[এই ধারাবাহিকটির লেখক তানকিউল হাসান, আর্থিক অনটন থেকে মুক্তির আশায় নিউইয়র্কের রাস্তায় শুরু করেছিলেন ট্যাক্সি চালানো। সেই সময় তিনি মুখোমুখি হন বিচিত্র অভিজ্ঞতার। সেইসব ঘটনাই ফুটে উঠেছে এই ধারাবাহিক রচনায়। আজ পড়ুন ১৬তম পর্ব।]
প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব
ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব
পর্ব ১১ পর্ব ১২ পর্ব ১৩ পর্ব ১৪ পর্ব ১৫
গেলাম জাপানিজ রেস্টুরেন্টে। খাবারের অর্ডার দিলাম। তারপর কাউন্টারে বসা বুড়ো জাপানিজ মহিলাটিকে এড্রেস বুকটি দিয়ে বললাম, দেখো তো এখানে কোনো নিউইয়র্কের ঠিকানা আছে কি না! সে বই দেখে একটি ঠিকানা বের করে বলল, এই ঠিকানাটা নিউইয়র্কের।
আমি বললাম, আমাকে ঠিকানাটা ইংরেজিতে লিখে দাও। সে ঠিকানা ইংরেজিতে তর্জমা করে দিল। বাসায় ফিরে লাঞ্চ সেরে ওই ঠিকানায় ফোন ঘুরালাম। ওপাশ থেকে স্পষ্ট ইংরেজিতে কেউ একজন বলল, হ্যালো?
আমি বললাম, এক জাপানিজ ভদ্রলোক আমার ট্যাক্সিতে তাঁর ব্যাগ ফেলে গেছে। সেই ব্যাগে একটি এড্রেস বুক ছিল এবং তোমার ঠিকানা আমি সেখানেই পেয়েছি, তোমার পরিচিত কেউ কি ব্যাগ হারিয়েছে?
লোকটি আনন্দে চিৎকার করে উঠল। ‘ওহ মাই গড, ওহ মাই গড’- বলে চেঁচাতে লাগল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাগটি কার?
সে উত্তেজনা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ব্যাগটি আমার বাবার। তুমি কোথায় থাকো আমাকে বলো আমরা এখনই আসছি।
আমি আমার ঠিকানা দিয়ে ফোন ছেড়ে দিলাম। ঘণ্টাখানেক পর সেই বৃদ্ধ জাপানিজ যাত্রী আর তাঁর পুত্র এসে হাজির। জাপানিজ বৃদ্ধ আমাদের দেখে আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন। তাদেরকে আমার ড্রয়িংরুমে এনে বসালাম। ব্যাগটি তাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম দেখো সব ঠিক আছে কি-না। অতি বিনয়ী সেই জাপানিজ ভদ্রলোক ব্যাগ খুলেও দেখলেন না। যাওয়ার সময় আমার হাতে ছোট্ট একটি খাম দিয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, আমার কাছ থেকে সামান্য উপহার গ্রহণ করলে খুশি হব।
আমি উপহার গ্রহণ করলাম। খাম খুলে দেখি ভেতরে দশটি একশো ডলারের চকচকে নোট। ট্যাক্সিতে মানুষ কত কি যে ফেলে যায় তা নিয়ে লিখতে গেলে অন্তত একশ’ পৃষ্ঠা লেখা যাবে। আরেকটা ঘটনা বলি। এক বৃদ্ধাকে ফিফথ এভিনিউতে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে নামিয়েছি। ডোরম্যান দরজা খুলে মালকিনকে গাড়ি থেকে নামাচ্ছে। সেন্ট্রাল পার্কের পূর্ব দিকের এভিনিউটির নাম ফিফথ এভিনিউ। এর অফিসিয়াল নাম মিউজিয়াম মাইল। কারণ এই রাস্তায় বেশ কিছু বিখ্যাত মিউজিয়াম আছে। যেমন, মিউজিয়াম অফ আর্ট, গুগেনহাইম মিউজিয়াম, নিউইয়র্ক ট্রানজিট মিউজিয়াম, ফ্রিক কালেকশন মিউজিয়াম অন্যতম। ফিফথ এভিনিউর বাসিন্দারা তাঁদের প্রিয় এই এভিনিউটিকে মিলিওনার মাইল বলেই ডাকেন। কারণ এখানে যারা বাস করে তারা সবাই অতি বিত্তবান। এক একটি অ্যাপার্টমেন্টের মূল্য কয়েক মিলিয়ন ডলার।
যা’ হোক, বৃদ্ধা গাড়ি থেকে নামার পর ডোরম্যান আমার জানালায় টোকা দিয়ে বলল, তোমার পেছনের সিটে এই মানিব্যাগটি পেয়েছি।
আমি মানিব্যাগ হাতে নিলাম। নিশ্চয়ই কোনো প্যাসেঞ্জার ফেলে গেছে! এ দেশে সবার মানিব্যাগে আইডি থাকে। এই মানিব্যাগে আইডির অভাব নেই। অন্তত দশ ধরনের আইডি কার্ড আর লাইসেন্স পেলাম। কী কী পেলাম সেটা বলি। ড্রাইভার লাইসেন্স, প্রাইভেট পাইলট লাইসেন্স, ফায়ার আর্মস লাইসেন্স, বোট লাইসেন্স, মাছ ধরার লাইসেন্স, শিকারের লাইসেন্স, কোনো এক কোম্পানির আইডি কার্ড, ব্লাড ডোনার কার্ড, ট্রিপলের কার্ড, দুনিয়ার রিসিট আর নগদ পঞ্চাশ ডলার। লোকটাকে খুঁজে পেতে আমার বেশি ক্ষণ লাগলো না। ষাটোর্ধ্ব এই লোকটিকে ওইদিন সকালবেলা ডাউন টাউনে নামিয়েছিলাম। এরপর বেশ ক‘টা প্যাসেঞ্জার নিয়েছি কিন্তু কেউই আমাকে পেছনের সিটে পড়ে থাকা মানিব্যাগের কথা বলে নি। অবশ্য এ দেশের মানুষই এ রকম। নিজের না হলে এরা ছুঁয়েও দেখে না, তবে সবাই এক নয়। ছ্যাঁচোড় টাইপের হলে ঠিকই পকেটস্থ করত। বৃদ্ধকে তাঁর লাইসেন্স ফেরত দিলাম। সে আমাকে একশ’ ডলার বকশিস দিয়েছিল। আরেকটা ঘটনা বলি। কাজ করছি, টিএলসি থেকে হঠাৎ করে ফোন। ফোন ধরলাম। জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার?
ওপাশ থেকে বলল, তোমার গাড়িতে আজ সকাল দশটার দিকে এক বৃদ্ধা ভুল করে তাঁর ডায়মন্ডের ব্রেসলেট ফেলে গেছে। তুমি কি তা পেয়েছ? না পেলে একটু খুঁজে দেখবে হয়তো বা সিটের চিপাচাপায় পড়ে আছে।
আমি বললাম, ঠিক আছে আমি দেখছি।
(চলবে…)
Leave a Reply
Your identity will not be published.