শম্পা কী চায়? (পর্ব ১২)

শম্পা কী চায়? (পর্ব ১২)

[থ্রিলার উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রতি পদে রহস্য ও রোমাঞ্চের হাতছানি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার জাহিদ আহমেদ। ঢাকার রেডিসন হোটেলে শম্পা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানের একটি রুমে শম্পার সঙ্গে যাওয়ার পর কী ঘটে, তা জাহিদের মনে নেই। এরপর শম্পা জাহিদের ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির ছাত্রী সেজে তার পিছু নেয়, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওর ভয় দেখিয়ে  ব্ল্যাকমেইলিং করতে থাকে...। এক সময় শম্পা খুন হয়। কে খুন করল শম্পাকে? জাহিদ আহমেদ নাকি অন্য কেউ? নাকি অন্য রহস্য জড়িয়ে আছে এখানে? আজ পড়ুন ১২তম পর্ব।]

রোকসানার মন পুরোপুরি ফিরে পাওয়ার জন্য প্রচুর পেঁয়াজ কাটা ছাড়া আমি কোনো উপায় দেখছি না।

এ কারণে হাতিরপুল বাজার থেকে তিন কেজি পেঁয়াজ কিনে খোসা ছাড়িয়ে কাটা আরম্ভ করেছি। যথারীতি পেঁয়াজের ঝাঁঝে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়া আরম্ভ করেছে। রোকসান ডাল বাগার দেওয়ার আগে আগে কিছু কাঁটা পেঁয়াজ ওর দিকে এগিয়ে দিলাম। ও গরম তেলে পেঁয়াজ ভাজতে ভাজতে বলল,

‘তুমি খেলারাম খেলেছ

(আমার তাই ধারণা),

কিন্তু প্রিয় খেলনা ভায়ায়

তুমি কিছুটা ক্লান্ত।

তুমি ক্লান্ত এই ভঙ্গুরতায়,

শুধুই ক্লান্ত।

আমিও তাই।’

এটা কার লেখা বলো তো প্রফেসর?

বুঝলাম রুকিমণি এই বিপদে আমার পাশে দাঁড়াবার অঙ্গীকার করলেও ওর ভগ্ন হৃদয়ের ক্ষত সারতে সময় আর শুশ্রূষা লাগবে। টিস্যু পেপার দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললাম, এটা তো ই ই কামিংস-এর সেই কবিতাটা,

‘You have played

(I think)

And broke the toys

you were fondest of,

And are a little tired now,

Tired of things that break, and-

Just tired.

So am I.’

তোমার টেবিলে ওনার বইয়ের এই পাতাটা খোলা ছিল, তাই আমিও পড়লাম একটু আগে।

রুকিমণি, তুমি কি এখনো মনে করো শম্পা আমার কোনো প্রিয় খেলনা ছিল?

মিড লাইফ ক্রাইসিসে তো পুরুষদের পাগলামোর কোনো সীমা-পরিসীমা থাকে না। ইয়াং মেয়েদের খেলনা মনে করা শুরু করে।

আর সেই খেলনা হারিয়ে আমি এখন ক্লান্ত?

সে তুমিই বোঝ, তোমার প্রিয় কবি তো তাই বলে গেছেন।

আমি মাথা ছুঁয়ে বলছি শম্পার সঙ্গে আমার ওসব কিছুই ছিল না। আমাকে হারিয়েছ ভেবে তুমি ক্লান্ত হোয়ো না, প্লিজ।

আই অ্যাম ট্রাইং মাই বেস্ট জাহিদ। আরেকটু সময় লাগবে হয়তো মন শান্ত হতে। যতবার ভাবি তুমি ওর সঙ্গে এক বিছানায় গেছ, আমার খুব কষ্ট হয়, বুক ভেঙে যায়।

রোকসানা শাড়ির আঁচলে চোখ ঢাকল। আমি আহত কণ্ঠে বললাম, তুমি তো এখন জানোই আমাকে রহিপনল খাওয়ানো হয়েছিল। পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এটা সিরাজ ভাই প্রমাণ করতে পারবেন। আর আই ডোন্ট বিলিভ শম্পার সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ কিছু হয়েছে। হলে সে এতদিন ভিডিও নিয়ে বসে থাকত না। শম্পা হয়তো ভয় দেখাচ্ছিল ব্ল্যাকমেইল করার জন্য।

শম্পা তাহলে কী চায়?

সেটাই তো সবচেয়ে বড় রহস্য, অনেস্টলি, আমি জানি না শম্পা কী চায়। কেউ জানে না শম্পা কী চায়।

আমার পতনে রোকসানার চেয়েও বেশি আঘাত পেয়েছে আমার আদরের মেয়ে মিলি। একদিকে ওর তথাকথিত যৌনশিকারি বাবা, অন্যদিকে ওর তথাকথিত নিহত অথবা নিখোঁজ বান্ধবী শম্পা সোহানি। শম্পা আমাকে পার্টি ড্রাগ দিয়ে বিবশ করেছিল শুনে মিলি আমার সঙ্গে আগের চেয়ে কিছুটা সহজ হয়েছে। কে ভিক্টিম, আমি নাকি শম্পা, এই নিয়ে তার মনে এখন সামান্য হলেও বিভ্রান্তি জেগেছে। মেয়েটা আজ সকালে আমাকে এক কাপ লেবুর চা বানিয়ে পড়ার ঘরে দিয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল চায়ে আর চিনি লাগবে কি না। এটা বরফ গলার লক্ষণ। ঘর থেকে যাওয়ার সময় জানাল ফেসবুকে নাকি প্রফেসর জাহিদ হেটার্স গ্রুপ খোলা হয়েছে। প্রথমদিনেই ওদের বারো হাজার সদস্য। ওই গ্রুপ পেজে নাকি আমাদের পুরো পরিবারের ছবি পোস্ট করেছে কেউ। লোকলজ্জা আর ট্রলের ভয়ে মিলি এখন বাসা থেকে বেরোচ্ছে না।

এর মাঝে আবার কাল রাতে কারা আমাদের বাসার দেয়ালে গরুর রক্ত নাকি লাল রং দিয়ে লিখে গেছে— এখানে শম্পার খুনি শান্তিতে জীবনযাপন করিতেছে।

পেঁয়াজ কুচি কুচি করে কেটে ছোট ছোট ব্যাগে ভরে আমি ডিপ ফ্রিজে রেখে দিলাম। মাছ-মাংস কিম্বা তরকারি রাঁধতে হলে রুকিমণি ফ্রিজ থেকে ছোট ছোট প্যাকেট বের করে নিতে পারবে চাহিদামতো। আজ আমি গরুর কালাভুনা রেঁধে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম কিন্তু রুকিমণি রাজি হলো না। বলল, পরেরবার দেখা যাবে।

আজ ভোরে ধুরন্ধর মারুফকেও ফোন করেছিলাম। ও কাল রাতে ব্যাংকক থেকে ফিরেছে। শম্পা মানে শ্রাবণীর সঙ্গে ওর পরিচয় কীভাবে জিজ্ঞেস করতেই সে অবাক হয়ে বলল শম্পাকে সে চিনেই না। আমি উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুই চিনিস না মানে? ফাজলামো নাকি?

সত্যি দোস্ত আমি ওই লাইনের অনেক মেয়েকে চিনি কিন্তু ওকে চিনি না।

ওই লাইনের মানে?

শম্পা তো বলল সে কর্ল-গাল। তুই বিজনেসের সঙ্গে প্লেজার মেলানোর জন্য ওকে কল করেছিলি।

আমি কল করেছি শম্পাকে?

সরাসরি রুমে নিতে লজ্জা পাচ্ছিলি। তুই নাকি চাইছিলি আমি তোকে শিল্পপতি খায়রুল আলম বলে পরিচয় দিই, আর বলি অ্যাড এজেন্সির। রোল প্লে আর কি।

কিন্তু কেন আমি সেটা করতে চাইব?

দোস্ত, প্লিজ ডোন্ট বি শাই। আমিও সুন্দরী কলগার্ল ডাকলে ওদের পাবলিক লাউঞ্জে ডিসেন্ট মেয়ে হিসেবেই সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। পারলে নিজের পরিচয় গোপন করি। তারপর তাকে অলংকারের মতো সঙ্গে নিয়ে প্রাউডলি ঘোরাঘুরি করি। তুই প্রফেসর মানুষ, সমাজে তোর আলাদা একটা ভাবমূর্তি আছে, আমি বুঝি রে। তুই নিশ্চয় বলবি না, দ্যাখো সবাই আমার সঙ্গে বাজারি মেয়ে মর্জিনা, আর আমি লুজ প্রফেসর জাহিদ। শম্পাকে পরিচয় লুকোতে বলে তুই ভালোই করেছিস দোস্ত, এটাই সবাই করে।

বুঝলাম মারুফের সঙ্গে বেশি কথা বলে লাভ নেই। সে দুই নম্বরি করতে করতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আমাকেও ওর মতো গুটিবাজ ভেবে নিয়েছে।

মারুফের কথা যদি সত্য হয় তাহলে পুরো পরিকল্পনাটা শম্পার মাথা থেকে এসেছে। র‌্যাডিসন হোটেলে আমার ড্রিংকে যেভাবে হোক শম্পা রহিপনল মিশিয়েছিল। কিন্তু সেটা এতদিন পর আর কোনোভাবেই প্রমাণ করা যাবে না।

মারুফের সঙ্গে কথা শেষে ভাবলাম, শম্পাকে তাহলে কে মারল? কেন মারল? নাকি সে অপহৃত হয়েছে? এমনকি হতে পারে কেউ ওকে কোনোভাবে ব্ল্যাকমেইল করে আমার বিরুদ্ধে কাজ করাচ্ছিল। শেষ দিকে এসে জাল গোটানোর জন্য ওকে নিকেশ করে দিয়েছে, আবার আমাকেও ফ্রেইম করেছে। শম্পা কি তাহলে নিছক খেলার পুতুল?

আমাদের সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে বিকেলবেলা সিরাজ ভাইয়ের ফোন এল। বললাম, কী অবস্থা সিরাজ ভাই?

ব্যাড নিউজ জাহিদ।

কী সেটা?

ওই দিন তোমার গায়ে যে চুল আর জামায় রক্ত পেয়েছে তার সঙ্গে ট্রাঙ্কের ভেতরের চুল, কাপড় আর দেয়ালের রক্ত সব একই মানুষের।

একই মানুষের বলতে কী? শম্পার?

তাই হবে তবে শম্পা সোহানি বলে কাউকে ন্যাশনাল আইডি ড্যাটাবেইজে সার্চ করে পাওয়া যায় নি।

মানে কী?

মানে আমি নিজেও জানি না, ওর কোনো ছবিও কোথাও নেই।

হুম।

রিয়েল ব্যাড নিউজ হলো, শম্পা সোহানির ডেডবডি তোমার অ্যাপার্টমেন্টের পেছনের ডাস্টবিনে পাওয়া গেছে। ইউনিভার্সিটির পরিচয়পত্র দেখে মৃতদেহ শনাক্ত করা হয়েছে।

আমার সারা শরীর বেঁয়ে বিদ্যুৎ বয়ে গেল। বললাম, এখন কী এই দায় আমার ঘাড়েই পড়বে?

এভিডেন্স তো তাই বলে। তোমার ঘরের রক্ত আর চুলের আলামতের সঙ্গে ডেডবডির আলামত মিলে গেছে। ওটাই তো আমাকে ওসি মকবুল জানালেন একটু আগে।

এখন?

তোমাকে হয়তো দু’ একদিনের ভেতরেই পুলিশ গ্রেপ্তার করবে। ওসি মকবুল আবার রিম্যান্ডের জন্য আবেদন করতে পারেন। তবে আমি আজই তোমার আগাম জামিন চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছি।

এখন কী উপায়? এসব কী হচ্ছে সিরাজ ভাই?

এই কেইস বেশি প্যাঁচ খেয়ে গেছে। কী হচ্ছে বোঝার জন্য গোয়েন্দা নিয়োগ করতে হবে।

গোয়েন্দা?

হ্যাঁ, তোমাকে বাঁচাতে পারে একমাত্র ইন্সপেক্টর লাবণি।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.