‘তুমি যে গিয়াছ বকুলও বিছানো পথে…’

‘তুমি যে গিয়াছ বকুলও বিছানো পথে…’

ছন্দে আর গীতিতে আজও হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায় শিল্পী শচীন দেববর্মন। আজও বুকের ভেতরে বাজে সেই টাকডুম টাকডুম...। আজও বাঙালি হৃদয়ের অতলান্ত গভীরতায় ঢেউ খেলে যায় সেই মধুর ধ্বনি। ১ অক্টোবর ছিল তাঁর ১১৫তম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে আমাদের এই বিশেষ রচনা।

শচীন দেবের জন্ম ১ অক্টোবর, ১৯০৬ সালে কুমিল্লায়। পিতা ত্রিপুরার রাজ বংশীয় নবদ্বীপ চন্দ্র বাহাদুর। শৈশব কেটেছে আগরতলা ও কুমিল্লায়। কৃষ্ণচন্দ্র দে, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, বাদল খাঁ প্রমুখ সংগীত গুণীর শিক্ষায় শচীন দেবের সংগীতজীবন গড়ে উঠেছে।

কিছুটা সানুনাসিক, তবে অসামান্য সুরেলা ছিল শচীন দেবের কণ্ঠস্বর। মেজাজ মতো গাওয়ার ক্ষমতাও ছিল তাঁর অতুলনীয়। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত সংগীত সমালোচক ধূর্জটি প্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আমি যত গায়কের গান শুনেছি, তার মধ্যে কুমার শচীন্দ্র দেববর্মনের মতো এমন মেজাজে গাইতে আর কাউকে দেখি নি।’

আজও শচীন দেবের কণ্ঠ আমাদের নাড়া দেয়, প্রেমানুভূতিতে আপ্লুত করে হৃদয়। কেননা মেজাজ মতো গাওয়ার ফলে গানের মর্মকথাটি পৌঁছে যায় আমাদের শ্রুতিতে। ওঁর প্রেম পর্যায়ের এ ধরনের গানগুলোর মধ্যে— ‘শোন গো দখিন যাওয়া’, ‘বর্ণে গন্ধে, ছন্দে, গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছো দোলা’, ‘রঙিলা রঙিলারে’, ‘মন দিল না বধূ, মন নিল যে শুধু’, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’, ‘নিশিথে যাইও ফুল বনে’, ‘তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে’, ‘বধূ গো এই মধু মাস’, ‘তুমি আর নেই সে তুমি’ ইত্যাদি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

১৯৩২ সালে শচীন দেবের প্রথম গ্রামোফান রেকর্ড প্রকাশিত হয়। রেকর্ডের দুটি গান ছিল— ‘ডাকলে কোকিল রোজ বিহানে...’ এবং ‘এই পথে আজ এসো প্রিয়...।’ উল্লেখ্য, ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর— এই ৪১ বছর ধরে শচীন দেববর্মনের রেকর্ডকরণ অব্যাহত থাকে এবং এই দীর্ঘকাল ধরে তিনি গায়ক ও সুরস্রষ্টা রূপে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেন। এ সময়ে তিনি মোট ১৩১টি বাংলা গান রেকর্ড করেন। ১২৭টি গান রেকর্ড করেন স্বয়ং একক কণ্ঠে, আর ৪টি রেকর্ড করেন পত্নী মীরা দেববর্মনের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে।

যা হোক, এবার আমরা শচীন দেবের গাওয়া এবং অনেক ক্ষেত্রেই সুরারোপিত প্রেমের গানগুলোর প্রতি মনোনিবেশ করি। আমরা যখন শুনি ‘নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক, পায়েলখানি বাজে/ মাদল বাজে সেই সঙ্গেতে শ্যামা মেয়ে নাচে...’ তখন মায়াবী এক কালো মেয়ের চঞ্চলতা এবং রূপমুগ্ধ এক প্রেমিক হৃদয়ের মাধুরী অপূর্ব ব্যঞ্জনায় শ্রুতিতে পৌঁছে, আমাদের মননে কি রসের ধারা বইয়ে দেয় না? কিংবা এক উতলা প্রাণের সোচ্চার ঘোষণা— ‘শোন গো দখিণ হাওয়া প্রেম করেছি আমি/ লেগেছে চোখেতে নেশা, দিক ভুলেছি আমি...।’ অথবা এক উদাসী প্রাণের গভীর প্রেমানুভূতি— ‘বর্ণে গন্ধে, ছন্দে, গীতিতে হৃদয়ে দিলে দোলা...।’ যেখানে সেই প্রেমিক হৃদয়ের প্রেমাঞ্জলি মূর্ত হয়ে উঠেছে— ‘মুক্তা যেমন শুক্তির বুকে, তেমনি আমাতে তুমি/ আমার পরানে প্রেমের বিন্দু, তুমি শুধু তুমি...’ তখন আমাদের স্পর্শকাতর মন কি গাঢ় অনুভূতিতে আক্রান্ত, প্রেমের মিষ্টি স্বাদে সিক্ত হয় না?

পাশাপাশি আবার প্রেমের যে কী নিদারুণ জ্বালা— ‘কী করি, আমি কী করি, বনে ফাগুন, মনে আগুন/গলে গলে দহে মন, ধিকি ধিকি হিয়ারে/ হিয়া যদি হয় ছাই, বাঁচিব কি নিয়ারে...।’ সেই নিদারুণ যন্ত্রণার সঙ্গে বিজড়িত হয় আমাদের হৃদয়— তখন যেন আর সহ্য করা যায় না— ‘আমি সইতে পারি না বলা/মন নিয়ে ছিনিমিনি সইব না...।’ আমাদের হৃদয় তখন কয়ে ওঠে ‘তুমি আর নেই সেই তুমি, জানি না কেন এমন হয়/ তোমার চোখের পাতা নাচে না/ হাসো না সেই মধুর হাসি/তুমি আর নেই সে তুমি...।’ কিন্তু জলে নামলে তো ভিজতে হবেই, প্রেমে পড়লে তো বিরহের জ্বালা সইতে হবেই, ‘তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে/নিয়ে গেছ হায়, একটি কুসুম আমারও কবরী হতে....।’ তখন তো বিরহ যন্ত্রণার অশ্রু ফেলতে হবেই: ‘আঁখি দুটি ঝরে হায়, একা জেগে থাকি/ রুধিরে রাঙানো আমি তীর বেঁধা পাখি...।’

এমনিভাবে শচীন দেব বিরহের মধুর ও যন্ত্রণাকাতর রূপকে তাঁর কণ্ঠে, বেশ কয়েকটি গানে মূর্ত করে তুলেছেন। যেমন— ‘বিরহ বড় ভালো লাগে...’, ‘ঝিলমিল ঝিলমিল ঢেউয়ের জলে ঢেউ খেলিয়া যায়’, ‘কাঁদিব না ফাগুন গেলে’ এই গানগুলোতে বিরহের মধুর রূপটি পাওয়া যায়, যা শচীন দেবের কণ্ঠে মূর্ত হয়ে ওঠে। এবং ‘ঘুম নাহি নিঝুম এ নিশীথে...’, ‘বধূ গো এই মধুমাস বুঝি বিফল হলো...’, ‘বাজে না গো বাঁশি’, ‘প্রেমের সমাধি তীরে...’ ইত্যাদি গানে বিরহের যন্ত্রণাকাতর রূপটি শচীন দেবের কণ্ঠে মূর্ত হয়ে ওঠে আমাদের শ্রুতিতে ও মননে পৌঁছে চোখ দু’টোকে অশ্রুসজল করে তোলে।

কানু ছাড়া নাকি গীত হয় না। হ্যাঁ, রাধা-কৃষ্ণের প্রণয় লীলাকে কেন্দ্র করে রচিত বেশ কয়েকটি গানে সুরারোপ করে তা আপন কণ্ঠে ধারণ করে সেই প্রেমানুভূতি আমাদের হৃদয়ে সঞ্চারিত করে দিতে সক্ষম হয়েছেন শচীন দেববর্মন। যেমন ‘রাধার ভাবে...’, ‘শ্রীমতি যে কান্দে...’, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নেই’, ‘মধু বৃন্দাবনে দোলে...’, ‘প্রেম যমুনার পারে’, ‘তুই কি শ্যামের বাঁশি’, ‘বাশুরিয়ারে কোথায় শিখেছো, বাঁশি বাজানো’ ইত্যাদি। অবশ্য এই গানগুলোতে প্রেমানুভূতি ছাড়াও কথা ও গায়কীতে এক ধরনের মজা পাওয়া যায়। এমনকি সুরের ক্ষেত্রেও বেশ নতুনত্ব রয়েছে। যেমন—‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই/ সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি/সে যে দিন দুপুরে চুরি করে/ রাত্তিরে তো কথা নাই...।’ এই গানেরই অন্য জায়গায়—‘বাঁশেতে ঘুণ ধরে যদি বাঁশিতে কেন ধরে না/কত জনায় মরে শুধু পোড়া বাঁশি কেন মরে না...।’ এই কথার মজা পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে শচীন দেবের কণ্ঠে। শুধু তাই নয়, এই গানে বাঁশি, একতারা, তারসানাই আজও শুনলে থমকে দাঁড়াতে হয়।

সুরের কথা যদি এসেই গেল, তবে ‘মলয়া চল ধীরে ধীরে’ গানটির প্রসঙ্গ তোলা যাক। এ গানটির বিষয় হলো বাতাসকে উদ্দেশ করে শ্রীমতি রাধার আর্তি—যেন সে ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়, কেননা শ্রীকৃষ্ণ ঘুমিয়েছেন। যাই হোক, এই ‘মলয়া চল ধীরে ধীরে’ গানটিতে শুধু একটি স্বর বেজে যায় একতারার মতো। মনে রাখতে হবে এখানে ‘ঘুম’ কথাটাই প্রধান। তাই একটা ঘুমের আমেজ।

শচীন দেববর্মনের প্রকৃত অবস্থান ছিল রাগ সঙ্গীতের জগতে। ওঁর প্রেমাশ্রয়ী অথচ রাগভিত্তিক গানের মধ্যে ‘কুহু কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া...’, ‘যদি দখিনা পবন...’, ‘নতুন ফাগুনে যবে...’, ‘আজি মধুরাতে তার বাঁশি বাজে হায়...’, ‘আলো ছায়া দোলে’, সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। রাগভিত্তিক গানের সুর সৃষ্টিতে শচীন দেব সামান্য যন্ত্রের সহযোগিতা নিয়েছেন। যেমন ‘নতুন ফাগুনে যবে’ বা ‘মম মন্দিরে’ শুধু হারমোনিয়াম ও তবলা। ‘গোধূলির ছায়াপথে’ বাঁশির বিরাট ভূমিকা আছে। পিয়ানো শুধু ভ্যাম্প করে যায়। ‘প্রিয় আজও নয়’ গানে হারমোনিয়াম, তবলার সঙ্গে বাঁশিও আছে। অথচ আজকের দিনে এই সামান্য যন্ত্রের ব্যবহার ভাবাই যায় না । আরও যন্ত্র যোগ হলে ঘুম ভাঙার মতো হয়ে যেত।

লোকসংগীতের আঙ্গিকে যে সমস্ত গান শচীন দেব গেয়েছেন, যেমন ‘নিশীথে যাইও ফুল বনে রে ভ্রমরা...’, ‘রঙ্গিলা, রঙ্গিলা, রঙ্গিলারে/ আমারে ছাড়িয়া রে বন্ধু কোথা গেলারে...’ ‘মন দিলো না বন্ধু...’, ‘ও কালো মেঘ বলতে পার...’, ‘পদ্মার ঢেউরে.....’ ইত্যাদি গানগুলো শচীন দেবের কণ্ঠে প্রেমানুভূতির নতুন মাত্রা এবং তাঁর সাংগীতিক ব্যক্তিত্বের অসামান্য প্রকাশ ঘটায়।

বাংলা গানের জগতে শচীন দেববর্মন একটি বিশিষ্ট নাম— ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর যাঁর মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু সংগীত অনুরাগী মানুষদের হৃদয়ে সোনার আঁখরে তাঁর নাম লেখা থাকবে। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.