[শহিদ হোসেন খোকন দীর্ঘদিন ধরে গল্প লিখছেন। এই প্রথমবারের মতো তিনি উপন্যাস লিখলেন। এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে অগ্নিঝরা একাত্তর, সেই সময়ের রাজনৈতিক আবহাওয়ার উতল হাওয়া। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের পটভূমিতে এই উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের প্রধান জাতীয় নেতৃবৃন্দ, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টোসহ আরও অনেকে। আজ পড়ুন ১২তম পর্ব...]
প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব
ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব
কামাল সাহেব সকাল ১০টার মধ্যেই ফ্যাক্টরিতে চলে আসেন। ফ্যাক্টরির সামনের দিকটায় তার অফিস। অফিসে স্টাফ মাত্র দুই জন- কালিপদ আর বশির উদ্দিন। এছাড়াও সুলেমান নামে একটি ছেলে আছে, সে বয়-বেয়ারার কাজ করে। এটি কামাল সাহেবের সাবানের ফ্যাক্টরি। সাবানের নাম বাংলা সাবান। কাপড় কাঁচার জন্য এই সাবান খুবই পপুলার। অফিসের পেছনে গোটা ৪০ জন শ্রমিক এই ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। প্রতিদিন অন্তত ৫০০০ পিস প্রোডাকশন হয়।
কামাল সাহেবের আরও দুটি কারবার আছে। বেবি মিল্ক পাউডারের সোল ডিস্টিবিউটর। সেখানে তিনি যান দুপুরের পরে। কর্মচারীরা আদায়-পত্র নিয়ে হাজির হতে থাকে। সব টাকা ব্যাংকে জমা না হওয়া পর্যন্ত তিনি স্বস্তি পান না। ক্যাশ টাকার ব্যাবসা নিজে না দেখলে সব ফাঁকা হয়ে যাবে। সম্পদ থাকার এই এক ঝঞ্ঝাট, একে পাহারা দিয়ে না রাখলে হাতছাড়া হয়ে যায়। আর ফতুল্লাতে আছে দুটি ইটের খোলা। সেটি তার ছোটভাই দেখে। তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার সেখানে যান।
কালিপদের বয়স পঞ্চাশের আশপাশে কিন্তু তাকে আরও বয়স্ক দেখায়। বয়স্ক দেখানোর কারণ হলো তার ঘরে সোমত্ত তিন মেয়ে। বড়ো মেয়ের বয়স ১৯, সে আইএ পাশ করে বিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। মেজো মেয়েটা মেট্রিক পরীক্ষা দেবে আর ছোটটি ক্লাস এইটে পড়ে। বড়ো মেয়েটির সম্প্রতি বিয়ে ঠিক হয়েছিল কিন্তু পণের টাকা যোগাড় না হওয়ার কারণে বিয়ে ভেঙে গেছে। ছেলের বাড়ি থেকে ২৫ হাজার টাকা পণ দাবি করেছিল। বহু দৌড়-ঝাঁপ করে কালিপদ ১০ হাজার পর্যন্ত যোগাড় করতে পেরেছিলেন।
কামাল সাহেবের কাছে ১০ হাজার টাকা লোন চেয়েছিলেন, কিন্তু কামাল সাহেব সরাসরি হ্যাঁ-না কিছু বলেন নি। শুধু বলেছেন, ‘যৌতুক দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়ো না। যৌতুকের সংসার ভালো হয় না। সারা বছরই জামাইদের ফ্যামেলি থেইকা নানা রকম ডিমান্ড লাইগা থাকব। তারচেয়ে বরং মেয়েরে পড়াশুনা করায়া চাকরিতে লাগিয়া দাও। সংসারের কিছু বার্ডেন কমল। তারপর ভাগ্যে যেইখানে থাকে সেইখানে বিয়া হইব। কালিপদ ভেবে দেখলো কামাল সাহেব কথাটা খারাপ বলে নি।’
কালিপদ একাউন্ট্যান্ট। শ্রমিকের বেতন-ভাতা, খাতকের হিসাবপত্র, বকেয়া আদায়, ব্যাংকিং পুরোটাই কালিপদ দেখেন। আর বশিরউদ্দিন দেখে মার্কেটিং। নতুন নতুন ক্লাইয়েন্ট বাড়ছে, বশির উদ্দিনের একজন সহকারী খুব দরকার হয়ে পড়েছে। কিন্তু কামাল সাহেব লোক নিয়োগের ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে। বিশ্বস্ত লোক ছাড়া উনি তার ব্যবসার আশপাশে কাউকে ভিড়তে দেন না। বিশ্বস্ত এবং নির্ভর করার মতো লোক না পেলে ব্যবসায় উন্নতি করা যায় না। আজকাল বিশ্বস্ত লোকের বড় অভাব।
কামাল সাহেবের মেজাজ আজ খুব খারাপ। শ্রমিকরা কেউ কাজে আসে নি, ফ্যাক্টরি বন্ধ। আজ নাকি তারা দলবেঁধে রেসকোর্সের ময়দানে শেখ সাহেবের ভাষণ শুনতে যাবে। ১২ মাইল রাস্তা হেঁটে হেঁটে ভাষণ শুনতে যাওয়ার কোনো মানে হয়! শেখ মুজিব মানুষকে কী ভেলকিবাজি দেখাবে কে জানে!
আজ অফিসে না এলেও চলত। কিন্তু এত বড় প্রতিষ্ঠান, একবার এসে না ঘুরে গেলে মন স্বস্তি পায় না। তাছাড়া অফিসের সিন্দুকে অনেকগুলো ক্যাশ টাকা আছে। সেগুলো নিতেই মূলত তিনি অফিসে এসেছেন। হাওয়া কোন দিকে বইছে কালিপদ কিছু বুঝতে পারতেছ? পরিস্থিতি মনে হয় খুব জটিল হইব। খারাপ সময় আসতাছে... কথা শেষ করে কামাল সাহেব কালিপদর মুখের দিকে তাকায়।
কালিপদ সারাক্ষণ মুখ বুজে কাজ করলেও রাজনীতির ব্যাপারে বেশ সচেতন, কোনো বাকবিতণ্ডায় না জড়িয়ে ভেবে-চিন্তে কথা বলে। এবারও সে কামাল সাহেবের প্রশ্নের উত্তরে বলল, খারাপের পরেই ভালো সময় আসে।
খুবই ডিপ্লোমেটিক আনসার, কামাল সাহেব কালিপদর উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না, তিনি আরও কিছু শুনতে চান।
আরে কী কও? তুমি খারাপের তো কিছুই দেখ নাই অহনো। পাঁচ নম্বর ঘাটের জেটিতে জাহাজ থেইকা রাতের বেলা গোলা-বারুদ নামানো হইছে। এই গোলা তো আর আতসবাজির গোলা না, মানুষ মারার গোলা। শেখ মুজিব কী ঝামেলার মধ্যে ফালাইল কও দেহি! ইন্ডিয়া ভাইঙ্গা লইয়া আইল পাকিস্তান আর অহন পাকিস্তান ভাইঙ্গা বানাইতে চায় বাংলাদেশ।
ভাঙ্গাভাঙ্গিটাই তো ভুল ছিল।
তোমার এই এক সমস্যা, কথা একটা বইলা ঝিম মাইরা থাকো। ভুল হইব কেন? হিন্দুরা কি মুসলমানগ শোষণ করে নাই, অপমান-অপদস্ত করে নাই? মুসলিম লীগ যে পাকিস্তানের দাবি তুলল হেইটা ত তাগো ন্যায্য দাবি আছিল, নাকি?
পাকিস্তানের দাবী ঠিক না বেঠিক সেটা হয়তো ১০০ বছর পর বুঝা যাবে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানকে জুড়ে দেয়া ছিল একটি মস্ত ভুল। ভাষার মিল নাই, খাদ্যের মিল নাই। কালচারের মিল নাই।
আরে ধর্মে তো মিল আছে। মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই।
সেই পাকিস্তানি মুসলমান ভাইরাই তো এখন এ দেশের মুসলমানদের শোষণ করছে। শোষকের চরিত্র সব দেশেই এক। শোষণটা কীভাবে হয় দেখেন- এইখানকার পাট-চা-চামড়া বিদেশে রপ্তানি করে যে আয় হয় সেটা আর পূর্ব-পাকিস্তানে আসে না। সে টাকা খরচ করা হয় পশ্চিম-পাকিস্তানে। শেখ মুজিবের ছয় দফা আর ছাত্রদের ১১ দফা এই শোষণ বন্ধ করার জন্যে।
কী যে কও না! তুমি দাদারে আদা পড়া শিখাও। ছয় দফা, এগার দফা সবই হইল পাকিস্তান ভাঙ্গার চাল। ছাত্ররা যে ঢাকায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ায়া দিছে সেইটা দেখো নাই তুমি? শেখ মুজিব-তাজউদ্দীন কী চায় সেইটা তো পানির মতন পরিষ্কার। এখন কথা হইল ইয়াহিয়া, ভুট্টো সাব তোমাগ এই দাবি দাওয়া কতটুকু মানব?
দাবি তো আমার একার না, এই দেশের সবাই আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। এখন ইয়াহিয়া খানকে শেখ মুজিবের ন্যায্য দাবি মেনে নিতেই হবে। যদি আর্মি নামায়া মানুষ মারা শুরু করে? তখন কী হইব বলো? খালি হাতে বাঙালি আর কি ফাইট দিব?
খালি হাতেই বাঙালি রুখে দাঁড়াবে।
(চলবে…)
Leave a Reply
Your identity will not be published.