[এই ধারাবাহিক রচনাটিতে প্রয়াত চিত্রনায়ক রাজ্জাকের জীবন ও কেরিয়ারের নানা দিকের ওপর আলো ফেলা হবে। এখানে নায়করাজ রাজ্জাক সম্পর্কে পাঠকদের নানা কৌতূহল মিটবে, নানা প্রশ্নের উত্তর মিলবে।
এখানে মূর্ত হয়ে উঠবে রাজ্জাকের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের দিনগুলি, জীবন সংগ্রাম, নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং পর্যায়ক্রমে নায়করাজ হয়ে ওঠা...। থাকবে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা গানের কথা। তাঁর নায়িকা ও পরিচালকদের প্রসঙ্গও উঠে আসবে। চলচ্চিত্রে যেসব কণ্ঠশিল্পীর গানের সঙ্গে তাঁর ঠোঁটের মেলবন্ধন ঘটেছিল, থাকবে তাঁদের কথাও। পরিচালক রাজ্জাক সম্পর্কেও পাঠকেরা জানতে পারবেন; জানতে পারবেন টালিউডে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসের কথা। পরিশেষে অন্য এক রাজ্জাকের অবয়বও ফুটে উঠবে এখানে।
এবার তুলে ধরা হলো রাজ্জাকের অতীত জীবনের কয়েকটি অধ্যায়।]
নতুন ইহুদি এবং ছবি বিশ্বাসের তালিম
রাজ্জাক যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়েন, তখন সর্বপ্রথম পাড়ার একটি নাটকে অভিনয় করেন। ‘নতুন ইহুদি’ নামের এই নাটকে তিনি একটি কিশোর ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেন—যে পড়াশোনার পাশাপাশি হকারি করে নিজের সংসার চালায়। এটা ছিল রাজ্জাকের জন্য একটি পরীক্ষা। কারণ এই চরিত্রটি তিনি পেয়েছিলেন অনেক ছেলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ...এই নাটকে রাজ্জাকের একটা মজার স্মৃতি আছে। নাটকের শেষ দৃশ্যে রাজ্জাক তার মৃত বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। সেদিন দর্শক সারিতে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন সময়ের স্বনামধন্য অভিনেতা ছবি বিশ্বাস। নাটক শেষে তিনি রাজ্জাকের কাছে এসে ধমকের সুরে বললেন—‘গাধা কোথাকার! মঞ্চনাটকে অভিনয়ের সময় কখনো দর্শকদের দিকে পিছন ফিরে অভিনয় করতে নেই।’ রাজ্জাক তাঁর কথার যৌক্তিকতা বুঝতে পারেন এবং মঞ্চে অভিনয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবগত হন। পরে ছবি বিশ্বাস রাজ্জাককে দেখা করতে বলেন। ছবি বিশ্বাস থাকতেন রাজ্জাকদের বাড়ির ঠিক সামনের বাড়িতে। রাজ্জাক প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে ঠিক তার পরের দিনই তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। ছবি বিশ্বাস রাজ্জাককে বললেন, নাটকের মূল জিনিসটি হলো উচ্চারণ। এ ছাড়া নাটক বিষয়ে তিনি সেদিন দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। শেষমেষ বলেন, তোমার প্রতিভা আছে, লেগে থাকলে কাজ হবে।
রাজ্জাক তার কিছুদিন পরেই ছবি বিশ্বাসের কাছে আবৃত্তি শেখার পাশাপাশি পাড়ার নাটকগুলোর নিয়মিত অভিনেতা বনে যান। এভাবে কেটে যায় বেশ কয়েকটি বছর।
রঙ্গসভা, ঝংকার এবং...
রাজ্জাকের বয়স তখন সতেরো-আঠারো হবে। সবেমাত্র কলেজে পা রেখেছেন, চারুচন্দ্র কলেজে। এ সময় অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর তৎকালীন সময়ের প্রথিতযশা পরিচালক পীযূষ বসুর নাট্যদল ‘রঙ্গসভা’-য় যোগ দিলেন।
সেখানে অভিনয় শেখার জন্য কত কী যে রাজ্জাক করতে লাগলেন। চা আনছেন, মহিলা শিল্পীকে বাসে তুলে দিচ্ছেন। আবার তাকে বাসা থেকে রিহার্সেলে নিয়ে আসছেন। রঙ্গসভার হয়ে নাটকে কিশোর চরিত্রে ছোটখাট অভিনয় করেন। দুটি কিংবা চারটি দৃশ্যে অভিনয় করছেন। কিন্তু তাতে কী! তার উৎসাহ অপরিসীম। পুরো নাটকটি মুখস্থ করে ফেলছেন। কোনোদিন দেখা গেল প্রমটার আসে নি। পীযূষ বসু চিন্তিত। তখন মুশকিল আসান হয়ে নতুন ভূমিকায় আবির্ভূত হচ্ছেন রাজ্জাক। তিনিই প্রমট করছেন। আবার কোনোদিন দেখা গেল, নায়ক আসে নি। পীযূষ বসু তখন বললেন, ‘রাজ্জাক তুই-ই হিরোর প্রক্সি দে।’ তার কথা বেদ বাক্য মনে করে রাজ্জাকই হিরোর প্রক্সি দিচ্ছেন। মনে মনে তখন তিনি উত্তমকুমার-দিলীপ কুমার হয়ে গেলেন। যে মহিলা শিল্পীর সঙ্গে সংলাপ বলছেন, তিনি বয়সে তার চেয়ে বড়। কিন্তু মনে মনে রাজ্জাক তখন নিজেকে তার চেয়ে বড় ভাবছেন, হিরো ভাবছেন। এভাবে বিভিন্ন চরিত্রে প্রক্সি দিতে দিতে অজান্তেই রাজ্জাকের অভিনয় শেখা হয়ে যাচ্ছে। এভাবে রঙ্গ সভায় কিছুদিন কাজ করার পর তিনি বুঝতে পারলেন, অভিনয় তার সমগ্র সত্তায় মিশে যাচ্ছে। তখন তার সকল চিন্তা-ভাবনা, উৎসাহ-উদ্দীপনা, ব্যস্ততা সবটাই আবর্তিত হতো নাটককে ঘিরে।
‘রঙ্গসভা’-র হয়ে বেশ কয়েকটি নাটক করার পর পীযূষ বসুর সঙ্গে রাজ্জাকের খুব ঘনিষ্ঠতা হয়। তার অভিনয়জীবনের দিকনির্দেশনা তখন পীযূষ বসুই দিতেন। তাকে রাজ্জাক অন্ধের মতো ভক্তি করতেন। ...রঙ্গসভার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন ছবি বিশ্বাস, সন্ধ্যা রায়, বলাই সেন, দিলীপ চক্রবর্তী, রসরাজ চক্রবর্তী প্রমুখ। এই নাট্যদলের নাটক ‘মৌচোর’ (সলিল সেন রচিত এই নাটকটি পরে বাংলাদেশ থেকে চলচ্চিত্র রূপ দেন রাজ্জাক এবং ছোট মেয়ে ময়নাসহ অভিনয় করেন)। মিনার্ভা থিয়েটারে অভিনীত এই নাটকে রাজ্জাকের অভিনয় সবার প্রশংসা অর্জন করে।
১৯৬২ সালে রঙ্গসভার পাশাপাশি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে নিজের পাড়াতে রাজ্জাক ‘ঝংকার’ নামে আরেকটি নাট্যদল গড়ে তোলেন। এই দলের অন্য সদস্যরা ছিলেন রাজ্জাকের পাঁচ বন্ধু—টি দাস ওরফে হিটলার, লালজি, রণেন, পিলু ও প্রদীপ। রণজিৎ কুমার চৌধুরী (খুলনার শিমুলিয়া গ্রামের জমিদার পুত্র) পরিচালিত রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’-এ অমল এবং শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ নাটকে আমিনার চরিত্রে অভিনয় করার পর পাড়াতে রাজ্জাকের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। পীযূষ বসু পরিচালিত ‘রূপকথা’ নাটকেও রাজ্জাক চমৎকার অভিনয় করেছিলেন। শুধু পাড়াতেই নয়, বাইরে থেকেও বিভিন্ন নাটকের অফার আসতে শুরু করে। বলা যায়, নাট্যাঙ্গনে তখন ‘রাজা’ নামটি বেশ পরিচিতি পায়। রাজা ছিল রাজ্জাকের ডাকনাম।
তখন ফুটবল খেলার নেশা দূর হয়ে গেছে। অভিনয়ই তখন রাজ্জাকের ধ্যান-জ্ঞান। তার বেশির ভাগ সময় তখন কাটে নাটকের রিহার্সেলে। বিষয়টি তার ভাইয়েরা ভালোভাবে নেয় নি। বিশেষত বড়ভাই। আর এমনটিই স্বাভাবিক। কেননা সেই সময়ে মুসলিম পরিবারের ছেলেদের নাটক করা ছিল এক ধরনের অপরাধ। তাই বড়ভাই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ভাইকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেন, যেন সে নাটকে অভিনয় না করে। কিন্তু রাজ্জাকের মনে এইসব দাগ কাটে না। তিনি মঞ্চনাটক নিয়েই মত্ত থাকেন। নাট্যগুরু পীযূষ বসুর প্রশংসাও তাকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে। তিনি বলেন, ‘রাজ্জাক অভিনয়ের সময় তোর চোখ-মুখ থেকে মুগ্ধতার ভাষা বের হয়। এই তো চাই। তোর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।’
রাজ্জাকের বন্ধু হিটলারের ভাষায়, রাজ্জাক ছিলেন তাদের চকোলেট বয়। পাড়ার সব বাড়িতেই ছিল রাজ্জাকের অবাধ যাতায়াত। এমনকি বন্ধু হিটলাররা হিন্দু রক্ষণশীল পরিবার হলেও সেই বাড়ির ঠাকুরঘরেও রাজ্জাক ঢুকতে পারতেন।
তৎকালীন সময়ে রাজ্জাকের নাট্যদলে কোনো মেয়ে ছিল না। ফলে তখন নারী চরিত্রের জন্য রাজ্জাকরা মহিলা শিল্পী সংগ্রহ করতেন যাত্রাদল থেকে। এ বাবদ একেকজনকে তিন শ’ থেকে চার শ’ টাকা দিতে হতো। আর যেহেতু পাড়ার মধ্যে প্যান্ডেল খাটিয়ে টিকিট কেটে নাটক করতেন তারা সেহেতু প্যান্ডেল থেকে শুরু করেসব খরচ বহন করতে হতো রাজ্জাককে। আর এই অর্থ তার ভাই-বোনরা সরবরাহ করত। ব্যতিক্রম ছিল শুধু বড়ভাই আব্দুর শুকুর। তিনি রাজ্জাককে অন্য সব বিষয়ে টাকা-পয়সা দিলেও নাটকের জন্য কোনো টাকা দিতেন না। এমনকি অন্যকেও দিতে মানা করতেন। অবশ্য মেজো ভাই আব্দুর গফুর ছিলেন একটু অন্যরকম। কোনো বিষয় নিয়ে তেমন নাক গলাতেন না। তবে তার তিন বোন শবুরুন্নেসা, শফুরুন্নেসা এবং ছোট বোন আশিরুন্নেসা সব সময়ই রাজ্জাকের নাটক দেখতে যেতেন। ভালো করলে প্রশংসা করতেন, কোনো সমস্যায় পড়লে সাধ্যমতো সাহায্য করতেন। তবে রাজ্জাকের কয়েকজন আত্মীয় তার অভিনয় মোটেই পছন্দ করতেন না। অবশ্য পাড়ার লোকেরা রাজ্জাককে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করত। আর মূলত এই পারিপার্শ্বিক অবস্থাই দিন দিন রাজ্জাককে অভিনয়ের প্রতি দুর্বল করে তুলেছিল। তবে তখনো চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন কিংবা অভিনয়কে পেশা হিসাবে নিবেন এমন চিন্তা মাথায় আসে নি।
চলচ্চিত্রে অভিনয়
অনেক আগে থেকেই রাজ্জাকের চলচ্চিত্র স্টুডিওগুলোতে যাতায়াত ছিল। এর প্রধান কারণ হলো—কাছেই ছিল টালিগঞ্জের একটি স্টুডিও। আর রাজ্জাকদের বাড়ির পাশে তখন এ জগতের স্বনামধন্য বেশ কয়েকজন অভিনয়শিল্পী ও পরিচালক থাকতেন। যেমন ছবি বিশ্বাস, মঞ্জু দে, পীযূষ বসু, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। তাদের সঙ্গে রাজ্জাকের আলাপও ছিল। উল্লেখ্য, পীযূষ বসুর সঙ্গে প্রায়ই স্টুডিওগুলোতে যেতেন রাজ্জাক। সিনেমার শুটিং দেখতে তার ভীষণ ভালো লাগত। সেই সময় উত্তমকুমারের দারুণ ভক্ত ছিলেন তিনি। যখন তিনি শুটিং করতেন রাজ্জাক সারাদিন বসে তাঁর শুটিং দেখতেন। স্টুডিওগুলোতে এভাবে যাতায়াত করার কারণে এক সময় বাংলা ছবির প্রায় অধিকাংশ অভিনেতা-অভিনেত্রীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। উত্তমকুমারের সঙ্গে রাজ্জাককে পীযূষ বসুই পরিচয় করিয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে উত্তমকুমার যখন পীযূষ বসুর একটি ছবিতে কাজ করেন, তখন তাঁর সঙ্গে রাজ্জাকের যথেষ্ট অন্তরঙ্গতা হয়। তিনি রাজ্জাককে প্রচণ্ড স্নেহ করতেন। প্রকৃতপক্ষে উত্তমকুমারের সান্নিধ্য পাওয়ার পর চলচ্চিত্রাভিনয়ের প্রতি তার নেশা জন্মাতে থাকে। তারও অনেক পরে যখন রাজ্জাক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশে) সফল হন, তখন উত্তমকুমার খুবই খুশি হয়েছিলেন। ...উত্তমকুমারের ছোটভাই তরুণ কুমারের সঙ্গেও রাজ্জাকের ঘনিষ্ঠতা হয়। উত্তমকুমার তাঁর ছেলের বিয়েতে রাজ্জাককে দাওয়াতও দিয়েছিলেন। রাজ্জাক প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে উত্তমের ছেলে গৌতমের বিয়েতে গিয়েছিলেন।
যাই হোক, আগের কথায় ফেরা যাক। সেই সময় উত্তমকুমারকে দেখে রাজ্জাক প্রচণ্ড আলোড়িত হয়েছিলেন। তখন তার মনেও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের বাসনা জাগে। কয়েকটি ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগও পান। ছবিগুলো হলো—পংকতিলক (পরিচালক মঙ্গল চক্রবর্তী), রতনলাল বাঙালি (পরিচালক অজিত ব্যানার্জি), শিলালিপি...। এ তিনটি ছবিতে রাজ্জাক অভিনয় করেন যথাক্রমে একজন ছাত্র, পকেটমার এবং একটি গানের দৃশ্যে এক্সট্রা হিসেবে। এ ক্ষেত্রে পীযূষ বসুই রাজ্জাককে সাহায্য করেন। অভিনয়ের ব্যাপারে তিনি তাঁর কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পেয়েছিলেন।
সেই সময় রাজ্জাক নিয়মিত ছবি দেখতেন। উত্তমকুমারের কোনো ছবিই বাদ দিতেন না। এভাবেই রাজ্জাকের মধ্যে চলচ্চিত্রের নায়ক হওয়ার সুপ্ত ইচ্ছা জেগে ওঠে। কিন্তু তা কারও কাছে প্রকাশ করতেন না। তবে পীযূষ বসু সেটি বুঝতে পেরেছিলেন। এ জন্য তিনি রাজ্জাককে নাটকের ওপর বেশি জোর দিতে বলেছিলেন। তিনি রাজ্জাককে প্রায়ই বলতেন—‘এখনো সময় হয় নি। তুমি বেশি করে অনুশীলন করো। সময়ই একদিন তোমাকে ডাক দেবে।’
Leave a Reply
Your identity will not be published.