শম্পা কী চায়? (পর্ব ১১)

শম্পা কী চায়? (পর্ব ১১)

[থ্রিলার উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রতি পদে রহস্য ও রোমাঞ্চের হাতছানি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার জাহিদ আহমেদ। ঢাকার রেডিসন হোটেলে শম্পা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানের একটি রুমে শম্পার সঙ্গে যাওয়ার পর কী ঘটে, তা জাহিদের মনে নেই। এরপর শম্পা জাহিদের ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির ছাত্রী সেজে তার পিছু নেয়, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওর ভয় দেখিয়ে  ব্ল্যাকমেইলিং করতে থাকে...। এক সময় শম্পা খুন হয়। কে খুন করল শম্পাকে? জাহিদ আহমেদ নাকি অন্য কেউ? নাকি অন্য রহস্য জড়িয়ে আছে এখানে? আজ পড়ুন ১১তম পর্ব।]

 

ডিড ইউ স্লিপ উইথ হার?

আকাশে এখন মাতাল জোছনা। বসন্ত বাতাসে মন হু হু করা কামিনী ফুলের সুঘ্রাণ। অথচ রোকসানা অশান্ত মনে ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে। ওর চোখে টলমল করছে এক সমুদ্র জল। ও আমার উত্তরের অপেক্ষা করছে।

গত কয়েক মাস ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি এই ভয়ংকর মুহূর্তটি এড়ানোর। কিন্তু কী লাভ হলো? যতই মিথ্যে বলেছি ততই পায়ে পায়ে বিপদে জড়িয়েছি। আমি রোকসানার কাঁধে আলতো করে হাত রাখলাম। ও হাত সরিয়ে দিল না। কম্পিত কণ্ঠে বললাম, শম্পার সঙ্গে শুয়েছি কি না আমি জানি না রুকিমণি।

এটা কোনো উত্তর হতে পারে না।

আমি সত্যি সত্যি জানি না। ওরকম কিছু হলে মনে থাকত। আমার তো কিছুই মনে নেই।

এমন মোহনীয় রাত গভীর আবেগে প্রেমের কবিতা পড়ার শ্রেষ্ঠ সময়। অথচ আমি এখন রোকসানার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে অস্বস্তিকর আলাপে মেতেছি। এত যে লুকোছাপা করলাম, ইঁদুর বিড়াল খেললাম, ভবিতব্য এড়াতে পারলাম না। হিংস্র সত্য সজারুর কাঁটা ফুলিয়ে ঠিকই দাঁড়িয়েছে আমাদের দুজনার মাঝে।

রোকসানার মতো ঠান্ডা মাথার মেয়ে পর্যন্ত এখন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, দ্যাখো রুকুমণি আমি ছাত্রীদের সঙ্গে একটু আধটু ফ্লার্ট করি। তুমি সেটা ভালোই জানো, হয়তো মুখে কিছু বলো না। কিন্তু তুমি এটাও জানো যে, আমি নিজের চারপাশে একটা সীমারেখা টেনে রেখেছি। ওর বাইরে আমি কখনো পা দিই নি।

শুধু এবার ছাড়া। ইউ ক্রসড দা লাইন দিস টাইম জাহিদ।

গতকাল রাতে সিরাজ ভাই পুলিশ কাস্টডিতে এসে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, সব শুনে ব্লাড স্যাম্পল নেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। রোকসানাকে ওরা দেখা করার অনুমতি দেয় নি। আমাকে থানা হাজতেই রাত কাটাতে হয়েছে। সিরাজ ভাইয়ের পরামর্শ মতো আমি আর মুখ খুলি নি। আজ দুপুরে ওরা আমাকে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির করেছে। চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর হাজির করাই নিয়ম, তা না হলে আমাকে ছেড়ে দিতে হতো।

ওসি মকবুল আমার মুখ থেকে কথা বের করবার জন্য তিন দিনের রিমান্ড চেয়েছিলেন। কিন্তু কাজ হয় নি। ঝানু ব্যারিস্টার সিরাজ ভাই চার শ’ নিরানব্বই ধারায় আমাকে অন্তবর্তীকালীন জামিনে ছাড়িয়ে এনেছেন। তবে মোটা অঙ্কের বেইলবন্ড লেগেছে। যে-কোনো সময় ওরা ডাকলে আদালতে হাজিরা দিতে হবে।

আজ অনেকগুলো নিউজপেপার আমাকে নিয়ে রগরগে প্রতিবেদন ছেপেছে। ‘প্রথমা লো’ পত্রিকার শিরোনাম ছিল, মগবাজারের অ্যাপার্টমেন্টে সুন্দরী যুবতী খুন, সন্দেহের কাঠগোড়ায় লম্পট প্রফেসর জাহিদ আহমেদ। অথচ এই ‘প্রথমা লো’ পত্রিকাই প্রোভিসিকে নিয়ে আমার ভাইরাল ভিডিও লিক হওয়ার পর লিখেছিল, একজন প্রফেসর জাহিদ আহমেদ, জাতির অনির্বাণ বিবেক।

এই দেশের মানসিকতায় অভিযুক্তরা নাকি গিল্টি আন্টিল প্রুভেন ইনোসেন্ট, আর বিদেশে অভিযুক্তরা ইনোসেন্ট আন্টিল প্রুভেন গিল্টি। এ কারণে আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয় খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সাময়িকভাবে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করেছে। ফিলোসফি ডিপার্টমেন্টের ছাত্রছাত্রীরা আমার ফাঁসির দাবিতে ভিসির অফিস ঘেরাও করেছে।

আজ বিকেলে আদালত থেকে বাসায় এসে দেখলাম, মিলি ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। মিলি ওর মাকে বলেছে আর কখনো ভার্সিটিতে যাবে না। নিজের প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে যদি নিজের বাবার অবৈধ সম্পর্ক থাকে, আর বাবা যদি সেই বান্ধবীকে খুন করে মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলে, তখন কি আর লোকসমাজে মুখ দেখানো যায়?

আমি রোকসানাকে সব ঘটনা খুলে বলেছি। র‌্যাডিসন হোটেলে কী ঘটেছিল, ইউনভার্সিটিতে শম্পা ইংরেজির ছাত্রী সেজে কীভাবে আমার পিছু লেগেছিল, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওর ভয় দেখিয়ে শম্পার ব্লাকমেইলিং, কক্সবাজারে ডুবে যাওয়ার অভিনয়, আমাকে অপমান করে যখন তখন চান্দু বলা। মিথ্যার বাঁধ ভেঙে সব সত্য আজ বন্যার জলের মতো বেরিয়ে এল। রোকসানা কোনো কথা বলে নি, এই বিশাল ধাক্কা সামলাবার জন্য সময় নিচ্ছিল।

রোকসানা যখন ছাদে দাঁড়িয়ে বলল, ইউ ক্রসড দ্য লাইন, আমি মিহি প্রতিবাদ করে বললাম, সেটা নাও হতে পারে রুকিমণি। সিরাজ ভাই কাল রাতেই আমার ব্লাড স্যাম্পল পরীক্ষার জন্য দিয়েছে। রিপোর্ট আসুক তারপর ওসব বলো।

এতদিন ধরে এত কিছু ঘটল, তুমি শুরুতেই আমাকে বলো নাই কেন?

আমি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম হোটেলে আদৌ কিছু ঘটেছিল কি না। তাছাড়া আমার সাহসে কুলোচ্ছিল না।

তুমি হাজবেন্ড হিসেবে পারফেক্ট না। সেটা আমি আশাও করি না। তাহলে সবাই নবী হয়ে যেত। কিন্তু এটা ভাবতে খুব কষ্ট হয় যে ইংরেজি বিভাগের একজন ফুল প্রফেসর বাস্তব জীবনে এমন গাধা হতে পারে। ওই যে তুমি ক্লাসের মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করো, হিরোগিরি দেখাও সেটাও একটা গাধামো। কিন্তু এখন সবচেয়ে খারাপ কী লাগছে জানো?

কী?

একটা রাস্তার মেয়ে আমার হাজবেন্ডকে চান্দু চান্দু করছে আর আমার হাজবেন্ড সেটা মুখ বুজে চুক চুক করে মেনে নিচ্ছে।

আমি চুপ করে রইলাম। মনে হচ্ছে রোকসানা এ যাত্রা আমাকে ক্ষমা করে দেবে, আমার পাশে দাঁড়াবে। তা না হলে ও এতক্ষণে বাড়ি ছেড়ে নিজের বাসায় চলে যেত। আমি কোনো কথা না বলে চাতকের মতো ওর মুখপানে চেয়ে রইলাম। রোকসানা বলল, তাহলে তুমি জানো না ওই মেয়ের সঙ্গে শুয়েছ কিনা?

না, ব্লাড রিপোর্ট আসলে একটা আইডিয়া পাওয়া যাবে।

কী আইডিয়া পাওয়া যাবে?

আমি ইচ্ছে করে কিছু করেছি কিনা।

একটা কথা পরিষ্কার করে বলো।

কী কথা?

ডু ইউ লাভ হার?

প্রশ্নই ওঠে না, কেন আমি ওই মেয়েকে ভালোবাসব?

তুমি কি ওকে খুন করেছ? আমাকে ছুঁয়ে সত্যি করে বলো। যদি মিথ্যা বলো আমি অসুখ হয়ে মারা যাব।

তুমি কি পাগল হয়েছ? আমি তো ঠিকমতো ছুরিই ধরতে জানি না। মেয়েদের কবিতা শোনানো ছাড়া আর কিছু করেছি জীবনে?

তুমি বলতে চাইছো অন্য কেউ খুন করে তোমাকে ফ্রেইমিং করছে?

সে রকম কিছুই হবে। আমি বুঝতে পারছি না।

রোকসানা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো তার মন। আমি যদি তোমার মন হারাতাম তাহলে নিজেকে নিঃস্ব মনে করতাম। আমার মনে হচ্ছে না আমি তোমার মন হারিয়েছি। আর তোমার শরীরের খবর তো তুমি নিজেই দিতে পারছো না। সে জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ভেবেছিলাম আমি এই সংসার ছেড়ে চলে যাব। না, আমি এখনই যাব না। আগে খুঁজে বের করতে হবে এই চান্দুওয়ালির কী হয়েছে। যদি সে বেঁচে থাকে তাহলে কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে ওর দুই গালে দুটো দুটো চড় মেরে বলব, আমার হাজবেন্ডকে কোন সাহসে চান্দু বলিস?

ভরসা পেয়ে আমি রোকসানাকে মেঘনা ব্রিজ থেকে লাফ দেওয়ার কাহিনি বললাম। মমতাময়ী রোকসানা এবার আমাকে কাছে টেনে বলল, নিজেকে কেন এত একা ভাবো বলো তো? আমরা তো আছি তোমার পাশে।

এই সময় মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। অনেক দিনের অভ্যাসের কারণে ভয় পেয়ে ভাবলাম, শম্পা নয় তো। দেখলাম সিরাজ ভাই ফোন করেছেন। ফোন ধরতেই সিরাজ ভাই বললেন, তোমার ব্লাড রিপোর্ট এসেছে।

কিছু পাওয়া গেল সিরাজ ভাই?

হুম। অ্যাজ ইউ গেসড, তুমি সম্ভবত ইনটক্সিকেটেড ছিলে।

কফি খেয়ে আমার খারাপ লাগছিল।

রোহিপনলের নাম শুনেছ?

না।

ডেইট রেইপ ড্রাগ।

মানে?

এটার কেমিকেল নাম বেনজোডায়াজিপাম। পশ্চিমা দেশে বেশি চলে। মেয়েদের যে-কোনো ড্রিংকসে রোহিপনল মিলিয়ে দিলে ওদের আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। একটা ঘোরের ভেতর চলে যায়। তখন ওদের নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করা যায়। ধাতস্থ হওয়ার পর ওদের তেমন কিছুই মনে থাকে না।

আপনি বলতে চাইছেন আমার ক্ষেত্রে উল্টো হয়েছে? শম্পা আমাকে রোহিপনল খাইয়ে যা মন চায় করেছে?

হুম, তোমাকে সে সম্ভবত দুবারই রোহিপনল খাইয়েছে। তবে হয়তো কিছুই করে নি, দু একটা ছবিটবি তুলেছে। কে জানে!

আমি ফোন ধরে স্তব্ধ হয়ে রইলাম। শম্পা কেন আমার সাথে এমন করল, সে আসলে কে? সিরাজ ভাই বললেন, ও হ্যাঁ বলতে ভুলে গেছি। তোমার ব্লাডে ট্রেস আমাউন্ট ক্লোরোফর্ম পাওয়া গেছে।

মারুফের খোঁজ পেয়েছেন? সে তো আমার ফোন ধরছে না।

মারুফ থাইল্যান্ডে। আমার লোকজন যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে।

সিরাজ ভাইয়ে সঙ্গে কথা সেরে আমি সব রোকসানাকে জানালাম। রোকসানা বলল, শম্পা তোমাকে ডেইটরেইপ ড্রাগ খাইয়েছে?

হুম।

কী আর বলব, তুমি আসলেই একটা চান্দু। কিন্তু তাই বলে শম্পা তোমাকে চান্দু বলবে কেন?

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.