আমজাদ হোসেন: এক বর্ণাঢ্য চরিত্র

আমজাদ হোসেন: এক বর্ণাঢ্য চরিত্র

[বরেণ্য চলচ্চিত্রকার, অভিনেতা, নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক আমজাদ হোসেনের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। এ উপলক্ষে এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হলো। ১৯৯৯ সালে আমজাদ হোসেনের মুখোমুখি হয়েছিল অন্যদিন। নানা প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন মোমিন রহমান। এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল অন্যদিন-এর ৪র্থ বর্ষ ১৬তম সংখ্যায় (১-১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯)।]

আমজাদ হোসেন। চলচ্চিত্রকার, নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, কথাসাহিত্যিক, গীতিকার। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর অবদান সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। সামাজিক দ্বন্দ্বের অনুশীলনের ক্ষেত্রে আমজাদ হোসেনের মতো শ্রম ব্যয় করেছেন স্বল্প সংখ্যক নির্মাতাই। শিল্প ও বাণিজ্যের সহাবস্থান লক্ষণীয় তার চলচ্চিত্রে (একমাত্র ব্যতিক্রম ‘আদরের সন্তান’)। স্বাধীনতাত্তোর আমজাদের চলচ্চিত্রে স্বাতন্ত্র্য, নিজস্ব স্টাইল পরিস্ফুটিত। তার চলচ্চিত্র যথার্থই পরিচালকের চলচ্চিত্র। স্বপরিচালিত ছবির নানা ক্ষেত্রেই তাঁর সম্পৃক্ততা- কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য ও গীত রচনা করেন তিনি নিজেই। নাট্যকার হিসেবে রয়েছে তাঁর সুপরিচিতি- বিশেষত বিটিভিতে প্রচারিত জব্বার আলী কেন্দ্রিক কয়েকটি নাটকে উঠে এসেছে এদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা। একদা কৌতুক অভিনেতা হিসেবেও চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় ছিলেন। আর গল্পকার-ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি সাহিত্যের মূলধারার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে বিজড়িত। হৃদয়স্পর্শী, স্মরণীয় কয়েকটি গানের রচয়িতা হিসেবেও তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বহুমুখী প্রতিভার দ্যুতিতে উদ্ভাসিত এই সৃজনশীল ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি হই আমরা সম্প্রতি। শিল্প-সাহিত্যসহ তাঁর ব্যক্তি জীবনের নানা দিক অন্তরঙ্গ এই আলাপচারিতায় উঠে আসে।

ব্যাপারি পাড়ার সেই ছেলেটি

চল্লিশ দশকের প্রথমার্ধে জন্মেছিলেন আমজাদ। পরিবারের প্রথম পুত্রসন্তান তিনি। সেই আমলের রীতি অনুযায়ী মূল বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে পাটখড়ি দিয়ে তৈরি আঁতুড় ঘরে যেদিন তিনি প্রথম পৃথিবীর আলো দেখলেন, সুতীব্র চিৎকারে সারা বাড়ি প্রকম্পিত করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিলেন-সবার মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে গেল। মা, দাদি আর জ্যাঠির কোলে কোলে বড় হতে লাগলেন তিনি। গলার তাবিজের মতোই দাদির শরীরে লেপটে থাকতেন তিনি। বুড়ির বড়ো আদরের নাতি তিনি। ‘উঠোন’-এর প্রধান দুই চরিত্রে তার দাদা-দাদিরই ছায়া। জ্যাঠিরও ছিলেন চোখের মণি। সারা জীবন তার নানা অত্যাচার মুখ বুঁজে তিনি সহ্য করেছেন, নানা আবদার মিটিয়েছেন। এই তো গত বছর ১০৪ বছর বয়সে যেদিন তিনি মারা যান, সেদিনও পথ চেয়ে থেকেছেন আমজাদের, প্রিয় মানুষের মুখটি দেখার জন্য। পেটে না ধরলেও সন্তানের চেয়ে যাকে বেশি ভালোবেসেছেন আজীবন।

পাড়ার এক মাদ্রাসায় তার লেখাপড়ার শুরু। সেখানে হাফপ্যান্ট পরে গেলে মাওলানা সাহেব হাঁটু থেকে মারতে মারতে জখম করেছিলেন আপাদমস্তক। অতঃপর জামালপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে ভর্তি। ক্লাস ফোর-এ। এখান থেকেই লেখালেখির দিকে ঝুঁকে পড়েন। মানুষ তাকে টানত, গরিব-দুঃখী মানুষের অসহায় অবস্থা আলোড়িত করত। গাছপালা, পশু-পাখি হাতছানি দিত।

তার প্রথম প্রেম ছড়া। অজস্র ছড়া লিখেছেন তিনি। খেলাঘর, মিল্লাত, মুকুল, শুকতারায় সেইসব ছড়া ছাপা হতো। স্কুল-ম্যাগাজিনে একটি গল্প ছাপা হলো-‘জানালার ফাঁকে’। সেটি বেশ সাড়া ফেলে দেয় চারদিকে। এর কিছুদিন পরে ভারতের ‘দেশ’ পত্রিকায় কবিতা প্রকাশিত হলে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। সাহিত্যচর্চা করতেন এমন অনেকেই অভিনন্দন জানান তাকে।

ঢাকার জনারণ্যে

জামালপুর কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে ‘৫৮তে ঢাকায় আসেন আমজাদ। সম্বল বলতে ছিল হলিক্রসের বাংলার শিক্ষয়িত্রী স্মৃতির (যাকে আমজাদ ডাকতেন স্মৃতিদি) দেওয়া এক শ’টি টাকার অবশিষ্ট সাড়ে চার টাকা। কেননা এর আগে গিয়েছিলেন ময়মনসিংহে, সেখানেই খরচ করে ফেলেন সিংহভাগ অর্থ। 

পত্রালাপের সূত্রে পরিচয় ছিল ছড়াকার রফিকুল হকের সঙ্গে। প্রথমে তার ওখানেই ওঠেন-কোর্ট হাউস স্ট্রিটে জগন্নাথ কলেজের হোস্টেলে। তিনি ঈদের ছুটিতে দেশের বাড়িতে গেলে হোস্টেলেও আর থাকা গেল না-বাকিতে খাবার-দাবার সরবরাহ করতে হোস্টেল কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করায়। এরপর নাজিরা বাজারের এক বাসায় জায়গির থেকে মাস্টারি করা, নানা রকম উঞ্ছবৃত্তি করা। বহু ঘটনা।

বেতারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা

তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের সঙ্গে আমজাদের সম্পৃক্ততা পঞ্চাশ দশকের শেষ পর্যায়ে। ’৫৯ সালে অভিনেতা হিসেবে অডিশনে পাস করেন। একটি নাটকে ছোট একটি চরিত্র করেন। চার-পাঁচটা সংলাপ ছিল। এরপর নিজের লেখা ‘নদী ও মানুষ’ নাটকের প্রধান চরিত্রে ছিলেন তিনি। সেই সময় ‘দুই পয়সার আলতা’সহ বহু নাটক করেন রেডিওতে।

মোমিন: বেতারের শ্রোতা তো তেমন নেই আজকাল। বিশেষত শহরে। এই মাধ্যমটির উপযোগিতা আগের তুলনায় ক্রম হ্রাসমান...

আমজাদ: বেতারের প্রয়োজন কিন্তু রয়েছে। শহরের জন্য না হলেও গ্রামের জন্য এটি থাকা দরকার। অল্প দামের ছোট্ট একটি সেট থেকে গ্রামের মানুষরা নানাভাবে উপকৃত হচ্ছে। বিনোদন তো পাচ্ছেই। কৃষকরা কৃষি খামারে কাজ করছে এই বেতার থেকেই নানা শিক্ষা গ্রহণ করে। কাজেই বেতারের প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। আবার এটাও ঠিক যে, আগের মতো উন্নত মানের অনুষ্ঠান তেমন হচ্ছে না। বিশেষত সংগীতের জন্য এক সময়ে বেতারের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। আমাদের পুরোনো গানগুলো, লোকজ গানগুলো শোনা যেত কিংবা দেশের প্রত্যন্ত জায়গা থেকে অনেক প্রতিভাবান গায়ককে তুলে এনে তাকে দিয়ে গান করত-যা এখন আর দেখা যাচ্ছে না।

মঞ্চে পদচারণা

পঞ্চাশ দশকের শেষ পর্যায় থেকে ষাট দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বহু মঞ্চনাটক করেছেন আমজাদ। নারিন্দার মুনির হোসেন লেনের মিনারবাগ থিয়েটারের সঙ্গে  যুক্ত ছিলেন তিনি।

মোমিন: কী কী নাটকে অভিনয় করেছেন?

আমজাদ: সত্যি কথা বলতে কী, মিনারবাগ থিয়েটারের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে বহু নাটক করেছি আমরা- রক্তকরবী’, ‘দায়ী কে?’, ‘গাঁয়ের বধূ’, ‘কালিন্দী’, ‘দুই পুরুষ’, ‘মায়ামৃগ’-সহ অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেছি। আর এদেশের মঞ্চে আধুনিক নাটকের কনসেপ্ট নিয়ে আসে যে নাট্য দলটি-সেই ড্রামা সার্কেলের জন্মলগ্ন থেকে এর সাথে জড়িত ছিলাম। হাসান ইমাম, আনোয়ার হোসেন এরাও আমার সাথে যুক্ত ছিলেন।

চলচ্চিত্রে আলো-আঁধারের জগতে

আমজাদ শিল্প-সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকলেও দেশব্যাপী তাঁর প্রধান পরিচয় একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবে। চলচ্চিত্রের সঙ্গে আমজাদের সম্পৃক্ততা ডিএফপির একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘নবারুন’-এ অভিনয়ের সূত্রে। ছোট্ট একটি চরিত্রে। এরপর পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র ‘তোমার আমার’ (১৯৬১)-এ অভিনয় করেন তিনি। তবে এর আগে মুক্তি পায় ‘হারানো দিন’। এ ছবিতে এক বুড়োর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আমজাদ। এমনিভাবে বহু ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। ‘ধারাপাত’, ‘দুই ভাই’, ‘সংসার’, ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ (অসমাপ্ত)। কৌতুকাভিনেতা হিসেবে গড়ে ওঠে তার একটা ইমেজ। আর এ ক্ষেত্রে রুবিনার সঙ্গে তার একটি জুটিও গড়ে ওঠে। তবে জীবনের প্রথম গুরুত্বপূণ চলচ্চিত্র, সালাহউদ্দিনের ‘ধারাপাত’-এ তিনি ছিলেন নায়ক (উল্লেখ্য, ‘ধারাপাত’ নির্মিত হয়েছিল আমজাদের মঞ্চসফল নাটক অবলম্বনে)।

চলচ্চিত্রকার আমজাদ ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রথম নির্দেশনা দেন ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবিতে। তবে তাঁর সঙ্গে ছিলেন নূরুল হক বাচ্চু। ‘দুই ভাই’-এর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা আরও তিনজন ছিলেন পরিচালকের ভূমিকায়। একক পরিচালনায় আমজাদের প্রথম ছবি ‘জুলেখা’। এরপর তিনি নির্মাণ করেন আরও দুটি চলচ্চিত্র-‘বাল্যবন্ধু’ ও ‘পিতাপুত্র’।

মোমিন: ‘নয়নমণি’ থেকে শুরু আপনার চলচ্চিত্র জীবনের দ্বিতীয় পর্ব। ‘একটি আমজাদ হোসেন’ এই অভিধায় আপনার চলচ্চিত্রগুলি মুক্তি পায়।...আপনি কি স্বাধীনতা-পূর্বকালের ছবিগুলিকে অস্বীকার করতে চান?

আমজাদ: আগের ছবিগুলিকে অস্বীকার করছি না। আমার সেটা প্রস্তুতির সময়। চলচ্চিত্রের ব্যাকরণ শেখার সময়।

স্বাধীনতা-পূর্ব কালে এদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে আমজাদের স্মরণীয় কীর্তি হচ্ছে ‘বেহুলা’ ও ‘জীবন থেকে নেয়া’। ফোক ছবির জগতে ‘বেহুলা’ একটি মাইলস্টোন। এ ছবির সংলাপ রচয়িতা ও গানগুলির সংগ্রাহক তিনি। আর আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনে যে ছবি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেই ‘জীবন থেকে নেয়া’-র কাহিনি ও সংলাপ আমজাদের।

স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে ‘নয়নমণি’ (১৯৭৬) থেকে শুরু হয় আমজাদ হোসেনের ছবির নতুন ধারা। যেখানে তার স্বাতন্ত্র্য চোখে পড়ার মতো।

আমজাদের ছবির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়—মানুষ ও মানুষের সংগ্রাম। প্রায় সব ছবিতেই তিনি এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তার ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য-জীবন ঘেঁষা সংলাপ।

মেলোড্রামাও তার ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নির্মাণশৈলী প্রসঙ্গে বলা যায়, আমজাদ হোসেনের ছবির মানবিক বিষয় তাকে যতটা আলোচিত করেছে সেই  অনুপাতে তার প্রয়োগের ভাবনা কিংবা আঙ্গিক বোধ তেমন উঁচু মানের নয়। অবশ্য ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘ভাত দে’র বেশ কিছু অংশে চলচ্চিত্র-ভাষার প্রশংসনীয় প্রয়োগ দেখা যায়।

আমজাদের মধ্যপথের ছবিগুলি সত্তর দশকের শেষার্ধ এবং আশির দশকের প্রথমার্ধে গড়পড়তা দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করতে পেরেছিল। আমজাদ বলেন, গ্রাম প্রধান বাংলাদেশের গ্রামের ব্যাপারগুলি আমার চোখের পলকে পলকে গেঁথে আছে। জীবন দিয়ে দেখা, জানা। যেমন ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ এদেশের চলচ্চিত্রে শ্রেণি সংগ্রামের বিষয়টি প্রথম নিয়ে আসে এবং ‘গোলাপী’ একটি শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে।

হ্যাঁ, ‘গোলাপী’ এই একটি নামে একটি শ্রেণি বোঝায়-চলচ্চিত্রে এই দুঃসাধ্য যুগান্তকারী কাজটি করেছেন আমজাদ। 

মোমিন: ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’তে ক্যামেরা বারবার জুম করে জহির রায়হান ও আলতাফ মাহমুদের স্টিল ছবিকে দেখায়। কেন?

আমজাদ: ছবির নায়কের সাথে তাদেরকে একই সমতলে দেখাতে চেষ্টা করেছি। এই ছবির নায়কের মতো তারাও জন্ম থেকে জ্বলেছে; সৃষ্টির জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য তারা পুড়ে পুড়ে নিজেদের নিঃশেষ করেছে।...দু’জনেই আমাকে দুটি চোখের মতো ভালোবাসত। 

মোমিন: ‘নয়নমণি’ থেকে আপনার যে নতুন যাত্রা, নতুন আমজাদের আবির্ভাব ‘আদরের সন্তান’-এ সেই আমজাদকে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রচলিত ধারারই ছবি এটি। আপনি স্পষ্টই আপস করেছেন এখানে। কেন?

আমজাদ: আপস করব না বলে তো ছবি করাই ছেড়ে দিয়েছি। ‘আদরের সন্তান’-এর ব্যাপারটি একটি মানবিক ব্যাপার। চারজন ছেলে আমাকে অনুরোধ করল, চেপে ধরল ছবিটা পরিচালনা করার জন্য। আমারও তখন অর্থের দরকার ছিল। আমি বাণিজ্যিক ধারার এ ছবিটি করে দিলাম। তবে এখানেও নতুনত্ব আনলাম-কাঞ্চন-মৌসুমী। এর আগে মৌসুমীর সাথে কাঞ্চন ছবি করে নি। আর কাঞ্চনের সাথে মৌসুমীর ছবি করার মানে ইন্ডাস্ট্রিতে কাঞ্চনের আরও দশ বছর থাকা হয়ে গেল। 

মোমিন: বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের তো এখন দুরবস্থা চলছে। জীবনঘনিষ্ঠ শিল্পমান সম্পন্ন দূরে থাক, পরিচ্ছন্ন, নির্মল বিনোদনের ছবিও নির্মিত হচ্ছে না। এর কারণ কী?

আমজাদ: শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি সরকারের অবহেলাই এর জন্য দায়ী। আগে টিভি কিছু গান, কিছু নাটক উপহার দিত জনগণকে। এখন সেটাও পারছে না। সিনেমা হলগুলো প্রচ-ভাবে খারাপ হয়ে গেছে-পরিবেশের দিক থেকে। সিনেমা হলগুলো চলে গেছে এলাকার সন্ত্রাসীদের হাতে। সিনেমা হলে এখন একদল উচ্ছৃঙ্খল ছেলেমেয়ে ছাড়া আর কেউ যায় না। আর এখন ছবিও বানানো হচ্ছে উচ্ছৃঙ্খল মানুষের জন্য কিছু উচ্ছৃঙ্খল-অশ্লীল, চিৎকার সর্বস্ব দৃশ্য সংযোজন করে। এগুলো ছবি নয়। ছবির ব্যাকরণে এগুলি পড়ে না। 

মোমিন: প্রচলিত অনুদান প্রথাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখছেন?

আমজাদ: প্রথম থেকেই অনুদানের নীতিমালাকে আমি ঘৃণার চোখে দেখছি। আমাকে চিত্রনাট্য জমা দিতে হবে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, যুগ্ম সচিব চিত্রনাট্য দেখে বলবেন যে এটা ঠিক আছে-এই নীতিতে বিশ্বাসী নই। অনুদান থাকবে ভালো চলচ্চিত্রকারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এখনকার অনুদান সম্পূর্ণ অসফল। চলচ্চিত্রকাররা-খান আতা, চাষী নজরুল ইসলাম এঁরাও ব্যর্থ। ...অনুদানের অর্থ দিয়ে ঠিকভাবে চলচ্চিত্র যেমন নির্মাতারা করতে পারছে না, তেমনি সরকারিভাবে অনুদানের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। ভারতে সরকার যা রাজস্ব পায় চলচ্চিত্র থেকে তার অর্ধেক দিয়ে দেয় এই শিল্পের উন্নয়নে।...ভালো ছবি নির্মাণেরও সমস্যা আছে। সুনীল, তারাশঙ্কর, শীর্ষেন্দুর মতো কথাসাহিত্যিক আমাদের নেই।

মোমিন: এটা বোধহয় সত্যি নয়। শওকত আলীরই বহু গল্প-উপন্যাস রয়েছে, যেগুলিকে নিয়ে শিল্প-বাণিজ্যের সহাবস্থানে জীবনঘনিষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যায়।

আমজাদ: কিন্তু বানাবে কে? শওকত আলীর উপন্যাসের চলচ্চিত্র রূপের জন্য তো অনুদান দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কাকে? এখন যেসব চলচ্চিত্র করার অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে, সেন্সর দিচ্ছে- তা চলচ্চিত্রশিল্পকে নষ্ট করার জন্যই দেওয়া হচ্ছে। কেননা ছাড়পত্রই তো মুখ্য। সেন্সর বোর্ডই প্রধান জায়গা। সরকার সৃজনশীলতাকে সাহায্য করবে এবং অসুন্দরকে বাদ দেবে সেন্সর বোর্ড থেকে-এটাই তো কাক্সিক্ষত। কিন্তু আমরা কী দেখতে পাচ্ছি?

বোকাবাক্সে আমজাদ

টেলিভিশনকে বলা হয় বোকাবাক্স। আমজাদ এই বোকাবাক্সের জন্য এমন সব নাটক নির্মাণ করেছেন- যা দেখে মানুষ সচেতন হয়, চারপাশের পারিপার্শ্বিকতা সম্বন্ধে সঠিক বোধ জন্মে।...বিটিভির জন্মলগ্ন থেকে এর সঙ্গে আমজাদের সম্পৃক্ততা। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পটভূমিতে লেখেন- ‘রক্ত দিয়ে লেখা’। তবে টেলিভিশনে তার স্মরণীয় কাজ হচ্ছে জব্বর আলী কেন্দ্রিক নাটকগুলি।

মোমিন: জব্বার আলী কেন্দ্রিক নাটকগুলির মাধ্যমে আপনি সমাজের আর্থ-সামাজিক চিত্রটি তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সময়। যখন যে অবৈধ ব্যাপারটি সমাজকে আলোড়িত করছে, সেই ব্যাপারটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে জব্বার আলী-আদম ব্যবসা, চোরা কারবার...। প্রতিটি খণ্ডের শেষেই সে ভালো হয়ে যাবে বলে প্রতিজ্ঞা করছে, কিন্তু হচ্ছে না। কয়লার ময়লা যেমন ধুলে যায় না...।

আমজাদ: এই চরিত্রটা এরকমই। একটি চরিত্রকে সামাজিক প্রেক্ষাপটে তুলে নিয়ে আসা, সমাজের যে-কোনো অধঃপতনের দিককে তুলে নিয়ে আসা- এ চরিত্রকে কেন্দ্র করে একটা বিশাল ব্যাপার। এটাকে যদি সুসংহতভাবে বা নিয়মিত করা যেত বোধহয় ক্ল্যাসিক্যাল চরিত্রে রূপ নিত।

মোমিন: জব্বার আলী কিন্তু সমাজের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। পরিবারের সবাইকে রমজান মাসে রোজা রাখার জন্য তাগিদ দেয় অথচ সে নিজেই ঠিক মতো রোজা রাখে না।

আমজাদ: এই ডুয়েল ব্যাপারটি আমাদের দেশের অনেক মানুষের ভেতরেই আছে। নামাজও পড়ছে, ঘুষও খাচ্ছে। ভালো-মন্দ মিলিয়ে।

মোমিন: এক সময় পশ্চিমবঙ্গের দর্শক বিটিভির নাটকের অনুরাগী ছিলেন। আর এখন আমরা দূরদর্শন-জিটিভি-সনি টিভির বিভিন্ন ধারাবাহিক নাটকের দর্শক। কেন বিটিভির নাটকের এই অবনতি?

আমজাদ: আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে শিল্প-সংস্কৃতির সর্বত্র একটা বন্ধ্যাত্ব চলছে। নতুন প্রজন্মের প্রতিভাসম্পন্ন কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, অভিনেতা-অভিনেত্রী উঠে আসছে না।

মোমিন: কেন? কারণ কী?

আমজাদ: রাজনৈতিক কারণেই এমনটি হয়েছে। যে শহীদ মিনার আমাদের চেতনার উৎস, সেই শহীদ মিনারকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে কীভাবে ব্যবহার করছি? জিয়াউর রহমানের ছবি নাকি শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ওপরে টাঙানো হবে-  এখানেই তো রাজনীতি এসে দাঁড়িয়েছে। ...যে শহীদ মিনার একদা সৃজনশীলতার উৎস ছিল, সেই ধারাটি বর্বর, অশিক্ষিত রাজনীতি একেবারে আবর্জনার মতো করে ফেলেছে।

সাহিত্য-সাংবাদিকতার ভুবনে

আমজাদ হোসেন তুমুল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক নন। কেননা, তিনি সাহিত্যের মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সৃজনশীলতা থেকে কখনোই বিচ্যুত হতে চান নি। অবশ্য নান্দনিক দিক থেকে তার সাহিত্য-কর্ম খুবই উঁচু মানের একথাও সত্যি নয়। তবে সাহিত্য-মনস্ক পাঠক তার গল্প-উপন্যাসে খুঁজে পায় জীবনকে, এদেশের সমাজকে। নিজের লেখা ‘দ্রৌপদী এখন ট্রেনে’ (চলচ্চিত্র: ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’) এবং ‘নিরক্ষর স্বর্গে’ (চলচ্চিত্র: নয়নমণি) অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন স্বয়ং। তার লেখা গল্প ‘টেলিফোন খেলা’ ও উপন্যাস ‘অস্থির পাখিরা’র টিভি নাট্যরূপ দেওয়া হয়েছে।

মোমিন: চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে সাহিত্য কিংবা সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে চলচ্চিত্রের কথা ভেবেছেন কি? অন্য কথায় আপনার চলচ্চিত্রে সাহিত্য, সাহিত্যকর্মে চলচ্চিত্র প্রভাব ফেলে কি?

আমজাদ: হ্যাঁ, প্রভাব ফেলে।

মোমিন: আপনার ‘যুদ্ধে যাব’ উপন্যাসে এই নষ্ট সময়ের চিত্র এঁকেছেন। তবে ডিটেলসে তা ফুটে ওঠে নি বলে শেষ পর্যায়ে যখন মুক্তিযোদ্ধা-নায়ক বলে ওঠে, ‘আরেকটি যুদ্ধ চাই’-তখন সেটি আরোপিত মনে হয়।

আমজাদ: আমি স্বীকার করছি। এর কারণ হলো পশ্চিমবঙ্গে ‘দেশ’ ও অন্যান্য পত্রিকায় সুনীল, শীর্ষেন্দু যে ডিটেইল ওয়ার্ক করতে পারছে- আমাদের এখানে সেই সুযোগ কোথায়?

এখনকার উপন্যাসের যে গভীরতা কম- এর কারণ হিসেবে আমজাদ লেখকদের বাণিজ্যিক মনোবৃত্তিকে দায়ী করলেন। ঈদকে সামনে রেখে তাড়াহুড়ো করে যে উপন্যাসটি লেখা- সেই উপন্যাসটি সংশোধন, বর্জন, সংযোজন ছাড়াই বাজারে চলে যাচ্ছে। ফলে বঞ্চিত হচ্ছে পাঠকরা। উপন্যাসে গভীরতা খুঁজে না পেয়ে হতাশ হচ্ছে।

মোমিন: ‘মাধবী সংবাদ’ উপন্যাসে আপনি চলচ্চিত্রের নায়িকাদের অন্ধকার দিক ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু পরিচালক ও প্রযোজকদের নেতিবাচক ব্যাপার-স্যাপার সেভাবে আসে নি। কেন?

আমজাদ: ‘মাধবীর মাধব’ পড়লে দেখবেন আপনার অভিযোগ সত্যি নয়। আর ‘মাধবী সংবাদ’ লেখা হয়েছিল এ কারণে যে, আমাদের সংস্কৃতিচর্চার এই জগতটি পরিশুদ্ধ হবে, সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হবে এখানে। কিন্তু তা হয় নি। আমাদের মেয়েরা (নায়িকা) যে শিক্ষিত হতে চায় না। প্রম্পটা করতে হবে-নইলে হবে না। শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ নেই। ‘চন্দ্রনাথ’-এর সরযু সে কি শরৎচন্দ্র না পড়ে করতে পারবে? কিন্তু তারা তো পড়বে না (আগে কিন্তু নায়িকারা ঠিকই পড়ত। তারা চরিত্রটা সম্পর্কে পরিচালক-চিত্রনাট্যকারের অভিমত জানতে চাইত, মেকাপ-গেটাপের বিষয়ে খোঁজ খবর নিত)। তারা কী করবে? সারারাত ঘুমাবে, পরের দিন সেই যুগের পোশাক একটু পরে দেখার  চেষ্টা করবে এবং সেটে গিয়ে পরিচালককে বলবে, ‘বলুন, সংলাপ বলুন।’...ইদানীং এডিটিং রুমে ঢুকতে গিয়ে অবাক হয়ে গেছি-সবাই জুতা পায়ে ঢুকছে। আগে কেউ জুতা পায়ে ঢুকতে পারত না। একটা পবিত্র জায়গা ছিল এডিটিং রুম।

আমজাদ ষাট দশকে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ‘চিত্রাকাশ’, ‘রূপবাণী’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘চিত্রালী’তে একটি কলামও লিখতেন।

গানে গানে জীবনের জলছবি

আমজাদ হোসেন। একজন গীতিকারও। ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত’, ‘কেউ কোনোদিন আমারে তো কথা দিল না’র মতো হৃদয়স্পর্শী গানের লিরিক তার হাত দিয়েই বেরিয়েছে। প্রথম গান লিখেন ‘ধারাপাত’ ছবিতে- ‘চাঁদ বুঝি কখনো দেখি নি’। সিরিয়াসলি লিখতে শুরু করেন ‘নয়নমণি’ থেকে। নিজের ছবি তো বটেই, অন্যের ছবিতেও- ‘বড় বাড়ির মেয়ে’, ‘রাই বিনোদনী’র  জন্য গান লিখেছেন।

মোমিন: আপনার গান তো এদেশের শ্রোতারা সাদরে বরণ করে নিয়েছেন। তারপরেও আপনি গান লিখছেন না কেন?

আমজাদ: গান তারাই লিখতে পারে যাদের কবিতার উপর দখল আছে। এবং কবি হলে হয় কী, শব্দচয়ন সুন্দর হয়। আমার গান লেখার ইতিহাস হচ্ছে- সিচুয়েশন অনুযায়ী গীতিকাররা যখন লিখতে পারেন নি, বাধ্য হয়ে আমাকে লিখতে হয়েছে। আমার চলচ্চিত্র ছাড়া বাণিজ্যিক ছবির গান লিখতে আমার ভালো লাগে না। তাই লিখতে যাইও না।

মোমিন: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?

আমজাদ: চলচ্চিত্রে যে-টুকু পেরেছি, করেছি। শেষ জীবনটা সিরিয়াসলি সাহিত্যের কাজ করতে চাই। সাহিত্য নিয়ে শুরু করেছিলাম, সাহিত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেই মরে যাব।

Leave a Reply

Your identity will not be published.