ধারাবাহিক রচনা নায়করাজ রাজ্জাক (পর্ব-৭)

ধারাবাহিক রচনা  নায়করাজ রাজ্জাক  (পর্ব-৭)

এই ধারাবাহিক রচনাটিতে প্রয়াত চিত্রনায়ক রাজ্জাকের জীবন ও কেরিয়ারের নানা দিকের ওপর আলো ফেলা হবে। এখানে নায়করাজ রাজ্জাক সম্পর্কে পাঠকদের নানা কৌতূহল মিটবে, নানা প্রশ্নের উত্তর মিলবে।

এখানে মূর্ত হয়ে উঠবে রাজ্জাকের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের দিনগুলি, জীবন সংগ্রাম, নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ এবং পর্যায়ক্রমে নায়করাজ হয়ে ওঠা...। থাকবে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা গানের কথা। তাঁর নায়িকা ও পরিচালকদের প্রসঙ্গও উঠে আসবে। চলচ্চিত্রে যেসব কণ্ঠশিল্পীর গানের সঙ্গে তাঁর ঠোঁটের মেলবন্ধন ঘটেছিল, থাকবে তাঁদের কথাও। পরিচালক রাজ্জাক সম্পর্কেও পাঠকেরা জানতে পারবেন; জানতে পারবেন টালিউডে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসের কথা। পরিশেষে অন্য এক রাজ্জাকের অবয়বও ফুটে উঠবে এখানে।

এবার তুলে ধরা হলো রাজ্জাক অভিনীত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবির কথা।

বেঈমান

রুহুল আমিন পরিচালিত ছবি। ১৯৭৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল। এ ছবিতে রাজ্জাক এক শহরের যুবক। ভালোবাসে এক যুবতীকে। ঘটনাক্রমে সে খুন করে ফেলে এক ভদ্রলোককে। পরে জানতে পারে সেই ব্যক্তি হলো তার বাবা। ফলে যুবকটি অনুশোচনায় ভেঙে পড়ে। মনের যন্ত্রণা ভুলতে মদের আশ্রয় নেয়। একপর্যায়ে জঙ্গলে যায়। সেখানে আরেক যুবতীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয়। যুবতীটি যুবকটিকে চাবুক দিয়ে মারে। পরে সেই যুবতী ভালোবাসে ফেলে যুবকটিকে। তাকে মদ খাওয়া থেকে বিরত রাখতে চায়, ভালোবাসার বন্ধনে বাঁধতে চায়। কিন্তু যুবকটি তো মেয়েটিকে ভালোবাসে না। সে তো ভালোবেসে ছিল শহরের মেয়েটিকে। অবশ্য শেষ পর্যায়ে জঙ্গলের মেয়েটির কোলে শুয়েই মারা যায় যুবকটি।... ছবিটির তিনটি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রাজ্জাক, সুজাতা এবং কবরী। এই ছবির ‘আমি তো বন্ধু মাতাল/মানুষ যদি নাই বলো/বেঈমান বলো বেঈমান’ জনপ্রিয় হয়েছিল। আর যন্ত্রণাদগ্ধ যুবকের ভূমিকায় রাজ্জাকের অভিনয়ও দর্শকদের অত্যন্ত পছন্দ হয়েছিল।

‘বেঈমান’ ছবিতেই দর্শকরা প্রথম রাজ্জাককে মৃত্যুবরণ করতে দেখে, তাও আবার কবরীর কোলে মাথা রেখে। রাজ্জাক-কবরী জুটির জনপ্রিয়তা ছিল সেই সময়ে আকাশচুম্বী। সেখানে এই জুটির মিলন হয় না, মারা যায় নায়ক—এমনটি দর্শকদের জন্য অভিনবই ছিল। দর্শক বিষয়টি গ্রহণ নাও করতে পারত। ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হতে পারত। এমন ঝুঁকি ছিল। এ প্রসঙ্গে রাজ্জাক একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন: “তিন পাতার একটি গল্প ছিল ‘বেঈমান’। ওটাকে আমি রিসার্চ করলাম, আমার বন্ধু জওহরকে নিয়ে বসলাম। সে বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে ? কোনো রকমে অ্যাকশন ছবি বানিয়ে পার পেয়ে গেছ, তুমি কবরীর কোলে মাথা রেখে মরবে, পৃথিবীর কোনো দেশ এটা এক্সেপ্ট করবে না। বাংলাদেশে তো নয়ই। আমি খুব জিদ্দি আর ডেসপারেট। আমি শখ করে নতুন কিছু একটা করতে চাই। আমি বানালাম বেঈমান।...রিলিজ করলাম ছবি। প্রথম শো হওয়ার পর আমি ভাবছি ফ্লপ হবে ছবি, বাসায় বসে আছি। আমার ওই ছবি ‘রংবাজ’ থেকেও বেশি ব্যবসা করে। ‘রংবাজ’ থেকেও বেশি পপুলার হয়।”

‘বেঈমান’ ছবিতে এক যন্ত্রণাকাতর যুবকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক, ভুলবশত পিতাকে হত্যা করে যে যুবক। প্রেমিকার কাছ থেকেও আঘাত পায়। সবমিলিয়ে বিধ্বস্ত এক যুবক। এই ছবিতে রাজ্জাক অনবদ্য অভিনয় করেছেন।

‘বেঈমান’ ছবিতে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ছবির প্রথম অংশে রাজ্জাকের চরিত্রটা ছিল খুব অত্যাচারী। জঙ্গলে থাকে, মানুষকে মানুষ মনে করে না, তাদের মারে। প্রথম এর প্রতিবাদ করে একটি মেয়ে। মেয়েটি রাজ্জাককে চাবুক দিয়ে পেটায়। আর এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন কবরী। তাকে বলা হয়েছিল, দেখানো মারে হবে না, মারাটা দেখতে হবে স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। শুটিংয়ের সময় কবরীকে বকা দিয়ে রাজ্জাক বলেও ছিলেন, ‘আমি যে রাজ্জাক, আপনাকে সেটা ভুলে যেতে হবে।’ মারটা যাতে রাজ্জাকের গায়ে না লাগে সেজন্য শার্টের নিচে পিঠের ওপরে একটা খাতা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। যা হোক কবরী রাজ্জাককে ঘোড়া পেটানোর সত্যিকার চাবুক দিয়ে মারতে শুরু করেন। আর সেই মারের একটাও খাতার ওপর পড়ে নি, পড়েছিল রাজ্জাকের কোমরে। রাজ্জাক তখন কিছু বলতেও পারছিলেন না। কারণ ক্যামেরা চলছিল। তাও আবার একটি নয়, দুটি।...শট শেষ হওয়ার পর রাজ্জাক নড়াচড়া করতে পারছিলেন না। ফরেস্ট বাংলোতে ইউনিটের সবাইকে রুম থেকে বের করে দিয়ে আবিষ্কার করেন, রক্তে ভিজে গেছে প্যান্ট। কবরী যখন বিষয়টি জানতে পারেন, তখন তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। হয়তো কবরী অমন করে মেরেছিলেন বলেই মারের দৃশ্যটা খুবই স্বাভাবিক হয়েছিল।

বাঁদী থেকে বেগম

মোহসিন পরিচালিত চলচ্চিত্র। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের পটভূমিতে এ ছবির গল্প আবর্তিত হয়েছে। এক নারী এক জমিদারের মেয়ে। সৎ মায়ের ষড়যন্ত্রে সে নারী ব্যবসায়ীদের হাতে বন্দি হয়। নিলামে তাকে কিনে নেয় নবাব নওশের। যে নাকি মেয়েটির মুখে তার প্রেমিকার ছায়া দেখতে পেয়েছিল। নবাব নওশের তাকে বাঁদী থেকে বেগমের মর্যাদা দেয়। তাকে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু শেষ পর্যায়ে বেগমকে ভুল বুঝে বিষ পান করে আত্মহত্যা করে। মৃত্যুর আগে অবশ্য তার ভুল ভেঙেছিল।

ছবিটিতে রাজ্জাক অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী অভিনয় করেছেন নবাব নওশেরের ভূমিকায়। বিশেষত শেষ দৃশ্যে তার অভিনয় ছিল অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। একটি একটি  করে সব মোমবাতি নিভিয়ে দিলেন নবাব নওশের রূপী রাজ্জাক। তারপর বিষ খাওয়ার আগে কান্না জড়ানো অদ্ভুত হাসি হেসে বলেন, ‘বিদায় জীবন! বিদায়!’ রাজ্জাকের অভিনয়ের জন্য ছবিটি সুপারহিট হয় (অবশ্য নারী প্রধান এই ছবিতে ববিতার অভিনয় এবং নাচও ছিল একটা বড় ফ্যাক্টর)। এ প্রসঙ্গে রাজ্জাকের ভাষ্য হলো: ‘ছবিতে আমি আত্মহত্যা করি। সেই মৃত্যুদৃশ্যের শুটিং শুরু করেছিলাম সকালবেলায়। তখনো ছবিতে সরাসরি শব্দগ্রহণ করা হতো। ফলে শুনশান নীরবতা ছিল জরুরি। এফডিসির পাশেই ছিল সিএসডি গোডাউন। সেটির কলাপসিবল  গেইট ছিল নষ্ট, নামত না। ফলে ভেতরের সব শব্দ শুটিংস্পট পর্যন্ত চলে আসত। ওই আওয়াজের ভেতরে তো এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা দৃশ্যের শুটিং করা যায় না। তাই ববিতাকে রাতে সময় দিতে বলা হলো। গোডাউনে তখন কাজ হবে না, শব্দের উৎপাতও থাকবে না। শুটিং শুরু হলো রাত আটটায়। এখন আর মনে নেই, কী করে সারারাত কাজ করেছিলাম। ভোর পাঁচটায় দিলাম সর্বশেষ শট। আমি মারা গেলাম। ...এরপর কী হয়েছে আমি জানি না। পর্দায় যখন দেখলাম, বুঝলাম, আমার করা একটি ভালো চরিত্র।’

অনন্ত প্রেম

রাজ্জাক পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। ১৯৭৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ ছবিতে তিনি নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তার বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন ববিতা। ছবির কাহিনিধারায় মূর্ত হয়ে উঠেছে—চার বন্ধু একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এক বন্ধু ভালোবাসে ববিতাকে। তাকে সাহায্য করে বাকি তিন বন্ধু। শহরের বাইরে যায় তারা ববিতাকে নিয়ে। একপর্যায়ে বন্ধুটি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার নাম করে ববিতাকে একটি নির্জন জায়গায় নিয়ে যায় এবং ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়। সে সময় চিৎকার শুনে রাজ্জাক এবং বন্ধুরা এগিয়ে যায়। এবার রাজ্জাকের হাতে ওই বন্ধু খুন হয়ে যায়। বন্ধুর লাশ নিয়ে শহরে ফেরে বন্ধুরা। ববিতাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে রাজ্জাক পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পুলিশের কাছে পুরো ঘটনা খুলে না বলে রাজ্জাক বলেন, টাকা নিয়ে ঝগড়ার কারণে বন্ধুকে খুন করেছেন তিনি একাই। পরে পুলিশ হেফাজত থেকে পালান তিনি। অন্যদিকে শৈশবে মাতৃহীন ববিতা সৎ মায়ের অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে আসছিলেন। কিন্তু এক লম্পট ব্যক্তির সঙ্গে তার বিয়ে দিতে চাইলে বিয়ের আসর থেকে তিনিও পালান। ট্রেনে রাজ্জাক ও ববিতার আবার দেখা হয়। দুজনই পালিয়ে চলে যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অরণ্যে। সেখানে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে তারা একে অপরের প্রেমে পড়ে যান।

ব্ল্যাক আনোয়ার ও এটি এম শামসুজ্জামান পুলিশের কাস্টডি থেকে পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা যান। ফলে প্রকৃত ঘটনার সাক্ষী দেওয়ার মতো কেউ থাকে না। রাজ্জাকের নামে পুলিশের হুলিয়া জারি হয়। অরণ্যের গভীরে প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের সুখের নীড় গড়ে তোলে।

পুলিশ এক পর্যায়ে নায়ক-নায়িকার সন্ধান পায়। অরণ্যের মধ্যে তাদের ধাওয়া করে পুলিশ। পালিয়ে বাঁচার জন্য সীমান্ত পাড়ি দিতে যায় তারা। একটি ঝর্ণা পার হওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় দুজনের। মৃত্যুর সময় পরস্পরকে চুম্বন করেন তারা। শেষ পর্যন্ত ঝর্ণার তীরে পড়ে থাকে প্রেমিক-প্রেমিকার আলিঙ্গনাবদ্ধ প্রাণহীন দেহ।

একটি গান সময়ের স্পর্শ বাঁচিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ল্যাসিক গানে পরিণত হয়েছে। গানটি হলো খুরশিদ আলম ও সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনি’। উল্লেখ্য, চুম্বন দৃশ্যটি শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রে ছিল না।

‘অনন্ত প্রেম’ প্রসঙ্গে রাজ্জাক বলেন, “বেঈমান-এর ওপর নির্ভর করে আমরা অনন্ত প্রেম বানালাম। অনন্ত প্রেমের দৃশ্যে আমরা দুইজন মারা যাচ্ছি।...অসম্ভব ভালো রোমান্টিক গল্প। অনন্ত প্রেম মনে হয় একটু অ্যাডভান্স বানিয়ে ফেলেছিলাম। আমাদের ছবিটা ভাঙিয়েই তো ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তাজ’ বানাল ইন্ডিয়ায়। সুপার ডুপার হিট হয়ে গেল আমির খানের প্রথম ছবি। কিন্তু আমি আর এই অনন্ত প্রেমের মতো ছবি বানাতে পারলাম না। অসম্ভব ভালো ছবি, অসম্ভব যত্ন নেওয়া ছবি এবং সবচেয়ে দুঃখ কি! এফডিসির ভল্টে তখন নেগেটিভ রাখা হতো। আমার ছবিটাসহ আরও কয়েক শ’ ছবির নেগেটিভ ড্যামেজ হয়ে যায়। এখন অনন্ত প্রেমের একটা ফ্রেমও আমরা খুঁজে পাব না।”

অশিক্ষিত

ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। ছবির পরিচালক ছিলেন আজিজুর রহমান। সংগীত পরিচালক ছিলেন সত্য সাহা। ছবিতে রাজ্জাকের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন অঞ্জনা, রোজী সামাদ, শওকত আকবর এবং মাস্টার সুমন। ছবির কাহিনিতে দেখা যায়—গ্রামের চৌকিদার রহমত (রাজ্জাক) লেখাপড়া জানে না। অশিক্ষিত রাজ্জাককে লেখাপড়া শেখায় গ্রামের দরিদ্র অনাথ বালক মাস্টার সুমন। রাজ্জাক নাম দস্তখত করা শেখে তার কাছে। কাহিনির শেষ পর্যায়ে দুর্নীতিবাজ আড়তদারের অপরাধ দেখে ফেলায় খুন হয় সুমন। তার খুনের সাক্ষী হয় রাজ্জাক এবং তার সাক্ষ্যে শাস্তি হয় অপরাধীর। সাক্ষীর দরখাস্তে নিজ হাতে নাম সই করে রাজ্জাক। ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে দারুণ সফল হয়। পাশাপাশি সমালোচকদের প্রশংসাও কুড়ায়। এ ছবির একটি গান ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’ দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন খন্দকার ফারুক আহমেদ এবং শাম্মী আখতার। গানের কথা লিখেছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। অশিক্ষিত রহমত চৌকিদারের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেন রাজ্জাক। এ ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করেন তিনি।

এ ছবিতেই রাজ্জাক প্রথম মেকাপ ছাড়া কাজ করেন। ছবিতে একটি গানের (‘ঢাকা শহর আইস্যা আমার’) দৃশ্য ছাড়া পুরো ছবিতেই রাজ্জাকের কস্টিউম ছিল একটিই। তারপরেও গল্প এবং রাজ্জাক ও মাস্টার সুমনের মর্মস্পশী অভিনয়ের গুণে ছবিটি ব্যবসা সফল হয়।

চন্দ্রনাথ

‘চন্দ্রনাথ’ মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে। ছবিটির পরিচালক ছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম। ছবিতে আরও অভিনয় করেন দোয়েল, সুচন্দা ও গোলাম মুস্তাফা। সংগীত পরিচালক ছিলেন নুরুল ইসলাম। গীতিকার রফিকুজ্জামান। কণ্ঠশিল্পী ছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন, সুবীর নন্দী ও প্রবাল চৌধুরী। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয় এই সিনেমা। কাহিনিতে দেখা যায়, কাশিতে গিয়ে দরিদ্র তরুণী সরযূর (দোয়েল) সঙ্গে পরিচয় হয় তরুণ জমিদার চন্দ্রনাথের (রাজ্জাক)। সরযূকে ভালোবেসে তাকে বিয়ে করে গ্রামে নিয়ে আসেন চন্দ্রনাথ। কিন্তু একসময় শোনা যায় সরযূর মায়ের চরিত্র নিয়ে বদনাম রয়েছে। সমাজের কারণে সরযূকে ত্যাগ করে কাশি পাঠিয়ে দেন চন্দ্রনাথ। তিনি নিজেও গৃহত্যাগ করেন। বেশ কয়েক বছর পর অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে আবার তাদের মিলন হয়। ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে সফল এবং সমালোচকদের প্রশংসায় সিক্ত। সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রের নায়ক হিসেবে পরিশীলিত বাচনভঙ্গি, সুদর্শন অবয়ব এবং সুঅভিনয়ের কারণে চন্দ্রনাথ চরিত্রে দারুণ মানানসই ছিলেন রাজ্জাক। ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আসরে চারটি পুরস্কার জয় করে। সেরা অভিনেতার পুরস্কার জয় করেন রাজ্জাক।

বড় ভালো লোক ছিল

ব্যতিক্রমী কাহিনির একটি চলচ্চিত্র ‘বড় ভালো লোক ছিল’। ১৯৮২ সালে মুক্তি পায় ছবিটি। পরিচালক ছিলেন মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। ছবিতে আরও অভিনয় করেন অঞ্জু ঘোষ, প্রবীর মিত্র ও আনোয়ার হোসেন। সংগীত পরিচালক আলম খান। গানের কথা লিখেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। কণ্ঠশিল্পী ছিলেন রুনা লায়লা ও এন্ড্রু কিশোর। কাহিনিতে দেখা যায় গ্রামের এক দরবেশের (আনোয়ার হোসেন) ছেলে রাজ্জাক আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। ট্রাক দুর্ঘটনায় বাবার অকাল মৃত্যুতে গ্রামে আসেন রাজ্জাক। তিনি আধ্যাত্মিক শক্তিকে স্বীকার না করলেও তার মধ্যে সেটির প্রকাশ দেখা যায়। গ্রামের মেয়ে অঞ্জু ঘোষ ভালোবাসে ট্রাকচালক প্রবীর মিত্রকে। অঞ্জুকে দেখে তার প্রতি প্রলুব্ধ হন রাজ্জাক। কিন্তু এই ঘটনার পর তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা চলে যায়। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সুপথে ফিরে আসেন তিনি এবং মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। জটিল এই চরিত্রে চমৎকার অভিনয় উপহার দেন নায়করাজ। ছবির গানগুলো দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘আমি চক্ষু দিয়া দেখতাছিলাম জগৎ রঙিলা’ ইত্যাদি গান লোকের মুখে মুখে ফেরে। ছবিটি ৬টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করে। সেরা অভিনেতার পুরস্কার ঘরে তোলেন রাজ্জাক।

কি যে করি

১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় ‘কি যে করি’। রাজ্জাক-ববিতা জুটি অভিনীত ছবিটির পরিচালক ছিলেন জহিরুল হক। সংগীত পরিচালক ছিলেন আলম খান। গীতিকার ছিলেন মুকুল চৌধুরী। সংগীতশিল্পী ছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন ও মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী। ছবির কাহিনিতে দেখা যায় অত্যাচারী বাবার হাতে মাকে জীবন দিতে দেখে শৈশব থেকেই পুরুষকে ঘৃণা করেন ববিতা। কিন্তু তার দাদার উইল অনুসারে সম্পত্তি পেতে হলে বিয়ে করতে হবে। তাই তিনি ফাঁসির আসামি রাজ্জাককে বিয়ে করেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে আদালতে খালাস পান রাজ্জাক। এর পর জন্ম হয় নানা মজার ঘটনার। অবশেষে রাজ্জাককে মন থেকে গ্রহণ করেন ববিতা। ছবিটি বাণিজ্যিকভাবে দারুণ সফল হয়। এ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান রাজ্জাক। রোমান্টিক কমেডি হিসেবে ছবিটি দারুণ উপভোগ্য হয় দর্শকের কাছে। এ ছবির ‘শোনো গো রূপসী ললনা’, ‘না আমি কারও চাকরি করি’ ইত্যাদি গান বেশ জনপ্রিয়তা পায়।

‘কি যে করি’ একটি কমেডি ছবি। এই ধরনের ছবিতে যেমন অভিনয় করা দরকার, রাজ্জাক তেমন অভিনয় করেছিলেন। তার চরিত্রটি ছিল ঘোড়েল টাইপের। কথা ছিল মেয়েটি (ববিতা) সম্পত্তি পাওয়ার পর সে চলে যাবে। কিন্তু যখন আরাম-আয়েশে থাকতে লাগল, তখন সেই জীবনের প্রতি দুর্বলতা জন্মাল তার। তখন সে আর যেতে চায় না। বলে, আমি তোমার স্বামী। এ চরিত্রটি রাজ্জাকের অভিনয়ের গুণে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল।

অবুঝ মন

১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটির পরিচালক ছিলেন কাজী জহির। বাংলাদেশের একটি চিরসবুজ প্রেমের ছবি ‘অবুঝ মন’। রাজ্জাক-শাবানা জুটি অভিনীত এ ছবিতে আরও ছিলেন সুজাতা, শওকত আকবর, নারায়ণ চক্রবর্তী, এটিএম শামসুজ্জামান প্রমুখ। স্বাধীনতার আগেই ছবিটির অধিকাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। ছবিটির সংগীত পরিচালক ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী আলতাফ মাহমুদ। গান লিখেছিলেন ড. মনিরুজ্জামান ও গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সংগীতশিল্পী ছিলেন ফেরদৌসী রহমান, সাবিনা ইয়াসমিন ও আবদুল জব্বার। ছবির কাহিনিতে দেখা যায়, দরিদ্র যুবক মাসুম (রাজ্জাক) বন্ধু বিজয়ের (শওকত আকবর) সহায়তায় ডাক্তারি পাস করে গ্রামে আসে গ্রামের মানুষের সেবায় কাজ করার জন্য। মাসুমকে ভালোবাসে তার সহপাঠী ডা. রাবেয়া (সুজাতা)। কিন্তু মাসুম সেটি জানে না। পথে ট্রেনে তার পরিচয় হয় জমিদারকন্যা মাধবীর (শাবানা) সঙ্গে। পরিচয় রূপ নেয় প্রেমে। কিন্তু তারা দুজন ভিন্ন ধর্মের মানুষ। বাধা হয়ে দাঁড়ায় সমাজ। মাধবীর বাবা জমিদার (নারায়ণ চক্রবর্তী)। মাসুম দরিদ্র। এটিও তাদের মিলনের পথে বাধা। জমিদারের অনুরোধে গ্রাম ছেড়ে চলে যায় মাসুম। মাসুমের বন্ধু বিজয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় মাধবীর। কিন্তু তাদের প্রেম মরে না। মাসুম-মাধবীর প্রেমের কথা জানতে পেরে তাদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চায় বিজয়। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় দৃষ্টি হারায় সে। মাসুম তাকে নিজের একটি চোখ দান করে। মাধবীকে অনুরোধ করে বিজয়কে ভালোবাসতে। মাধবী সে কথা মেনে নিয়ে মাসুমের সঙ্গে রাবেয়ার জীবন যুক্ত করে দেয়। ধর্মীয় ও সামাজিক পরিচয়ের অনেক উপরে প্রেমের ও মানবতার বিজয় ঘোষণা করে ‘অবুঝ মন’ ছবিটি। ‘অবুঝ মন’ তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এ ছবির ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’ গানটি এখনো দারুণ জনপ্রিয়।

‘অবুঝ মন’-ই এদেশের প্রথম ছবি যেখানেÑহিন্দু-মুসলমানের প্রেম দেখানো হয়, এবং সেই প্রেমও ব্যর্থ প্রেম। এ ছবির নায়ক মাসুম তখা রাজ্জাক যখন মাধবীর (শাবানা) প্রেমে পড়ে, তখন সেই সময়ের দর্শকের মনে অন্যরকম অনুভূতির খেলা চলছিল। অথবা বলা যায়, কোনো কোনো দর্শকের অচরিতার্থ বাসনার প্রকাশই যেন মাসুম ও মাধবীর প্রেম। তাই ছবিটি তারা লুফে নিয়েছিল।  ছবির শেষে মাসুম ও মাধবীর মিলন হয় না। মাসুমের বন্ধু বিজয়ের সঙ্গে মাধবীর বিয়ে হলে এবং ঘটনাচক্রে বিজয় অন্ধ হয়ে গেলে মাসুম তার একটি চোখের কর্ণিয়া দান করে বন্ধুকে এবং মাধবীকে বলে, ‘বিজয় যখন তোমার দিকে চাইবে, তখন ওর চোখের দিকে চেয়ে তুমি আমাকেই দেখতে পাবে।’ এই সংলাপও নিশ্চয়ই দর্শকদের ভালো লেগেছিল। ভালো লেগেছিল রাজ্জাকসহ অন্যদের অভিনয়। তাই তো ছবিটি তুমুল ব্যবসা করেছিল। ঢাকার সদরঘাটের তৎকালীন রূপমহল সিনেমাহলে এক শ’ দিনের অধিক একনাগাড়ে চলেছিল ছবিটি।

রাজ্জাক অভিনীত আরও কয়েকটি চলচ্চিত্রের কথা বলা যেতে পারে, যেখানে তার চরিত্রে ছিল গভীরতা ও ভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য। যেমন ‘আনোয়ারা’ (১৯৬৭)। সাহিত্যের এই চলচ্চিত্রায়নে তার অভিনয় ছিল চরিত্রানুগ। আনোয়ারার স্বামীর চরিত্রটি বড়পর্দায় ভালোভাবেই মূর্ত করে তুলেছিলেন রাজ্জাক।...নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘নীল আকাশের নীচে’ (১৯৬৯)-তে রাজ্জাক এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ভার্সিটি পড়ুয়া এই যুবকটি সংসারের প্রয়োজনে ট্যাক্সি চালায়। ঘটনাচক্রে সে প্রেমে পড়ে এক ধনী কন্যার। সংগ্রামী যুবক ও প্রেমিকের ভূমিকায় রাজ্জাককে ভীষণ মানিয়েছিল।...আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘অতিথি’ (১৯৭৩)-তে প্রথম রাজ্জাক তথাকথিত নায়ক চরিত্রের বাইরে অভিনয় করেন। এখানে তিনি এক খুনের মামলার ভুল আসামি। সাজা হিসেবে নিহত ব্যক্তির পরিবারের ভরণপোষণ তাকে করতে হয়।...সুভাষ দত্তের ‘আকাক্সক্ষা’(১৯৭৬)-য় সন্তান আকাক্সক্ষায় তাড়িত এক যুবক তিনি। প্রেমিক ও স্বামী তো বটেই।...আলমগীর কুমকুমের ‘গুণ্ডা’ (১৯৭৬)-য় নাম ভূমিকায় রাজ্জাক স্বচ্ছন্দ। আবদুল লতিফ বাচ্চুর ‘যাদুর বাঁশি’ (১৯৭৭)-তে বাতিঘরের কর্মী তিনি। সমুদ্রে চলা জাহাজকে রাতে পথ দেখান। নিঃসন্তান এক মানুষও বটে। এ ছবিতে রাজ্জাক অনবদ্য অভিনয় করেছেন। আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সখি তুমি কার’ (১৯৮০) রাজ্জাক অভিনীত আরেকটি চলচ্চিত্র। ত্রিভুজ প্রেমের এই চলচ্চিত্রে তিনি এক বয়স্ক ব্যবসায়ীর ভূমিকায় অভিনয় করেন, যিনি ছোটভাইয়ের প্রেমিকাকে বিয়ে করেন অজান্তে। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব ও জটিলতা। ছবিতে রাজ্জাকের অভিনয় চমৎকার হলেও কোনো কোনো দৃশ্যে তিনি ওভার অ্যাকটিং করেছেন।...আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘ছুটির ঘণ্টা’ (১৯৮০)-য় রাজ্জাক এক স্কুলের দপ্তরি। এক মেধাবী ছাত্রকে ভীষণ ভালোবাসেন, স্নেহ করেন। সেই ছেলেটি দীর্ঘ ছুটির আগের দিন বাথরুমে গেলে ভুলবশত দরজাটি আটকে দেয় দপ্তরিটি। স্কুল ছুটি শেষ হলে বাথরুমে আবিষ্কৃত হয় ছাত্রটির লাশ। এই দৃশ্য দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে দপ্তরি। গ্ল্যামারহীন এই চরিত্রে রাজ্জাক অনবদ্য।...আকবর কবীর পিন্টুর ‘কালো গোলাপ’ (১৯৮৩)-এ রাজ্জাক এক পঙ্গু ব্যবসায়ীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। স্ত্রীকে গভীর ভালোবাসেন তিনি। পরে সন্দেহের শিকার হন স্ত্রীর প্রাক্তন প্রেমিককে ঘিরে। এখানে যন্ত্রণাকাতর স্বামীর চরিত্রে রাজ্জাকের অভিনয় ভালো হলেও কখনো কখনো মেলোড্রামার ভূত তার ঘাড়ে চেপেছিল।...‘সৎভাই’ (১৯৮৫)-এ রাজ্জাক এক সচ্ছল পরিবারের বড়ভাই। সম্পত্তি নিয়ে ছোটভাইয়ের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব বাঁধে। শরৎচন্দ্রের ‘বৈকুণ্ঠের উইল’ অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে রাজ্জাক চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। নিজের পরিচালিত এ ছবিটি পরে তিনি ‘সন্তান যখন শত্রু’ নামে রিমেক করেন। ...শরৎ কাহিনির আরেকটি চলচ্চিত্র ‘শুভদা’ (১৯৮৬)। এখানে গ্রামের পরোপকারী এক যুবকের ভূমিকায় রাজ্জাক অনবদ্য। ‘রাজলক্ষী শ্রীকান্ত’ (১৯৮৭)-তে জমিদারের ভূমিকায়ও রাজ্জাক সফল।...একজন পিতার শেষ বয়সের বাস্তবতা নিয়ে নির্মিত ‘বাবা কেন চাকর’ (১৯৯৭)-এ রাজ্জাক বাবার চরিত্রটি বড়পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন। তিনি ছবিটির পরিচালকও ছিলেন। চলচ্চিত্রটি পরে টালিউডেও রিমেক হয় এবং সেখানেও রাজ্জাক অভিনয় করেন।

Leave a Reply

Your identity will not be published.