী’। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এটি পরিচালিত। ...বাড়িটি বিরাট এলাকাজুড়ে। কয়েকটি অংশে বিভক্ত। অধিকাংশই একতলা। শুধু পূজামণ্ডপ সংলগ্ন ডানপাশের দালান এবং তৎসংলগ্ন বিল্ডিংটি দোতলার। এখানে রয়েছে প্রশাসনিক ভবন, বাগান, পূজামণ্ডপ, জাদুঘর (এখানে রক্ষিত রয়েছে দত্ত পরিবারের ব্যবহৃত নানা আসবাব ও জিনিসপত্র), গ্রন্থাগার। এখানে মধুসূদনের একটি আবক্ষ মূর্তিও রয়েছে। আরও রয়েছে বাঁধানো একটি জায়গা, যেখানে জন্মেছিলেন মধুকবি। সেখানে শোভা পাচ্ছে একটি তুলসীগাছ।

মনে পড়ে, সেই সময়ে, ২০০২ সালে মধুপল্লীর একজন কর্মচারীর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল। নাম গোবিন্দ দত্ত। তিনি দত্তবাড়ির সন্তান। মধুকবির পিতামহ রামনিধি দত্তের দ্বিতীয় ছেলে মদনমোহন দত্তের বংশধর।

২.

যশোর থেকে আমরা যাই ঝিনাইদহে। সেখানকার মনোহরপুরে কবি গোলাম মোস্তফার পৈতৃক বাড়ি দর্শন করি। পরে রওনা দিই ফরিদপুরের উদ্দেশে। শেষ বেলায় পৌঁছি পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিঘেরা অম্বিকাপুর গ্রামে।

অম্বিকাপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। ছায়াঘেরা ঘুঘু ডাকা এক গ্রাম। সেই গ্রামেই পল্লীকবির পৈতৃক বাড়ি। বাড়ির সামনে কবির পারিবারিক বাগান ও কবরস্থান।

বাড়ির ভেতরে বড় একটি উঠান। চারদিকে চারটি ঘর। তিনটি টিনের ঘর। একটি একতলা দালান। উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিমে থাকতেন যথাক্রমে কবির ছোটভাই, বড়ভাই এবং সেজোভাই। আর পূর্ব দিকের ঘরে থাকতেন পল্লীকবি। উল্লেখ্য, জসীমউদ্দীন ছিলেন ভাইদের মধ্যে মেজো।

পল্লীকবির পৈতৃক বাড়িটি চৌদ্দবিঘা জমির ওপর। এটির পত্তন করেছিলেন কবির দাদা ছমির উদ্দীন মোল্লা।

পারিবারিক কবরস্থানের মাঝে একটি ডালিম গাছের নিচে পল্লীকবির কবর। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ এখানে তিনি শায়িত হোন। এই পারিবারিক কবরস্থানের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে পল্লীকবির কবিতার চারটি পঙ্ক্তি : ‘এই নদীতটে বরষ বরষ ফুলের মহোৎসবে/আসিবে যাহারা তাহাদের মাঝে মোর নাম নাহি রবে-/সেদিন কাহারো পড়িবে না মনে, অভাগা গাঁয়ের কবি/জীবনের কোন কনকবেলায় দেখেছিল কার ছবি।’

এখানে রয়েছে একটি স্থায়ী মুক্তমঞ্চ, যেখানে অভিনীত হয় পল্লীকবি রচিত কাব্যনাট্যসহ আরও নানাকিছু। প্রতিবছর জানুয়ারিতে, পল্লীকবির জন্মমাসে, এখানে অনুষ্ঠিত হয় ‘জসীম পল্লীমেলা’। তখন আশেপাশের জেলা থেকে কবির গুণগ্রাহীরা আসে। তাদের বিশ্রামের জন্য কিছু ছাউনিও রয়েছে। একটি ছাউনির নাম ‘রূপাই ছায়াঘর’।

পল্লীকবির বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পদ্মা নদী। এখনকার ক্ষীণ স্রোতের নদীতে আর বেদের বহর দেখা যায় না। কিন্তু কবির শৈশব-কৈশোর-যৌবনে এই নদীতে দেখা যেত বেদেদের। ফলে বেদে সম্প্রদায়ের জীবন অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছেন কবি। রচনা করেছেন ‘বেদের মেয়ে’।

৩.

দ্বিতীয় পর্যায়ে আমি এবং বিশ্বজিৎ রওনা হই কুষ্টিয়ার উদ্দেশে। সেখানে কয়েকজন লেখকের জন্মস্থান।

শুরুতেই আমরা যাই কুষ্টিয়া শহরের লাহিনীপাড়ায়। সেখানে ‘বিষাদ সিন্ধু’ খ্যাত মীর মশাররফ হোসেনের পৈতৃক ভিটা। লাহিনীপাড়ার কাছাকাছি আসতেই চোখে পড়ে পথের ধারের একটি ফলক— মীর মশাররফ হোসেন সড়ক। সেই পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে আমরা এক সময়ে পৌঁছি যাই মী ম. হোসেনের প্রথম স্ত্রী আজীজান্নেসার কবরে। কবরটি বাঁধানো, ছোট্ট এক বাঁশবনের ভেতর। আজীজান্নেসার সঙ্গে মশাররফের বিয়েটা ছিল একটি পরিকল্পিত দুর্ঘটনা। আসলে মশাররফ ভালোবেসেছিলেন আজীজানের বোনকে। সেই বোন এই বিয়ের পরে বেশি দিন বাঁচেন নি। আর আজীজানের সঙ্গে মশাররফের দাম্পত্যজীবন হয়ে উঠেছিল বিষময়। কিন্তু একটি বিষয় বেশ রহস্যময়। যে স্ত্রীকে মশাররফ পছন্দ করতেন না, কেন তাঁর নামেই তিনি ‘আজিজন নেহার’ পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন? আজীজান্নেসার কবর দেখার পরে আমরা পৌঁছি মীর মশাররফ হোসেনের জন্মস্থানে। দেখতে পাই, সেখানে এখন দুটি বিদ্যালয় অবস্থিত। একটি হলো, মীর মশাররফ হোসেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেকালে এখানেই একটি পাঠশালা ছিল— জগমোহন নন্দীর পাঠশালা। এই পাঠশালায়ই মশাররফের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দেখার পরে আমরা পৌঁছি মীর মশাররফ হোসেন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের কাছে। লক্ষ করি, স্কুল চত্বরে একটি ল্যাংড়া জাতির আমগাছ। জানতে পারি, এই গাছটি মশাররফ নিজের হাতে লাগিয়েছিলেন। ডান দিকের খোলা জায়গায় রয়েছে মশাররফের স্মৃতিধন্য আরেকটি জিনিস। একটি কুয়া। এর পানি পান করেছেন মশাররফ স্বয়ং। লাহিনীপাড়ার রাজপথ সংলগ্ন একটি বাড়িতে বসবাস করে মীর মশাররফ হোসেনের উত্তরাধিকারীরা। সেখানে যাই আমি। পরিচিত হই মশাররফ-এর নাতি মীর আবদুল হামিদের নাতি-নাতনিদের সঙ্গে। তাদের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে মীর মশাররফ হোসেনের ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র—বদনা, থালা, চেয়ার, টুল...। মীর মশাররফ হোসেন চির নিদ্রায় কোথায় শুয়ে আছেন? না, এখানে নয়। কুষ্টিয়ায় নয়। তিনি শুয়ে আছেন রাজবাড়ি জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলাধীন পদমদী গ্রামের ঘাসের নিচে।

৪.

মীর মশাররফ হোসেনের পরে আমরা যাই রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রামে। এখানে জন্মেছিলেন ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন। ‘অবাঞ্ছিত’ খ্যাত আকবর হোসেনের ‘কি পাইনি’, ‘মোহমুক্তি’, ‘ঢেউ জাগে’, ‘মেঘ বৃষ্টি বাদল’-ও সাড়া জাগিয়েছিল পাঠকদের মাঝে। আমরা কয়া গ্রামে আকবর হোসেনের পৈতৃক বাড়িতে একটি ঘর খুঁজে পাই, যেখানে তিনি থাকতেন। তাছাড়া তাঁর স্মৃতিধন্য অন্য কিছুই পাই না। জানা যায়, সেইসব জিনিস রয়েছে ঢাকার কবি জসীমউদ্দীন রোডে অবস্থিত বাড়িতে।

উল্লেখ্য, আকবর হোসেন ছেলেবেলায় আকস্মিকভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। তখন রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ থেকে কলকাতা যাবার পথে তরী ভিড়িয়েছিলেন এই কয়া গ্রামে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার বাসনায় উঠেছিলেন নদীঘাট সংলগ্ন আকবর হোসেনদের বাড়িতে। অতঃপর ঘটনাক্রমে গুরুজনদের অনুরোধে কবিগুরুর সামনে একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন শিশু আকবর হোসেন। এই আবৃত্তি, বলাই বাহুল্য, খুবই মনোগ্রাহী হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ স্নেহের পরশ বুলিয়েছিলেন শিশু আকবর হোসেনের গায়ে এবং আশীর্বাদ করেছিলেন এই বলে, ‘তুমি একদিন বড় কবি হবে’। রবীন্দ্রনাথের এই আশীর্বাদ একেবারে বিফলে যায় নি। কবি হতে না পারলেও আকবর হোসেন বড় মাপের ঔপন্যাসিক হয়েছিলেন।

৫.

এবার আমরা ছুটি কাঙাল হরিনাথের পৈতৃক বাড়ির উদ্দেশে। কুষ্টিয়ার কুমারখালী সদরে। সেখানেই প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী, বাউল গানের রচয়িতা, আধ্যাত্মিক সাধক কাঙাল হরিনাথ। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকার সম্পাদক এবং প্রকাশক। লালনের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর সম্পর্ক। গদ্য-পদ্য মিলিয়ে প্রায় ৪০টি গ্রন্থের জনক হরিনাথ। ‘বিজয় বসন্ত’ নামের উপাখ্যানটি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি। বাংলা উপন্যাসের উন্মেষ-পর্বে এটি উপন্যাসের স্বাদ মিটিয়েছিল।

কুমারখালী সদরে বিধ্বস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে ‘কাঙাল কুটির’। কাঙাল হরিনাথের পৈতৃক বাড়ি। সেখানে পরিচয় হলো হরিনাথের পৌত্র নির্মল চন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে, যার কাছে সংরক্ষিত আছে হরিনাথের নিজের হাতে লেখা কয়েক শ গান। ...কাঙাল কুটিরে লক্ষ করি, একটি ঘরে রয়েছে পুরোনো ছাপার মেশিন, যার মাধ্যমে সেকালে মুদ্রিত হতো ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’।...কাঙাল কুটিরের অদূরে দেখি, হরিনাথ প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়। বিধ্বস্ত এই বিদ্যালয়টি এখন একটি মহল দখল করতে চাইছে।...কুমারখালীতে রয়েছে ‘কাঙাল হরিনাথ স্মৃতি পরিষদ’। এই পরিষদ প্রতি বছর হরিনাথের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উদ্যাপন করে। এখানে একটি সড়কও রয়েছে কাঙাল হরিনাথের নামে।

৬.

তৃতীয় পর্যায়ে বিশ্বজিৎ এবং আমি পৌঁছি ময়মনসিংহের ধানীখোলা গ্রামে। এখানে জন্মেছিলেন আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল কালাম শামসুদ্দিন। ধানীখোলা বাজারের অদূরে আবুল মনসুর আহমেদের বাড়ি, যে বাড়িটি ফরাযী বাড়ি হিসেবে পরিচিত। উল্লেখ্য, আবুল মনসুর আহমদের প্রকৃত নাম আহমদ আলী ফরাযী।  ফরাযী বাড়িতে গিয়ে আমরা মনসুর ভিলা পরিদর্শন করি, যেখানে আবুল মনসুর আহমদের নানা স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে আছে। লক্ষ করি পরিত্যক্ত একটি ঘর, যেটি ছিল সেকালে বাড়ির বৈঠকখানা। এখানে বসত আবুল মনসুর আহমদের চাচা মুনশী ছমিরুদ্দীন ফরাযীর মক্তব বা ফ্রি মাদ্রাসা। এখানে আবুল মনসুর আহমদ আরবি ও ফারসি শিখেন। দেখি ফরাযী পরিবারের পারিবারিক মসজিদ, যা ৩০০ বছরের পুরোনো। লক্ষ করি বড় একটি পুকুর। এইসবই আবুল মনসুর আহমেদের স্মৃতি বহন করছে।

৭.

ধানীখোলার আরেক কীর্তিমান পুরুষ আবুল কালাম শামসুদ্দিন। তাঁর পৈতৃক বাড়িটি মোড়লবাড়ি নামে পরিচিত, যেখানে নানা শরিকের বাস। আমরা সেই বাড়িতে এই খ্যাতিমান সাংবাদিক-সাহিত্যিকের ব্যবহৃত আসবাবপত্র দেখি, তাঁর শয়নকক্ষে বসি। তাঁর স্মৃতিধন্য লিচুগাছও লক্ষ করি। তবে তাঁর ব্যবহৃত ইদারাটি এখন নেই, সেটি মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়েছে।

৮.

চতুর্থ পর্যায়ে আমাদের পা পড়ে সিরাজগঞ্জ ও শাহজাদপুরে। শুরুতে যাই সিরাজগঞ্জ শহরে। এখানেই রয়েছে সাহিত্যিক ইসমাইল হোসেন শিরাজীর বাড়ি বাণীকুঞ্জ। একতলা একটি বাড়ি। পুরোনো আমলের। বামদিকে একটি পাঠাগার, যা ইসমাইল হোসেনের শিরাজীর নাম বহন করছে। ডানদিকে একটি ছোট দালান, ভেতরে শিরাজী ও তাঁর স্ত্রীর কবর। বাইরে আরও দুটি কবর। শিরাজীর দুই ছেলেমেয়ের। পাঠাগারে নানা বইয়ের মাঝে শিরাজীর বইও রয়েছে। দেয়ালে ঠাঙানো সৈনিক বেশী শিরাজীর প্রতিকৃতি। এটি তাঁর তুরস্ক প্রত্যাগত সময়ের ছবি। তিনি বলকান যুদ্ধে তুরস্কের সাহায্যে মেডিকেল মিশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

৯.

আমরা বাসযোগে সিরাজগঞ্জ শহর থেকে আটচল্লিশ কিলোমিটার দূরে শাহজাদপুরের ঘোড়শালে যাই। দেখি সাহিত্যিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ’র পৈতৃক বাড়িটি। এটি একজন কেয়ার টেকার দেখাশোনা করে। এখানে বরকতুল্লাহ্’র নানা স্মৃতিচিহ্ন রক্ষিত আছে। রয়েছে একটি আমগাছ, যে গাছের ফল তিনি খেয়েছেন।

১০.

ঘোড়শালের পাশের গ্রাম চরবেলতৈল। সাহিত্যিক মোহাম্মদ নজিবর রহমানের জন্মভূমি। পৈতৃক বাড়ি। বাড়িটি উঁচু জায়গায় অবস্থিত। এর কারণ হচ্ছে, এটি সেকালে একটি নদীর পাশে অবস্থিত ছিল। এখন অবশ্য নদীটি অনেক দূরে সরে গেছে। এই বাড়িতে এখন আর নজিবরের উত্তরাধিকারেরা থাকেন না। তাঁর স্থায়ী বসত-ভাটি হচ্ছে হাটি কুমরুল গ্রামে। সেখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।

১১.

পঞ্চমবারে আমরা যাত্রা করি পাবনার উদ্দেশে। সেখানে পাবনা শহরের লাগোয়া গোবিন্দা গ্রামে দেখি আবু হেনা মোস্তফা কামালের পৈতৃক বাড়িটির অংশবিশেষ। কেননা মালিক বদল হয়েছে বলে সেটি তখন ভাঙা হচ্ছিল। অতঃপর আমরা যাই পাবনা শহরের আরেক স্থানে, রাধানগর তথা নারায়ণপুরে। সেখানে কবি বন্দে আলী মিয়ার পৈতৃক বাসস্থান।

কয়েক বিঘা জমি জুড়ে বাড়িটির অবস্থান। এখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করেন কবির ছেলেমেয়েরা। কবি যেখানে বাস করতেন, সেটি এখন পুরোনো একটি দালান। যে ঘরে বন্দে আলী মিয়া থাকতেন, সেখানে পুরোনো একটি খাট, আলনা, দুটি আলমিরা। আলমিরার নিচে দুটি ট্রাঙ্ক। সেখানে বন্দে আলী মিয়ার অপ্রকাশিত রচনাবলী রয়েছে।

পুরোনো দালানের পাশে কবি বন্দে আলী মিয়া কিন্ডারগার্টেন। এটি স্থাপিত হয়েছে ১৯৯৮ সালে। কিন্ডারগার্টেনের পাশেই বন্দে আলী মিয়া চির নিদ্রায় শায়িত। তাঁর কবরটি বাঁধানো, চারদিক ঘেরা। পাশেই লেখা কবির ‘আমাদের গ্রাম’ শীর্ষক বিখ্যাত কবিতাটি: ‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর/ থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর...’।

১২.

এরপর দু বছর কেটে গেছে। এ সময়ে অবশ্য লেখকদের শিকড় সন্ধানের কাজটি থেমে থাকে নি। বগুড়া, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের নানা জায়গায় ছুটে গিয়েছেন অন্যদিন-এর অন্য দুজন প্রতিবেদক—কাজল রশীদ শাহীন এবং দীপংকর গৌতম। আলোকচিত্রী বিশ্বজিৎ সরকার।

২০০৫ সালে আবার আমি পথে নামি। সঙ্গী হন বিপুল হাসান। অন্যদিন-এর আরেক প্রতিবেদক। গন্তব্য হাসান হাফিজুর রহমানের জন্মভূমি। ভালোভাবে খোঁজখবর না নেয়ায় এ যাত্রায় আমাদের যথেষ্ট ভোগান্তি পোহাতে হয়। কেননা আমরা ট্রেন থেকে নামি জামালপুর স্টেশনে। সেখান থেকে বাসে দেওয়ানগঞ্জে পৌঁছি। এক ডাকবাংলোয় রাত্রিযাপন করি। পরদিন সকালে রিকশায় কুলকান্দা গ্রামে পৌঁছি, যেখানে হাসান হাফিজুর রহমানের পৈতৃক ভিটা, মিয়াবাড়ি (আসলে ট্রেনে সরাসরি বাহাদুরাবাদ না যাওয়াতেই এতখানি পথ আমাদের পাড়ি দিতে হয়)। লক্ষ করি, মিয়াবাড়িতে একদিকে নতুন ঘর, অন্যদিকে পুরোনো ছোট ঘর। বাড়ির সামনে পথ। পথের ওপারে পারিবারিক কবরস্থান। কবরস্থানের সঙ্গে ফলের বাগান। তৎসঙ্গে বন, মসজিদ এবং সরকারি বাঁধ। বাঁধের ওপারে যমুনা বয়ে চলেছে।

জানতে পারি, বাঁধের ওপারে ছিল মূল মিয়াবাড়ি। আরও জানতে পারি, হাসান হাফিজুর রহমানের কোনো ব্যবহৃত জিনিসপত্র এখানে নেই। সবই রয়েছে ডিওএইচএস-এ তাঁর মেয়ে এশা হাসানের কাছে। তবে জামালপুর শহরের গুঠাইলে রয়েছে হাসান হাফিজুর রহমান স্মৃতি পরিষদ। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৪ সালে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর হাসান হাফিজুর রহমানের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।

এরপর আমরা পর্যায়ক্রমে যাই মোজাম্মেল হক (ভোলা), আরজ আলী মাতুব্বর (লামচরি গ্রাম, বরিশাল), জীবনানন্দ দাশ (বরিশাল শহর), আহসান হাবীব (শঙ্করপাশা, পিরোজপুর), মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (খালিশপুর, বেগমগঞ্জ, নোয়াখালী), শহীদুল্লাহ্ কায়সার (মজুপুর, ফেনী), জহির রায়হান (মজুপুর, ফেনী), দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার (উলাইল, সাভার), কায়কোবাদ (আগলা, পূর্ব পাড়া, নবাবগঞ্জ), আবু জাফর শামসুদ্দীন (দক্ষিণবাগ, গাজীপুর), হুমায়ুন আজাদ (রাড়িখাল, মুন্সীগঞ্জ), জগদীশ চন্দ্র বসু (রাড়িখাল, মুন্সীগঞ্জ), ফররুখ আহমদ (মাঝআইল, মাগুড়া)-এর জন্মভূমি তথা পৈতৃক বাসস্থানে।

১৩.

২০১৬ সালের অক্টোবরে, কবি শামসুর রাহমানের ৮৭তম জন্মবার্ষিকীকে সামনে রেখে আমরা যাই নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার পাড়াতলী গ্রামে। কবির পৈতৃক ভিটাতে। আলোকচিত্রী হিসেবে সঙ্গে ছিল আহ্নাফ  মোস্তাফিজ ওয়াসিক। পাড়াতলী গ্রামটি ছবির মতো সুন্দর। চারদিকের সবুজ শ্যামলিমা দৃষ্টি কেড়ে নেয়। গ্রামের এই অপরূপ প্রকৃতি ভালো লাগত রাহমানেরও। গ্রামে তিনি খুব একটা আসতেন না। একাত্তরে অবশ্য দীর্ঘদিন ছিলেন। পাড়াতলীতে রাহমানদের বাড়িটি মুন্সীবাড়ি হিসেবে পরিচিত। বাড়ির সঙ্গে একটি মসজিদও রয়েছে। মুন্সীবাড়িতে ঢুকি। একতলা একটি দালান দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখানকার একটি ঘরেই শামসুর রাহমান থাকতেন, যখন তিনি এখানে আসতেন। আর হ্যাঁ, বাড়িটির নাম ‘বায়তুল আমান’। জানতে পারি, একাত্তরের এপ্রিল-মে-তে যখন রাহমান এখানে ছিলেন, তখন তিনি একদিন দুটি কবিতা লিখেন পুকুরের আম গাছতলার নিচে বসে। এখন সেই আম গাছটি নেই, তবে সেই সময়ের বকুল গাছটি রয়েছে। আর হ্যাঁ, একাত্তরে লেখা রাহমানের সেই দুটি কবিতা হলো, ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’। দুটিই বিখ্যাত কবিতা। পুকুরের সঙ্গে শুধু রাহমানের কবিতা নয়, তাঁর ছোট ছেলে মতিনও বিজড়িত। কেননা এই পুকুরে ডুবেই একদিন মতিন মারা যায়। প্রিয় সন্তানকে নিয়ে রাহমান লিখেছেন ‘একটি ফটোগ্রাফ’সহ একাধিক কবিতা।

পাড়াতলীতে আমরা একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আরেকটি উচ্চ বিদ্যালয় ঘুরে দেখি, যে দুটি বহন করছে যথাক্রমে শামসুর রাহমানের পিতা ও পিতামহের নাম। দেখতে পাই, উচ্চ বিদ্যালয়টিতে শামসুর রাহমানের নামে একটি পাঠাগার রয়েছে। কিন্তু সেখানে কোনো গ্রন্থাগারিক নেই, নেই কোনো বই। জানতে পারি, সরকারি উদ্যোগে এটি গড়ে উঠেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো গ্রন্থাগারিক ও পিয়ন সরকারের তরফ থেকে নিয়োগ দেওয়া হয় নি বলে পাঠাগারটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।

প্রয়াত লেখকদের শিকড় সন্ধান করতে গিয়ে আমাদের অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা হয়েছে। কখনো কখনো তিক্ত ঘটনারও মুখোমুখি হয়েছি, যা আমাদের আহত করেছে। অবাকও হয়েছি। অন্য কোনো সময়ে, অন্য কোনো লেখায় তা তুলে ধরার ইচ্ছা পোষণ করছি।

Leave a Reply

Your identity will not be published.