শামসুজ্জামান খানঃ লোক সংস্কৃতির প্রতি নিবেদিত প্রাণ

শামসুজ্জামান খানঃ লোক সংস্কৃতির প্রতি নিবেদিত প্রাণ

করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঝরে গেছেন এ দেশের অনেক কীর্তিমান। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রথিতযশা প্রাবন্ধিক-গবেষক এবং লোক সংস্কৃতির প্রতি নিবেদিতপ্রাণ শামসুজ্জামান খানও। গত ১৪ এপ্রিল অপরাহ্নে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এখন তিনি চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন মায়ের কবরে, মানিকগঞ্জের সিংগাইরের চারিগ্রামে। একটি বৃত্ত যেন সম্পূর্ণ হলো। কেননা ১৯৪০ সালের ২৯ ডিসেম্বর এই চারিগ্রামেই শামসুজ্জামান খান প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। উল্লেখ্য, মানিকগঞ্জের মাহমুদুর রহমান খান-শামসুন্নাহার খান দম্পতির সন্তান তিনি।

শামসুজ্জামান খানের শৈশব-কৈশোর কেটেছে চারিগ্রামে। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন তিনি। পরে হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। অন্যদিন-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নিজের শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে শামসুজ্জামান খান বলেছিলেন: ‘আমি বড় হয়েছি মা এবং নানির কাছে। আমার আর কোনো ভাই-বোন ছিল না। দুরন্তপনার বয়স হওয়া সত্ত্বেও মা-নানির চোখ ফাঁকি দিয়ে বেশি কিছু করতে পারতাম না। ছোটবেলার খেলার সাথিরা ছিল অধিকাংশ মেয়ে এবং আমার চেয়ে বয়সে বড়। ছোটবেলায় খেলাধুলার পাশাপাশি আরেকটা নেশা আমার ছিল, সেটা মাছ ধরা। বড়শি দিয়ে দোয়ার পেতে মাছ ধরতাম।’ 

হ্যাঁ, শামসুজ্জামান খান আদর-স্নেহ পাবার আগেই তাঁর বাবা মারা যান। মা আর নানির কাছেই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর জীবনে যদি ভালো কোনো প্রভাব পড়ে থাকে সেটা মা আর নানির অবদান। এরপরে রয়েছেন তাঁর শিক্ষকেরা। প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষক ছিলেন আনিসুর রহমান। তিনি জীবনানন্দ দাশের ভীষণ অনুরাগী ছিলেন এবং শামসুজ্জামান খানদেরও তাঁর বই পড়তে দিতেন। সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা মূলত তাঁর কাছ থেকেই পান শামসুজ্জামান খান। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, তারাশঙ্কর— এঁদের একটা প্রভাব তাঁর জীবনে ছিল।

ছোটবেলায় শামসুজ্জামান খানের স্বপ্ন ছিল, বড় হয়ে তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন। তাঁর এই স্বপ্ন শতভাগ পূর্ণ হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করার পরে তিনি ১৯৬৪ সালে মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে চার মাস অধ্যাপনা করার পরে অজিত কুমার গুহের আহ্বানে জগন্নাথ কলেজের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন। পরে তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং জাতীয় জাদুঘরের। বাংলা একাডেমির পরিচালক, মহাপরিচালক এবং সবশেষে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। উল্লেখ্য, বাংলা একাডেমিতে শামসুজ্জামান খান মহাপরিচালক হিসেবে দশ বছর ছিলেন (২৪ মে ২০০৯-২৩ মে ২০১৮)। আর ২০২০ সালে বাংলা একাডেমির সভাপতি থাকা অবস্থায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মারা গেলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন শামসুজ্জামান খান এবং সেই পদে থাকা অবস্থায়ই তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন শামসুজ্জামান খান। তিনি বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে আসেন গত শতকের  পঞ্চাশের দশকে, যখন তিনি জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। সেই সময় কাছ থেকে শামসুজ্জামান খান দেখেছেন নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর মমতা, মিছিলে আহত যুবকদের প্রতি সহমর্মিতা এবং দায়িত্ববোধ। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে পুরোনো ঢাকায় দাঙ্গার পরে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাও কাছ থেকে অবলোকন করেছেন শামসুজ্জামান খান এবং ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজও করেছেন, জগন্নাথ কলেজে খোলা আশ্রয়কেন্দ্রে। উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের মে-তে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় লেখক সম্মেলনে শামসুজ্জামান খান যোগ দিতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধুরই সহযোগিতায়।

শামসুজ্জামান খানের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছেÑফোকলোর চর্চা; মাটি থেকে মহিরূহ; মুক্তবুদ্ধি ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমকাল; বাংলাদেশের উৎসব; বাংলা সন ও পঞ্জিকা; বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ ও প্রাসঙ্গিক কথকতা; আধুনিক ফোকলোর চিন্তা; মীর মশাররফ হোসেন: নতুন তথ্যে, নতুন ভাষ্যে; নির্বাচিত প্রবন্ধ; ঢাকাই রঙ্গ-রসিকতা; গ্রামবাংলার রঙ্গ-রসিকতা। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্মারকগ্রন্থ।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় শামসুজ্জামান খান কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তাঁরই উদ্যোগে একাডেমিতে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন হয়েছে, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অভিধান প্রকাশিত হয়েছে, বের হয়েছে ৬৪ খণ্ডে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার লোক সংস্কৃতি বিষয়ক গ্রন্থ, ১১৪ খণ্ডে ফোকলোর সিরিজ, রবীন্দ্রনাথের জীবনী, রবীন্দ্রনাথের আলোকচিত্রের অ্যালবাম, বাংলা একাডেমির আলোকচিত্রের অ্যালবাম।

স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক-গবেষক শামসুজ্জামান খানের প্রতি অন্যদিন-এর শ্রদ্ধাঞ্জলি। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.