এ দেশের কবিতার দিগন্তে জ্বলজ্বলে একটি নাম—হাসান হাফিজুর রহমান। গল্পকার ও প্রাবন্ধিক হিসেবেও সৃজনশীলতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে সম্পাদক ও সংগঠক হিসেবে তাঁর ভূমিকা ও অবদান সত্যিই অনন্য। 'শেকড়ের সন্ধানে' বিভাগে তুলে ধরা হলো মানুষ ও মৃত্তিকালগ্ন সাহিত্যস্রষ্টা হাসান হাফিজুর রহমানের জীবন ও জন্মভূমির কথা।
লেখকের শিকড় সন্ধানে যাচ্ছি হাসান হাফিজুর রহমানের পৈতৃক ভূমি জামালপুরের কুলকান্দি গ্রামে। এ যাত্রায় আলোকচিত্রী হিসেবে আমার সঙ্গী হয়েছেন সহকর্মী বিপুল হাসান, অন্যদিন-এর স্টাফ রিপোর্টার।
আন্তঃনগর অগ্নিবীণার (আগে নাম ছিল পদ্মা) ফার্স্ট ক্লাস কমপার্টমেন্টের যাত্রী আমরা। ট্রেনটি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে আধঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে। তখন আমার সঙ্গে অবশ্য বিপুল হাসান ছিলেন না। তিনি জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন রেলওয়ে স্টেশন থেকে কিছুক্ষণ আগে উঠেছেন। ট্রেন এখন উত্তরা অতিক্রম করছে।
অগ্নিবীণা মন্থরগতিতে চলছে। সামনেই টঙ্গী স্টেশন বলেই এই অবস্থা। এক সময় ট্রেনটি টঙ্গী স্টেশনে থামে। হুড়মুড় করে লোক ওঠে। নামার যাত্রী নেই বললেই চলে। কিছুক্ষণ পরে আবার ট্রেনটি চলতে থকে। জানালার বাইরে বাংলাদেশের সুন্দর প্রকৃতি ও মানুষের জীবনধারা। সেই প্রকৃতি ও জীবনের ছবি দেখতে থাকি মগ্ন হয়ে; বুক ভরে নিই নির্মল বায়ু। নানা ভাবনায়ও আলোড়িত হই। প্রয়াত হাসান হাফিজুর রহমানও ছায়া ফেলেন মনের আয়নায় ও চেতনায়।
হাসান হাফিজুর রহমানের প্রধান পরিচয়, তিনি একজন কবি। এ দেশের কবিতার দিগন্তে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ছোটগল্প ও প্রবন্ধ রচনায়ও তিনি কুশলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় যে উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ এবং নানাজনকে চিঠি দিয়েছেন সেগুলোর সাহিত্যমূল্যও অসামান্য। তবে সম্পাদক ও সংগঠক হিসেবে হাসান হাফিজুর রহমানের ভূমিকা ও অবদান সত্যিই অনন্য।
হাসান হাফিজুর রহমান ১৯৩২ সালের ১৪ জুন জন্মগ্রহণ করেন জামালপুর শহরের মিয়া বাড়িতে, মাতুলালয়ে। দিনটি ছিল শনিবার, সময় প্রত্যুষ অর্থাৎ সূর্যোদয়ের আগে। বাবা আবদুর রহমান চাকরি করতেন শিক্ষা বিভাগে, যদিও তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়ন করেছিলেন কিন্তু তা শেষ করেন নি। চাকরি ছাড়াও তাঁর আয়ের উৎস ছিল গ্রামের ভূ-সম্পত্তি—যা জামালপুরের বাহাদুরাবাদের চরাঞ্চল ও দেওয়ানগঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। মা হাফিজা খাতুনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন না থাকলেও তিনি আরবি পড়তে পারতেন, নানা বিষয়ে বই পড়তেন এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেতেন। উল্লেখ্য, হাফিজা খাতুন ছিলেন আবদুর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
হাসান হাফিজুর রহমানরা সাত ভাই ও তিন বোন—হাসান হাফিজুর রহমান, হাসিবুর রহমান ফারুক, আমিনুর রহমান কায়সার, মুস্তাফিজুর রহমান, তারেক, ইস্কান্দার, খালেদুর রহমান খালেদ, রোকেয়া খাতুন, লায়লা আর্জুমান্দ বানু এবং কানিজ ফাতেমা। এদের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয় অল্প বয়সে। মাত্র চার-পাঁচ বছর বয়সে তারেক পরলোকগমন করে। ১৩-১৪ বছর বয়সে মারা যায় লায়লা আর্জুমান্দ বানু। জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই জীবনের ইতি ঘটে ইস্কান্দারের। হাসিবুর রহমান ফারুক (৩৭) ও আমিনুর রহমান কায়সার (২৫) ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শহীদ হন।
ট্রেন থেমে পড়ায় ভাবনার জাল ছিন্ন হয়। হুড়মুড় করে কিছু মানুষ নেমে পড়ে ট্রেন থেকে।
নেত্রকোনা থেকে ঢাকাগামী এক কোচকে ধাক্কা দিয়েছে ট্রেনটি। লাইনম্যান না থাকায় পথের মাঝে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না। এই সুযোগে গাড়িটি দ্রুত পার হতে চেয়েছিল। তার খেসারত দিতে হলো কয়েকজন মানুষকে—অকালে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। কিছুক্ষণ পরে ট্রেনটি আবার যাত্রা শুরু করে। মন্থরগতিতে এগিয়ে ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনে থামে। যাত্রীরা ওঠে, নামে। অগ্নিবীণা আবার এগিয়ে চলে। ট্রেনের জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি, একদল ছেলে বই-খাতা হাতে পথ চলছে। মনে পড়ে হাসান হাফিজুর রহমানের কথা, তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কথা। হাসান হাফিজুর রহমানের প্রথম স্কুল ঢাকার নবকুমার স্কুল। এতে তিনি সরাসরি তৃতীয় শ্রেণিতে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হন, ১৯৩৮ সালে। এরপর তিনি পড়েন জামালপুরের সিংজানী হাইস্কুলে, চতুর্থ শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত (১৯৩৯-৪১)। ১৯৪২ সালে বাবার চাকুরিস্থল ‘বরিশাল জেলা স্কুল’-এ ভর্তি হন সপ্তম শ্রেণিতে; অতঃপর ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেন প্রবেশিকা পর্যন্ত (১৯৪৩-১৯৪৬)। ঢাকা কলেজে থেকে তিনি আইএ পাশ করেন ১৯৪৮ সালে। অনার্সে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু অনার্স ফাইনাল না দিয়ে ১৯৫১ সালে পাস কোর্সে বিএ পাশ করেন এবং এ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রথম পর্ব এমএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে এমএ দুটি পর্ব একসঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।
হাসান হাফিজুর রহমানের কর্মজীবনের কথাও মনে পড়ে। তিনি প্রথম চাকরি নেন বেগম পত্রিকায়, ১৯৫২ সালে, সহকারী সম্পাদক হিসেবে। ১৯৫৫ সালে তিনি যোগ দেন ইত্তেফাক পত্রিকায়, সহকারী সম্পাদক হিসেবেই। ১৯৫৭ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন জগন্নাথ কলেজে। এখানে তিনি ছিলেন ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৫ সালের ১ জানুয়ারি তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানে যোগ দেন সহকারী সম্পাদক হিসেবে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এ পদে ছিলেন। ১৯৭২ সালে সম্পাদক ও কর্মাধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন দৈনিক বাংলায়। এ পদে যুক্ত থাকেন ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত। অতঃপর মস্কো’র বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করেন (১৯৭৩-৭৪)। মস্কো থেকে ফেরার পর বাংলাদেশ সরকারের ঊংঃধনষরংযসবহঃ বিভাগে ঙ.ঝ.উ. হিসেবে কাজ করেন (১৯৭৪-৭৫)। তারপর ১৯৭৭ সালের আগে পর্যন্ত প্রায় কর্মহীন জীবনযাপন করেন। ১৯৭৭ সাল থেকে জীবনের শেষবেলা পর্যন্ত তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প—মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্প-এর পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
অগ্নিবীণা ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়েছে বহু আগেই। আর কিছুক্ষণ পরেই জামালপুরে থামবে। অদূরে সহকর্মী বিপুল। আনমনা। বাইরের দিকে চেয়ে আছে। তার পাশে এক ভদ্রলোক। তার হাতে দৈনিক প্রথম আলো মেলে ধরা। নানা সংবাদ নানা হেডলাইন। ‘কূটনীতিক আলোচনায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার’, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: ছাত্রদের দুই উপদলে সংঘর্ষ, আহত ৫০’...। হাসান হাফিজুর রহমান রাজনীতি সচেতন একজন মানুষ ছিলেন। ১৯৪৯-৫০ সাল থেকেই রাজনীতির সঙ্গে তার যোগাযোগ। এ সময় নানা রাজনৈতিকগ্রন্থ পড়েন, জড়িত হন প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয় ১৯৫০ সালে। রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক পর্যায়ে কাজ করতেন। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। কর্মী হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত তুখোড়। প্রথম লিফলেটটা তিনিই করেন। এছাড়া তিনি পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-এর সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। ড্রামা সার্কেল-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি ছিলেন (১৯৬৪-৬৫); পাকিস্তান সাহিত্য সংসদেরও সাধারণ সম্পাদক (১৯৫৮-৬৫) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জামালপুর স্টেশনে অগ্নিবীণা থামে। আমি ও বিপুল নেমে পড়ি। হেঁটে হেঁটে স্টেশন চত্বরের বাইরে এসে এক রিকশায় ওঠি। কিছুক্ষণ পরে রেলগেট পার হয়ে এসে ইসলামপুরের দেওয়ানগঞ্জগামী একটি সুপিরিয়র কোচে উঠে পড়ি। আড়াই ঘণ্টা পর গাড়িটি গন্তব্যে পৌঁছে। এর মধ্যে অবশ্য গাড়িটি থেমেছে। যাত্রীরা উঠেছে, নেমেছে।
চারদিকে আলো-আঁধারি পরিবেশ। সূর্য বহু আগেই অস্তমিত হয়েছে। লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, দেওয়ানগঞ্জ ফাঁড়ি সংলগ্ন একটি ডাকবাংলো আছে। সেখানে রাত্রিযাপন করা যেতে পারে। আমরা তাই করি। তার আগে দেওয়ানগঞ্জের বড় বাজারে ইউসুফ হোটেল থেকে রাতের খাবার খেয়ে নিই।
পরদিন সকালে রিকশায় কুলকান্দি গ্রামের দিকে রওনা হই। গ্রামের কাছে এসে রিকশা থেকে নেমে পড়ি। সামনে জলাশয়। ব্রিজ ভেঙে পড়ায় ভেলায় পাড়ি দিই ওপারে। পারাপারের জন্যে কড়িও গুনতে হয়। কড়ি তো নয়, টাকা। দু’জনের জন্যে চার টাকা।
নানাজনকে জিজ্ঞেস করে একসময় পৌঁছে যাই কুলকান্দি গ্রামের মিয়াবাড়িতে—হাসান হাফিজুর রহমানের পৈতৃক ভিটাতে। লক্ষ্য করি মিয়াবাড়ির একদিকে নতুন টিনের ঘর। অন্যদিকে পুরোনো ছোট ঘর। বাড়ির সামনে পথ। পথের ওপারে পারিবারিক কবরস্থান। এখানে হাসান হাফিজুর রহমানের বাবা, একাত্তর সালে নিহত শহীদ দুই ভাই এবং তাদের একজনের (হাসিবুর রহমান) একমাত্র কন্যা আশা চির-নিদ্রায় শায়িত আছেন। কবরস্থানের সঙ্গে ফলের বাগান। তার সঙ্গেই বন। তৎসঙ্গে মসজিদ। সরকারি বাঁধ। বাঁধের ওপারে যমুনা বয়ে চলেছে।
মনে পড়ে, এই নদী গর্ভেই তলিয়ে গেছে বাবার কাছ থেকে পাওয়া হাসান হাফিজুর রহমানের শ’ বিঘা জমি। জানতে পারি, বাঁধের ওপারে বনের ধারেই ছিল মূল মিয়া বাড়ি। এখনকার মিয়া বাড়ি হাসান হাফিজুর রহমানের ভাতিজারা নির্মাণ করেছে। এখানে অবসরে ঢাকা থেকে এসে থাকেন হাসান হাফিজুর রহমানের বড় ছেলে রিপন, সেজ ছেলে সনেটসহ অন্যরা। বাঁধের ওপারে নদীর পাড় ধরে হেঁটে যাই আমরা। লক্ষ্য করি নদী ভাঙছে। সেই ছবি ক্যামেরায় বন্দি করে বিপুল হাসান। একসময় আমরা পৌঁছে যাই বাহাদুরাবাদ ঘাটে। এখানে ঢাকা থেকে আন্তঃনগর ট্রেন তিস্তা আছে। এই ট্রেনটি আমরা মিস করেছি। ফলে জামালপুর ভায়া দেওয়ানগঞ্জ হয়ে আমাদের কুলকান্দিতে আসতে হতো না। আমরা সরাসরি বাহাদুরাবাদ ঘাটে পৌঁছুতে পারতাম।
আমরা আবার মিয়াবাড়ির কাছে যাই। নিজেদের পরিচয় দেই এবং ভেতরের ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করি। রিপন মিয়া আমাদের অভ্যর্থনা জানান। তিনি গতকাল ঢাকা থেকে সপরিবারে এসেছেন। আমাদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। জানতে পারি যে, হাসান হাফিজুর রহমানের ব্যবহৃত জিনিসপত্র এখানে নেই। সবই রয়েছে ডিওএইচ-এ তার মেয়ে এশা হাসান ওরফে মুন্নীর কাছে। তবে জামালপুর শহরের গুঠাইলে রয়েছে হাসান হাফিজুর রহমান স্মৃতি পরিষদ। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৪ সালে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর হাসান হাফিজুর রহমানের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। তাঁর জন্মদিনটির কথা তো শুরুতেই আমরা উল্লেখ করেছি। ১৯৩২ সালের ১৪ জুন এ পৃথিবীর আলো প্রথম দেখেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান আর মৃত্যু হয় অকালে, অনেকটা গতকালের দুর্ঘটনায় নিহত, নেত্রকোনা থেকে ঢাকাগামী কোচ যাত্রীদের মতো। তবে আকস্মিক নয়, মৃত্যুর পায়ের ধ্বনি তিনি ধীরে ধীরে টের পেয়েছিলেন। হার্ট, লিভার ও কিডনি খারাপ হওয়ার দরুন মস্কোর সেন্ট্রাল ক্লিনিক হাসপাতালে ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল তার মৃত্যু হয়।
হাসান হাফিজুর রহমানের প্রধান পরিচয় তিনি একজন কবি। তবে তার প্রথম প্রকাশিত রচনা একটি গল্প ‘অশ্রুভেজা পথ চলতে’। এটি ‘সওগাত’ পত্রিকায় বৈশাখ ১৩৫৪ এবং জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৪ সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে সোনার বাংলা পত্রিকায়। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বিপুল প্রান্তর’ (১৯১৩)। এই গ্রন্থেই ধরা পড়ে যে, তিনি স্বাবলম্বী এবং মৌলিক কবিকণ্ঠ। বলা যায়, এ কাব্যেই বিভাগোত্তর বাংলাদেশের কবিতার রূপ এবং স্বরূপ নির্দেশিত হলো। আর এ ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা তাঁর সৃষ্টিশীলতায় নতুন মাত্রা যোগ করে। হাসান হাফিজুর রহমানের অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে আর্ত শব্দাবলী, অন্তিম শরের মতো, যখন উদ্যত সঙ্গীন, বজ্রেচেরা আঁধার আমার, শোকার্তের তরবারি, আমার ভেতরের বাঘ, ভবিতব্যের বাণিজ্যতরী, হাসান হাফিজুর রহমানের অপ্রকাশিত কবিতা। কবিতায় হাসান হাফিজুর রহমান এ দেশ, মাটি ও মানুষের জয়গান গেয়েছেন, জাতিসত্তার শিকড়ের অন্বেষণে মগ্ন হয়েছেন আবার সেই তিনিই এক পর্যায়ে মনুষ্যত্বের অবমাননায় হয়েছেন দুঃখ-কাতর। শেষের জীবনের শেষ পর্যায়ে রক্ষিত কবিতাগুলো ছোট, কিন্তু এগুলো তার কাব্যের একটি নতুন দিককে প্রকাশ করেছে। এখানে এই কবি মিতবাক, অবিশ্বাস্যভাবে সরল।
হাসান হাফিজুর রহমানের প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘আরো দুটি মৃত্যু’। এ ছাড়া আরো আটটি গল্প রয়েছে তার।... তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের জাতীয় জীবনের নানা আন্দোলন ও সংগ্রামের পটভূমিতে হাসান কোনো গল্প রচনা করেন নি, যদিও এইসব বিষয়কে অবলম্বন করে অনবদ্য কবিতা রচনা করেছেন ঠিকই।
একজন মননশীল প্রাবন্ধিক হিসেবেও উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন হাসান হাফিজুর রহমান। তার প্রবন্ধগ্রন্থ মোট চারটি—আধুনিক কবি ও কবিতা (১৯৬৫), মূল্যবোধের জন্যে (১৩৭৬), সাহিত্য প্রসঙ্গ (১৯৭০), আলোকিত গহ্বর। এর মধ্যে ‘আধুনিক কবি ও কবিতা’ হচ্ছে বাংলাদেশের কবিতাবিষয়ক প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। এমনকি বাংলাভাষার আধুনিক কবিতাবিষয়ক আলোচনা হিসেবেও এ গ্রন্থের ঐতিহাসিক তাৎপর্য অপরিসীম।
একজন সম্পাদক হিসেবেও হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন অনন্যসাধারণ। একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ তার অনন্য কীর্তি। তবে হাসানের মহত্তম সম্পাদনা কীর্তি হচ্ছে, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র’। এছাড়া সিকান্দার আবু জাফরের সঙ্গে ‘সমকাল’ এবং ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকা সম্পাদনায়ও হাসান হাফিজুর রহমান ব্যতিক্রমী উদাহরণ রেখে গেছেন আমাদের সামনে। তাই নয়ন সম্মুখে আজ তিনি না থাকলেও পাঠকদের মনের মাঝে তিনি নিজের আসন গড়ে নিয়েছেন।
[২০০৫ সালে অন্যদিন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত]
Leave a Reply
Your identity will not be published.