কবিতা সম্বন্ধে আমার কিছু নিজস্ব ভাবনা, ভালোলাগা আছে, সেই ভালোবাসাকে আমি নিজে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। সেই ছোটবেলা থেকে কবিতার প্রতি ভালোলাগা আজ একটা ফায়সালায় পরিণত হয়েছে যে, আমি কবিতা ভালোবাসি। সেই কারণে অনেকের বক্রোক্তি শুনতে হয়েছে। তাতে পুরো ভাবনায় সামান্যও ছেদ পড়ে নি। এই সময়ের বহু বহু কবির কবিতা আমার ভালো লেগেছে। বিখ্যাত অনেকের কবিতাই আমার ভালো লাগে নি। সম্ভবত আমার বোধের সীমাবদ্ধতা আমাকে ভালো লাগতে দেয়নি।
এইবার বইমেলা উপলক্ষে বেশকিছু বই সংগ্রহ করেছি। সেগুলো সবই আমার ভালোলাগার কবিতা ও কথাসাহিত্য। অন্যপ্রকাশের স্টল আলো করে যে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন, সেখানে কবি বীথি রহমানের কবিতার বই ‘এখানে অনেকদিন বৃষ্টি হয় না’। এটি ভীষণ আনন্দের যে বীথি রহমানের কবিতা অযথা প্রকরণ আর ভারিক্কি শব্দের মায়াজালে আটকানো নয়। বরং বীথি রহমানের কবিতা যেন পাশে বসে থেকে থেকে সেই আলাপ, যা আপনার ভেতরেও আছে অথচ আপনি করতে পারছেন না।
কবিতায় মূলত আমি যে নন্দন, মেটাফোর, চিত্রকল্প আর দর্শন খুঁজি, সেটা বীথি রহমানের কবিতায় আছে। কবির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট গুণ, তিনি জানেন কবিতাটা কোথায় শেষ করতে হবে।
কবির একটি কবিতা পড়ে দেখা যাক বীথি কবিতায় কী বলেন।
‘এমন কিছু বলো নি’ কবিতায় এমনভাবে উঠে এসেছে এমন বোধ আর ভাবনার সম্মিলন—
‘এমন কিছু বলো নি যে এতটা বেহায়া হতে হবে আমাকে
হাই হ্যালো, কেমন আছি, কী করছি- এই তো
তাতেই কী এমন মহাভারত উল্টাল?
অথচ রোজকার রাত কানে কানে অপেক্ষার শিস বাজাল
ধনুকবাঁকা চাঁদ, শেষবেলার নক্ষত্র, তিনরঙা বুলবুলির ভেজা পালক
এসব আগে চোখে পড়ে নি কেন?
তুমি জানো না, শুধু ব্রক্ষ্মপুত্র জানে
আমার কিছু নেই, কিছু হবে না।’
প্রকৃতির সাথে নন্দনের এমন মিশ্রণ বারবার প্লেটোনিক লাভের বিশুদ্ধ বয়ানের ইশারা দেয়, যেখানে নিজের সাথে লকলকে ডাল, যার প্রকৃতপক্ষে কোনো ক্ষমতা নেই, সেই বায়বীয় শরীর এক আশ্চর্য দ্যোতনায় পাখনা মেলে দেয় আর পাঠককে একাত্ম করে ঘ্রাণ আর মৌরিতানিয়ার পেলব সৌন্দর্য।
‘তুমি এলেই কামিনীর ঘ্রাণে
ভরে যেত আমার উঠোন
পুকুর পাড় ঘেঁষে গন্ধরাজের ভারে নোয়ানো
তেত্রিশ বছরের লকলকে ডাল
তার সাদা পাপড়ি বাতাসে দোল খেতো’
-নক্ষত্রের চেয়েও দূরে
কবিদের মনের আর্দ্রতা এত প্রখর হয় তাতে পাঠক অনায়াসে সাঁতার কাটতে পারে। কবির বেদনা প্রায়শই একটা নৈর্ব্যক্তিক ভাবনা তখনই হয়, যখন পাঠক নিজেকে একাত্ম করতে পারেন, প্রতিস্থাপনের একটা যৌগিক ভাবনায় তাড়িত করে। কবির ভাবনায় কেন জানি ব্যক্তিগত পছন্দের ইঙ্গিতও পাঠক পেয়ে যান, তখন সেটা একটা বহুমাত্রিক কোরাসের মতো শিল্প হয়ে ওঠে। প্লেটোনিক লাভের গণ্ডি ছাড়িয়ে কবি ফ্রয়েডের সূত্রের দিকে হাত দেন। নির্দ্বিধায় খুলে দেন সেই প্রকোষ্ঠ যেখানে চাঁদ আর অন্ধকার একটা কামজ ভঙিমায় নিজেদের মেলে ধরেন আর কাব্যের ভেতর সেই উৎপ্রেক্ষা আনেন যা সচরাচর অলক্ষেই থাকে। নাগ আর কামের মেটাফোরে যেন সকলকে ছুঁতে চায়। সেই মনোরম চাহনিতে পাঠক ফেলুক তার দৃষ্টিজাল।
‘কামিনীপুরের সাদা মেঝেতে গড়াগড়ি করে
শ্বাস নেয় বেহুলা রাত্রিগুলোতে
যেমন করে অমাবশ্যার রাতে নাগদেবী কামবিষে
মোচরাতে থাকে দূর্বাঘাসে
তবু লোকালয়ে আসেনা!’
-রাত্রীর কামিনীপুর
কবির আকাঙ্ক্ষা কোনো কোনো সময় তীব্রতম শারীরিক উল্লাসে কেঁপে কেঁপে উঠে একটা সু-অসুখে রূপান্তর ঘটে, যে অসুখের সাথে পাঠক রিলেট করতে পারে এবং পাঠের সুখানুভূতি বহুক্ষণ জেগে থাকে নিউরন সেলে। কবির এই ক্ষমতায় আমি পুলকিত হই। হই কবির চিন্তার সারথী।
‘তুমি আমার অসুখ হবে?
খুব করে একটা অসুখ দরকার
প্রেমের চেয়ে বড় অসুখ কে কবে দেখেছে!’
-অসুখ
কাব্যে একটা পরম আকাঙ্ক্ষা থাকে নিজের চিত্রকল্পের ভেতর অন্যকে পাক খাইয়ে আনা এবং একই সাথে নিজের দর্শনকে অন্যের ভালোলাগায় পরিনত করতে চাওয়া। বীথি রহমানের এই কাব্যও এমনই ইঙ্গিত দেয়। পরম একটা ধাক্কা তাকে দিতেই বাধ্য হবে।
‘আমাকে মনে রেখো না
এ রকম তো কতই হয়
যেতে যেতে থামে ক্লান্ত শালিক
সবুজ মধ্যাহ্নের আহার খুঁটে
তাই বলে কি শালিক পোষে কেউ, শুনেছ এমন?’
-আমাকে মনে রেখো না
কবিতায় একটা ভাবালুতা আছে বৈকি কিন্তু শেকড় আর অস্তিত্বের আকাঙ্ক্ষায় ক্রমশ উন্মুখ হতে চাওয়া সব প্রাসঙ্গিক উপাদানে বীথির কবিতা সব সময়ই ব্যক্তিক চিন্তা ছেড়ে যায়। একটা মহৎ কাব্যের টানে আমরা ক্রমাগত হারাই আমাদের নিজেকে কাব্যের গহনে।
‘মৃত্যুর টানে বড়ো হচ্ছি ক্রমাগত
বড়ো হতে হতে ছোটো হওয়ার বাসনা জাগে
পা টিপে টিপে মৌলভীবাড়ীর উঠোনে যাই
ভ্যাপসা গরমে পাটি বিছানো নক্ষত্র রাত
তালপাখার ফাঁক গলে আম্মার মাখন মুখ ভাসে
ডালিমের চিকন ডালে খেলা করে জরাগ্রস্ত দাদুর হাসি’
-আমার আজ কোথাও যাওয়ার নেই
ভালোবাসার এক দুর্দমনীয় প্রকৃতি, যা যৌক্তিক গুরুভারের চাইতেও, অযৌক্তিক লঘুতাকে বেছে নেয়। নিখাদ ভালোবাসায় ভালোমন্দের বিচার করা তখন অদরকারি ও অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়। এই কথাটার মতো অনেক মন্দকে ভালোবাসবার একটা নিজস্ব অহং তৈরি হয়, তৈরি হয় এক নিজস্ব সুন্দর অন্ধকার। যা আপাত মন্দের মতো মনে হলেই কবি পারেন পাঠকের কাছে সুন্দর করে তুলতে। অন্ধকারের পাশে আলো জ্বাললে সেই আলো অনেক বেশি দেদীপ্যমান হয়। কবির মন্দকেও তার ব্যক্তিক অভিব্যক্তিতে এক আশ্চর্য সুন্দর।
‘তুমি মন্দ জেনেই ভালোবেসেছি
বেসে যদি থাকি-ই, ক্ষতি কী?
ভালো হতেই হবে এমন মাথার দিব্যি তো দেই নি
ভালো জেনে ভালোবেসে কত কী যে হয়
তাও তো দেখি নি আমি?’
-তুমি মন্দ জেনেই
কবি বীথি রহমানের সমস্ত কাব্যগ্রন্থে কোনো কসরত করার চেষ্টা ছিল না। ছিল সরল করে কাব্যের সকল সৌন্দর্য ধারণ করে চিত্রকল্পের বাঁকে বাঁকে গভীর চিন্তা আর বিস্ময় নিয়ে দাঁড়ানোর নিজস্ব প্রচেষ্টা।
শাখাওয়াত বকুল: কবি ও কথাসাহিত্যিক
Leave a Reply
Your identity will not be published.