রমা অথবা সুচিত্রার গল্প

রমা অথবা সুচিত্রার গল্প

তেমন দীর্ঘাঙ্গী নন, নন স্লিমও। তবুও সুন্দরী। বড় বড় ভাসা চোখ। সুগঠিত নাক। লম্বাটে ভরাট মুখমণ্ডল। ছোট্ট কপাল। ঝরনাধারার মতো চুল। কালো। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ত্বক। হাসলে ঠোঁট ঈষৎ বাঁকে। ব্যক্তিত্বময় কণ্ঠস্বর। তিনি রমা দাসগুপ্ত, আমাদের সুচিত্রা সেন।

প্রথম জীবনে স্বজনরা তাঁকে ডাকতো কৃষ্ণা বলে। অন্যদিকে সুচিত্রা সেন হলেন রুপালি পর্দার অভিনেত্রী বা নায়িকা। সেলুলয়েডে মূর্ত হওয়া তাঁর নানা অভিব্যক্তি, হাসি-কান্না দেখে গত শতকের পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তর দশকের দর্শকরা ছিল মুগ্ধ। তাদের স্বপ্নে বারবার রেখাপাত ঘটেছে তাঁর। এদের মধ্যে রয়েছেন দুই বাংলার কোনো কোনো লেখক-কবিও।

তেমনই একজন হলেন নির্মলেন্দু গুণ। প্রথিতযশা এই কবি সুচিত্রাকে নিয়ে লিখেছেন একটি কবিতা: ‘তোমার চুলে-চোখে, ঠোঁটে-স্তনে,/ নিতম্বে গ্রীবায়/ ছিল সুন্দরের সুষম বণ্টন।/ তোমার কণ্ঠস্বরে ছিল মধু—/ হাসিতে হিল্লোল,/ আর ক্রন্দনে মৃত্যুর হাহাকার।/ আমার যৌবনে/ তুমি ছিলে প্রিয়ার প্রতীক।/ প্রেমের প্রকর্ষে, কামের দহনে,/ আমি তোমাকে পেয়েছি স্বপ্নে,/ আলিঙ্গনে, বারবার...।’

রমার কথা

রমার জন্ম ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল, তৎকালীন পাবনার সিরাজগঞ্জ মহকুমার ভাঙাবাড়ি গ্রামে, নানাবাড়িতে। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত। মা ইন্দিরা দেবী। তিন ভাই পাঁচ বোনের মধ্যে সে ছিল পঞ্চম। বাড়ির সবাই ওকে ডাকত কৃষ্ণা বলে। স্কুলে ভর্তির সময় ওর নাম দেওয়া হয় রমা।

কৃষ্ণা বা রমার ছোটবেলায় উচ্চারণে ত্রুটি ছিল। কয়েকটি অক্ষর সে উচ্চারণই করতে পারত না। একদিনের একটি মুহূর্তের কথা বললেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। সেদিন ছোট্ট কৃষ্ণার বাড়ির (পাবনা শহরের গোপালপুরে মহল্লার হিমসাগর লেনের একতলা পাকা পৈতৃক বাড়ি) রান্নাঘরে ঢুকে রান্নার ঠাকুরের কাছ থেকে খুন্তি কেড়ে নিয়ে তার উদ্দেশে বলেছিল: ‘তুমি সরে যাও, আমি আন্না করব।’

রমা খুব দুরন্ত মেয়ে ছিল। ইছামতি ও পদ্মার তীরে ছুটে বেড়াত সে। বান্ধবীদের সঙ্গে খেলত। নানারকমের খেলা। গাছে চড়ে ফল পাড়তেও জুড়ি ছিল না ওর। আর কাছাড়িবাড়ি এবং জজ সাহেবের কম্পাউন্ড ওয়ালের ফাঁক দিয়ে সবার অগোচরে পালিয়ে যেত কাশবনে। বৃষ্টিতে ভিজতে রমা ভীষণ ভালোবাসত।

পাবনা শহরের মহাখালী পাঠশালায় রমা পড়েছে ক্লাস ফোর পর্যন্ত। সেখানকার পড়া শেষে সে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয় পাবনা বালিকা বিদ্যালয়ে (বর্তমানে পাবনা গার্লস হাই স্কুল)। সেখানে সে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। না, রমা ভালো ছাত্রী ছিল না। পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী ছিল না সে। তাবে হ্যাঁ, নাচ-গানের প্রতি খুবই ঝোঁক ছিল রমার। চমৎকার গ্লাস পেইন্টিংও করত সে। আর ছিল সিনেমা দেখার তীব্র নেশা। ক্লাস সেভেনে ওঠার পর থেকেই ওই নেশাটি ওর পিছু নেয়। সুযোগ পেলেই বান্ধবীদের নিয়ে রমা ছুটত পাবনার অরোরা (বর্তমানে যার নাম বাণী) সিনেমাহলে।

বাজল যখন বিয়ের সানাই

রমার বয়স তখন চৌদ্দ কী পনেরো। তখনো সে কলি। ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হয় নি ওর সৌন্দর্য। পাবনা বালিকা বিদ্যালয়ে ক্লাস নাইনে পড়ছে। এই সময়েই রমার বিয়ে ঠিক হলো। পাত্র দিবানাথ সেন। কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী আদিনাথ সেনের ছোট ছেলে। এ বিয়েতে মধ্যস্থতা করেছিলেন রমার কমলা পিসি, যিনি থাকতেন শান্তিনিকেতনে।

শান্তিনিকেতনেই, পিসির বাড়িতে, দিবানাথকে প্রথম দেখে রমা। আর দুজনের মধ্যে আলাপ-পরিচয় হয় বড়দি উমার বিয়েতে। সেই বিয়েতে দিবানাথ ছিলেন আমন্ত্রিত অতিথি। বলাই বাহুল্য, কিশোরী রমাকে দিবানাথের পছন্দ হয়েছিল। আর রমাও মুগ্ধ হয়েছিল দিবানাথকে দেখে। কেনইবা হবে না! স্মার্ট, কথা বলায় ওস্তাদ, স্যুট-টাই পরনে একেবারে পাক্কা সাহেব।

দিবানাথের চোখে যে রমা পড়েছে— এ সংবাদটি কানে গেল আদিনাথ সেনের। ঠিক হলো তাঁকে দেখানো হবে রমাকে, না শান্তিনিকেতনে নয়, কলকাতায়। মনোহরপুর রোডে আত্মীয় সুরেন্দ্রনাথ সেনের বাড়িতে রমাকে দেখলেন আদিনাথ। কোনো দাবি-দাওয়া নয়, আদিনাথের চাহিদা ছিল এটিই- তাঁর ছোট ছেলের স্ত্রীকে হতে হবে সত্যিকারের সুন্দরী। রমাকে দেখে আদিনাথের ভীষণ পছন্দ হলো। তিনি তখনই বিয়ের দিনক্ষণ পাকা করতে চাইলেন। বলা যায়, বিয়ের ব্যাপারে ভীষণ তাড়া দিলেন আদিনাথ। কিন্তু অত তাড়াতাড়ি রমাকে বিয়ে দেবেন কী করে রমার বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত! তিনি তো আর আদিনাথের মতো ধনী নন। আসলে বিয়ের ব্যাপারে আদিনাথের ব্যস্ত হওয়ার কারণ ছিল। তিনি দিবানাথকে সোনার শিকলে বাঁধতে চেয়েছিলেন।। ভেবেছিলেন, ছেলে সংসারী হলে, ঘরে লক্ষ্মী-সুন্দর বউ এলে, দিবানাথের ছন্দছাড়া দশা ঘুচবে। যা হোক, ১৯৪৭ সালে বিয়ে হয়ে গেল রমা-দিবানাথের। কিছুটা হৃদয়ঘটিত সম্পর্কেরও ছোঁয়া ছিল এ বিয়েতে। এ বিষয়টি পরে সাংবাদিক গোপালকৃষ্ণ রায়ের কাছে রমা কবুলও করেছে। গোপালকৃষ্ণ যখন রমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমরা তাহলে কিছুটা ভাব করেই বিয়ে করেছিলে?’ উত্তরে রমা হেসে জানিয়েছিল, ‘হয়তোবা! অতদিন আগের কথা, আমার কি এখন মনে আছে? ওই বয়সে একটু ভাব হয় বৈকি’ (সুচিত্রার কথা/ গোপালকৃষ্ণ রায়, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ২৫)।

ওহ হ্যাঁ, রমা কিন্তু বিয়ের পরে পাবনাতে এসেছিল। আদিনাথ যখন রমাকে দেখে পছন্দ করেন, বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হয়, তখন একবার রমা এসেছিল পাবনাতে। বন্ধুদের জানিয়েছিল, ‘আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। মা, বাবা-ভাইবোনদের ছেড়ে যেতে হবে বলে খারাপ লাগছে।’ কলকাতার বালিগঞ্জে (৩২বি বালিগঞ্জ প্রেস) ছিল আদিনাথের বিশাল বাড়ি। শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে রমার শঙ্কাও ছিল। এ সম্পর্কে সে বন্ধুদের কাছে মনের কথা খুলেও বলেছিল: ‘বড়জা যা শুনেছি খুব ফ্যাশনেবল। ননদ কনভেন্টে পড়ে। ভাসুর বিদেশে থাকেন। আমি কি পারব ওদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে?’

রমার এই সংশয় বা শঙ্কা যুক্তিসঙ্গতই ছিল। দিবানাথ এবং রমার পরিবারের মধ্যে ছিল বিরাট ব্যবধান। আর্থিক তো বটেই সাংস্কৃতিকও। কিন্তু আবার এটাও সত্যি যে, রমা ছিল অন্য ধাতুতে গড়া মেয়ে। অন্য আর পাঁচজনের মতো নয়। উচ্চাকাঙ্খাও ছিল ওর। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় রমা একদিন পাবনা বালিকা বিদ্যালয়ে ডেস্কের ওপর বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় হঠাৎ বলেছিল: ‘দেখিস, আমি পৃথিবীতে অমর কীর্তি দেখে যাব’। বিষয়টি আরও পরিষ্কার করার জন্য সে এটাও বলেছিল, ‘আমি এমন নাম করব যে, পৃথিবী চিরকাল আমায় মনে রাখবে।’

বিয়ের আসরেও প্রকাশ পেয়েছিল রমার ভিন্ন দৃষ্টিকোণ। সে মাথায় ঘোমটা ছাড়াই বিয়ের লগ্নে আসরে এসে দাঁড়িয়েছিল। জানা যায়, সেই সময় রমা আত্মীয়স্বজনদের জানিয়েছিল: ‘ঘোমটা দিও না। আমি ঘোমটা ছাড়াই বিয়ে করব।’ ওর এই কথায় উপস্থিত সবাই বুঝে ফেলেছিলেন যে, এ সাধারণ মানসিকতার মেয়ে নয়।

বিয়ের পরে রামা পাবনায় খুব-একটা আসে নি। তবে ওর পরিবার আরও কিছুদিন ছিল। দেশভাগের পর যখন পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠল, তখন সেখানকার তৎকালীন জেলা প্রশাসকের কাছে বাড়িটা ভাড়া দিয়ে রমার বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত সপরিবারে পাড়ি জমান শান্তিনিকেতনের ভুবনডাঙা গ্রামে। সেখানে প্রথমে তাঁরা রমার কমলা পিসির বাড়িতে ওঠেন। প্রথমে ভাড়াবাড়ি, এরপরে ভুবনডাঙায় নিজেদের বাড়িই গড়ে তোলেন করুণাময় দাশগুপ্ত। শান্তিনিকেতনে আসার পর অবশ্য করুণাময়ের পরিবারটি সবকিছু ধীরে ধীরে গুছিয়ে নিয়েছিল। বোলপুর মিউনিসিপ্যালিটিতে স্যানিটেশন ইন্সপেক্টরের চাকরি করুণাময় দাশগুপ্তের পরিবারে অন্ধকারে এক ঝলক আলো ছড়িয়েছিল নিঃসন্দেহে। রবীন্দ্রসংস্কৃতির সংস্পর্শেও আসে পরিবারটি। রমার বড়ভাই নিতাই ওরফে অরুণ ভর্তি হন কলাভবনে (পরে তিনি চলচ্চিত্রের ব্যানার আঁকার কাজ করেন। বলা যায়, পরিবারে তিনিই প্রথম ওই মাধ্যমটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন)। রমার অন্য ভাইবোনরাও ভর্তি হয়েছিল পাঠ ভবন ও অন্য ভবনে। ছোট বোন রুনা ছিল কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্রী। আর রমা? সে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী নীলিমা সেনের কাছে গান শিখেছিল, সাইকেলে চড়া শিখেছিল। বিয়ের পরেও ভাইবোনদের সঙ্গে সে অনেক মজা করেছে। একবার পুজোর সময় তো ধুনুচি নাচ নেচে সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিল সে। গান আর ছবি আঁকায়ও রমার প্রতিভার উদ্ভাস চোখে পড়েছিল সবার।

সুচিত্রার আত্মপ্রকাশ

রমা জীবনে বড় হতে চেয়েছিল— এ কথা তো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তা যে চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী হয়েই হবে— তা সে ভাবে নি। বলা যায়, চলচ্চিত্রে ওর আগমন, ‘সুচিত্রা সেন’ হয়ে ওঠার বিষয়টি ঘটনাচক্রে হয়েছে। শুরুতে সাধ করে চলচ্চিত্রের আলো-ছায়ার জগতে সে প্রবেশ করে নি। বলা যায়, সারাটা জীবন রমা আর সুচিত্রা—এই দুটি সত্তা সে বহন করেছে। চলচ্চিত্রের স্টুডিওতে সে সুচিত্রা সেন আর ঘরের মাঝে রমা। এই প্রসঙ্গে গোপালকৃষ্ণ রায় বলেছেন: “রমা আর সুচিত্রা সেন এক হলেও এক নন। সুচিত্রা নিজেই বলেন, ‘তোমার তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য খুব ভালো লাগে নি, তার একটা ডায়াল মনে আছে?

আমি বলি, ‘তুমিই বলো, তোমার মুখে শুনতে ভালো লাগবে।’

সুচিত্রা বলেন, ‘বিষ্ণুপ্রিয়ার মুখে একটা সংলাপ ছিল—এক অঙ্গে রাধাকৃষ্ণ। আমারও এক অঙ্গে রমা আর সুচিত্রা সেন’।” (সুচিত্রার কথা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩১)।

রমাকে প্রথম চলচ্চিত্রাভিনয়ের প্রস্তাব দেন মামাশ্বশুর বিমল রায়। কিন্তু তাঁর এই প্রস্তাবে সায় জানান নি কেউ। পরে অবশ্য অনেকটা বাধ্য হয়েই চলচ্চিত্র জগতে পা রাখে রমা। বলাই বাহুল্য, শিল্পী সত্তার বিকাশ নয় এক্ষেত্রে আর্থিক বিষয়ই প্রাধান্য পেয়েছিল। কেননা আদিনাথ যে উদ্দেশ্যে রমাকে ঘরের বউ করে এনেছিলেন, তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ হয় নি। মদ আর বিলাসী জীবন যাপন ত্যাগ করেন নি দিবানাথ। একের পর এক ব্যবসাতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। তাই পরিবারের আর্থিক বিপর্যয়ে যখন আয়-রোজগারের ভিন্ন পথের সন্ধান করা হচ্ছিল, তখন এক্ষেত্রে রমাকেই এগিয়ে আসতে হয়েছিল। কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের এক অডিও স্টুডিতে রমা এসেছিলেন চলচ্চিত্রের নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে অডিশন দেওয়ার জন্য। সেই পরীক্ষায় অবশ্য সে পাশও করেছিল। কিন্তু ওর আর গায়িকা হয়ে ওঠা হয় নি। ওকে চলচ্চিত্রের নায়িকা হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এই প্রস্তাব অবশ্য রমা ফিরিয়ে দিতে পারে নি, স্বামী দিবানাথের জন্যই। কিন্তু চলচ্চিত্রে অভিনয় করার আগে তো শ্বশুর আদিনাথ সেনের অনুমতি প্রয়োজন। তাই একদিন দুপুরে শ্বশুরের প্রসন্ন মেজাজ দেখে কথাটি পাড়ল রমা। “আদিনাথ সব শুনলেন। ব্যক্তিত্বশালী মানুষটির মধে দৃশ্যত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। একবার শুধু পূর্ণ দৃষ্টি মেলে বৌমার মুখের দিকে তাকালেন। তারপর কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইলেন। একটু পরে ধীরে ধীরে বললেন, ‘তোমার মধ্যে যদি ট্যালেন্ট থাকে, তাকে নষ্ট করার অধিকার আমার নাই বৌমা। অতএব, তোমার যদি ইচ্ছা থাকে তাহলে আমি বাধা দেব না’...।” (সুচিত্রার কথা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৭)

শ্বশুরের অনুমাতি পাওয়ার পর রমা আবার পার্ক স্ট্রিটের স্টুডিওতে গেল, চুক্তিপত্রে সই করল, অগ্রিম কিছু টাকা গ্রহণ করল। কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে ওর মধ্যে পিছুটান দেখা গেল। অগ্রিম টাকা ফেরত দিতে বলল স্বামীকে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত আর টাকা ফেরত দিতে হয় নি, সেই ছবিতে রমা অভিনয় করল, ছবিটির নাম ছিল ‘শেষ কোথায়’, যদিও সেই ছবিটির কাজ শেষ হয় নি, মুক্তিও পায় নি।

প্রকৃতপক্ষে সুচিত্রার প্রথম চলচ্চিত্র ‘কাজরী’। পরিচালক নীরেন লাহিড়ী। তবে এই ছবির নায়িকা ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বান্ধবীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন। তবে ‘কাজরী’ সুচিত্রার মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি নয়। সুচিত্রার মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র ‘সাত নম্বর কয়েদি’। পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্ত। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। সুচিত্রাই ছিলেন এ ছবির নায়িকা। তাঁর বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন সমর রায়। আর হ্যাঁ, এ ছবি থেকেই সুচিত্রা সেনের যাত্রা শুরু। ছবিটির সহকারী পরিচালক নীতিশ রায় ছবিটি মুক্তির সময় রমার নাম বদলে দেন ‘সুচিত্রা সেন’।

কত ছবি কত চরিত্র

সুচিত্রা মোট ৬০টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ৫৩টি বাংলা এবং ৭টি হিন্দি চলচ্চিত্রে। উল্লেখ্য, গোপালকৃষ্ণ রায়ের ‘সুচিত্রার কথা’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বিভ্রান্তিকর তথ্য রয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, মোট ১৯৮টি বাংলা চলচ্চিত্রে সুচিত্রা সেন অভিনয় করেছিলেন। বইটির ১৬২ পৃষ্ঠায় এর উল্লেখ রয়েছে। মজার বিষয় হলো, ওই বইয়ের শেষে সুচিত্রা অভিনীত চলচ্চিত্রের যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেখানে বাংলা চলচ্চিত্রের সংখ্যা কিন্তু ৫৩টিই।

সুচিত্রা যে ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে প্রথম দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, সেই ছবিটির নাম ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ (১৯৫৩)। দেবকীকুমার বসুর অনন্য একটি চলচ্চিত্র। এ ছবিতে সুচিত্রা বিষ্ণুপ্রিয়ার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, যে নাকি কৃষ্ণের প্রেমে মগ্ন। এ প্রসঙ্গে সুচিত্রার বক্তব্য হলো: “বিষ্ণুপ্রিয়ার ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে আমি কার্যত বিষ্ণুপ্রিয়াই হয়ে গিয়েছিলাম। এখনো দু’একটা ডায়ালগ আমার মনে আছে। এই ডায়ালগটি আমি কোনোদিন ভুলব না—‘আমার আবার কৃষ্ণপ্রেম, হা কৃষ্ণ’...।” (সুচিত্রার কথা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬১)

অজয় করের ‘হারানো সুর’ (১৯৫৭) চলচ্চিত্রে ডাক্তার রমার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সুচিত্রা সেন। যে নাকি স্মৃতিভ্রম অলককে (উত্তমকুমার) সেবা ও ভালোবাসায় ভালো করে তোলে। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় স্মৃতি ফিরে পেয়ে রমাকে ভুলে বাড়ি দিয়ে যায় অলক। রমা সেই বাড়িতেই চাকরি নেয়—স্বামীকে ফিরে পাওয়ার জন্য। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সে অলককে ফিরে পায়।

অসিত সেনের ‘দীপ জ্বেলে যাই’ (১৯৫৯) চলচ্চিত্রে এক মানসিক হাসপাতালের নার্স তথা সেবিকার চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুচিত্রা। এই সেবিকা অর্থাৎ রাধা এক রোগীকে সেবা দিয়ে সুস্থ করতে গিয়ে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু ভালো হওয়ার পর সেই রোগী তাকে ভুলে যায়। কিন্তু প্রেমে ব্যর্থ এক মানসিক রোগীকে (বসন্ত চৌধুরী) সুস্থ করার পর সে কিন্তু রাধাকে একান্ত আপন করে পেতে চায়, প্রাক্তন প্রেমিকাকে নয়। কিন্তু দেখা যায় রাধা নিজে মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য, এ ছবির শেষ দৃশ্যে রাধার প্রচণ্ড উন্মত্ততার পর শান্তভাব ধারণের ভাবটি বড় সুন্দরভাবে সেলুলয়েডে ফুটিয়ে তুলেছেন সুচিত্রা সেন— এ কথা স্বীকার করতেই হবে। সেখানে স্থির এক জোড়া ভাষাহীন চোখের সামনে কোনো শব্দই আর উচ্চারিত হয় না।

অজয় করের ‘সপ্তপদী’ (১৯৬১) চলচ্চিত্রে খ্রিস্টান রিনা ব্রাউনের ভূমিকায়ও সুচিত্রা চমৎকার অভিনয় করেছেন। সহপাঠী কৃষ্ণেন্দুকে (উত্তমকুমার) ভালোবাসে রিনা। কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর বাবা রিনাকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে পারেন না। রিনা কৃষ্ণেন্দুর বাবাকে কথা দেয় যে সে কৃষ্ণেন্দুর জীবন থেকে সরে যাবে। রিনা তার কথা রাখে। পরে যুদ্ধের ডামাডোলের মাঝে ডাক্তার কৃষ্ণেন্দু দেখা পায় হারিয়ে যাওয়া প্রিয়া রিনাকে—তখন সে নেশাগ্রস্ত, জীবনের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে। কৃষ্ণেন্দু সেবা-যত্নে ভালো করে তোলে রিনাকে। তার ভালোবাসার কাছে পরাজয় স্বীকার করে রিনা।

এ ছাড়া অজয় করের ‘সাত পাকে বাঁধা’র অর্চনা, অসিত সেনের ‘উত্তর ফাল্গুনী’র দেবযানী ও সুপর্ণা— মা ও মেয়ের দ্বৈত ভূমিকায়ও সুচিত্রা অসাধারণ অভিনয় করেছেন। তাঁর এমনি একটি চলচ্চিত্র হচ্ছে গুলজারের ‘আঁধি’। এই হিন্দি চলচ্চিত্রে এক রাজনীতিবিদের ভূমিকায় সুচিত্রা দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন। আরেকটি হিন্দি চলচ্চিত্র, বিমল রায়ের ‘দেবদাস’-এ পার্বতীর ভূমিকায়ও সুচিত্রা মন্দ অভিনয় করেন নি। তবে সার্বিক বিচারে এটাই বলা যায় যে, সুচিত্রা সেন যত বড় তারকা ছিলেন তত বড় অভিনেত্রী ছিলেন না।

সুচিত্রার বিপরীতে অধিকাংশ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন উত্তমকুমার। তাঁর সঙ্গে গড়ে ওঠা সুচিত্রার জুটি এখন পর্যন্ত কিংবদন্তি হয়ে আছে। সুচিত্রার নায়করা হলেন: সমর রায়, বসন্ত চৌধুরী, রবীন মজুমদার, প্রশান্ত কুমার, দীপক মুখোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, অশোক কুমার, অসিতবরণ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দিলীপ মুখার্জী, প্রদীপ কুমার, নির্মল কুমার, উৎপল দত্ত, সমিত ভঞ্জ এবং রঞ্জিত মল্লিক। হিন্দি চলচ্চিত্রে সুচিত্রা অভিনয় করেছেন দিলীপ কুমার, শেখর, ভারত ভুষণ, দেব আনন্দ, অশোক কুমার, ধর্মেন্দ্র এবং সঞ্জীব কুমারের বিপরীতে।

যে ছবি করা হয় নি বা শেষ হয় নি

বিশ্ব নন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ‘দেবী চৌধুরানী’ চলচ্চিত্রে সুচিত্রাকে নাম ভূমিকায় নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন বিভিন্ন ছবিতে সুচিত্রা ব্যস্ত থাকায় ওই ছবির জন্য সময় বের করতে পারেন নি তিনি। এমনভাবে দীনেশ গুপ্তের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ চলচ্চিত্রটিও করতে পারেন নি সুচিত্রা। অন্যদিকে, পূর্ণেন্দু পত্রীর পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’-এ দামিনীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা। কিন্তু হঠাৎ ছবিটির প্রযোজক হেমেন গাঙ্গুলীর মৃত্যু হওয়ায় ছবিটি আর শেষ হয় নি। তাই একটি অতৃপ্তি ছিল সুচিত্রার। তিনি বিশিষ্ট সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরীর কাছে বলেছিলেন: ‘কেউ যদি চতুরঙ্গের নাট্যরূপ দেয়, আমি তাহলে অভিনয় করতে চাই।’

পুরস্কার, সম্মাননা

‘দেবদাস’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা নবাগতা অভিনয়শিল্পী হিসেবে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডস (১৯৫৫) পান সুচিত্রা। প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী হিসেবে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পান, ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সূত্রে (১৯৫৩)। শিল্পকলায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য পদ্মশ্রী পান (১৯৭২)। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘বঙ্গভূষণ’ও সুচিত্রা পেয়েছেন (২০১২)। এ ছাড়া ২০০৫ সালে সুচিত্রা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন, কিন্তু জনসম্মুখে আসতে রাজি না হওয়ায় পরে পুরস্কারের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় তাঁকে।

কেন দূরে থাকো, শুধু আড়াল রাখো…

সুচিত্রা সেনের শেষ চলচ্চিত্র ‘প্রণয় পাশা’। ১৯৭৮ সালে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। এরপর আর কোনো ছবিতে অভিনয় করেন নি সুচিত্রা। তিনি নিভৃত জীবনযাপন করতে থাকেন। তাঁর অগণিত দর্শক ও ভক্তকুলের কাছ থেকে আড়ালে থাকেন। নিজের চারপাশে রহস্যের একটি বাতাবরণ তৈরি করেন।

উল্লেখ্য, সুযোগ-সন্ধানী কয়েকজন আলোকচিত্রী নানা সময়ে উদ্যোগী হয়েছেন সুচিত্রার ফটো তোলার জন্য। একবার একজন তো কিছুটা সফলও হয়েছিলেন, সুচিত্রার মুখের পাশটুকুর ছবি তুলতে পেরেছিলেন— যখন তিনি কয়েক মিনিটের জন্য বালিগঞ্জের ভোটার লিস্টে নিজের নাম নিবন্ধীকরণ করতে এসেছিলেন। সে ১৯৯৫ সালের কথা। নিজেকে এভাবেই আড়ালে রেখেছেন সুচিত্রা সেন।

কেন সত্তরের দশক থেকে সুচিত্রা সেন স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন? তাঁকে দেখা যায় নি। কথা বলা যায় নি। টেলিফোন করলেও সুচিত্রা নিজেই বলেছেন যে, সুচিত্রা সেন কথা বলবেন না। এমনকি বাড়িতে গেলেও দর্শনার্থীরা তাঁর দেখা পান নি। কেন লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার জন্য সুচিত্রার এই প্রাণপণ চেষ্টা ছিল? কী কারণ লুকিয়ে ছিল তাঁর এই প্রচেষ্টার আড়ালে? এই প্রশ্নের জবাব একমাত্র তিনিই দিতে পারতেন। আমরা শুধু অনুমান করতে পারি।

আমরা জানি যে, সুচিত্রা সেনের স্বামী দিবানাথ সেনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। এই মৃত্যু কি গভীর বেদনা বয়ে এনেছিল তাঁর জন্য যে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেলেন? না বোধহয়, কেননা দিবানাথ সেনের মৃত্যুর পরেও বেশ কয়েক বছর চলচ্চিত্রের আলো-ছায়ার জগতে ছিলেন তিনি। কয়েকটি ছবিতে দেখা গেছে তাকে।

তবে কি প্রিয় বন্ধু উত্তমকুমারের মৃত্যু তাঁকে শোকে মুহ্যমান করেছিল? তাই তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান? না, অন্তত এ ক্ষেত্রে আমরা স্থির সিদ্ধান্তেই পৌঁছাতে পারি। কেননা উত্তমকুমার মারা যান আশির দশকে আর সুচিত্রা আড়ালকে বেছে নিয়েছেন সত্তর দশকেই।

আচ্ছা, সুচিত্রা কি পশ্চিমবঙ্গের বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন, তাই তিনি চলচ্চিত্র থেকে কেবল দূরেই সরে যান নি— তাঁর ফ্যানদের চোখের অন্তরালেও চলে যান? না, তাও ঠিক নয়। কেননা তাঁর একমাত্র সন্তান মুনমুন সেন যখন চলচ্চিত্রাভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হন তখন তিনি বাধা দেন নি। যদিও তাঁর ইচ্ছে ছিল মুনমুন চিত্রশিল্পী হোক। পরে তাঁর দুই নাতনি রিয়া ও রাইমাও চলচ্চিত্রে আসে। এখন তারা শুধু বাংলা চলচ্চিত্রেই নয়, হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করছেন। শুধু তাই নয়, ১৯৮৮ সালে শারদীয় আনন্দলোক পত্রিকায় প্রকাশিত গোপালকৃষ্ণ রায়ের ‘সুচিত্রা প্রসঙ্গ’ শিরোনামের লেখা থেকে জানা যায়, উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গের বাংলা চলচ্চিত্রে যখন ধস নামে, মাধুর্য নষ্ট হয়, এখন এ বিষয়ে সুচিত্রা মোটেই সুখী ছিলেন না। বিষয়টি নিয়ে তিনি ভেবেছেন। তখনকার বাংলা ছবিতে ধার করা চিন্তা প্রয়োগের বিরোধী ছিলেন তিনি। ছবি শুধু আমোদ-প্রমোদের জন্য নয়—তাকে শিক্ষা ও সমাজ চেতনার বাহন করে তোলারও পক্ষাপাতী ছিলেন সুচিত্রা সেন।

সত্তর দশকেই সুচিত্রার কাছের মানুষরা লক্ষ করেছিলেন, তিনি আধ্যাত্মিক জগতের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। এই সম্পর্কে গোপালকৃষ্ণ রায় বলেছেন: “ঘোরতর সংসারী সুচিত্রার মধ্যে সন্ন্যাসিনী সুচিত্রা সেনকে খুঁজে পাবেন। একটা নিস্পৃহ, ত্যাগী মন সুচিত্রার সংসারের খাঁচা থেকে মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যায়। আর সেই মুহূর্তে সুচিত্রা সেন আমার কাছে বিষ্ণুপ্রিয়া হয়ে ওঠেন।” তাহলে কি যে সুচিত্রা সেন কৃষ্ণপ্রেমে আবিষ্ট হয়ে ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন, সেই সুচিত্রা সেনের মন কি অন্য এক শক্তি সংগ্রহে ছিল নিবেদিত? তাই কি তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে যাপিত জীবনের প্রহরগুলো কাটিয়েছেন? হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে।

তবে আরেকদিকে আলো ফেলেছেন পশ্চিবঙ্গের চলচ্চিত্র-সাংবাদিক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। তার মতে, বাঙালি দর্শকদের কাছে সুচিত্রা হলো চিরকালের প্রেমিকা। এমনকি সত্তর দশকের কিছু ছবিতে তিনি যখন হাতাকাটা ব্লাউজ পরলেন, তাঁর খোলা কোমর দেখা গেল—তাও দর্শকরা গ্রহণ করে নি। বোঝা গিয়েছিল বাঙালি দর্শকদের গহন মনে সুচিত্রা দেহাতীত প্রেমিকা। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “সুচিত্রা বুঝতে পেরেছিলেন তাঁকে নিয়ে বাঙালির এই অবসেশন-এর কথা। তিনি বুঝেই সরে গেলেন। তা ছাড়া উপায় ছিল না তাঁর। তিনি নিজেকে নির্বাসনে পাঠালেন বাঙালির এই সুচিত্রা অবসেশনকে বাঁচিয়ে রাখতে।”

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণে যুক্তি রয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু ২০১৪ সালে কলকাতার আনন্দলোক পত্রিকা সুচিত্রার মৃত্যুর পর যে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল—তাতে সুচিত্রার প্রয়াত মেকাপম্যান জামানের স্ত্রী জামিলার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে জামিলা বলছেন: “একদিন জামান খুব মন খারাপ করে বাড়ি ফিরল। বলল, সুচিত্রা আর অভিনয় করবেন না এবং এর পেছনের কারণটি তিনি নাকি জামানকে জানিয়েছেন। কারণটি শুনে জামান নিজে নাকি ভীষণ চমকে গিয়েছিলেন। কিন্তু শত অনুরোধেও জামান কারণটি আমাকে বলে নি। ও ঈশ্বরের দিব্যি দিয়ে বলেছিল, ওকে যেন এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন না করি।” বোঝাই যাচ্ছে, সুচিত্রার স্বেচ্ছা নির্বাসনের পেছনে গভীর কোনো বিষয় জড়িত ছিল, যা অত্যন্ত মর্মান্তিক।

২০১৪-এর ১৭ জানুয়ারি সকালে না-ফেরার দেশে চলে গিয়েছে রমা। কলকাতার কেওড়াতলা শ্মশানে দেহ দাহর পর পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেছে ওর অস্তিত্ব।

সুচিত্রা কিন্তু বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন সেলুলয়েডে, অগণিত অনুরাগীর হৃদয়ে। বলা যায়, বাঙালি দর্শকদের কাছে এখনো সুচিত্রা সেন মানেই এক রোমান্টিক স্বপ্ন। সেই স্বপ্নে নিরন্তর আসা-যাওয়া সুচিত্রার— যিনি তেমন দীর্ঘাঙ্গী নন, নন স্লিমও। তবুও সুন্দরী। বড় বড় ভাসা চোখ। সুগঠিত নাক। লম্বাটে ভরাট মুখমণ্ডল...।

Leave a Reply

Your identity will not be published.