[থ্রিলার উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রতি পদে রহস্য ও রোমাঞ্চের হাতছানি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার জাহিদ আহমেদ। ঢাকার রেডিসন হোটেলে শম্পা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানের একটি রুমে শম্পার সঙ্গে যাওয়ার পর কী ঘটে, তা জাহিদের মনে নেই। এরপর শম্পা জাহিদের ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির ছাত্রী সেজে তার পিছু নেয়, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওর ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং করতে থাকে...। এক সময় শম্পা খুন হয়। কে খুন করল শম্পাকে? জাহিদ আহমেদ নাকি অন্য কেউ? নাকি অন্য রহস্য জড়িয়ে আছে এখানে? আজ পড়ুন পঞ্চম পর্ব।]
প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তৃতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চতুর্থ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ভয়ে এবং উত্তেজনায় আমার সাড়া শরীর মৃদু কাঁপছে। আমার সামনে স্কিনটাইট জিন্স আর হাল্কা বেগুনি টি-শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে উদ্ভিন্নযৌবনা শম্পা। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এ কী করে সম্ভব!
রোকসানা প্রশ্নাতুর চোখে শম্পার দিকে তাকাতেই পেছন থেকে একটা বড় কেক হাতে মিলি এসে বলল, হ্যাপি বার্থ ডে, মা, সারপ্রাইজ, সারপ্রাইজ।
রোকসানা প্রবল বিস্ময়ে মিলির দিকে তাকিয়ে বলল, তুই কোথা থেকে এলি মিলি? আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? এসব প্ল্যান কে করল?
মিলি বিশাল কেকটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল, তোমার জন্মদিন হবে আর আমি একমাত্র মেয়ে হয়ে থাকব না, সেটা কীভাবে ভাবলা? শম্পাকেও সঙ্গে নিয়ে আসলাম।
শম্পা আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে সালাম দিল। তারপর একটা বেলুনে অন্যদের থেকে মুখ আড়াল করে আমার দিকে চোখ টিপি দিল। আমার মনে হচ্ছিল ওখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাই। মিলি বলল, এই হলো শম্পা। এখন পর্যন্ত ডিপার্টমেন্টে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, যদিও সে অলরেডি ক্লাস ফাঁকি দেওয়া আরম্ভ করেছে। একদিন আসে তো তিনদিন আসে না। এ জন্যই আমার ঘাড়ে চেপেছে। আমাদের পরশুদিন একটা অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। শম্পাকে বললাম সঙ্গে চলে আসতে যেন ফাঁকি দিতে না পারে। ও রাজি হয়ে গেল।
শম্পা বলল, জি আন্টি, একটু লেখাপড়াও হলো আবার আপনার বার্থডেও হলো।
রোকসানা আনন্দে গদগদ হয়ে বলল, খুব ভালো করেছ শম্পা। আমি এখনই বুঝতে পারছি তুমি একটা লক্ষ্মী মেয়ে।
শম্পা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সালাম আঙ্কেল, আপনাকে কেমন আপন আপন লাগছে, মনে হচ্ছে যেন কত জনমের চেনা।
ওর কথা শুনে আমার গলা শুকিয়ে এল। মিলি বলল, তোকে একবার বলেছি না, আব্বু আমাদের ইউনিটে ইংলিশের প্রফেসর?
শম্পা উদাস ভঙ্গিতে বলল, কী জানি, হয়তো দেখেছি করিডরে, কিন্তু মনে হচ্ছে অন্য কোনোভাবে চিনি। কোথায় দেখেছি আপনাকে আঙ্কেল?
মৃদু হেসে মাথা নাড়া ছাড়া তখন আমার কী বা করার ছিল? ওদিকে জন্মদিনের কেক বাইরে নিয়ে আসায় সমস্যা হয়েছে। মোম জ্বালাতে গেলেই বাতাসে নিবে যাচ্ছে। কোনোরকম একটা প্রতীকী মোম জ্বালিয়ে আমরা হ্যাপি বার্থডে গাইলাম। রোকসানা কেক কাটল, আমরা হাততালি দিলাম। শম্পা সবাইকে কাগজের প্লেটে কেক বেড়ে বেড়ে দিচ্ছিল। আমাকে দেয়ার সময় ওর লাল নেলপলিশ লাগানো লম্বা নখ দিয়ে আমার হাতে কচাত করে আঁচড় কেটে দিল। আমি উহ করতে গিয়েও কোনোরকমে নিজেকে সামলালাম।
কেক খেতে খেতে আমি হিসেব মেলালাম। আমার মেয়ে ফিলোসফিতে পড়ে। তার মানে শম্পা ফিলোসফিতে ঢুকেছে। ওদের লেকচারের ফাঁকে ফাঁকে ইচ্ছে করে আমার লেকচারে এসেছে আমাকে জ্বালিয়ে টাকা নেওয়ার জন্য। কিন্তু ঘুড়ির সব সুতো ধুনধুনা মেয়েটা একসঙ্গে ছাড়ে নি। আর এখন তো সে পুরো ফ্যামিলির ভেতর ঢুকে পড়েছে। বল এখন শম্পার কোর্টে। চাইলে সে যে-কোনো সময় আমাদের পরিবারটাকে বালুর বাঁধের মতো ভাসিয়ে দিতে পারবে। কেক খেতে খেতে হঠাৎ শম্পা বলল, আন্টি, একটু এদিকে আসবেন, আমার একটা পার্সোনাল কথা ছিল। প্লিজ।
মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে শম্পা এর ভেতর রোকসানাকে মোহিত করে ফেলেছে। এ কারণে শম্পা ডাকবার সঙ্গে সঙ্গে রোকসানা চেয়ার ছেড়ে উঠে ওর সঙ্গে খানিক দূরে চলে গেল। আমার বুকটা ধরাস করে উঠল। দেখলাম শম্পা হাতমুখ নেড়ে কী যেন বোঝাচ্ছে রোকসানাকে। এখন মোবাইল ফোনে কিছু একটা দেখাল। তারপর হাত দিয়ে আমাকে ইঙ্গিত করে রোকসানার ঘাড়ে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে দিল। রোকসানা ওড়নার আঁচল দিয়ে ওর চোখমুখ মুছে দিল। তারপর গটগট করে হেঁটে আমার দিকে এগিয়ে এল।
ওকি এখন বাংলা সিনেমার দুখিনী বধূর মতো আমার গালে চড় মারবে? আসন্ন সর্বনাশের আশঙ্কায় আমি ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালাম। রোকসানা গম্ভীর মুখে বলল, দ্যাখো তো, কী ঝামেলা হয়েছে!
কী ঝামেলা?
শম্পার মনে পড়েছে ও কোথায় তোমাকে দেখেছে।
আমার গলা দিয়ে আওয়াজ আসছে না। কোনোরকমে কোঁ কোঁ করে বললাম, কোথায়?
তুমি নাকি দেখতে অবিকল ওর পালিয়ে যাওয়া দুলাভাইয়ের মতো, আমাকে ফোনে ছবি দেখাল। ওই দুলাভাই নাকি শম্পাকে অনেক মায়া করত কিন্তু ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম করে পালিয়ে গিয়েছিল। ও এখন বায়না ধরেছে আমাকে আপা বলবে আর তোমাকে চান্দু ভাইয়া বলবে। চান্দু ওর দুলাভাইয়ের নাম। তাছাড়া আপনি আপনি করে কথা বলতে ওর নাকি মোটেও ভালো লাগে না। কিন্তু ভয় পাচ্ছে তুমি হয়তো মাইন্ড করবে। কী বলব ওকে বলো? এসবে আমার কোনো অসুবিধা কিংবা আপত্তি নেই জানিয়ে রাখলাম।
আমার বুক থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গেল, যাক শম্পা কোনো কিছু ফাঁস করে দেয় নি। বললাম, তুমি যা ভাবো তাই, আপনি বলল না তুমি বলল এতে কী-বা যায় আসে?
রোকসানা খুশি হয়ে শম্পাকে সব জানাল। ধুনধুনা চালাকটা আনন্দে রোকসানাকে জড়িয়ে ধরল। আমি মনে মনে বললাম, হে ধরণি দ্বিধা হও, এরপর কী খেল দেখতে হবে কে জানে!
মিলি আর শম্পা সন্ধ্যায় শহর দেখতে বেরিয়েছিল। ওরা ফিরে আসার পর আমরা সমুদ্রের কাছে একটা নিরিবিলি জায়গায় চেয়ার বিছিয়ে বসলাম। আজ আকাশে সেদিনের মতো ভরা পূর্ণিমা। সমুদ্রের পানিতে চাঁদের আলো এলুমিনিয়ামের মতো চিকচিক করছে। শম্পা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, চান্দু ভাইয়া, তুমি তো ইংলিশ লিটারেচার পড়াও, চাঁদ আর সমুদ্র নিয়ে একটা কবিতা শোনাও না প্লিজ। মিলি ওর সঙ্গে সুর তুলে বলল, হ্যাঁ, আব্বু, শোনাও না প্লিজ।
আমি বললাম, একই সঙ্গে চাঁদ আর সমুদ্র নিয়ে তেমন কোনো ভালো ইংরেজি কবিতা মনে পড়ছে না। ই ই কামিংস নামে একজন কবি ছিলেন, ভয়াবহ ভালো কবি, নন-কনভেনশনাল স্ট্রাকচারে লিখতেন, ওনার কয়েকটা লাইন শোন,
“there is a
moon sole
in the blue
night
amorous of waters
Tremulous„
‘রাতের ঘন নীল আঁধারে
একাকী চাঁদ,
তার আবেশে দ্যাখো
সাগরের জল
কেঁপে কেঁপে অস্থির’
শম্পা চেঁচিয়ে উঠল, হায় আল্লাহ, উনি তো আমার কবিতা নকল করেছেন। আমার সেইম একটা কবিতা আছে।
রোকসানা অবাক হয়ে জিগেস করল, তুমি কবিতা লেখো নাকি? শোনাও তো।
সাগরের নোনা স্বাদ,
পেল কি ঘোলা চাঁদ?
বারবার ছুটে আসে ক্ষেপে,
প্রফেসর ভয়ে ওঠে কেঁপে।
মিলি অবাক হয়ে বলল, সুন্দর কবিতা কিন্তু শেষে কী বললা? প্রফেসর না কী যেন?
ওহ স্যরি, ভুলে প্রফেসর বলেছি ওটা সমুদ্র হবে।
কথা শেষ করেই শম্পা হঠাৎ সমুদ্র বরাবর হাঁটা দিল। মিলি বলল, এই শম্পা, তুমি কই যাচ্ছ? অত গভীরে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না।
শম্পা বলল, আরে ধুর, দেখতেই গভীর আসলে অত গভীর না। এই যে আমি হাঁটছি, মাত্র কোমর পানি। চলে আসো সবাই তাড়াতাড়ি, বড় ঢেউয়ের সঙ্গে সেই রকম ছবি তুলব।
মিলি শম্পাকে অনুসরণ করল আর আমরা মিলিকে। সবাই কাছে যেতেই শম্পা রোকসানার দিকে তাকিয়ে বলল, আপু দ্যাখো, এখন ঢেউগুলো ফিল করা যাচ্ছে। ম্যান্দার মতো তীরে ঘেঁষে হাঁটলে কোনো লাভ হতো?
রোকসান খুশি হয়ে বলল, তোমার সাহস অনেক বেশি মেয়ে। তোমার বয়সে আমার এত সাহস ছিল না।
শম্পা ফোন হাত দিয়ে উপরে উঠিয়ে সেলফির অ্যাঙ্গেলে ধরে বলল, এখন সবাই একসঙ্গে হাত ধরে দাঁড়াও। বড় একটা ঢেউ আসার সঙ্গে সঙ্গে সবাই চিজ বলবে, ওকে? একদম মাক্ষি ছিলিবিলি ছবি আসবে।
আমরা সবাই হাত ধরাধরি করে দাঁড়ালাম। পেছনে ঢেউয়ের শব্দ ক্রমশ বাড়ছে। সেই শব্দ হঠাৎ যেন বাঘের গর্জনের মতো চড়া হয়ে গেল। কিছু বোঝার আগেই প্রবল ঢেউ এসে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দিল। একটা তীব্র জলের ঘূর্ণি আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল, তারপর টেনে নিল কালো জলের গভীরে। ততক্ষণে আমার পায়ের নিচ থেকে বালু সরে গেছে। আশেপাশে একটা খড়কুটোও নেই যে ধরবার চেষ্টা করব। বুঝলাম আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। মান, অভিমান, ন্যয়-অন্যায়, ভাব-ভালোবাসা সব কূলে রেখে আমি চলে যাচ্ছি অচিন অকূলে।
এভাবে কত সময় গেল জানি না। হঠাৎ হাইওয়েতে দ্রুত ধাবমান বিশ টন ট্রাকের মতো আরেকটা ঢেউ কোত্থেকে এসে জোরে ধাক্কা দিয়ে আমাকে আছড়ে ফেলল ভেজা বালুকাবেলায়।
অবসন্ন দেহটাকে কোনো রকমে উঠিয়ে দেখলাম, একটু দূরেই ক্লান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে আছে রোকসানা আর মিলি। আমি পাগলের মতো ওদের দিকে ছুটলাম। আমি পৌঁছুতে পৌঁছুতে ওরা উঠে বসল। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
পরক্ষণেই মনে হলো, শম্পা কোথায়?
চারদিকে তাকালাম। না, কোথাও শম্পা নেই। ও কি তাহলে ডুবে গেল?
(চলবে...)
উপন্যাস বিভাগ থেকে আরও পড়ুন।
Leave a Reply
Your identity will not be published.