নীল ধ্রুবতারা (পর্ব ২১)

নীল ধ্রুবতারা (পর্ব ২১)

[এই পত্রোপন্যাসটি মূলত দুজন মানুষের গল্প। ফাহিম আর সিমির। একজন থাকে আমেরিকায়, অন্যজন বাংলাদেশে। একটা অনাকাঙ্খিত ই-মেইলের কারণে দুজনের পরিচয় হয়েছিল। ভুল থেকে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর বিচ্ছেদ। এর মাঝে ই-মেইলে দুজন অসংখ্য পত্র আদান-প্রদান করেছে। সেইসব পত্রে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, মনস্তত্ত্ব— সবই ফুটে উঠেছে। আজ পড়ুন ২১তম পর্ব।]

প্রথম পর্ব  দ্বিতীয় পর্ব  তৃতীয় পর্ব চতুর্থ পর্ব পঞ্চম পর্ব 
ষষ্ঠ পর্ব সপ্তম পর্ব অষ্টম পর্ব নবম পর্ব দশম পর্ব পর্ব ১১ পর্ব ১২ 
পর্ব ১৩ পর্ব ১৪ পর্ব ১৫ পর্ব ১৬ পর্ব ১৭ পর্ব ১৮ পর্ব ১৯ পর্ব ২০

সিমি এখনো মাঝে মাঝে রাশেদকে চিঠি লেখে। নিজের মনের কথা, স্মৃতির কথা। চিঠির মাধ্যমে সে তার মনের ভাব প্রকাশ করে। তার জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া মানুষটি সেই চিঠির উত্তর দেবে না জেনেও সে তাকে ইমেইল লিখে এবং তার ঠিকানায় পাঠিয়েও দেয়। আজ সে আবার একটি চিঠি লিখল রাশেদকে উদ্দেশ্য করে। শিরোনাম লিখল, ‘মিসিং ইউ জান’। 

My love,

My morning dew,

My bright sunny day,

My warm woolen mitten,

My glass of hot chocolate,

My book of sweet memories,

My mountain,

My spring stream, my river, my ocean,

My bottle of spicy pickles,

My winter sunny morning,

My everything,

কেমন আছ জান? আমি যখন অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে, হৃদয়ের গভীরের যন্ত্রণায় সিক্ত, চোখের পানি মুছতে মুছতে এই চিঠি তোমাকে লিখছি, তখন তুমি ঘুমিয়ে আছ— শান্তিতে। শক্ত মাটির বিছানায় বিশ্রাম নিচ্ছ। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি ঘর, যেখানে অন্য কারও প্রবেশাধিকার নেই। খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তোমার এখন কেমন লাগছে এই কনকনে শীতের রাতে— একা একা?

আমার জান, আমার হৃদয়ের টুকরা, তোমার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। মিস করছি খুব। যদি তোমাকে এখন, এই মুহূর্তে আমার শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে পারতাম! খুব খুব ইচ্ছে হচ্ছে।

কতদিন হয়ে গেছে তোমাকে একটি চিঠি লিখি না। দশ বছর, সময়টা বেশ দীর্ঘ, তাই না? গত দশ বছর ধরে তোমাকে আমি কোনো চিঠি লিখি নি— আসলে তোমাকে আমার কোনো চিঠি লিখতে হয় নি। তুমি ছিলে আমার সামনে, সব সময়, প্রতিদিন, প্রতিরাত। আমার পাশেই ছিলে। ছিলে আমার ভালোলাগার এবং মন্দলাগার দিনগুলিতে। একটি উষ্ণ ব্লাংকেটের মতো, এক গ্লাস বরফ শীতল পানির মতো, অথবা আমার হাতের পার্সটির মতো, তুমি ছিলে আমার কাছেই, পাশেই। আমাকে কখনো একা থাকতে দাও নি। তোমার উষ্ণ আলিঙ্গন, তোমার হাসি, তোমার কাঁধ— যা কিনা আমার নির্ভরতার জায়গা, সেসব অভাব কখনোই আমাকে বুঝতে দাও নি। স্বভাবতই আমিও কখনো বুঝি নি। কখনো ভাবিও নি—তোমাকে হারানোর কথা। আজ যখন সত্যিই তুমি নেই, এই পৃথিবীর কোথাও তোমার অস্তিত্ব নেই, হঠাৎ করেই আমার সমস্ত পৃথিবীই আমার কাছে নেই হয়ে গেছে। আমার চারিদিকটাই শূন্য। নিস্তব্দ। আমার কোথাও কেউ নেই। আমার শূন্যতা বিভীষিকার মতো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কুরেকুরে খায়।

আমাকে এভাবে কেন একা ফেলে তোমাকে চলে যেতে হলো? কিসের এত তাড়া ছিল তোমার? আমার সঙ্গে আর কিছুদিন থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো তোমার? তুমি চলে যাবে অথচ একবারের জন্যেও আমাকে জানাও নি। আমাকে একবার বলেও গেলে না। কিসের এত অভিমান ছিল তোমার? অথচ আমাকে না বলে তুমি কখনো কোথায় যেতে না। আমি কী করেছিলাম। কী অপরাধে আমাকে এভাবে ফেলে চলে গেলে? কেন জান? কেন? তুমি না আমাকে অনেক ভালোবাসতে? বাসতে না? ভালোবাসার মানুষকে একা ফেলে এভাবে কেউ চলে যায়?

আমি জানি তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। তোমার কষ্ট দেখে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আমি কিছুই করতে পারছিলাম না। এতটা অসহায় আমি কখনোই বোধ করি নি। তোমাকে নিয়ে শেষ যেদিন হাসপাতালে গেলাম, তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তোমার মুখের দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। কান্নায় আমার চোখ ভিজে যাচ্ছিল। যদিও আমার মন বলছিল তোমাকে খুব শীঘ্রই বাসায় নিয়ে যেতে পারব। আমরা একসাথে সকালের নাস্তা করলাম, কিন্তু কে জানত সেটিই হবে আমাদের একসাথে বসে শেষ নাস্তা করা। যদি জানতাম, তবে তোমার সব পছন্দের আইটেমগুলো তৈরি করে রাখতাম। আলুর দম, লুচি, মুরগি ভুনা, দই বড়া, আরও কত কী! আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবি নি যে তুমি আর কখনোই ফিরে আসবে না।

যেদিন তোমাকে আইসিইউ-তে প্রথমবারের মতো নেয়া হলো, আমার বিশ্বাস ছিল— তুমি ফিরে আসবে। তোমার ওপর আমার আস্থা ছিল। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবেন এবং দিয়েছিলেনও। তার প্রতি আমি যে কত কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু তুমি দ্বিতীয়বার আর ফিরে আসতে পারলে না। কেন ফিরলে না? আমি কি খুবই খারাপ কিছু করেছিলাম? কী এমন অভিমানে, কষ্ট নিয়ে তুমি চলে গেলে?

আজ তুমি নেই। তুমি আমার জীবনে আর কোনোদিন ফিরেও আসবে না। অথচ এই নিষ্ঠুর সত্যটাকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। মনে আছে জান, একটা পারিবারিক ঝামেলায় আমি খুব ফ্রাস্ট্রেটেড ছিলাম, কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। হতাশা যখন একটু একটু করে গ্রাস করছিল আমাকে, তখন তুমি আমার ডায়রিতে লিখেছিলে, "Life at times seems to me like a losing battle, but I never gave up the fight." তুমিই তো আমাকে শিখিয়েছিলে, সমস্যা যতই গুরুতর হোক, কিছুতেই যেন হাল ছেড়ে না দিই। তাহলে তুমি কেন এত সহজেই হার মেনে নিলে, জান?

সেই রাতটির কথা আমার এখনো মনে আছে খুব। সে রাতে আমি রেড ক্রিসেন্ট ব্লাড ব্যাংকে গিয়েছিলাম তোমার জন্য প্লেটলেটস সংগ্রহ করতে। তুমি কী ভীষণ চিন্তায় পড়েছিলে, আমি এত রাতে একা কীভাবে যাব সেখানে? ফিরেই-বা আসব কী করে? এত চিন্তা ছিল আমাকে নিয়ে, আমার একা থাকা নিয়ে, তাহলে এখন কেন আমাকে একা ফেলে চলে গেলে জান? একবারের জন্যেও ভাবলে না যে আমি একা একা তুমিহীন বাকি জীবনটা পার করব কী করে?     

ভোর তিনটায় ব্লাড ব্যাংক থেকে আমি যখন তোমার জন্য প্লেটলেটস নিয়ে ফিরলাম, তোমার মুখের সেই প্রসন্ন হাসি আমি কোনোদিন ভুলব না। এমন নির্মল বিশুদ্ধ অকৃত্রিম হাসি আমি আর কখনোই দেখি নি।

যেদিন থেকে তুমি কোমাতে চলে গেলে, আমি প্রতিটা দিন তোমার কাছে গিয়েছি। তোমার হাত ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছি। যেন আমার শরীরের উষ্ণ ভালোবাসা হাতের মধ্য দিয়ে তোমার শরীরে পৌঁছে যায়। তুমি কি অনুভব করতে জান? আমি জানি তুমি করতে। আমি কথা বললে তুমি সাড়া দিতে। আমার হাতের মধ্যে তোমার আঙুলগুলো প্রাণ ফিরে পেত। উষ্ণতা ফিরে পেত। আমি বুঝতে পারতাম তুমি আমার কথা শুনছ। আমার হাতের মুঠোয় তোমার হাতের চাপ আমি স্পষ্ট বুঝতে পারতাম। তোমাকে আমার তখনকার মনের অবস্থা যদি বোঝাতে পারতাম! আমি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে যেতাম। শিহরিত হতাম। তোমার কানের কাছে মুখ নিয়ে শুধু বলতাম, ফিরে এসো জান। তোমাকে ফিরতেই হবে। প্লিজ কাম ব্যাক। তখন ডিউটিতে থাকা ডাক্তার আমাকে নিষেধ করত, আমি যেন তোমায় না ডাকি। কথা না বলি। আমার ডাকে তোমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যেত। তাতে অতিরিক্ত চাপে তোমার ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তুমি নিশ্চয়ই আমার কথা শুনতে পেতে, বুঝতে পারতে তাই না? নিশ্চয়ই, তা নাহলে তোমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যেত কেন?

আমার জান, আমার ভালোবাসা, তুমি কখনোই আমাকে না বলে বাসার বাইরে যেতে না। আমাকে বিদায় না বলে কোথাও যেতে না। অথচ তুমি এত দূরে চলে গেলে চিরদিনের জন্য, আমাকে একবার বলেও গেলে না। কেমন স্বার্থপরের মতো, আমার কথা একবারও না ভেবে, এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমাকে একা ফেলে তুমি চলে গেলে। কেন জান কেন? আমি তোমাকে ভীষণভাবে মিস করছি। প্লিজ ফিরে এসো। প্লিজ প্লিজ প্লিজ। এখন যে তোমাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন। তোমায় ছাড়া আমি নিঃস্ব। শূন্য। আমার চারিদিকে শুধুই শূন্যতা। তুমি ছাড়া বেঁচে থাকা অর্থহীন। আমি তোমাকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি। অনেক।

-তোমারই সিমস  

আজ সিমির কী হয়েছে কে জানে!

সে তার মৃত স্বামীকে উদ্দেশ করে লেখা চিঠিখানির কপি একই সাথে ফাহিমকেও পাঠিয়ে দিল। কেন দিল কে জানে!

অল্প ক’দিনেই সিমির জীবনে ফাহিম অনেকখানিই জড়িয়ে গেছে। আর সেই কারণেই হয়তো সিমি রাশেদকে লেখা তার ইমেইলটি ফাহিমকে পাঠিয়ে দিয়েছে। কাজটি হয়তো সে তার অবচেতন মনেই করেছে— হতে পারে সে তার অনুভূতি, কষ্টের স্মৃতি ফাহিমের সাথে ভাগ করে নিয়ে নিজেকে হালকা করতে চায়।

চিঠির শেষে সিমি একটি কবিতার কয়েকটি লাইন লিখল। সিমির স্বভাব বিশ্বের বিখ্যাত কবি লেখকদের জনপ্রিয় লেখা কিংবা কবিতা থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি চিঠির শেষে লিখে দেওয়া। আজ সে লিখল আমেরিকান লেখক এডওয়ার্ড এভারেট হেল-এর অতি বিখ্যাত কবিতার লাইন, ‘আই অ্যাম অনলি ওয়ান’।

I am only one,

But still, I am one.

I cannot do everything,

But still, I can do something;

And because I cannot do everything,

I will not refuse to do something that I can do.

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.