শম্পা কী চায়? (পর্ব ১৭)

শম্পা কী চায়? (পর্ব ১৭)

[থ্রিলার উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রতি পদে রহস্য ও রোমাঞ্চের হাতছানি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার জাহিদ আহমেদ। ঢাকার রেডিসন হোটেলে শম্পা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানের একটি রুমে শম্পার সঙ্গে যাওয়ার পর কী ঘটে, তা জাহিদের মনে নেই। এরপর শম্পা জাহিদের ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির ছাত্রী সেজে তার পিছু নেয়, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওর ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং করতে থাকে...। এক সময় শম্পা খুন হয়। কে খুন করল শম্পাকে? জাহিদ আহমেদ নাকি অন্য কেউ? নাকি অন্য রহস্য জড়িয়ে আছে এখানে? আজ পড়ুন ১৭তম পর্ব।]

প্রথম পর্ব  দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব 

ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব  

পর্ব ১১ পর্ব ১২ পর্ব ১৩ পর্ব ১৪ পর্ব ১৫ পর্ব ১৬

হালের জনপ্রিয় কবি আলেকজান্ড্রা ভাসিলু গত নভেম্বরে একটা বেস্ট সেলার কবিতার বই বের করেছেন। বইটির নাম be my moon, মানে ‘আমার চান্দু হও’। এই বইয়ের একটা কবিতার দুটো লাইন পড়ি, শোন—

all I want is to chase

beautiful dreams

With you.

I want to catch

tiny stars

for you

and display them

in your hair

like beautiful tropical flowers

মাত্র ছ’ মাস আগে লেখা কবিতা কিন্তু আমি এর অনুবাদ করব না, কেন করব না বলো তো বিলকিস?

আপনার এখন মুড নাই, সে জন্য স্যার? আমি অনুবাদ করে দিব স্যার?

না বিলকিস, আমাকে অনুবাদ করে দেওয়ার অনেক সুযোগ আসবে তোমার জীবনে। বাকি সুন্দরী বিদুষীরা, সুযোগ তোমাদেরও আসবে। আমি ভাসিলুর কবিতাটা অনুবাদ করব না কারণ ওনার এগারো লাইনের কথাগুলো প্রায় তিরানব্বুই বছর আগে মাত্র এক লাইনে লিখে গেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। উনি বলেছেন,

মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেব খোঁপায় তারার ফুল

তারা আছে, খোঁপা আছে, প্রিয়া আছে, ফুল আছে, স্বপ্নমাখা আহ্বান আছে, অথচ কত সংক্ষেপে। এখন বলো নজরুলের এই গানের পরের লাইন কী?

অন্যরা বলার আগেই মেঘলা তাড়াহুড়া করে বলল, কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দুল

ঠিক, অথচ এই কথা বলার জন্য আলেকজান্ড্রাকে লিখতে হলো আরেকটা আস্ত কবিতা,

For you

I will hunt down the moon,

I will catch it

And offer it to you

As a diamond on your ring finger

এটাই নজরুলের প্রতিভা, বুঝেছ? আমি ইংরেজি সাহিত্য পড়ালে কী, বাংলা সাহিত্যেও ছড়ানো আছে অনেক মণিমুক্তো আর হীরে জহরত।

লাজুক মেয়ে সালমা হঠাৎ প্রগলভ হয়ে বলল, কিন্তু স্যার, আলেকজান্ড্রার কবিতায় কানের দুল হাতের আংটি হয়ে গেছে।

হুম, তোমার কী পছন্দ সালমা, দুল নাকি আংটি?

আমার দুল পছন্দ, স্যার।

আচ্ছা, মনে রাখলাম। তোমার বাঁশপাতার মতো পাতলা কানের লতিতে তৃতীয়া তিথির চাঁদের মতো দুল ভারি সুন্দর মানাবে।

সালমা লজ্জা পেয়ে লাল হয়ে গেল।

লালমাটিয়া মহিলা কলেজের জুম লেকচার শেষ করে প্রফেসর রান্নাঘরে এলেন। আজ লেকচারের পর প্রফেসর গরুর মাংসের কোর্মা রাঁধবেন বলে রেখেছেন। কিন্তু প্রফেসর রান্নাঘরে এসে দেখলেন পেঁয়াজ, মাংস কেটে, হলুদ, মরিচ, আদা, রসুন, জিরার গুঁড়া পরিমাণ মতো একটা বাটিতে আর তেজপাতা, এলাচ, লবঙ্গ আরেকটা বাটিতে রেখে রোকসানা সব কাজ এগিয়ে রেখেছে। প্রফেসরকে যেন শুধু লালফিতা কেটে রান্নার উদ্বোধন ঘোষণা করতে হবে। প্রফেসর খুশি হয়ে বললেন, ম্যানি থ্যাঙ্কস রুকিমণি, এত কিছু তোমার করা উচিত হয় নি।

রোকসানা টক দই এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, তোমার লেকচার শুনছিলাম। মাঝে মাঝে ভুলেই যাই যে আমিও ইংরেজি সাহিত্য পড়েছি। তোমার ভরাট কণ্ঠে আলেকজান্ড্রা ভাসিলুর কবিতা শুনে এত ভালো লাগল! আমার রিনরিনে গলায় ওনার একটা কবিতা তোমাকে শোনাতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে, শোনাব?

প্রফেসরের মনে পড়ল, মুন্সিগঞ্জের দুঃসময়ের পর উনি জগন্নাথে এলেন। সেখানে আরেক কলিগের ছোট বোন ছিল রোকসানা, ওর নিজের ছাত্রী। সেই কলিগ একদিন বোনের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এল। প্রফেসর আগপাশ না ভেবেই একটা মানসিক আশ্রয়ের জন্য বিয়েটা করে ফেললেন। কিন্তু ভুল করে হলেও তিনি ঠিক কাজই করেছেন। প্রফেসর ভালোই জানেন রোকসানা ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে হলে তাকে এতদিনে ছেড়ে চলে যেত। প্রফেসর বললেন, অবশ্যই শুনব, বলো রুকিমণি।

তুমি এত তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মানুষ অথচ একটু বেশি উজ্জ্বল আলো ছড়াবার লোভে নিজের জীবনের মোম দু’দিক দিয়ে জ্বালালে। কিন্তু দিন দিন আমার মনে হচ্ছে বড় কোনো অন্ধকার তোমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, এ জন্যই তুমি এভাবে নিজেকে জ্বালিয়ে ফেলেছ।

কবিতা আবৃত্তি করবে বললে।

স্যরি, এই যে শোনাচ্ছি,

If you wish to keep secrets,

then let me tell you

that they don’t matter to me.

Even if your past is covered in shadows,

you are plagued by ghosts,

or you harbor skeletons in your closet,

they can’t tell me anything meaningful about you.

I already know

that there is no other moon like you.

 

যা কিছু গোপন তোমার

যে ছায়ায় ঢেকেছ অতীত,

সেইসব অশরীরী

আর লুকনো কঙ্কালে

আমার যায় আসে না,

আমি তো ভিজেছি

তোমার বন-জোছনায়।

 

আমি এ জন্য কৃতজ্ঞ রুকিমণি।

আবার moon like you বলেছি বলে নিজেকে শম্পার চান্দু ভেবো না।

সেদিন রোকসানারা যখন প্রফেসরের সদ্য রাঁধা কোর্মা দিয়ে লাঞ্চ সারছিল, ঠিক তখনই ইন্সপেক্টর লাবণি অফিসের বিএম ডাব্লিউ এক্স ফাইভ নিয়ে ছুটছে ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশে। গতকাল সারা দিন তদন্তের জন্য ঢাকার বাইরে এখানে ওখানে কাটিয়েছে ইন্সপেক্টর লাবণি। হরগঙ্গা কলেজে এখনো অনেক শিক্ষক আছেন, যারা প্রফেসর জাহিদের সমকালীন। তাঁদের সবার মত হলো, প্রফেসর জাহিদ একটা ধূমকেতুর মতো এসে সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে চলে গেছে। হি ওয়াজ অ্যা ডিজরাপ্টর। এদের মাঝে প্রফেসর মৃণাল দাস কিছু বস্তুনিষ্ঠ এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। মনীষা দাস, শম্পা সোহানি আর ডাস্টবিনে পাওয়া মৃতদেহের রহস্য আশা করা যায় আজই সুরাহা হয়ে যাবে। লাবণি হ্যান্ডস ফ্রি ফোনে অফিসে জানিয়ে দিল, সাদা পোশাকের পুলিশ হাসপাতালের ভেতরে এবং বাইরে যেন অবস্থান নেয়।

আধঘণ্টার ভেতর ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সির গেট দিয়ে ইন্সপেক্টর লাবণি ভেতরে ঢুকল। ইমারজেন্সি পার হয়ে ডান দিকে গেলেই ডিউটি ডাক্তারদের রুম। ভেতরে একজন ডাক্তার গভীর মনোযোগে কিছু একটা লিখছেন। লাবণি বলল, সাদিয়া চৌধুরী কি আজ এখানে বসবেন?

জি, সাদিয়া বাইরে গেছে, চলে আসবে এখনই, আপনি চাইলে বসতে পারেন।

লাবণি একটা চেয়ার টেনে বসে টেবিলের ওপর থেকে প্রথমা লো পত্রিকা নিয়ে পড়তে লাগল। মিনিট পাঁচেকের ভেতর চোখে চশমা, মাথায় স্কার্ফ পরা একটা মেয়ে ঘরে ঢুকে গম্ভীর মুখে বললেন, জামিল ভাই, মরফিন তো শেষ হয়ে গেছে, সিরিয়াস অ্যাক্সিডেন্টের রোগী আসলে ঝামেলা হয়ে যাবে।

আচ্ছা আমি দেখছি। ইনি তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

সাদিয়া চৌধুরী লাবণির দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাকে খুঁজছেন?

জি।

কী করতে পারি বলুন? এটা কিন্তু আউটপেশেন্ট না।

একটু বাইরে আসবেন? আমি পারসোনালি একটা কথা বলতে চাইছি। বেশি সময় লাগবে না। খুব ইম্পরট্যান্ট।

পাশে বসা ডক্টর জামিল বললেন, ঠিক আছে যান, আমি এদিকটা সামলে নিচ্ছি।

বাইরে আসতেই লাবণি বলল, আপনাকে একটু আমাদের সঙ্গে ডিটেক্টিভ ব্র্যাঞ্চে আসতে হবে। একটা কনফিডেনশিয়াল আইডেনটিফিকেশনের জন্য।

সাদিয়া চৌধুরী অবাক হয়ে বললেন, আমাকে? কিসের আইডেনটিফিকেশন বলুন তো?

এখানে বলা যাবে না, আমি দুঃখিত। আপনাকে আমাদের সঙ্গে আসতে হবে।

সাদিয়া চৌধুরী সতর্ক দৃষ্টিতে দু’ পাশে তাকালেন, বেশ ক’জন সাদা পোশাকের পুলিশ তাকে ঘিরে আছে। পালানোর চেষ্টা করে লাভ হবে না।

লাবণি ওর বিএমউডাব্লিউ এক্স ফাইভেই সাদিয়াকে এসকর্ট করে নিয়ে এল ডিটেকটিভ ব্র্যাঞ্চে। হাসপাতালে আসার পথে লাবণি প্রফেসর জাহিদকে বলে রেখেছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিলি আর রোকসানাকে নিয়ে যেন ডিটেকটিভ ব্র্যাঞ্চে অপেক্ষা করে।

ডিটেকটিভ ব্র্যাঞ্চে পৌঁছুনোর পর সাদিয়াকে একটা বড় ইন্টারোগেশন রুমে নিয়ে আসা হলো। লাবণি বলল, সাদিয়া চৌধুরী, আমি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটা ক্রাইমের ব্যাপারে আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব।

জানি না আমাকে কী ভাবছেন, আমি কোনো ফরেনসিক এক্সপার্ট না, আমি জাস্ট একজন জেনারেল ডাক্তার। আমি মনে হয় না আপনাকে তেমন সাহায্য করতে পারব।

ওরা কথা বলতে বলতেই দরজায় কেউ টোকা দিল। দরজা খুলে দিতেই একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে ভেতরে ঢুকলেন প্রফেসর জাহিদ, রোকসানা আর মিলি। ইন্সপেক্টর লাবণি প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই মহিলাকে কি আপনি চিনতে পারছেন?

প্রফেসর সাদিয়ার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। লাবণি সাদিয়া চৌধুরীকে বলল, সাদিয়া, কাইন্ডলি আপনার হেডস্কার্ফ আর চশমাটা খুলতে পারবেন?

কেন? আমি কেন আমার স্কার্ফ খুলব?

কারণ আছে, প্লিজ খুলুন।

সাদিয়া চৌধুরী প্রবল অনিচ্ছা নিয়ে হেডস্কার্ফ আর চশমা খুলে টেবিলে রাখতেই মিলি অস্ফুট স্বরে বলল, শম্পা তুই?

এবার প্রফেসর আর রোকসানাও ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন।

ইন্সপেক্টর লাবণি সাদিয়া চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনিই তাহলে কুখ্যাত শম্পা সোহানি?

সাদিয়া চৌধুরী প্রফেসর জাহিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যালো চান্দু।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.