নিরমিন শিমেল-এর পাঁচটি কবিতা

নিরমিন শিমেল-এর পাঁচটি কবিতা

তা কে  দে খে ছি

তাকে দেখেছি আমি আশশ্যাওড়ার বনে

ভোরের কুয়াশার সর গায়ে মেখে কাশফুল রঙে।

 

তাকে দেখেছি আমি অধরার স্নানসিক্ত চুলে।

তমসাঘোর আকাশে ছড়িয়ে থাকা

নক্ষত্রের মতো ঊজ্জ্বল,

সঙ্গম শেষে শান্ত সরোবর।

 

তাকে দেখেছিলাম কৃষকের ললাটের ভাঁজে,

খরতপ্ত জমিনে জলহীন,

সর্পিল করোটিতে নৈরাশ্যের প্ল্যানচেট

সমুদ্রের নোনাজল অশ্রুবিন্দু রেখে যায়।

 

নির্জলা আমি দেখেছি তাকে শ্রাবণের মেঘে

আধো ঘোমটা টেনে ঝুলে থাকা

বাবুইয়ের বাসার মতো

হিমঘরে জলছাপ বুকে নিয়ে শ্রান্ত।

সন্ধ্যা যেখানে শুধুই নির্ঘুম।

 

য মু না র  কা ছে  মি ন তি

যমুনা তুমি আর উতলা হয়ো না।

এখানে এই অভিসারী ঘাটে আমার বাসন্তী

তার আলতা পায়ের অস্তরাগ রেখে গেছে;

তুমি জল-কল ছলে তা মুছে মুছে নিয়ো না।

যমুনা তুমি উন্মাদ হয়ো না।

উছলে পড়া অনুরাগের রসটম্বুর কলসিটিরে

তুমি ভাসিয়ে নিয়ো না।।

 

কোনো এক শাওন সিক্ত ভোরে স্নান সেরে সে

হাতের কাঁকনটি ভুলো মনে ফেলে রেখে গেছে।

স্মৃতির লণ্ঠন জ্বেলে আমি আজ তা খুঁজতে এসেছি।

লুকোচুরি না খেলে পারো কি সেই

নিরুদ্দেশি কাঁকনটিরে ফিরিয়ে দিতে?

 

যমুনা তুমি আর কলকণ্ঠে তরঙ্গ তুলে

মাতাল নৃত্য কোরো না।

এখানে এই মদিরা হাওয়ায় বাসন্তীর

প্রণয় সংগীত মিশে আছে।

আমি সেই মৌন মিহি তানে কান পেতে রয়েছি।

 

দোহাই যমুনা-

তুমি গর্জন তুলে ওই প্রণয় সুরকে বিলীন কোরো না।

 

অ ন্ত রা লে  অ মা নি শা

(শহীদ নেতা আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান অগ্রজপ্রতিমেষু)
 

একাত্তরের কালরাতে তরল জ্যোৎস্না ম্লান হয়ে আসে অকস্মাৎ;

নিকষ আঁধারে ড্রাকুলার নিঠুর দংশনে

ক্ষতবিক্ষত নিভৃত শহর।

যুদ্ধ-বিধ্বস্ত উত্তাল রাজপথ- উত্তপ্ত স্বদেশ।

রৌদ্র-ফেস্টুন হাতে মহান নেতা কামরুজ্জামান

তুমি মুহূর্তেই সোচ্চার,

তোমার উজ্জীবিত স্লোগানের টুটি চিপে শাসায়

তপ্ত লেলিহান শিখা।

রাত্রির নির্জন আকাশে মেহেরপুর সীমান্তের

কালো শামিয়ানায় জেগে থাকা ফোটা ফোটা সন্ধ্যাতারা

যেন বিন্দু বিন্দু সলতে প্রদীপ।

অবিনাশী আশ্বাসে ভিত গড়ে তোলে অস্থায়ী সরকার।

দিগন্তে স্বাধীনতার সূর্য ওঠে-

হাতে তোমার সূর্যোদয়ের নিশানে জড়ানো রক্ত-আবীর,

অথচ দীর্ঘশ্বাসে নিমগ্ন পৃথিবী তখনো কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন

হায়েনার হিংস্র থাবা অলক্ষে ওঁত পেতে থাকে।

ড্রাকুলার নিষ্ঠুর পীড়নে বিক্ষত স্বাধীনতা- প্রিয় মাতৃভূমি।

জেলহত্যার ভয়াল রাত্রিশেষে সূর্যোদয় এখন

আবীর ছড়িয়ে কী নির্বিকার!

আলগোছে সূর্যস্নান সেরে ভোরের জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড

নির্বিঘ্নে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালে।

অথচ ইতিহাস তখনো নিমগ্ন প্রতীক্ষায় ছায়াবন্দি

অন্তরালে তাই অমানিশার প্রেতছায়া নাচে।

 

স ল তে টা  বা ড়ি য়ে  দা ও  সূ র্যা স্ত

সলতেটা বাড়িয়ে দাও সূর্যাস্ত।

আলোর কুচিগুলো নিষ্প্রভ হয়ে আসছে।

অন্ধকারের ঘেরাটোপ ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর।

সামনে আমার নাফ নদীর জলজ বেরিকেড।

 

পেছনে ফেলে আসা রোদ্দুর আঙিনা,

স্বপ্নময় ভিটেবাড়ি আগুনে পুড়ে ছারখার।

জবাই করা কোলের ছেলেটির রক্তমাখা অবয়ব,

স্বামী বর্ষাফলকে গাথা ক্রুশবিদ্ধ যিশু।

 

আর আমার...

সেটি বলতে যে বড় লজ্জার।

নরপশুর হিংস্র থাবা কেড়ে নিল সব লজ্জাভূষণ।

আমি নির্যাতিতা রোহিঙ্গা নারী।

 

এ ক্রান্তিকাল মৌন জড়তার নয়।

কবি তোমার কলম থেকে ঝরে পড়ুক লাল অশ্রু।

রক্ত-আঁচড়ে শব্দগুলো আগুনের ফুলকি হয়ে

কাগজের ক্যানভাসে জ্বালুক ফোটা ফোটা অগ্নিমশাল।

অনভ্যাসের মরচে ধরা হাত আমার সামনে প্রসারিত।

 

সলতেটা বাড়িয়ে দাও সূর্যাস্ত।

আলোর কুচিগুলো সব নিষ্পভ হয়ে গেছে।

এই গাঢ় অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে

খুঁজে ফিরি আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই।

 

তৃ ষি ত  ঠোঁ ট

অবশেষে তোমার দেখা পেলাম,

যখন চৈতের করমচা-দিঘি শুকিয়ে প্রায় হাঁটুজল,

প্রতীক্ষার ঘোলাজল যখন পারা ওঠা প্রতিবিম্বহীন আর্শিফলক,

ঠিক তখনই তোমার দেখা পেলাম।

নিকষ কালো ওড়নার ফাঁকে মাথা গলিয়ে

যেন এক প্রজ্ঞাশীল চন্দ্রিমা।

 

তোমায় খুঁজেছি কতকাল-

সিলসিলা থেকে কলাভবনের সবুজ কার্পেট,

ছলকে ওঠা চায়ের কাপে,

পাম গাছের চিরল পাতায়,

নৈরাশ্যের প্লানচেট অহর্নিশ বিলাপ করে ফেরে।

 

অবশেষে তুমি এলে এবং অকস্মাৎ,

অধরের দিগন্তরেখায় শেষ বিকেলের

আবির রঙা অস্তরাগ নিয়ে।

যেন সদ্য উন্মোচিত টসটসে কমলার কোষ।

আবেগে থরো থরো মদিরা বাতাসে মৃদু কম্পমান

শতাব্দীর চক্রকাল পেরিয়ে প্রতীক্ষিত আমি

নিমীলিত চোখে স্বাপ্নিক মোহাবিষ্টতায়

সেই নৈঃসর্গিক পানয়োলারূপী রক্তিম অধরে

নেমে আসে আমার তৃষিত ঠোঁট।

Leave a Reply

Your identity will not be published.