মালাকর যেভাবে হারায়: কিযী তাহনিন

মালাকর যেভাবে হারায়: কিযী তাহনিন

লোকে বলে পাকের হাট নাকি বিখ্যাত। কেন? সে কথা কেউ ঠিক সাজিয়েগুছিয়ে বলতে পারে না। কেউ বলে পংকু গায়েনের সুরের জন্য বিখ্যাত। কেউ বলে কোরবানির গরুর হাটের কথা। কিংবা কেউ বলে, ওই দাঁত ফোকলা বুড়ি পান্তার মায়ের মতন কোনোরকমে রয়ে যাওয়া বহুদিনের পুরোনো ব্রিজের মুখে ওই গর্তটার কথা। যে গর্তে প্রতি বছর কেউ আছাড় খেয়ে পরে দাঁত-মুখ-নাক কিংবা পা ভাঙে। যারা গর্তে পড়ে, তারা ভাঙা হাড্ডির ব্যথায় কাতর হয়ে ওই মরা গর্তের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে। তারপর হাড্ডি জোড়া লাগে, ব্যথা সারে। গর্ত ভরাট করতে সবাই ভুলে যায়। আর ওই গর্ত নাকি বিশেষ, এক মণিওয়ালা কেউটে সাপ বাস করে সেই গর্তে, আর পাকের হাটের মানুষগুলোকে সব বিপদ মুসিবত থেকে বাঁচিয়ে রাখে। এমন কত খুচরো কারণে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার পাকের হাট নিয়ে মানুষের মুখে মুখে গল্প জমে।

পাকের হাটের মানুষজন অবশ্য এসব কথা বলে না। এইসব বিখ্যাত হওয়ার নানা কারণ নিয়ে গুলতানি করে আশপাশের চিরিরবন্দর, কাহারোল, বীরগঞ্জ এলাকার মানুষজন। পাকের হাটের মানুষজন ভালো করেই জানে যে পংকু গায়েনের গলায় এখন আর কোনো সুর বসে না। কখনো কখনো ওই মরা গর্তকে মাঝে রেখে চি চি চি চি এক সুরে কী যেন গায় আর গোলগোল করে পা উঁচিয়ে নাচে। ওই গর্তে পড়ে ব্যাটার হাত-পা ছিলে ভেঙে যা ইচ্ছে তাই হয়েছে কয়েকবার। পাগল তবু নাচে, কথা শোনে না।

আর কোরবানির হাট? ধুর ধুর, ওই তাগড়া কালা ত্যালত্যালা গরু আর আছে কোনো ঘরে যে হাট জমবে? কোথায় সেই সবুজ কচি ঘাসের মাঠ, আর কই সেই ঘন থকথকে ভাতের ফ্যান! ওই শুকনা কুঁচকে যাওয়া অপুষ্ট চালে কী আর ফ্যান বর্ষে আদর না দিলে, পেটভর্তি খাওয়া না দিলে গরু তাগড়া হয়? কত মায়ার সংসারই তো ভেঙে যাচ্ছে আজকাল অনাদরে, আর গরু। আর মণিওয়ালা সাপ? হায়! সেই কোন জনমে গর্তে এক নিরীহ নির্বিষ ঢোঁড়া সাপ রোদ পোহাচ্ছিল। মানুষের গুতা খেয়ে কই পালিয়েছে। সেই নিয়ে এখনো কল্পকাহিনি চলছে। পাকের হাটের মানুষ জানে তাদের গল্প ফুরিয়ে আসছে। তাই মানুষ এসব পুরোনো কাসুন্দির বয়াম খোঁজে। আশপাশ এলাকার নাক চুলকানো উৎসাহী মানুষদের থেকে পাকের হাটের মানুষজন খানিক দূরেই থাকে।

নাক লম্বা বলে বেশ খ্যাতি আছে পাকের হাটের লোকজনের। এই অঞ্চলের মানুষগুলোর জন্মের দোষে কিংবা গুণে নাক লম্বা এবং তার ডগায় অহেতুক অহংকার লাউয়ের মতন ঝুলতে থাকে। এই নিয়েও বাইরের এলাকায় বেশ আলোচনা হয়। তাতে এখানকার মানুষের কিছু যায় আসে না। এরা বাইরের কাউকে তোয়াক্কা করে না, নিজেরা একাট্টা। নিজেরদের মতন। আবার বৈচিত্র্যময়ও।

এই যেমন মেহেন্দি মালাকর। সংক্ষেপে মেন্দি হুজুর। মেহেন্দি ওরফে মেন্দি হুজুর আসলে কোনো হুজুর না। একজন তাবিজবিক্রেতা। তার নামের শেষের ‘মালাকর’ লেজটুকু ধরে লোকজন বড্ড টানাটানি করে। হিন্দু নাকি মুসলমান? এই জিজ্ঞাসা যদিও এলাকার বাইরের মানুষের। পাকের হাটের মানুষজন তো জানে, মেহেন্দির বাপ লুৎফর মিয়া ফুলের মালার ব্যবসা করত। আশপাশের বড়লোক মহাজন আর জমিদারদের বাড়ির বিয়েবাড়িতে, পাঠশালা কিংবা এলাকার নির্বাচনের আয়োজনে তার তৈরি মালা কিনে নিয়ে যেত লোকজন। হিন্দুদের শ্রাদ্ধ আর পূজার জন্য আশপাশ গ্রাম ছাড়িয়ে সেই রাজশাহী থেকেও লোক এসে মালা কিনে নিয়ে যেত। মালা তো অনেকেই গাঁথতে পারে। কিন্তু মেন্দি হুজুরের বাপ মালার গাঁথুনিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। বুনো বেগুনি ফুলের সাথে সাদা রজনীগন্ধা আর লাল গোলাপ, দুই সুই দিয়ে ফুলগুলোকে এফোঁড় ওফোঁড় জুড়ে বেণির মতন এক মালা গাঁথত। বিন্যাকুড়ির জমিদারবাবু তার বিয়ের মালাবদলের জন্য দুটি হলুদ সূর্যমুখী ফুলের মালা তৈরি করিয়েছিলেন লুৎফরের হাতে। সে তো কবেকার কথা। সেই মালা গলায় পরে বলেছিলেন, ও ব্যাটা লুৎফর, তুই তো জন্মই নিসিলু মালা গাঁথার জন্য। আইজ তুই হলু দুনিয়ায় সেরা মালাকর।

সেই থেকে লুৎফরের নামের সাথে জুড়ে গেল মালাকর। লুৎফর মালাকর। একমাত্র ছেলের নামের সাথেও জুড়ে দিলেন মালাকর। বললেন, এই আমাদের পদবি। আমাদের বংশ নাতিপুতি চৌদ্দগুষ্ঠি হইলো মালাকর। নামেই মালাকর। মেন্দি ফুলের মালা গাঁথা তো দূরের কথা, পাঁচটা ফুল মুঠি করে একটা তোড়া পর্যন্ত বানাতে পারে না। ছোটকালে বাপের সাথে মালা বানাতে বসে, একটা আস্ত গোলাপ চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছিল। পেট পাতলা হয়ে সাত দিন যে ভুগল। একবার মালা গাঁথার সময় সুয়ের খোঁচায় বুড়ো আঙুলের ঘা করে ফেলল। এরপর লুৎফর আর তার ছেলেকে মালার ধারেকাছে ঘেঁষতে দেয় নি।

ফুল যে সুন্দর আর পবিত্র, লুৎফর তা বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাস বিক্রি করেই বাঁচে লুৎফর। ব্যবসা করতে গেলে বিশ্বাস শক্তপোক্ত হতে হয়। ব্যবসাই তো তার ধর্ম। তাই কুমড়ার ফুলের মতন সুন্দর একটা সৃষ্টিকে চালের গুঁড়া দিয়ে মেখে গনগনে তেলে ভেজে মানুষ যখন বড়া বানিয়ে কপকপ করে খায়, ছ্যাৎছ্যাৎ করে ওঠে লুৎফর মালাকরের মন। ছুঁয়েও দেখে না সে বড়া। কাদামাটির মতন নরম মন হলেও লুৎফর বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ছিল। শেষ বেলায় সে বুঝেছিল, তাজা ফুলের সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের বিশ্বাস আস্তে আস্তে ডুবছে। প্লাস্টিক আর কাগজের ফুলে সয়লাব বাজার। ওই জাতহীন আলগা সুগন্ধি মাখা কাগজের ফুল লুৎফরকে টানে না। নতুন কিছু ভাবতে হবে। লুৎফরের ম্যালা টাকাপয়সা নাই। সে জানে তার পুঁজি মানুষের বিশ্বাস। তাই অনেক চিন্তাভাবনা করে সে শেষ জীবনে নতুন ব্যবসায় নামে, তাবিজের ব্যবসা। কয়েক বছর চারপাশের ভাও বুঝে মানুষের মনে বিশ্বাসের চারাগাছ বুনে তারপর ব্যবসায় নেমেছে। মানুষজনকে জানিয়েছে, তোমরা সবাই বুইজছেন, মুই ইশারা পাসু। হামার এই অঞ্চলের ভালো মন্দ দেখার ইশারা আইসে। মুই আছরের পর যখন তসবি গুনো, তখনই ইশারাটা আইসে। ঠিক করসি সেই পথেই হাঁটমু।

ব্যবসার জোগাড়যন্ত্র শুরু করেছিল মেহেন্দিকে সাথে নিয়ে। ছেলের এ ব্যবসায় আগ্রহ আছে, এবং তার চেয়ে দ্রুত সবকিছু বুঝে নিচ্ছে দেখে মালাকর বড্ড স্বস্তি পেয়েছিল। শুরুতে ছেলেকে সাথে নিয়ে দিনাজপুর শহরে গিয়ে একসাথে মাস দুয়েকের মালসামান কিনে নিয়ে আসত। তারপর থেকে ছেলে নিজেই জোগাড়যন্ত্র করে সব কিনত। মেহেন্দির মাথা থেকেই বুদ্ধি এল, আব্বা শুধু ব্যথা ব্যতনা আর পুরুষ মাইনষের অসুখের তাবিজে লাভ হবে না।

তো!

পোয়াতিদের বাচ্চা হওয়ার টাইমে যে ব্যথা হয়, জমিলার সময় দেখেন নাই? এই অসুখের তাবিজ লাগবে। মরিয়ম ফুলের তাবিজ, এই দেখেন আব্বা এইহানে ফর্মুলা লেখা আছে।

ছেলের ব্যবসায়িক জ্ঞানে মুগ্ধ হয়েছিল লুৎফর। ছেলে মালাকর হয় নি এ নিয়ে পিনপিনে এক কষ্ট বুকের মধ্যে খোঁচাত। কিন্তু সবাই তো আর ফুল ভালোবাসে না। ফুল হোক আর তাবিজ, দিন শেষে তো সব বিশ্বাসেরই খেলা। মেহেন্দি শুধু তাবিজ না, ঢাকার চকবাজারের এক দালাল ধরে জায়নামাজ তজবি আর আলিফ ব্র্যান্ডের আতরের কারবার শুরু করল। যারা তাবিজ কেনে, তারা যে সাথে একটা তজবি বা আতর কিনে ফেলবে টুক করে, এটা সে অনেক হিসাবনিকাশ গবেষণা করে বের করেছে। লুৎফর এরপর আর বেশিদিন বাঁচে নি। মেহেন্দি বাপের মৃত্যুর পর নিজের মতন করে ব্যবসা বাড়িয়ে সাজিয়েগুছিয়ে বসল।

মেন্দি হুজুর কারও মুশকিল আসানের আশ্বাস দেয় না। সে বলে, তোমরা কাম করেন বাহে কাম করেন। হামার তাবিজ এল্লা রাস্তা বাতলাইবে। কিন্তু তোমার কাম তোমরাই করিবেন। মেন্দি হুজুরকে সবাই শ্রদ্ধা করে বোধহয় তার অহংকারের জন্য। সেই অহংকারটা পরিমিত, আলগা নয়, নাকের ডগায় এক চিলতে রোদের মতন খেলা করে। মৃদু হেসে পথ চলে, কথা কম বলে এবং মনে মনে বিশ্বাস করে, তার কারণেই আজ পাকের হাটকে মানুষ চেনে। সেটা পাকের হাটের মানুষও বিশ্বাস করে, কিংবা করত। একসময় লুৎফর মালাকরের জন্য পাকের হাট সুখ্যাত ছিল। তারপর মেন্দি হুজুরের তাবিজ। আশপাশের এলাকা থেকে মানুষ আসে তাবিজ নিতে, মেন্দি হুজুরের সাথে দুটো কথা বলতে। মেন্দি হুজুর এ-গ্রাম ও-গ্রামে ঘুরে বেড়ায় না। গ্রামের মজলিশ দাওয়াতপাতিতেও সচরাচর যায় না। কেউ তার কাছে গেলে কথা বলে, তাও পরিমিত। খুব একটা হাসে না, কাঁদেও না কখনো। বাপ যেদিন মরল সেদিনও এক ছটাক চোখের পানি ছিল না তার চোখে। একসময় পাকের হাট বলতে মানুষ মেন্দি হুজুরকেই বোঝাত। গ্রামের চেয়ারম্যান, জমিদারেরাও মনে করে মেন্দি হুজুরের মতন একজন চটকদার মানুষের প্রয়োজন আছে। এদের কারণে এলাকা আলোচনায় থাকে। মালাকর মরে গেছে। পংকু গায়েন, যার সুরের টানে একসময় সাত-আট কিলোমিটার পথ হেঁটেও প্রতিবেশী এলাকার মানুষ হাটবারে এখানে এসে জমা হতো, সে এখন পাক্কা পাগল। খোঁচা দিলেও সুর বের হয় না। গল্প তৈরির আর কেউ নেই, মেন্দি হুজুর ছাড়া।

সময়েরও জোয়ার-ভাটা আছে। মেন্দি হুজুরই প্রায়ই বলে এ কথা। তার সময়ও যে জোয়ার-ভাটায় বাঁধা, সে কি ভুলে গিয়েছিল? নুরুদ্দিন কাজীর মেয়ে পারুলকে বিয়ে করল যখন মেন্দি হুজুর, গ্রামের মানুষ একটু ধাক্কা খেলো। হলদেটে শরীরে, তিরতিরে টিকালো নাকের সুদর্শন মেন্দি হুজুরের কি অন্যরকম কাউকে বিয়ে করার কথা ছিল না? কেলো দাঁত উঁচু তীক্ষ্ণ স্বরের পারুলের কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবে নি। গ্রামে তো মেয়ে ছিল, দুই একজন যারা মেন্দি হুজুরের পাশে দিব্যি মানিয়ে যায়। কেউ বলে, ‘হুজুর আর পারুল প্রেমে মজছিল।’ আবার এমন শোনা যায়, পারুলের বাপ নুরুদ্দিন কাজী অনাথ মেন্দিকে প্রতি শুক্রবার দুপুরে জুম্মার পর খিচুড়ি আর গরুর মাংস ভুনা খাইয়ে বশ করেছে।

বিয়ের পর পর, মেন্দি হুজুরকে কয়েকবার খোলা মুখে হা হা হাসতে দেখা গিয়েছে। তার ডান পাশের গজদাঁতটা হাসিতে দারুণ লাগে। গ্রামের লোকে বলাবলি করে, হুজুর হাসলে ফাইন দেখায় যে। যার স্ত্রী দিন রাত গলা ফাটিয়ে হাসে আর তীক্ষ্ণ চিৎকারে আনন্দ প্রকাশ করে, তার আর না হেসে উপায় কী? মেন্দি হুজুরের বাড়ির পাশে ছেলেপেলে আর মহিলারা ভিড় করে প্রায়ই। কান পেতে শোনে, ঘরের ভেতর থেকে ছিটকে আসা খিলখিল আওয়াজ, আর চৌকির ধরং ধরং নড়বার শব্দ। হেসে গড়িয়ে পড়ে মহিলারা, ছেলেপেলেরা লজ্জায় দৌড়ে পালায়। মেন্দি হুজুরের মন ব্যবসায় বসে না। দোকানের ছোকরাটি বেশিরভাগ দিন দোকান চালায়, বিকেলের পর হুজুর এসে একটু বসে। আজকাল তাবিজের সাপ্লাইও নাই প্রায়। পোয়াতি মহিলারা মরিয়ম ফুলের তাবিজের জন্য ছটফট করছে। কিন্তু তাবিজের স্টক শেষ। মুরব্বিরা কেউ কেউ বিরক্ত, বুঝদারেরা বলল, আচ্ছা ওকে যেন সময় দাও বাহে। কেবল বিয়ে করসে। অহন ভরা যৌবন। কদিন পর সব ঠিক হইবে এলা। এতদিন তো সবার খেদমত কইরসে। এবারে এনা বৌয়ের খেদমত করুক ক্যানে... হাসিতে ভেঙে পড়ে তারা। এমন করে দিন যাচ্ছে।

খুব বেশি দিন নয় যদিও, হুজুরের সময়তেও ভাটা নামে। পারুল তার বাপের বাড়ি গাট্টিবোচকা সমেত ফিরে এল। আর যাবে না সংসারে। ‘শালা পাগল। রাতের বেলা মাইরধোর করে।’ নুরুদ্দিন কাজী মেন্দি হুজুরকে ডেকে মিটমাটের চেষ্টা করল। মেন্দি হুজুর মেপে মেপে ঠান্ডা গলায় ঘটনার বর্ণনা দিল, পারুল একদিন তার মুখে স্টিলের বদনা ছুড়ে মেরেছিল, নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে পারুলকে একটা ধাক্কা দিয়েছিল। পারুল স্বীকার করল ঘটনা সত্য। পারুল যে মাঝে মাঝে খেপে ওঠে এবং গালিগালাজ করে, মেন্দির চুল ধরে ঝাঁকি দেয়, এসব কথা নুরুদ্দিন কাজী বিশ্বাস করল। তার মেয়ের রেগে যাওয়ার দোষ আছে। মেন্দি হুজুর এসব কিছু উপেক্ষা করে সংসার করতে চায়। পারুলের বাপ মেয়েকে সকলের সামনে থাপ্পড় মেরে, বুঝিয়ে, বকাঝকা দিয়ে ভয় দেখিয়ে সংসারে পাঠাতে রাজি করায়। সবকিছু ঠিকঠাক যখন, পারুল আবার খেপে উঠে। এত মানুষের সামনে বাপ গালি দিল! জীবনে প্রথম চর মারল! মেনে নেয়া যায়! খেপে যায়, কেঁপে কেঁপে ওঠে পারুল। সেই পাগলা রাগ ওঠে তার, গড়গড় করে বলে দেয়, ‘এই মেন্দি ব্যাডা তো চোর। পাইকারি জরি বুটি কিনে  তাবিজের মধ্যে ঢুকাইয়া বিক্রি করে। কিসের দোআ দুরুদ পড়া তাবিজ? হে বেটা তো ঠিক কইরা পাকসাফই থাকে না! বাড়িতে থাকলে তো এক ওয়াক্তের নামাজও পড়ে না। পুরাই ধান্দা, মাইনষেরে ঠকায় শালা চোর।’

মেন্দি হুজুর তাকিয়ে দেখে শ্বশুরবাড়ির উঠোনে ভিড় জমেছে হালকা, উৎসুক  চোখ পিটপিট করে। জানে, বাতাসের সাথে এ কথা রাষ্ট্র হবে গ্রামে গ্রামে। শিরশির করে কেঁপে ওঠে তার চূড়ার মতন অহংকারী নাকের ডগা। ধীরে ধীরে হেঁটে বের হয়ে আসে। মাথা নিচু হয়ে যায়। আর কোনোদিন পারুলের মুখ দেখবে না বলে স্থির করে। দেখেও না। ব্যবসাও আর জমে না। কিছুদিন তসবি, জায়নামাজ-আতর বিক্রির চেষ্টা করেছে। জমে নি। আজকাল মেন্দি হুজুরকে দেখা যায় না কোথাও। উঠোনের কোনায় বসে লাউয়ের ডগার মতন তিরতির কাঁপে সে। চোখ দুটো খটখটে তার, ভাষাহীন, জলহীন। ওই মৃদু এক ছটাক হাসি, তাও হাসে না আজকাল। হাট বসে আগের মতনই, তাবিজের দোকান ছাড়াই। হুজুরকে ছাড়া মুশকিল আসানের চেষ্টা করে যাচ্ছে এলাকার মানুষ।

আর আশেপাশের এলাকার মানুষ ভুলে যাচ্ছে যে পাকের হাটে একসময় এক মালাকর ছিল, মেন্দি হুজুর ছিল। পাকের হাট বিখ্যাত ছিল তারা মনে করতে পারে, কিন্তু কেন সেটা ভুলে যায়। তাই অমন খুচরো সাপখোপ, আদিকালের মাথা নষ্ট পংকু গায়েনের গল্প জুড়ে দেয় পাকের হাটের নামের সাথে।

দিন যায়, পাকের হাটের মানুষেরা বুঝতে পারে তারা ভালো নাই। কেন কেন, কারণ খোঁজে তারা। যারা বুঝদার তারা ভেবেচিন্তে বের করে যে, তারা ভালো নাই কারণ তাদের কোনো গল্প নাই। এ অঞ্চলের উঁচু জাতের সুন্দর নাকওয়ালা মানুষেরা, তারা বিখ্যাত হতে অভ্যস্ত। পাকের হাটের সাথে জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকবে কোনো গল্প। যেই গল্প তাদের আলাদা করবে ওই প্রতিবেশী অঞ্চলের ছোঁকছোঁকে লোকদের থেকে। অথচ কতদিন হলো তাদের কোনো গল্প নেই। মানুষ ভুলে যাচ্ছে পাকের হাটকে। আর দশটা গ্রামের মতন এ এক অযথা গ্রাম হয়ে উঠছে। সূর্যের সাথে তাল মিলিয়ে ওঠো খাও দাও, চাষবাস করো, ট্যাট্যা বাচ্চাকাচ্চা সামলাও আর রাতে খিটখিটে জিরজিরে বৌদের সাথে সেই আদরবাদর খেলা। আর সপ্তাহে দুইবার ম্যারম্যারে হাট বসে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার পংকু গায়েনকে জোর জবরদস্তি করে গান গাইতে বসানো হয়েছে। গানের আসরের কারণে হাটে যদি একটু লোক বাড়ে! গান তো গাইলই না, সে উল্টো এই দোকান সেই দোকান থেকে মুরগির পাখনা, রুই মাছের লেজ, আর কচুর লতি কেড়েকুড়ে নিয়ে, ধেইধেই করে হাটের মাঝে নেচেছে। লজ্জা!

সকলে ভাবল। অনেক অনেক ভাবল। ভেবেটেবে মেন্দি হুজুরের কাছে গেল।

হুজুরকে বলল, তোমরা এনা বুদ্ধি উপায় বাইর করো।

কী বুদ্ধি?

হামার গ্রামটাক এনা পপুলার করা লাগবে।

হুজুরের চোখে টুকরো আলো ঝিলিক দেয়, মুই কি আর...

জি হুজুর আপনেই পারিবেন।

তারা মনে মনে ভাবে, এসব চিকন শয়তানি বুদ্ধি তুমি ছাড়া আর কার আছে? বলে না মুখে, গিলে যায়। আর মেন্দি হুজুর ভাবে, এই এক সুযোগ আবার আলোতে আসবার। এই অনুতাপের দিন আর কত!

আজকাল হাটে বেচাকেনা কম। আশপাশের মানুষের আকর্ষণ কমে গিয়েছে। পাকের হাটে আর এমন কী আলগা তামাশা আছে যা অন্যখানে নেই? আর এদিকে এবারের ভরা বন্যায় খেতের ফসলও নষ্ট হলো কত। অভাব হুড়হুড় করে ঢুকছে বাড়ির ফুটো দেয়াল দিয়ে।

মেন্দি অনেকদিন পর ঘরের বাইরে বের হয়, একটু একটু করে। হেঁটে হেঁটে বেড়ায় গ্রামের কানাগলি, বাড়ির উঠোনগুলোর ধার দিয়ে যায়, শোনে নেংটো বাচ্চারা ট্যা ট্যা করে পেট ভাসিয়ে কাঁদে। হাটবারে বিক্রি হয় না প্রায় কিছু। মানুষই আসে না। এর মাঝে চুরির ঘটনা ঘটল। ধনরঞ্জন শীলের একটা বাছুর চুরি হলো, করিম সুলতানের এক হালি মুরগি, জরিনা বেগমের সোনার কানবালি। গাছের ফল, বাগানের শাক, কুমড়া তো যে যখন পারে কেড়েকুড়ে খাচ্ছে।

এমন হাহাকারের দিনে কী গল্প ফাঁদবে বুঝে না মেন্দি হুজুর। মেন্দির সাথে এলাকার পোলাপান পুরোনো ভক্তরা জুটেছে আবার। তারা বিশ্বাস করে, এ খরার দিন থেকে মুক্তির উপায় একমাত্র মেন্দিই খুঁজে পাবে।

মেন্দির খাস লোক কাল্লুমিয়া। এত বছর হুজুরের সাথে ব্যবসা সামলিয়েছে। বুঝতে পারে হুজুরের কপালে চিন্তার রেখা, নাক কেঁপে ওঠে পাকের হাটকে বাঁচিয়ে তোলার ভাবনায়।

হুজুরকে তৃপ্ত করার জন্য বলে, চারপাশে খালি তো সবাই কান্দে, এত কান্দনের মধ্যে কী আর কোনো বুদ্ধি মাথায় আসে!

মেন্দির মাথায় ফট করে আলো জ্বলে ওঠে। কাল্লু মিয়াকে জড়িয়ে ধরতে মন চায় আনন্দে। ইচ্ছাকে আড়াল করে মুখে শুধু ছোট্ট করে বলে, ‘মারহাবা!’

এরপর দিনরাত এক করে নতুন ব্যবসার ফন্দি করে মেহেন্দি হুজুর। সে নিশ্চিত জানে এমন ব্যবসা আগে কেউ করে নি। তার বিশ্বাস, পাকের হাটে মানুষ আসবে আবার, জমজমাট হবে হাট। যদিও এলাকার মানুষ নিশ্চিত না এমন এক আজগুবি ভাবনা কাজে লাগবে কিনা, তবু তারা মেন্দির ওপর ভরসা করল। এ ছাড়া তো উপায়ও নাই আর। এ ব্যবসায় সবচেয়ে বেশি দরকার জনবল। নান্টু-ফান্টু ধরনের যে-কোনো মানুষ হলেই হবে না। যোগ্য মানুষ লাগবে। খুঁজে খুঁজে মানুষ জোগাড় করে মেন্দি। তার দল তৈরি। ব্যবসার প্রচার-প্রসারের বিষয়টা সে ভালো বোঝে। লাল-নীল কালিতে ব্যবসার নাম-ঠিকানা দিয়ে গ্রামে হাটে বাড়িতে কাগজ বিলায় কাল্লু মিয়া আর সাঙ্গপাঙ্গ। কাগজে লেখা থাকে ‘পাকের হাটের নতুন খবর, সহজ মূল্যে কান্নার লোক সরবারহ।’ বিশদে বলতে গেলে, মেন্দি হুজুর চারপাশ তাকিয়ে দেখেছে যে, মানুষ চোখের জলকে বিশ্বাস করে। তার মালাকর বাপের এ কথা সে ভোলে না যে, বিশ্বাসকে পুঁজি করে ব্যবসা করতে হয়। এ গ্রামের মানুষ কাঁদতে পারে। তাদের মাঝে হারানোর ভয় আছে, আছে অতৃপ্তি আর অভাব। তাদের কান্না খাঁটি। সেখান থেকে বেছে বেছে খুঁজে নিয়েছে তাদের, যাদের কান্নায় একটা সুর আছে, কিংবা যারা অনেকক্ষণ ধরে কাঁদতে পারে এবং ক্লান্ত হয় না। কান্না আদতে এক পরিশ্রমের কাজ। সবার দ্বারা হয় না।

চাহিদার বিষয়টাও সে বিবেচনা করেছে। বড়লোক মরা বাড়িগুলোতে কান্নার লোকের অভাব আজকাল। কিংবা গ্রামের সালিশে বিচার-আচারেও কান্নার লোক লাগে, বাদী কিংবা বিবাদীর পক্ষে। আর বিভিন্ন নেতারা যখন আশপাশের অঞ্চলে এসে দেশপ্রেমের ভাষণ দেয়, কেউ একফোঁটা চোখের পানি ফেলে না। অথচ ওই সময় কান্নার মানুষ জরুরি, খুবই জরুরি। আর গ্র্যান্ড যাত্রা কোম্পানি যখন গেলবার সিরাজুদ্দৌলার পালা করল, কী এক বেইজ্জতি হলো! বাংলার শেষ নবাব মরছে যখন মঞ্চে, আর দর্শক সারিতে বজ্জাত পোলাপান হেসে খুন খুন। এই শেষ দৃশ্যে দর্শকের যদি চোখে যদি দু-ফোঁটা জল না এল তো যাত্রা পুরা ফ্লপ।

কিছু মানুষ প্রশ্ন তোলে, এরা তো সাজানো কান্নার লোক। এদের কান্না মানুষ বিশ্বাস করবে ক্যান?

প্রশ্নটা পছন্দ হয় হুজুরের। চকবাজারের পুরোনো দোস্তর সাথে শলাপরামর্শ করে। কান্নার লোক এলাকার মধ্যে সরবরাহ করা যাবে না। দূরের শহরে আর গ্রামে ব্যবসা করতে হবে। যেখানে তাদের কেউ চেনে না।

 মেন্দি দলবল নিয়ে অন্য শহরে যায়। অনেক দূরের গ্রামে যায়। ঘুরে ঘুরে নানা ধরনের পাতি নেতা, যাত্রাপালার দল আর গ্রামের মাথাদের সাথে ব্যবসায়িক আলোচনা করে। তাদের জন্য কান্নার লোক যোগান দিবে। শিখিয়ে পড়িয়ে দিবে কোন সময় কখন কাঁদতে হবে। সব কান্নার ঢং আবার এক রকম না। সেটাও মাথায় রাখতে হবে। মরাবাড়ির কান্না হবে তীব্র, লাইলী-মজনুর পালার কান্নার সাথে তা মেলানো যাবে না। আর দেশপ্রেমের ভাষণে যে কান্না তাতে জল থাকবে, কিন্তু মুখে কোনো শব্দ থাকবে না। কোন ধরনের কান্না, কত লোক লাগবে এসবের উপর রেট নির্ধারণ করে মেন্দি। কান্নার লোকদের প্রশিক্ষণ দেয় হুজুর। মুখে মুখে শেখায়, এমনে কান্দো, ওমনে কান্দো বাহে। মেন্দি হুজুরকে কেউ কখনো কাঁদতে দেখে না। তবু সে কান্নার রীতিনীতি আর কৌশল জানে, একদম নিখুঁত। গ্রামের মানুষ ভাবে, কী তাজ্জব ব্যাপার!

বিভিন্ন শহরে এজেন্ট ঠিক করে মেন্দি হুজুর। তারা নতুন বায়না পেলে হুজুরকে খবর দেয়, আর বিনিময়ে কমিশন পায়। নতুন জিনিস সবাই চায়। এই যেমন সেদিন ঢাকা থেকে এক সিনেমার নায়ক তার বাচ্চার জন্মদিনের জন্য কান্নার লোক ভাড়া করেছে। নায়কের বাচ্চা নিজের হাতে ছাগল বিলাবে গরিবদের মাঝে, তা দেখে আনন্দে মুখ ফুলিয়ে মৃদু কাঁদবে এমন এক দল লোক। ব্যবসা জমজমাট। আজকাল হাটবারে কান্নার লোকের দল দেখতে ভিড় করে মানুষ। গ্রামের চেয়ারম্যান জমিদারদের বুদ্ধি দেয় মেন্দি, ‘দিনকাল এনা ভালো যায়ছে বলে মজুরি বাড়ান না কিন্তু। এন অভাবত থাকবার দ্যান। অভাবত না থাকলে কান্নার মাইনষের ব্যবসা লাটত উঠিবে।’ হুজুর জানে, গ্রামের মানুষ বেশি আরামে থাকলে, কাঁদতে ভুলে যাবে। কান্নার দলের জন্য লোক পাওয়া মুশকিল হবে তখন। একটু অভাব থাকুক, সামান্য অভাব। মুগ্ধ হয় তারা মেন্দি হুজুরের বুদ্ধিতে।

পাকের হাট জমে উঠছে আবার। কান্নার লোকের দল নিয়ে নানা গল্প জমে ওঠে। সরকার নাকি কান্নার দলকে কোম্পানি রেজিস্ট্রি করে দিবে। কান্নার দল এত বড় হবে যে, তার ওপর ট্যাক্স বসানোরও চিন্তা-ভাবনা চলছে। মেন্দি হুজুর গল্পের পালে হাওয়া দেন। চলুক যতদিন ইচ্ছা। তারপর না হয় নতুন গল্প, নতুন ধান্দা। মেন্দি বুঝে গিয়েছে যে, কোনো বিশ্বাস বেশিদিন টেকে না, ব্যবসাও।

স্কুলঘরের পাশের ঘরটা কান্নার দলের অফিস এখন। কত এলাকা থেকে, শহর থেকেও বায়না করতে আসে নানারকম মানুষ। একটা হাবভাব তো দরকার, নাইলে ব্যবসা কি আর জমে? কান্নার দলের ব্যবসা চলে জোরসে।

গ্রামের মানুষ তৃপ্ত। তারা বড় একটা সাইনবোর্ড বানিয়ে অফিসঘরে ঝুলায় মেন্দি হুজুর পরিচালিত কান্নার লোকের দল।

সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে মেন্দি হুজুর, অহংকারী শুষ্ক চোখে, তার নাকের ডগায় ঝিলমিল করে মুগ্ধতা। তার নামের লেজ থেকে টুপ করে খসে যায় ‘মালাকর’ কখন, কেউ মনে রাখে না আর।  

[গল্পটি অন্যদিন ‘ঈদুল আজহা সংখ্যা ২০২৩’-এ প্রকাশিত]

Leave a Reply

Your identity will not be published.