সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (পর্ব ১৩)

সার্বিয়া: শুভ্র শহরের দেশে (পর্ব ১৩)

[কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা বা ঘোরাঘুরি— এসব ক্ষেত্রে ভ্রমণপিপাসু বেশির ভাগ মানুষের ঝোঁক পশ্চিম ইউরোপের দিকে। অথচ পাহাড়-নদী-প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিখ্যাত পূর্ব ইউরোপও। যেখানে রয়েছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাস্তবধর্মী পাঠ। এমনই এক দেশ সার্বিয়া। ভ্রমণের বহুরৈখিক পথে লেখকের কাছে নতুন উপজীব্য হয়ে ওঠে সার্বিয়ান এক তরুণী। ঠিক প্রেম নয়, প্রেমের চেয়ে কম কিছুও নয়। পার্থিব দৃশ্যপটের সঙ্গে উঠে এসেছে রোমান্সের হৃদয় ছোঁয়া-না ছোঁয়ার গল্পও। যার পুরো বর্ণনা থাকছে ইমদাদ হকের এই ভ্রমণকাহিনিতে। আজ পড়ুন ১৩ তম পর্ব।]

প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব ষষ্ঠ পর্ব 

সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব পর্ব ১১ পর্ব ১২

দানিউব ও সাভা নদীর রহস্য

নদীর দুই তীরজুড়ে ঘন গাছপালা। আরেকটু দূরে এগোলে জনমানবহীন জঙ্গল। তবে জঙ্গলের মাঝে মাথা উঁচু করে কোথাও কোথাও দাঁড়িয়ে বাণিজ্যিক কিছু ভবন। গাছপালার পাতার ফাঁকে কিছুক্ষণ পরপর পাখির ডাক, সেই সঙ্গে নাম জানা, না জানা বিভিন্ন গাছের উপর দিয়ে বয়ে চলা সুবাসিত বাতাস মন জুড়িয়ে দেয়। প্রকৃতিতে তখনো বৃষ্টির রেশ। ভারী হয়ে আছে আকাশ, ভারী চারপাশও।

প্রকৃতিতেই আমার মনোযোগ। ছেদ পড়ে মিলিচা ক্রিভোকাপিচের ডাকে।

কফি চলবে?

শিউর।

বৃষ্টির এই ঠান্ডাক্ষণে সময়োপযোগী অফার। লুফে নিই। কফি আসতে সময় লাগে ১০ মিনিটের মতো। আমি প্রকৃতি দেখি। এই নীরব প্রকৃতি আকর্ষণের। পুরো জগতজুড়ে যেন নীরবতা। ক্লান্তিময় দিনের ব্যস্ততা শেষে এমন শীতলতাই কাম্য।

‘আকাশের রং বোঝা দায়। ক্ষণে ক্ষণে তার রূপের বদল। বৃষ্টি শেষে ঝরঝরে আকার রূপ নিচ্ছে। আকাশটাও যেন জগতের সব নীল রং পান করে উপচে দিয়েছে। আজ তার দেওয়ার দিন। নদী তীর, তীরের জঙ্গল, গাছপালা, বনভূমি, লোকালয় আজ সব নিশ্চুপ। এদিন কাউকে দেখার জন্য উন্মুখ। নদীর বুকে ছন্দহীন তাল-লয়ে বয়ে যাওয়া পানির প্রবাহ।

অসাড় হয়ে পড়া এই নদীই এনে দেয় একটা নিঃশব্দ দিনের কোমলতা। পূর্ণ হয় মনোবাসনা, নদীর কাছে যাওয়ার বা না যাওয়ার যে আকুলতা, তা ভাসে শ্রাবণের শেষ বাতাসে। প্রতিধ্বনিত হয় সব পারাপারে।

এ ঘোর কি আদৌ কাটবার? আমি কি সার্বিয়ার শীতে নির্জীব গাছের মতো প্রাণহীন হয়ে যাচ্ছি? তাহলে এই যে, শিস দিয়ে ডেকে যাওয়া, অনন্তকাল ধরে বয়ে যাওয়া দানিউবের গল্প কীভাবে বলব? সাভার প্রকৃতি তুলে ধরব কীভাবে? ক্রিভোর ছায়াপ্রেমকে কোথায় রাখব?

বেলগ্রেডে আসার পর দানিউব-সাভার রাজত্ব টের পেলাম। শহরের যে প্রান্তেই যাই, ঘুরে ফিরে এদিক-ওদিক, সব দিকেই দানিউবের রেখা। পাহাড়, বন, জঙ্গল, উঁচুনিচু-সমতল ভূমির পথে বয়ে চলেছে। বয়ে চলেছে অবিরত এক নদী, যার নাম দানিউব। যে নদীর অববাহিকায় রয়েছে অন্তত ১০টি দেশের রাজধানী শহর। সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড, হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট, অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাসহ ব্রাতিস্লাভা, বুখারেস্ট, সোফিয়া, জাগরেব, লুব্লজানা, সারাজেভো এবং প্রিস্টিনা সবগুলোই একেকটি রাজধানী। দানিউবের অববাহিকায় অবস্থিত চতুর্থ বৃহত্তম শহর মিউনিখ, বাভারিয়ার রাজধানী ইসার এই নদীর ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

নদীর দুপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তা। হালকা যানের থেমে থেমে চলাচল। গাড়ির চাপ নেই খুব একটা। নদীর দুপাশ এত শক্ত করে বাঁধাই করা, প্রবল স্রোতের বন্যায় বাঁধ ভাঙার কোনোই আশঙ্কা নেই। অদূরে একটি সেতু, যা পুরাতন বেলগ্রেডের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে নতুন বেলগ্রেডকে।

এ নদী, ভাববাদের নদী। এ পরিবেশ, প্রেমকে জাগ্রত করার পরিবেশ। ভালোমন্দের মিশেলে মনে প্রকট দ্বন্দ্ব।

ক্রিভোকাপিচকে কি পাত্তা দিচ্ছি না?

কী জানি, হবে হয়তো! এত সুন্দরী রমণী। কীই-বা লাভ দুদিনের সখ্যে? আমার ভাবুক চেহারা ধরা পড়ে তার রাডারে। নদীর প্রতি ভালোলাগার কথা শোনায় সেও। সমুদ্র তার পছন্দ। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তার সমুদ্রস্নান সহজ হয়ে ওঠে না, দানিউব-সাভাই তার ভরসা।

পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল কয়েকটি স্থানে। সেসবের মধ্যে দানিউবের উপত্যকা অন্যতম। পৃথিবী বিখ্যাত বিভিন্ন গল্পে, কবিতায় যে নদীর উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি, সেটা দানিউব।

ইতিউতি দেখে নদীর তীরে নামতে চাই। নদীর পানি থেকে অন্তত ৩০০ ফুট ওপরে আমাদের রেস্টুরেন্ট। ক্রিভোকাপিচ না করল। ঠান্ডার মধ্যে তাল রেখে নিচে নামাও কঠিন। এই নদীর তলদেশ থেকে ওপরের পাড় পর্যন্ত রকমভেদে নানা রকম কনক্রিটের আস্তরণ। এখানে সবুজ ঘাস নেই, নেই কাদা জল। আবার গাছ আছে, ঘন জঙ্গল আছে। আমার প্রাণের বাংলার নদীরূপের সঙ্গে কিছু মেলে, অনেক কিছু মেলে না।

এই নদী শীতকালের নদী। আমার বাড়ির পাশে বয়ে যাওয়া বড়াল নদীর মতোই। বড়াল নদীতে ভাটার টান আছে। কাদা, জল আছে। নদীর দু’পাশে জঙ্গল আছে। রহিমা, শাহানারা, আক্কাছ আলীদের ঘামে গজে ওঠা শিমের বাগান আছে, বেগুনের খেত আছে। সোঁদা মাটির গন্ধে পরম মমতা আছে। বিদেশের নদীতীরে বসে ভাবি, কেন আগে আরও মমতা নিয়ে বাংলার পথে-প্রান্তরে ঘুরি নি। বাংলার নদীতীরের তরমুজের খেত, কাশবনে এই যে মায়া, এত জাদু, তা কি পৃথিবীর অন্য কোথাও কি আছে? নেই। দানিউব-সাভা যত বড়ো নদীই হোক, যতই ঐতিহ্য-ইতিহাস থাকুক, তা কি বাংলার পলিমাটিতে ভরাট হওয়া নদীর মতো এত মায়াজাল তৈরি করতে পারে? আমাদের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, আমাদের বড়াল বা বুড়িগঙ্গাই কম কীসে?

দানিউবের ইতিহাস আছে, আছে শাখা-প্রশাখা। প্রায় ৩০০-র মতো উপনদী আছে দানিউবের। এদের মধ্যে ৬০টি নৌপরিবহনের অনুকূল। দানিউব নদীর উপত্যকার আয়তন প্রায় ৭ লাখ ৭৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। বিশাল এই উপত্যকার অস্তিত্ব জার্মানি, অস্ট্রিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, স্লোভেনিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, ও ইউক্রেন জুড়ে। দানিউব প্রায় ২ কোটি মানুষের পানীয় জলের উৎস।

ক্রিভোর সঙ্গে তখনো ছোটোখাটো কথা। বেশির ভাগই হু, হ্যাঁ। তার ফোন বেজে ওঠে, কানে ধরে উঠে পড়ে সে। নদীর ওপাশে তাকাই। পাইন গাছের দীর্ঘ সারি। প্রাচীনকাল থেকে দানিউব সমগ্র ইউরোপের একটি ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্য পথ। এ নদী জলবিদ্যুতের বড়ো উৎস।

ভাবনার জটে বাঁধা পড়ি। আমাদের নদীর মায়া আছে, জাদু আছে। কিন্তু পেটে ভাত না থাকলে রোমান্স থাকে কতক্ষণ? এই যে, বাংলাদেশে বড়োছোটো সব মিলিয়ে সাড়ে ৭০০ নদী আছে। আমরা কি তার যথাযথ ব্যবহার করতে পারছি? অথচ নদীর সঙ্গে আমাদের কত সখ্য। জীবন-প্রকৃতি বাঁচানোর জন্য নদী বাঁচানো দরকার। নদীপথের যোগাযোগে খরচ কম ও জ্বালানিসাশ্রয়ী। এটা পরিবেশবান্ধব ও দুর্ঘটনামুক্ত, তুলনামূলক নিরাপদ। আমাদের রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা উন্নয়নের জন্য কত কিছু করছেন, কত ভাবছেন। নদী নিয়ে তারা কবে ভাববেন?

দানিউব নদীর জলপথ, অর্থাৎ প্যান-ইউরোপিয়ান করিডর-৭-কে ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবহণ করিডর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ বাংলাদেশের চিত্রটা ভিন্নরকম। ব্রিটিশ আমলে আমাদের দেশে নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল ১৪ হাজার ৩৮ কিলোমিটার। দুই হাজার কিলোমিটার কমে পাকিস্তান আমলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ হাজার কিলোমিটার, শুকনো মৌসুমে যা দাঁড়ায় ৮ হাজার কিলোমিটারে। ১৯৮০-এর দশকের শেষ ভাগে পানির মৌসুমে নৌপথ ছিল পাঁচ হাজার ৯৬৮ কিলোমিটার, আর শুকনোর সময় তিন হাজার ৬০০ কিলোমিটার।

কফি শেষ করে আসে ক্রিভো। বাংলাদেশের নদী নিয়ে আক্ষেপ শোনাই তাকে।

‘বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে ৩৭ শতাংশ মালামাল পরিবহণ করা হতো নদীপথে। তখন ১৬ শতাংশ যাত্রী নৌপথে যাতায়াত করত। এখন তা কমে মালামাল পরিবহণ দাঁড়িয়েছে ১৬ শতাংশে, আর নৌপথের যাতায়াত আট শতাংশে।’

নদীর প্রতি ভালোলাগার কথা শোনায় ক্রিভো। তার পছন্দের নদী এই দানিউব আর সাভা। বাংলাদেশের নদনদীর হতাশা তাকে ছোঁবে কীভাবে?

‘পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশের অধিকাংশ ভূমি গঠিত পলিমাটি দিয়ে। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জমা হচ্ছে কিছু পলি, সেখানে মহাকালের ধারাবাহিকতায় জেগে উঠছে নতুন নতুন ভূমি। সন্দ্বীপ-হাতিয়া থেকে সুন্দরবন পুরো এলাকাতেই জাগছে বড়ো বড়ো চর। বড়ো হচ্ছে বাংলাদেশের ভূমি সীমানা। আবার বাঙালির ইলিশ নিয়ে, ইলিশের রসনা বিলাস নিয়ে কত গল্প-কবিতা হয়েছে, তা কি গুনে শেষ করা যাবে? আমরা যদি একটু মনোযোগী হই নদীর দিকে, আমাদের নদীর দিকে, আমরা বাঁচব, অস্তিত্ব শক্ত হবে পরের প্রজন্মের। মহাকালে শক্ত ভিত হবে বাংলাদেশের।’

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আসি। দানিউব-সাভার তীর ধরে হাঁটি। কখনো গাড়ি শাঁ করে চাকা ঘুরায় নদীর তীর ধরে বেয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা সড়কে। তীরের ধারে ছোটো-বড়ো, মাঝারি সাইজের ঘরবাড়ি। লোকজন হাঁটছে ফুটপাত ধরে। তাদের সুশৃঙ্খল হাঁটা। কিছু খাবারের দোকানও খোলা। চা-বিস্কুটের কয়েকটা দোকান, ঢাকার টং দোকানের মতো। জঙ্গল আর গাছপালা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। মাঝেমধ্যে পাখির ডাক। বৃষ্টিস্নাত পরিবেশে কি পাখি ডাকে? কী জানি? তবে আছে শিরশিরে বাতাস। আকাশে সূর্যের দেখা নেই।

শীতকালে যখন তাপমাত্রা মাইনাসের নিচে থাকে, তখন দানিউবের বড়ো একটা অংশ বরফে পরিণত হয়। বরফের আঘাতে টাইটানিক ডুবে গিয়েছিল, এটা সবার জানা। কিন্তু গভীরতা সম্পন্ন একটি চলমান নদীও যে শক্ত বরফে পরিণত হতে পারে— তা বিস্ময়ের। যেখানে গ্রীষ্মকালে মানুষ গোসল ও অবিরাম সাঁতার কাটে, সেই নদী সম্পূর্ণ বরফে পরিণত হয়েছে, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করাও কঠিনই বটে! দানিউব নদীর বরফ হওয়ার সুযোগ কাজে লাগায় স্কেটিং-প্রিয় ছেলেমেয়েরা। তারা স্কেটিং শু পরে নেমে পড়ে স্কেটিংয়ে।

রাত হলেই নদীর বুকে জেগে ওঠে জেলেদের ভেলার মতো ভ্রাম্যমাণ ক্লাববোট। এগুলো অনেকটা কাশ্মীরের বোট হাউজের মতো। টার্বো ফোক পারফরম্যান্সের সঙ্গে সঙ্গে রাতের খাবার ও পানীয়ের জমজমাট আয়োজন হয় এসব বোটে।


বেলগ্রেডের কেন্দ্রে দানিউবের সঙ্গে মিলিত হয়েছে সাভা নদী। দানিউব-সাভা নদীর মিলনে যে মোহনা গড়ে উঠেছে বেলগ্রেডে, তা সমগ্র ইউরোপের সবচেয়ে রোমান্টিক দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি। ইউরোপজুড়ে দানিউব নদী যেমন, যুগোস্লাভিয়ায় প্রবেশের সময় সাভা নদী অনেকটা তেমন রূপ লাভ করে। সাভা প্রায় ৯৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ, যার মধ্যে ৪৫ কিলোমিটার সাভা ডলিঙ্কা হেডওয়াটার জেলেনসি, স্লোভেনিয়ায় উঠছে। জলের আয়তনের দিক থেকে এটি দানিয়ুবের বৃহত্তম উপনদী। সাভা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারী জনসংখ্যা ৮০ লাখেরও বেশি।

পৃথিবীটা সুন্দর, সুন্দর এর প্রকৃতি। ঘুরে বেড়ালে মনের দৃষ্টি বড়ো হয়। কিন্তু ঘোরাঘুরির জন্য সময় বেঁধে দেওয়াটা কেমন বেখাপ্পা না? রেস্টুরেন্টে ফিরতে হবে। মোবাইল ফোন বের করি, টপাটপ কয়টা ছবি তুলে রাখি। স্মৃতির খাতা বড়ো হোক। 

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.