‘অসাধারণ’, ‘মাইলস্টোন’ এইসব অভিধা ক্লিশে মনে হবে মেজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রটি দেখলে। কেননা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন চলচ্চিত্র আগে নির্মিত হয় নি।
এ দেশের সমুদ্রতীরবর্তী মানুষদের গল্প বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে। এইসব চলচ্চিত্রের শুটিং হয়েছে প্রধানত এফডিসিতে, সামান্য অংশ উপকূলের কোনো গ্রাম বা চরে। আর আবদুল্লাহ আল-মামুনের ‘সারেং বউ’ (১৯৭৮) চলচ্চিত্রে তো এই দুর্বলতা বেশ স্পষ্ট। এই ত্রুটি থেকে পুরোপুরি মুক্ত ‘নোনাজলের কাব্য’ (২০২১)। রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিতের এই চলচ্চিত্রের শুটিং হয়েছে উপকূলবর্তী এলাকাতেই। তবে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হাওয়া’র ক্যামেরা (শুরুর সামান্য অংশ ছাড়া) ঘুরে ফিরেছে মাঝ সমুদ্রে। দেশীয় চলচ্চিত্রে এমন দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা প্রথম।
একটি মাছ ধরার ট্রলার বা বোটকে কেন্দ্র করে ‘হাওয়া’র গল্প গড়ে উঠেছে। এতে দেখা যায়- চাঁন মাঝি, নাগু, ইব্রাহিম, উরকেস, পারকেসসহ কয়েকজন জেলে বোটে চড়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। একদিন হঠাৎ তাদের জালে এক নারী (গুলতি) ধরা পড়ে। শুরুতে তাকে মৃত ভাবা হলেও দেখা গেল, সে জীবিত। এই নারীটি ট্রলারে আবিভূর্ত হওয়ার পর ঘটতে থাকে নানা ঘটনা- মাছ না ওঠা, তেলের ড্রাম ফুটো হওয়া...। এক সময় পুরো ট্রলারেই বেঁধে যায় হাঙ্গামা।
চলচ্চিত্রটি শুরু হয় বন্দর থেকে। মানুষজনের ভিড়। চাঁন মাঝিকে দেখা যায়, একটি সেলুনে শেভ করছে। একজন ক্যানভাসার লোকদের উদ্দেশে বলছে, ‘এই দুনিয়ায় আমিও দুইবার মইরা গ্যাছিলাম। আমার লগেরগুলা মইরা ভূত হইয়া গ্যাছে। আমি শুধু বাঁইচা গ্যাছি।’ ক্যানভাসারের কথায় কেমন যেন হেঁয়ালি। আসলে সে চিত্রনাট্যকার-পরিচালকেরই বার্তা বহন করছে। ইংগিত দিচ্ছে ছবিটির প্রকৃতি সম্পর্কে। এক পর্যায়ে সে বলে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা। হ্যাঁ, ‘হাওয়া’য় বিশ্বাসযোগ্য বিষয়ের পাশাপাশি অবিশ্বাস্য বিষয়ও রয়েছে।
আমরা দেখি, চাঁন মাঝি একটি খাঁচায় বন্দি পাখিসহ বোটে ওঠে। তার নির্দেশে ইব্রাহিম ইঞ্জিন চালু করে। মাস্তুলে বসে চাঁন মাঝি দিকনির্দেশনা দেয়। বোট এগিয়ে চলে। গভীরে সমুদ্রে, যেখানে মাছের বসতি, সেখানে বোট নোঙ্গর করে। জেলেরা জাল ফেলে সমুদ্রে। এক সময় জালে মাছের অস্তিত্ব অনুভব করে তারা। জাল গুটিয়ে ফেলে। সেই জালে ধরা পড়া অসংখ্য মাছ তারা ডেকে স্তুপ করে। সেইসব মাছ বোটের নিচের সংরক্ষণঘরে নিয়ে যায়। বরফ দিয়ে যত্ন করে রাখে। এইভাবে দর্শকদের চোখের সামনে একদল জেলের জীবন ফুটে ওঠে। দর্শকেরা তখন সম্মোহিত। হ্যাঁ, তারা তো সত্যিকারের জেলেদেরই দেখছে। এভাবেই চলচ্চিত্রকার দর্শকদের বিশ্বাস অর্জন করেন।...এরপরই গল্প নতুন দিকে মোড় নেয়, অবিশ্বাস্য ঘটনার দিকে; পরাবাস্তব বা মিথ-আশ্রিত আধুনিক রূপকথার দিকে। আর এই ব্যাপারটির সূচনা ঘটে বেদেনি গুলতির আবির্ভাবের পর। সে যে সাধারণ কোনো নারী নয়, সেটির আভাস দেন চলচ্চিত্রকার নেশাগ্রস্ত নাগুর (নাসিরউদ্দিন খান) চোখে জালের মাঝে ধরা পড়া গুলটিকে একটি মাছ হিসেবে দেখিয়ে। পরে পেঁয়াজের খোসার মতো অবিশ্বাস্য গল্পের জট খুলতে থাকেন চলচ্চিত্রকার। ক্রমশ গুলতির রহস্যময়তাও গাঢ় হতে থাকে। গুলতির সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে গিয়ে চান মাঝিসহ আরেকজন নাস্তানাবুদ হয়; বোবা গুলতির মুখে কথা ফোটে; মাছ কম ধরা পড়ছে, এ কথা শুনে অন্য একটি বোটের মাঝি সংরক্ষণঘরে উঁকি দেয়, গুলতি সেখানেই লুকিয়ে ছিল অথচ তাকে তখন দেখা যায় না; ইব্রাহিমের মুখে যখন গুলতি শোনে যেহেতু মাছ ধরা পড়ছে না সেহেতু তারা বন্দরে ফিরে যাবে, তখন গুলতি বলে, ‘আর যদি মাছ ধরা পড়ে?’ এরপর সত্যি জেলেরা কল্পনাতীত মাছ পায়...! এক সময় জানা যায়, সে বেদের মেয়ে। বাবার হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য, চাঁন মাঝিকে খুন করার জন্য সে এই বোটে আশ্রয় নিয়েছে। আর এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছে দেবী, তাকে মাছে রূপান্তরিত করে। এ পর্যায়ে বোদ্ধা দর্শকদের মানসপটে ভেসে ওঠে চাঁদ সওদাগর ও মনসার উপাখ্যান। তারা ভীষণ বিস্মিত হয় আর তা চূড়ান্ত পর্যায় লাভ করে শেষ পর্যায়ে। অবশ্য এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হলো, শিল্পের একটি অবগুণ্ঠন থাকে আর সেটি এখানে উন্মোচন করে দিয়েছেন চলচ্চিত্রকার-চিত্রনাট্যকার। এটি না করলে কী হতো না? ছবিটি কি এভাবে শেষ হতে পারত না- মাস্তুলের উপরে মৃত ইব্রাহিম, একটি সাপ গলা পেঁচিয়ে তাকে প্রগাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছে! অবশ্য এ কথাও আমি কবুল করছি যে, বিষয়টি সব শ্রেণির দর্শকদের কাছে বোধগম্য হতো না। দর্শকদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য এমন করেছেন চলচ্চিত্রকার। তার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল, দর্শকদের একটি প্রবল ধাক্কা দেওয়া। এ ক্ষেত্রে তিনি বেশ সফল।
যে কোনো মহৎ শিল্পের কয়েকটি স্তর থাকে, যা দর্শক-সমালোচকদের অন্য ভাবনায় তাড়িত করে। ‘হাওয়া’রও এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন জেলেদের সঙ্গে চাঁন মাঝির ব্যবহার দেখে মনে হয়, এ যেন শাসক-শাসিতের সম্পর্ক। চাঁন মাঝি উপড়ি আয়ের জন্য সব সময় মাঝ নদীতে কিছু মাছ অন্যদের কাছে বিক্রি করে দেয়, মহাজন জানতে পারে না। বলাই বাহুল্য, মাছ বিক্রির এই টাকার সিংহভাগ কুক্ষিগত করে চাঁন মাঝি। এ ব্যাপারে ইব্রাহিম প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সে টাকার সমান-সমান অংশ দাবি করে। তাকে সমর্থন করে নাগু। তখন তাদের ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করে চাঁন মাঝি। এভাবে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি অনুসরণ করে সে।...চাঁন মাঝি বড়ো স্বার্থপর। তার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ালে কয়েকজন জেলেকে খুন করতেও দ্বিধা করে না; খেতে দ্বিধা করে না পোষা পাখিকেও। তখন তাকে ভীষণ ভীতিকর মনে হয়; রাক্ষসের মতো লাগে।
আবার এই ভাবনাও দর্শক-মানসে আসতে পারে যে, বোটে চান মাঝিসহ অন্যদের অবস্থানের মাধ্যমে চলচ্চিত্রকার সমাজের শ্রেণিদ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তুলেছেন। চাঁন মাঝি এখানে সমাজের এলিটদের প্রতিনিধিত্ব করছে। সে সাধারণত মাস্তুলে বসে থাকে (স্মরণীয় হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’র জহির চরিত্রটি। সে-ও মাস্তুলের ওপর বসে থাকে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে)। বোটের ডেকে অবস্থান নেয়া জেলেরা যেন মধ্যবিত্ত। আর একেবারে নিচে মেশিনঘরে থাকা ইব্রাহিম নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র শ্রেণি। দরিদ্র শ্রেণির মানুষেরা সমাজের উপর তলায় উঠে আসে রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যমে। ‘হাওয়া’য় যেমন ইব্রাহিমের স্থান মাস্তুলে হয় রক্ত ঝরিয়ে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। আর তাকে যখন স্থানচ্যুত করতে যায় চাঁন মাঝি, প্রতিক্রিয়াশীলদের মতো, তখন তাকে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়।
এ দেশে গত শতকের আশির দশকের শুরুতে বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে ‘গাংচিল’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন রুহুল আমিন। মূল কাহিনি অর্থাৎ জ্যাক লন্ডনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘সী উলফ্’-এর গল্প গভীর সমুদ্রের, এক বিচিত্র চরিত্রের জাহাজের ক্যাপ্টেনের। রুহুল আমিন মূল কাহিনির স্বাদ চলচ্চিত্রে সঞ্চার করতে ব্যর্থ হযেছেন; গভীর সমুদ্রে শুটিং করতে পারেন নি বাজেট স্বল্পতার জন্য অথবা সেই উদ্যোগ গ্রহণই করেন নি।
মেজবাউর রহমান সুমন অবশ্য ‘হাওয়া’য় শুধু গভীর সমুদ্রের গল্পই বলেন নি, তার চলচ্চিত্র নান্দনিক দ্যুতিতেও উদ্ভাসিত। যেমন চলচ্চিত্র মানেই ইমেজ আর শব্দের খেলা। শুরুতে ইমেজ তথা সিনেমাটোগ্রাফির কথা বলা যাক। এ ক্ষেত্রে কামরুল হাসান খসরুর কাজ অসাধারণ। কোনো কোনো শট দেখে মনে হয়, এটি তিনি কী করে ক্যামেরাবন্দি করলেন? তার ক্যামেরায় ‘হাওয়া’য় ধরা পড়েছে সমুদ্রের দিন-রাত্রি-সকাল-সন্ধ্যা-দুপুর; সূর্যের আলোর সঙ্গে সমুদ্রের ঢেউয়ের নাচন; জলের ভেতর তিমির অবগাহন; জোছনা রাতে সমুদ্রের অপরূপ রূপ...। আর কালার গ্রেডিং সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বিভিন্ন দৃশ্য বা শটের মেজাজ বড়পর্দায় ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে।
এবার শব্দের প্রসঙ্গ। আনুষঙ্গিক শব্দ বেশ যথাযথ- বন্দরে মানুষের কোলাহল, নরসুন্দরের ক্ষুরের শব্দ, বোটের ইঞ্জিনের শব্দ, জেলেদের জাল ফেলা বা গুটিয়ে ফেলার শব্দ, বরফ পড়ার শব্দ, বোটের উপরে হাঁটা বা দৌড়ানোর শব্দ...। সংলাপ অবশ্য দু’ একটি জায়গায় অস্পষ্ট লেগেছে। তবে সবচেয়ে কানে বেজেছে সংলাপের একই টোন, কাছে বা দূরে কোনোই পরিবর্তন নেই! দুটি উদাহরণ হলো: বোটের মাঝিদের সংলাপ লং শটে বন্দরের তীর থেকে একইভাবে শোনা যায়; শোনা যায় টপ শটে সমুদ্রের ওপর থেকেও।
সম্পাদনা প্রসঙ্গে বলা যায়, ছবির প্রথমার্ধ একেবারে টানটান। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে কিছুটা মন্থর। এখানে সম্পাদক সজল অলকের কাচি নির্দয় হওয়া উচিত ছিল।
অভিনয়ে চঞ্চল চৌধুরী নিজেকে ভেঙেছেন। চাঁন মাঝির চরিত্রে তার দুর্দান্ত পারফরমেন্স দেখে কেউ ভাবতেই পারেন, তার সেরা অভিনয় কোন চলচ্চিত্রে? ‘মনের মানুষ’, ‘আয়নাবাজি’, ‘দেবী’, ‘পাপপূণ্য’ নাকি ‘হাওয়া’য়? যাই হোক এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, চঞ্চলের সেরা অভিনয়ের অন্যতম চরিত্র চাঁন মাঝি। ‘পরাণ’-এর পরপরই শরিফুল রাজের অভিনয় সমৃদ্ধ আরেকটি স্মরণীয় চরিত্র (ইব্রাহিম) দেখা গেল ‘হাওয়া’য়। ওটিটিতে নাজিফা তুষি ভালো করছেন, তবে ‘আইসক্রিম’-এর পর বড়পর্দায় এটাই তার কামব্যাক। আর কী দারুণ কামব্যাক! এখানে অভিনয়শিল্পী হিসেবে তার উত্তরণ ঘটেছে অনেকখানি। ‘হাওয়া’য় তুষি অভিনয় করেছেন একমাত্র নারী চরিত্র বেদেনি গুলতির ভূমিকায়। ছবির অনেকখানি অংশে এই চরিত্রটি ছিল বোবা। তখন তার নীরব অভিব্যক্তিও ছিল বাঙ্ময়। চরিত্রটি সবাক হওয়ার পর সংলাপ প্রক্ষেপণ থেকে শুরু করে চোখের চাহনি- সবকিছুতেই তিনি গুলতি হয়ে উঠেছেন; তার অভিনয়ে রহস্যময়তা ঝরে পড়েছে। আর দুজনের কথাও আলাদা করে বলতে হয়, নাসিরউদ্দিন খান ও সোহেল মণ্ডল। তারাও চরিত্র হয়ে উঠেছেন।
আমরা জানি, গান ছবির গতিকে ব্যাহত করে। আরোপিত মনে হয়। তবে বাদ্যযন্ত্রসহ পারফরমারদের যদি গানটি গাইতে দেখা যায়, সেক্ষেত্রে সেটি ছবির অংশ হয়ে ওঠে। ‘হাওয়া’য় ‘সাদা সাদা কালা কালা’ তেমনই একটি গান। এখানে খমক ছাড়া আর যেগুলো বেজেছে সবই অ-যন্ত্র কাঠ, বাঁশ, হাঁড়ি, পাতিল ইত্যাদি। আর এরফান মৃধা শিবলীর কণ্ঠও জেলেদের সঙ্গে মানিয়ে গেছে।
ছবিতে বিভিন্ন দৃশ্য ও বিশেষ মুহূর্তে যে আবহসংগীত শোনা গেছে, তা পরিবেশকে জীবন্ত করে তুলেছে। রহস্য, রোমাঞ্চ, আতঙ্ক, উত্তেজনা- সব অনুভূতিই আবহসংগীতের কল্যাণে দর্শক চেতনায় গেঁথে যায়। এমন আবহসংগীত শুনলে মনে আশা জাগে, এ দেশের চলচ্চিত্রে আবহসংগীতের যে দৈন্য দশা তা নিশ্চয় কেটে যাবে।
জয়তু মেজবাউর রহমান সুমন!
Leave a Reply
Your identity will not be published.