উতল হাওয়া (পর্ব ১১)

উতল হাওয়া (পর্ব ১১)

[শহিদ হোসেন খোকন দীর্ঘদিন ধরে গল্প লিখছেন। এই প্রথমবারের মতো তিনি উপন্যাস লিখলেন। এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে অগ্নিঝরা একাত্তর, সেই সময়ের রাজনৈতিক আবহাওয়ার উতল হাওয়া। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের পটভূমিতে এই উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের প্রধান জাতীয় নেতৃবৃন্দ, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টোসহ আরও অনেকে। আজ পড়ুন ১১তম পর্ব...]

মুজিব স্নান সেরে দৈনিক পত্রিকা নিয়ে নাস্তার টেবিলে বসলেন। প্রথমে ইত্তেফাকের হেডলাইনগুলো দেখলেন। ২৫ শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান, আওয়ামী লীগ কমিটির জরুরি বৈঠক, জাতির উদ্দেশে প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের বিবরণ। সুর খান বলেছেন ‘আইনত শেখ মুজিবই দেশের শাসন পরিচালনার অধিকারী’। প্রেসিডেন্টের মন্তব্যে দুঃখ প্রকাশ; অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিবন্ধকতা দূর করার আহ্বান। একটি ছোট বক্স নিউজে মুজিবের চোখ আটকে গেল— ‘গভর্নর পদে লেঃ জেঃ টিক্কা খান’। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেছেন।

টিক্কা খানকে গভর্নর নিযুক্ত করা মানে হলো পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমারা সামরিক অভিযান চালাবে, বেলুচিস্তানের মতো এখানেও একটা বড় রকমের গণহত্যা সংগঠিত হবে। টিক্কা খানকে গভর্নর বানিয়ে আবার ২৫ শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করার মানে কী? প্রেসিডেন্ট কি একটা ধাপ্পাবাজির খেলা খেলছে? আচ্ছা এমন কি হতে পারে না যে- ইয়াহিয়া আসলে শেখ মুজিবকে ভয় দেখানোর জন্যে এসব করছে? হয়তো শেষ মুহূর্তে একটা আপস-রফা হবে।

যদি না হয়? যদি টিক্কা সত্যি সত্যি সামরিক অভিযান চালায়? যদি বড় ধরনের ক্র্যাক ডাউন হয়? তাহলে কীভাবে ওদের প্রতিরোধ করবেন? সেই প্রস্তুতি কি তার দল কিংবা সাধারণ মানুষের আছে? সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে খালি হাতে মানুষ কি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে? দলের নেতা কর্মীদের যদি ধরে ধরে মেরে ফেলা হয়? তাহলে কে দেবে নেতৃত্ব? মানুষের মনে স্বপ্নের বীজ আর স্বাধিকারের আন্দোলনের যে আলো তিনি জ্বালিয়ে দিয়েছেন সেই আলো যদি নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়? তাহলে নিভে যাওয়া আলোকে আবার কবে কে জ্বেলে দেবে? আজকের ভাষণে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের একটা রূপরেখা থাকা দরকার। 

ঠিক এ মুহূর্তে সমস্ত নীরবতা ভেঙে লিভিং রুমের টেলিফোন বেজে উঠল। আজকাল ফোন বাজলে বুকের ভেতরে কেমন ঘণ্টা বাজানোর শব্দ হয়। এই বুঝি কোনো দুঃসংবাদ শুনতে হয়। বিগত দিন মাস ধরে চলা এই গণআন্দোলনে ভালো কোনো খবর নেই। মুজিব ভাবলেন ইয়াহিয়া বুঝি আবার ফোন করেছে কিন্তু নেশা-ভাং করা লোকের এত সকালে ঘুম ভাঙার কথা না।

গতকাল ইয়াহিয়া ইনিয়ে-বিনিয়ে এইটা বলার চেষ্টা করেছেন যেন স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া না হয়। বলেছেন এমন কিছু যেন না হয় যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব না। শুধু টেলিফোন করেই ইয়াহিয়া ক্ষান্ত হয় নি পরে এক ব্রিগেডিয়ারকে দিয়ে তিনি একটা বার্তাও পাঠিয়েছেন- ‘অনুগ্রহ করে কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি শিগগিরই ঢাকায় আসছি এবং আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করব। আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি, আমি আপনার আকাঙক্ষা এবং জনগণের প্রতি দেওয়া আপনার প্রতিশ্রুতির পুরোপুরি মর্যাদা দেব। আমার কাছে একটি পরিকল্পনা আছে- যা আপনার ছয় দফা থেকেও আপনাকে বেশি খুশি করবে। আমি সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, কোনো দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না।’

ফোন করছেন আমেরিকার অ্যাম্বেসিডর মিস্টার ফারলেন্ড। তিনি শেখ মুজিবের সাথে দেখা করতে চান ১১টায়। মুজিব সায় দিলেন, তিনি জানতেন ফারলেন্ড শেষ মুহূর্তে তার সাথে দেখা করবে। ফারলেন্ড কী বলবে সেটাও তিনি জানেন। আমেরিকার যা গণতন্ত্র সে কেবল তাদের দেশে, দেশের বাইরে গণতন্ত্র নিয়ে তারা মাথা ঘামায় না। যদিও মুখে মুখে তারা বলে তারা গণতন্ত্রের ধ্বজাধারি কিন্তু ফরেন পলিসিতে নিজেদের স্বার্থের বাইরে অন্য কিছু চিন্তা করে না। নইলে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে আমেরিকা কি করে সাপোর্ট দেয়। ভিয়েতনামের গণতন্ত্রকামী মানুষকে ঠান্ডা মাথায় কী করে খুন করে?

হাসুকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে মুজিব একটু অবাক হলেন। তার বড়মেয়ে হাসিনাকে হাসু বলে ডাকেন। হাসিনা চার মাসের প্রেগন্যান্ট, এখনই গালটাল ফুলে কি রকম হয়ে গেছে। চেহারায় কী রকম একটা মা মা ভাব চলে এসেছে। মুজিব বললেন, আয় মা আয় আমার পাশে আইসা বস। এত তাড়াতাড়ি উঠলি কেন? আরেকটু ঘুমাইতে পারতি।

এত টেনশন নিয়ে কি ঘুম হয় নাকি বাবা?

তুই এত টেনশন করছিস কেন। আমরা তো আছি। আমরা সবাই মিলে সব ঠিক করে ফেলব। কোনো চিন্তা করবি না।

চিন্তা হয় বাবা, অনেক চিন্তা হয়। তোমার জন্য আমার অনেক চিন্তা হয়। রাতে আমি চিন্তায় ঘুমাতে পারি না। আমি স্বপ্নে দেখেছি, পাকিস্তানি আর্মিরা রাস্তায় ট্যাঙ্ক নামিয়ে মানুষ মারছে। বহু বাড়িঘরে আগুন লাগিয়েছে। আমাদের এই বাড়িতেও ওরা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। তারপর মেশিনগানের গুলি... শেখ মুজিব বিষয়টিকে হালকা করার জন্যে হাসতে হাসতে বললেন, কী যে হাবিযাবি স্বপ্ন দেখিস!

না বাবা না, একদম দিনের মতো স্পষ্ট। ওরা আমাদের বাসায় আগুন লাগিয়েছে। আমরা সবাই বেরোনোর জন্য ছটফট করছি, বেরুতে পারছি না। ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে বাবা, বাবা ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে...

হাসু চিৎকার করে কাঁদছে। হাসুর কান্না শুনে ঘুমিয়ে থাকা শেখ মুজিবের অন্য সব ছেলেমেয়ে- জামাল, কামাল, রেহানা- সবাই ডাইনিং টেবিলের কাছে ছুটে এল। সবাই দেখল বাবার কাঁধে মাথা রেখে তাদের হাসু আপা কাঁদছে। আর বাবা মেয়েকে আদর করতে করতে বলেছেন, আমার কিছু হবে না রে পাগলি, কারও কিছু হবে না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ভয় পাবি না, আমি তো আছি। আই উইল ফিক্স এভরিথিং। আমার নাতিটির নাম কী ঠিক করেছিস?

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মুজিবের স্ত্রী রেণু বলল, নাতি যে হইব আপনে কেমনে জানেন? নাতনিও তো হইতে পারে।

মুজিব জোর বললেন, না নাতি হইব। নাতির নাম রাখা হয়ে জয়...জয়বাংলা।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.