প্রতিটি দিনই বন্ধু দিবস

প্রতিটি দিনই বন্ধু দিবস

আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস বলে কিছু হয় না। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত আমাদের বন্ধুর প্রয়োজন। বন্ধু না হলে আমরা এক পাও চলতে পারি না। কিন্তু যেমন আন্তর্জাতিক মা দিবস, বাবা দিবস রয়েছে—তেমনি বন্ধু দিবসও এখন আমাদের বিশ্ব প্রবণতা। আমি অবশ্য জীবনের প্রতি দিনকেই বন্ধু দিবস বলে মনে করি।

এবার কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি। সত্তর দশকে প্রতিদিন বিকেলে আড্ডায় বসতাম এক দঙ্গল বন্ধুদের নিয়ে। ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে, ধানমন্ডি লেকের পাড়ে। আমরা তখন একই সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে পড়া বেকার ছাত্র। আড্ডার শেষ ছিল না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসত আব্দুল কাদির খান, আলাউদ্দিন, হাফিজ, ফকির উদ্দিন, বেলাল আহমেদসহ আরও অনেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা প্রায় আরও দশজন যুক্ত হতাম একসাথে। সমমনা বন্ধুদের মিলনমেলা বসত এখানে। বন্ধুত্বের সীমার মাঝে আরেকটা সীমাবদ্ধতা আছে। সেটা হলো একে অপরের ব্যক্তিগত জীবনের ভাববিনিময়। এত বন্ধুর মাঝেও কেউ কেউ আবার ভীষণ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। ক্রিকেট খেলা, ফুটবল, ভলিবল খেলার মাঠ ছিল ধানমন্ডির আবাহনী ক্লাব মাঠ। ছোট-বড় টুর্নামেন্টগুলো উপভোগ করতাম বন্ধুরা মিলে। তার মধ্যে অবশ্য দলের গোদা ছিল আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় বন্ধু এবং মুক্তিযোদ্ধা গাজী আব্দুল মালেক। যার সাথে  কলেজজীবনে এক ঘরে থাকা, এক থালায় খাওয়া, আবার স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক সংকটের দিনে কলেজে ‘হুকোপার্টি’ বানানো। তরুণ বয়সে বহু বিচিত্র ভাবনার মধ্য দিয়ে বন্ধুটির  বড্ড কাছাকাছি এসেছিলাম। দেউলিয়া টাইপের বন্ধুটি আমার। যত টাকাই থাকুক আমার পকেট তার মারা চাই। কলেজ ক্যান্টিনে বাকি ফেলা অনেক টাকা আমার পকেট মেরে পরিশোধ করে সে।

পকেটে ফুটো পয়সা নিয়ে প্রায় সারাদেশ ঘুরে বেড়াত মালেক। পথেই তার বন্ধু, পথেই তার বান্ধবী, পথেই তার সংসার। আবার ফিরে আসত আমার কাছে। সে এক অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ ছিল। আর সেই ছিল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের দলের নেতা। নেতার কথা বেশ সবাই মেনে চলত। অমুকের টাকা দরকার—সবাই মিলে সহযোগিতা করা; থাকার জায়গার অভাব, সবাই মিলে ব্যবস্থা করার অলিখিত দায়িত্ব ছিল গাজী আব্দুল মালেকের।

এই বন্ধুত্ব ভেঙে যেতে লাগল যে যখন যেখানে চাকরি পেয়ে গেল। কেউ দূরে কেউ কাছে, কেউ আবার চাকরি ছাড়াই ঘরে বসে গেল। বন্ধুদের সদস্য সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় দুই-তিনে পৌঁছাল। আমার কাজ ছিল অধ্যাপনা। ঢাকাতেই।

কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার ছিল কাদির খান, বদরুন্নেসা কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক ছিল আলাউদ্দিন। মালেক যেদিন বিদেশে চলে গেল, সেদিন থেকেই কেমন যেন শূন্য হয়ে এল আমাদের আড্ডা।

 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘পনেরো আনা’ প্রবন্ধে বলেছেন, মানুষের চরিত্রের পনেরো আনাই হলো বাজে, অকাজের। বাকি এক আনা হলো নিরেট খাঁটি। আর এই পনেরো আনার মধ্যেই মানুষকে চেনা যায় বেশি। চরিত্রের স্খলন, ত্রুটি আবার সত্য সুন্দর প্রকাশ এখানেই। পনেরো আনার মধ্যেই এক আনার শেকড়। মনস্তত্ত্ব বিজ্ঞানের ভাষায়, মানুষের মনের পনেরো আনাই  সাবকনশাস মাইন্ড অর্থাৎ অর্ধঅবচেতন মার্গ। পৃথিবীর শিল্প-সাহিত্য দর্শন, বিজ্ঞানের আবিষ্কার, ভূবিজ্ঞান, ভৌত বিজ্ঞান—সবকিছুই এই সাবকনসাস মাইন্ড থেকেই বেরিয়ে আসে। আর সেখান থেকেই তৈরি হয় বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা। ভালোবাসা যখন এক আনায় বা আত্মার ভেতরে পৌঁছে তখন পরিপূর্ণ বন্ধুত্ব। কিন্তু চেতন মার্গের অবস্থান মাত্র এক আনা।

কবি  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, কাজ কম কথা বেশি তার নাম আড্ডা। আড্ডার মধ্য দিয়েই বন্ধুত্বের মিলনমেলা। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও এ আড্ডার শরিক ছিলেন। বন্ধুত্ব এভাবেই গড়ে ওঠে।

এবার মানব ইতিহাসের সূচনা পর্বের বন্ধুত্ব নিয়ে  কয়েকটা কথা বলা যাক। বন্ধুত্ব ব্যাপারটি সভ্যতার আদিম খেলা। যখন মানুষ কথা বলতে শেখে নি, তখন থেকেই বন্ধুত্বের সূচনা। নৃতত্ত্ব ঘেঁটে দেখা যাক কী বলে।

‘বন্ধু’ একটা ছোট্ট শব্দ। আমাদের সভ্যতা গড়ে ওঠার বহু আগে শিকারজীবী মানুষের ভয়ংকর শক্তিশালী পশুর সাথে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল একত্রিত হওয়া। একত্র হয়ে দলবদ্ধভাবে পশুকে দমন করে তার মাংস আগুনে ঝলসে খাওয়া। পশুর মাংস উদরপূর্তি হলে নারী-পুরুষ মিলে চলত অগ্নিনৃত্য। আগুনকে ঘিরে এই নৃত্যে অংশগ্রহণ করত সহকর্মী বন্ধুরা। পশুর আক্রমণে আক্রান্ত হলে এক ধরনের সংকেত পাঠাতে শুরু করত। মুখের শব্দ, আকাশ ফাটা চিৎকার শুনে ছুটে আসত নারী-পুরুষ সহযোদ্ধারা। পশুর সঙ্গে চলত নিরন্তর যুদ্ধ। যুদ্ধে একসময় সংঘবদ্ধ শিকারজীবী মানুষ জয় লাভ করত। এভাবেই আদিমকাল থেকেই বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল। বন্ধু শব্দটার জন্ম অনেক পরে হলেও আদিম মানুষের মনে একটা প্রাণের গভীর টান তৈরি হয়। পরবর্তীকালে বন্ধু শব্দটির জন্ম হয়।

প্রাচীন গ্রন্থ থেকে এটাও জানতে পারি, যাযাবর জাতিরা শিকারের ভূমি সন্ধানে দলে দলে ছুটে চলত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। কখনো হাজার হাজার মাইল তারা যুদ্ধ করতে করতে চলে যেত। পথে হঠাৎ দেখা যেত একজন নারী সদস্য আত্মচিৎকার করে বসে পড়েছে, প্রসব বেদনায়। পথ চলতি মানুষেরা যে যার পথে এগিয়ে গেলেও ঠিক তার কাছের প্রিয় মানুষটি রয়ে যেত, দলসঙ্গ ত্যাগ করেও। কারণ সে তার প্রিয় রমণীকে ফেলে এগোতে পারল না। অবশেষে সন্ধ্যা রাত দিন কাটিয়ে সন্তান জন্ম নিল। সন্তানের নিরাপত্তায় গাছপালা থেকে কাঠ পাতা সংগ্রহ করে ছোট্ট কুড়ে তৈরি করে নিল পুরুষটি। এখানেই তৈরি হলো একটা পরিবার। আসলে বন্ধু বন্ধুকে ভালোবাসে। তাকে ফেলে কোথাও যাওয়া চলে না, বিশেষ করে বিপদের দিনে। পৃথিবীতে পরিবারতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল একে অপরের ভালোবাসার মাধ্যমে।

     আবার যাযাবর জাতির মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার গড়ে ওঠার কথা জানতে পারি রাহুল সংকৃত্যায়নের নৃতাত্ত্বিক গ্রন্থ ‘ভোলগা সে গঙ্গা’য়।

 খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক সাড়ে ছয় হাজার বছর পূর্বের মাতৃতান্ত্রিক  পরিবারের প্রধান নারীকেন্দ্রিক চরিত্র নিশা, দিবা, অঙ্গিরা ইত্যাদি নারীর সন্ধান পাওয়া যায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় আসতে বহু কাল লেগে গেছে মানুষের। শিকার, ভূমি দখল, যুদ্ধ সংঘাত লড়াই পুরুষের হাতেই চলে আসে। কেননা নারীর থেকে পুরুষেরাই বেশি সামর্থ্যবান। এভাবে পরাহুত প্রবাহন, সুদাস, বন্ধুল মল্ল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষের সন্ধান মিলে।

তারপর কেটে গেছে হাজার হাজার বছর। তাম্র যুগের পর লৌহ যুগের সূচনা। লৌহ মানবের হাতে এল ধারালো তরবারি, তীর ধনুক, বল্লমের মতো শাণিত তীক্ষè অস্ত্র। মানব সভ্যতা বিকাশের পথে বন্ধুত্বই হলো আসল শক্তি। একা নয়, সমবেত প্রতিষ্ঠায় প্রতিষ্ঠিত হলো সমাজ, রাষ্ট্র, নগর, বাসস্থান। কৃষিকাজের পাশাপাশি পশুপালন যুগের সূচনা ঘটল অর্থাৎ চারণ যুগ। তৈরি হলো গোষ্ঠীকেন্দ্রিক জীবনব্যবস্থা। বিবাহ প্রথা, পূজা অর্চনা, আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধ, যুদ্ধবিদ্যা এসব থেকে বন্ধুর রিলে রেস চলছে সমাজে। হাজার হাজার বছর ধরে।

 আজ আমাদের সমাজে কেউ কৃষক, কেউ জেলে, কেউ কুমোর, তাঁতি, বহু পেশাজীবী মানুষ। এখন তো অফিস-আদালিত, ইন্টারনেট ল্যাপটপ, গাড়ি ঘোড়া প্লেন, এরোনটিকাল বিজয় চলে এসেছে আমাদের হাতে। কিন্তু এই পেশাজীবী মানুষেরা কিন্তু আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় বন্ধু। বন্ধু ছাড়া সমাজ-সংসার জীবন অচল। এককালে আমাদের একেকটা গ্রামকে বলা হতো ‘লিটিল রিপাবলিক’। অর্থাৎ স্বনির্ভর প্রজাতন্ত্র। যার খাদ্যের দরকার কৃষক, মাছের দরকার জেলে, পোশাকের দরকার তাঁতি, জুতোর দরকার চামার—তিল থেকে তাল যা কিছু প্রয়োজন সবই জোগান দিত প্রতিবেশী সমাজ বন্ধুরাই। গ্রামের বাইরে থেকে কোনো জিনিস  আনতে হতো না। অর্থাৎ তারা পরনির্ভর ছিল না।

এভাবেই গড়ে উঠেছে আমাদের সভ্যতার প্রাথমিক স্তর। বন্ধু বিনে জগৎ নেই ভাই, আসল বন্ধু পাই যে কোথায়! আসল বন্ধু আমাদের সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষেরা, যাদের অবদানে আমরা বেঁচে থাকি সবাই সবাইকে নিয়ে।

যত প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটেছে ততই পরনির্ভর হয়েছি আমরা; বিদেশি শাসন-শোষণের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী শোষিত হয়েছি আমরা। গোটা দেশটাই পরনির্ভর হয়ে পড়েছে আজ। বন্ধুত্বের বাঁধন যেন আলগা হয়ে গেছে জীবনযুদ্ধে।

মোবাইল-ইন্টারনেটের যুগে এসে দেখতে পেলাম, এখন বন্ধু হলো মোবাইল-ইন্টারনেট। তবু বন্ধুত্ব থাকবেই। মানুষের গোটা জীবন চলবে মানুষকে নিয়েই। বন্ধু বিনে জগৎ চলে না, ও ভাইরে!

Leave a Reply

Your identity will not be published.