দ্বীপের নাম ম্যাকিনেক

দ্বীপের নাম ম্যাকিনেক

স্বনামধন্য ভ্রমণলেখক, গল্পকার, অনুবাদক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক ফারুক মঈনউদ্দীন। তাঁর ধারাবাহিক ভ্রমণগদ্য ‘মরু গুহা ও দ্বীপের গল্প’-এর চতুর্থ পর্ব 'দ্বীপের নাম ম্যাকিনেক' প্রকাশ হলো আজ।

প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন...

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন...

তৃতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন...

মিশিগানের ট্রয় থেকে ম্যাকিনেক আইল্যান্ড প্রায় ২৮০ মাইলের পথ। হিউরন হ্রদের পূর্ব প্রান্তের দুটো উপদ্বীপের মাঝবরাবর জলপ্রণালি ঘেরা দ্বীপটিতে সড়কপথে যাওয়ার উপায় নেই, ফেরিবোটে চড়ে পার হতে হয় জলপথ। প্রাচীন কিংবা ঐতিহাসিক জায়গা সম্পর্কে আমার দুর্নিবার আকর্ষণের কথা জানে বলেই দুই ভ্রাতুষ্পুত্র আমার ভ্রমণসূচির সঙ্গে মিলিয়ে ঐতিহাসিক এই দ্বীপটিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আটঘাট বেঁধে তৈরি হয়ে ছিল। তাই মিশিগান পৌঁছার তৃতীয় দিনের মাথায় এক অন্ধকার ভোরবেলায় ওরা দুজন আমাদের তুলে নিয়ে রওনা হয় ঐতিহাসিক সেই দ্বীপের পথে। দীর্ঘ পথ ওরা দুই ভাই পালা করে গাড়ি চালাবে, এমনই পরিকল্পনা। সকালের আলো ফোটার অনেক আগে আমরা যখন ৭৫ নম্বর হাইওয়েতে উঠে আসি, গাড়ির দীর্ঘ সারির হেডলাইট চলমান মালার মতো ফুটে ছিল অন্ধকারের বুকে। এই কাকভোরে লোকজন ছুটে চলেছে কর্মস্থলে। কয়েক ঘণ্টা ড্রাইভ করে কাজে যেতে হবে ওদের, আবার যখন ফিরে আসবে তখন সন্ধ্যা উতরে যাবে। এ কারণেই উইকএন্ডের দুটো দিন আনন্দে কাটাতে ওরা পাগলের মতো ছুটে যায় নানান জায়গায়।

ডেট্রয়েট ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে জেনারেল মোটর কোম্পানির বিশাল কারখানা, মাত্র দিন দশেক আগে সেখানে শ্রমিকেরা শুরু করেছে ধর্মঘট। প্রদোষের ম্লান আলোতে কারখানার গেটের বাইরে গুটিকয় শ্রমিক প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বেলা বাড়লে জমায়েত হয়তো আরও বাড়বে। গেট পার হওয়ার সময় দীর্ঘ হর্ন বাজিয়ে ওদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করি আমরা। ওরাও হাত নেড়ে তার জবাব দেয়। সেই আধো অন্ধকারে ওদের উত্তোলিত হাতের আন্দোলন মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আমরা জায়গাটা পেরিয়ে যাই। উল্লেখ্য, সারা আমেরিকার প্রায় ৪৮ হাজার কর্মী শামিল হয়েছে এই ধর্মঘটে। ওদের দাবির তালিকা তেমন দীর্ঘ নয়, চাকরির নিরাপত্তা, অস্থায়ী শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করার ব্যবস্থা, উন্নত বেতনকাঠামো, ২০০০ সালের পরের দশকের মন্দার সময় বন্ধ করা স্বাস্থ্যরক্ষার সুবিধাগুলো বহাল করা ইত্যাদি। মন্দার সময়ে কোম্পানির দুরবস্থা বিবেচনা করে শ্রমিক সংগঠনগুলো মালিকপক্ষকে ছাড় দিয়েছিল, কিন্তু কর রেয়াতসহ কোম্পানি মুনাফায় ফিরলেও শ্রমিকদের দাবিগুলো উপেক্ষিত রয়ে গিয়েছিল। তাই ওদের ধর্মঘটে যাওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। বিশ্লেষকদের মতে, এই ধর্মঘটের ফলে জেনারেল মোটরস কোম্পানির দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ হবে ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি ডলারের মতো। এটা নিয়ে আমেরিকায় রাজনীতিও কম হচ্ছে না। অভিযোগ উঠেছে, ট্রাম্প প্রশাসনের দুজন কর্মকর্তা মালিক-শ্রমিকের মধ্যকার দর কষাকষিতে হস্তক্ষেপ করছে। রাজনৈতিক নেতা ও সিনেটরদের কেউ কেউ পিকেটিংরত শ্রমিকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক আখের পোক্ত করার কাজেও পিছিয়ে নেই। এ রকম ব্যাপার যে কেবল আমাদের দেশে ঘটে তা নয়, পৃথিবীর সব রাজনৈতিক নেতাই বোধ হয় এক রকম।

এত তোড়জোড় করে যেখানে যাচ্ছি সেই ম্যাকিনেক দ্বীপ এমন কোনো আহামরি জায়গা নয়, কারণ, আমেরিকার সবকিছুই বড় বড়, নাশতা করতে রেস্তোরাঁয় ঢুকলে ঢাউস সাইজের গ্লাসে কোক, পার্কিং এরিয়ায় গাড়ি রেখে আধা কিলোমিটারের হাঁটা, এমনকি সুপারমার্কেটে একটা বা দুটো আইটেম কিনতে গেলেও হাসপাতালের রোগী বহন করার আকারের ট্রলি ঠেলতে হয়। সেই আমেরিকায় তিন শ মাইলের কাছাকাছি দূরত্ব পেরিয়ে যে দ্বীপটাতে যাচ্ছি, সেটার আয়তন চার বর্গমাইল কিংবা দশ বর্গকিলোমিটারেরও কম। সকালে হাঁটতে বের হলে, অন্তত চার বা পাঁচ কিলোমিটার হাঁটার অভ্যেস রয়েছে বলে ভাবি, এই দ্বীপ তো নস্যি। সে প্রসঙ্গে পরে আসি।

প্রকৃতপক্ষে সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় উপনিবেশ হওয়ার আগে ছোট্ট এই দ্বীপটি ছিল ‘ওদাওয়া’ নামের আমেরিকান আদিবাসীদের বাসভূমি। আদিবাসীদের ভাষায় ওদাওয়া নামটি এসেছে ওদের বাণিজ্যকেন্দ্রিক তৎপরতার কারণে। ‘ওদাওয়া’ শব্দের অর্থ হচ্ছে বাণিজ্য কিংবা কেনাবেচা। লেক হিউরনের এক প্রান্তে পশুচর্মের বাণিজ্যের জন্য এই দ্বীপ ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ বাজার। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এই বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ সরকার এখানে স্থাপন করে ম্যাকিনেক দুর্গ। আমেরিকান স্বাধীনতাকামীরা এবং ব্রিটিশ বাহিনীর মধ্যে ১৮১২ সালে এখানে সংঘটিত হয়েছিল কমপক্ষে দুটি যুদ্ধ।

আমেরিকান আদিবাসীদের কাছে এই দ্বীপ এতই প্রিয় ছিল যে ওরা দ্বীপটির কাছিমসদৃশ আকৃতির জন্য এটির নাম রাখে ‘মিচিম্যাকিনেক’, অর্থাৎ বড় কাছিম। আমেরিকার বহু জায়গার নাম এসেছে আদিবাসীদের দেওয়া নাম থেকে। আমেরিকার বিভিন্ন গাড়ির নাম, যেমন পন্টিয়াক, ডজ, ডাকোটা, ফোর্ড থান্ডারবার্ড, চেরোকি, শেভ্রোলে চেয়েন, জিপ কোমানচি— এসবই এসেছে আমেরিকান আদিবাসীদের নাম থেকে। এই তালিকা দীর্ঘ হবে বলে আমাদের দেশে পরিচিত কয়েকটা নাম দিয়েই উদাহরণটা সারলাম। ব্রিটিশরা এই নাম সংক্ষিপ্ত করে এটিকে ডাকত ‘ম্যাকিনেক’ বলে। নাম সংক্ষিপ্ত করার ব্যাপারে মার্কিনীরা সিদ্ধহস্ত জানতাম, ব্রিটিশদের এই সুনাম আছে জানতাম না।

সম্ভবত এক ফরাসি-কানাডীয় ফার ব্যবসায়ী ১৬৩৪ সালে প্রথম এই দ্বীপের সন্ধান পান। এখানকার আদিবাসী আমেরিকানদের জন্য এখানে মিশন স্থাপন করেছিল ফরাসি মিশনারিরা, এই মিশনকে কেন্দ্র করে এটি হয়ে ওঠে ফারের জমজমাট বাণিজ্যকেন্দ্র। বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ফরাসিদের সঙ্গে আদিবাসীদের সংঘর্ষ ঘটতে থাকে। এই সংঘর্ষের সুযোগে উত্তর আমেরিকায় ব্রিটিশ দখলদারেরা ফরাসিদের হটানোর জন্য কৌশলগত কারণে আদিবাসীদের সঙ্গে হাত মেলায়। ফলে একসময় ম্যাকিনেক প্রণালির দখল নেয় ব্রিটিশ বাহিনী। দ্বীপের আদি বাসিন্দা বিভিন্ন আদিবাসী গোত্রের মানুষেরা শক্তিশালী ইরোকুয়েদের তাড়া খেয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়লে প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে দ্বীপটা। একটা সুরক্ষিত দুর্গের উপযুক্ত বলে ম্যাকিনেক দ্বীপের খাড়া পাড়সমৃদ্ধ মালভূমিতে ১৭৮০ সালে নির্মাণ করা হয় ম্যাকিনেক দুর্গ। তবে বেশি দিন এই দুর্গের অধিকার ভোগ করতে পারে নি ব্রিটিশরা। বছর তিনেক পর প্যারিস চুক্তির বদৌলতে পুরো ম্যাকিনেক প্রণালির দখল পেয়ে যায় আমেরিকা। তবে ব্রিটিশ বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে এলাকা ছেড়ে চলে যায় নি। ১৭৯৪ সালে আরেক চুক্তির বলে ছয়টি অঙ্গরাজ্যের ওপর (মিশিগানসহ) আমেরিকার সার্বভৌম অধিকার বলবৎ হওয়ার পরই কেবল ব্রিটিশ বাহিনী চূড়ান্তভাবে তাদের দখলদারত্ব ছেড়ে দেয়।

কিন্তু ঔপনিবেশিক ব্রিটেন আবার আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়, উভয় পক্ষে ছিল নিজ নিজ মিত্ররা। এটাকে নেপোলিয়নের যুদ্ধের অংশ বলে মনে করা হলেও আসলে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ব্রিটেন যখন ফ্রান্সকে বাণিজ্যিকভাবে পঙ্গু করার জন্য নৌপথে অবরোধ বসায়, তখন আমেরিকা আবার ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়। ব্রিটেনের প্রতি আমেরিকার বিদ্বেষ আরও বাড়ে, যখন নৌ অবরোধে যুক্ত করার জন্য দেশটি মার্কিন নাবিকদের ব্রিটিশ নেভিতে নিয়োগ দেওয়া শুরু করে এবং বসতি স্থাপনকারী আমেরিকানদের ওপর ক্রমাগত আক্রমণকারী আদিবাসী আমেরিকানদের অস্ত্র সরবরাহ করে।

এই যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী ম্যাকিনেক দুর্গ দখল করে নেয়। তবে ১৮১৫ সালে এক শান্তিচুক্তির পর দ্বীপটির অধিকার ফিরে পায় আমেরিকা। বেশ কয়েক বছর এটা জেলখানা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল। এ সময় আমেরিকান মালিকানাধীন এক ফার কোম্পানি এখানে প্রায় তিরিশ বছর ধরে পশু চামড়ার রমরমা ব্যবসা করে আসছিল। একসময় ফার ব্যবসার জায়গায় ধীরে ধীরে শুরু হয় বাণিজ্যিক মৎস্য আহরণ। গৃহযুদ্ধের পর মিশিগান ডেট্রয়েট থেকে শৌখিন মৎস্যশিকারি এবং ভ্রমণকারীরা লেক বেয়ে ও সড়কপথে এই দ্বীপে আসা শুরু করে। বাড়তি অতিথিদের জন্য এখানে গড়ে উঠতে থাকে হোটেল-রেস্তোরাঁ।  

রাতের অন্ধকার থাকতে রওনা দিয়েছিলাম বলে আকাশের চেহারা দেখার সুযোগ হয় নি, তবে আবহাওয়াবার্তা জানিয়ে রেখেছে, বৃষ্টি হবে। প্রস্তুতি হিসেবে একাধিক ছাতা নেওয়া হয়েছে। ভোরের আলো ফোটার পর আকাশের অবস্থা টের পাওয়া যায়। বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে বলে আকাশের মতো আমাদেরও মন ভার। মাঝপথে কোথাও কোথাও আচমকা মেঘের পর্দার ছেঁড়া কোনো অংশ দিয়ে সূর্য আচমকা উঁকি দেওয়ার সুযোগ পেলে আমরা সহর্ষে চিৎকার করে উঠেছি, ভেবেছি ওদের আবহাওয়াবার্তার পূর্বাভাস সব সময় কি আর অক্ষরে অক্ষরে ফলে? কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো সূর্যের সোনালি রং ছড়িয়ে পড়বে দুপাশের ঘন সবুজ অরণ্যের গায়ে। সেই বনের কোথাও কোথাও একঝলক রঙিন পাতার উদ্ভাস দেখেও আশা জেগে ওঠে যে এবার হেমন্তের বর্ণিল আগুনশিখার পূর্ণ বিকাশ দেখার সুযোগ মিলবে। কারণ, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে অবিশ্বাস্য সুন্দর এই দৃশ্য আসন্ন শীতের আগাম উপহার হিসেবেই যেন মানুষের কছে পাঠায় প্রকৃতি। তখন গাছের পাতায় পাতায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে নানা বর্ণের শিখা, একই গাছে এত বিচিত্র বর্ণের পাতার সমাহারে পুরো বনরাজি যেন হয়ে ওঠে প্রকৃতির অবারিত ক্যানভাস, এক মহাশক্তিধর শিল্পী সবার অলক্ষে বসে বুলিয়ে দিয়েছেন অদৃশ্য তুলি, কোথাও-বা মনে হয় কোনো অদৃশ্য ব্রাশ থেকে এলোপাতাড়ি সব ধরনের রং ছিটিয়ে গিয়েছেন কোনো পাগলশিল্পী। যা-ই হোক, এবারের যাত্রায় হেমন্তের অপরূপ সেই দৃশ্য আমাদের আর দেখা হয় না।           

ম্যাকিনেক দ্বীপে যাওয়ার জন্য ফেরিঘাটে যখন পৌঁছাই, তখন আরও ভারী হয়েছে আকাশের মুখ, সামান্য কিছু বৃষ্টি ঝরিয়ে দ্বীপগামী মানুষদের সাবধান করে দিচ্ছে প্রকৃতি। কিন্তু আগে থেকে পরিকল্পনা করে রাখা যাত্রা বাতিল করার অনেক হ্যাপা। এর মধ্যে একটা বরযাত্রীদল সাদা পোশাকের কনেকে নিয়ে ফেরিঘাটের ওয়েটিং এরিয়ায় ফেরির অপেক্ষায় বসে থাকে। মেয়েটির বিয়ের দিন বেছে নিয়ে আবহাওয়ার এ রকম বাজে আচরণ যেন মেনে নিতে পারছে না বেচারি। ওর মনের মতো দুধসাদা বিয়ের গাউনেও যেন ময়লারং মেঘের ছোপ পড়েছে, তাই সাদাকেও সাদা মনে হয় না। ওর সঙ্গে আসা নারী-পুরুষের একটা দল জেটির খোলা জায়গায় জড়ো হয়ে আড্ডা দিয়ে ভারী মন হালকা করতে চাইছিল। টিপটিপ বৃষ্টি ভারী হয়ে এলে সবাই হুড়মুড় করে ওয়েটিং এলাকায় ঢুকে পড়ে।

স্টার লাইনের দোতলা জাহাজটিকে ফেরিঘাটের দিকে আসতে দেখে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের মধ্যে মৃদু ব্যস্ততা জেগে ওঠে। আজ রোদেলা আবহাওয়া থাকলে এটিকে দেখাত গর্বিত সাদা রাজহাঁসের মতো, কিন্তু বৃষ্টি আর মেঘের কালো ছায়ায় ওটা যেন পাতিহাঁসের মতো জেটির দিকে এগোতে থাকে। ঘাটের কর্মীরা পন্টুনের পাশে গিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়ায়, যাতে জলযানটি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে ওটাকে পোষমানানো পশুর মতো বেঁধে ফেলা যায়।

সবার সঙ্গে সারবেঁধে উঠে জাহাজের দোতলায় একেবারে সামনের দিকে মূল চালকের কেবিনের পেছনে এক পাশের আসনগুলো পেয়ে যাই আমরা। কাপ্তানের উঁচু টুল, সামনে মিটার, গেজ, জয়স্টিক—সবই আছে, নেই কেবল চারপাশে হ্যান্ডেল লাগানো খাড়া বড় স্টিয়ারিং হুইলটা, যেটা ছাড়া কোনো জলযান কল্পনাই করা যায় না। জাহাজ ছাড়ার নির্দিষ্ট সময়ের আগেই দশাসই শরীরের কাপ্তান এসে টুলে বসেন, পাশে আরেকজন। সামনে আধখাওয়া একটা পেপসিকোলার বোতল ছিল, ওটা থেকে বেশ খানিকটা গলায় ঢেলে নিয়ে কাপ্তান প্রস্তুত হয়ে বসেন। মৃদু ভোঁতা গর্জন করে ইঞ্জিন চালু হয়ে গেছে ততক্ষণে। ঘাট বোট থেকে সরে যাচ্ছে, ঠান্ডায় জমে যাওয়া হাত আগুনের ওপর সেঁকে নেওয়ার মতো কাপ্তান হাতের তালু জয়স্টিকের পাশে সেন্সরের ওপর বাড়িয়ে ধরে হালকা এদিক-সেদিক করছেন। স্টিয়ারিং হুইল ছাড়া জাহাজটি চালানোর রহস্য ভেদ করতে পেরে আনন্দ হয়, প্রযুক্তি আমাদের চোখে অভ্যস্ত বহু জিনিসকে নাকচ করে দিচ্ছে।

ঘাট ছেড়ে জাহাজ রওনা হলে পেছনের ডেকে বের হয়ে আসি আমরা। বৃষ্টি নেই, তবে হলেও সমস্যা নেই, ডেকের এক পাশ ছাদে ঢাকা। সেখান থেকে দেখা যায় আট কিলোমিটার লম্বা ম্যাকিনেক সেতু। ওটা দিয়ে গেলেও সেন্ট ইগনেস থেকে ফেরিবোটেই পৌঁছাতে হতো ম্যাকিনেক দ্বীপে। ব্রিজটাতে আমাদের চড়িয়ে ওপারে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেছিল ভ্রাতুষ্পুত্র রনি, তবে ওখান থেকে আবার ফেরিতে চাপতে হবে বলে এই প্রস্তাব খারিজ করি। শুনেছি বেশি বাতাস থাকলে এই সেতু থেকে নাকি ছোট হালকা গাড়ি উড়িয়ে নিচে ফেলে দেয়, যদিও আমাদের বাহনটি মোটেই হালকা নয়। এমন অপবাদ শোনার পর এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে সেতুতে চড়ার অভিজ্ঞতা অর্জনের কোনো ইচ্ছে আর অবশিষ্ট থাকে না। তবে লোকমুখে যা-ই শোনা যাক, সেতু কর্তৃপক্ষের দাবি, সেতুটির পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে এ রকম ঘটনা ঘটেছে মাত্র দুটো। প্রথমটি ঘটেছিল ১৯৮৯ সালে, প্লুহার নামের এক হোটেলকর্মীর বেলায়। মহিলা প্রায় ৬০ মাইল বেগে গাড়ি চালিয়ে ব্রিজটি পার হচ্ছিলেন, বাতাসের বেগ ছিল ৪৮ মাইল, আর তাতেই গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ব্রিজের রেলিং টপকে নিচে পড়ে যায়। আট দিন পর ১৫২ ফুট গভীর থেকে গাড়িটি উদ্ধার করে পুলিশ। এই ঘটনার পর ব্রিজের ওপর গাড়ির গতিসীমা বেঁধে দেওয়া হয় ঘণ্টায় ২০ মাইলে। আরেকটি ঘটে ১৯৯৭ সালে, পুলিশের ধারণা, এটির চালক ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি নিয়ে ব্রিজের ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়েছে।

ঘটনা যা-ই হোক না কেন, ব্রিজটি সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা এমন অপবাদের কারণ জেফাইরোফোবিয়া নামের এক ধরনের ভীতিরোগ। উঁচু দীর্ঘ সেতুর ওপর গেলে মানুষের মধ্যে যে ভীতির সঞ্চার হয়, সেটিই জেফাইরোফোবিয়া। উচ্চতাভীতি বা অ্যাক্রোফোবিয়ার সঙ্গে লম্বা সেতুভীতি যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয় এটি।

যা-ই হোক, এই সেতু নিয়ে গবেষণায় আমাদের কাজ নেই। ম্যাকিনেক দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছালে দেখা যায়, সবুজ গাছগাছালির ফ্রেমের মাঝখানে অস্বাভাবিক লম্বা একটা ভবনের সফেদ কাঠামো তার অভিজাত স্তম্ভরাজি, সুরমা রঙের চাঁদওয়ারিতে গম্ভীর স্কাইলাইট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটিই এখানকার বিখ্যাত গ্র্যান্ড হোটেল। ১৮৮৭ সালে চালু হওয়া হোটেলটি সে সময় ছিল বিশ্বের দীর্ঘতম বারান্দাওয়ালা হোটেল। এখানে রাত কাটিয়েছেন কমপক্ষে পাঁচজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। বৈজ্ঞানিক টমাস আলভা এডিসন ও সাহিত্যিক মার্ক টোয়েনের মতো ব্যক্তিত্বও এই হোটেলে কখনো অতিথি হিসেবে রাত কাটিয়েছেন। হোটেলটির প্রতি রাতের ভাড়া সম্পর্কে জানার পর এটিতে এ রকম মাপের ভিআইপি অতিথিদের সমাগমের কারণ পরিষ্কার হয়। একক অতিথির এক রাতের ভাড়া রকমভেদে সাড়ে ছয় শ ডলার থেকে শুরু হয়ে এক হাজার ডলার পর্যন্ত আছে। তার ওপর তিরিশ পার্সেন্ট গুচ্ছের ট্যাক্স। এটি একনজর দেখার জন্য ঢুকতে গেলেও প্রবেশমাশুল গুনতে হয় জনপ্রতি দশ ডলার করে। বেশ কিছু হলিউড ফিল্মের অংশবিশেষের শুটিং হয়েছিল এই হোটেলে, যেমন ১৯৮০ সালের ছবি ‘সামহোয়্যার ইন টাইম’।

জেটির খুঁটির ওপর বসা গাঙচিলগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে ফেরিজাহাজটি যখন ম্যাকিনেক দ্বীপের ঘাটে এসে পৌঁছায়, তখন দুপুর। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে দ্বীপটিতে সব ধরনের যান্ত্রিক বাহন চলাচল নিষিদ্ধ। কারণ, দ্বীপের অধিবাসী মানুষ এবং ঘোড়াদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ঘোড়ার মালিকদের আরও একটা অভিযোগ ছিল যে গাড়ির শব্দে ঘোড়াগুলো আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সে কারণে এখানকার একমাত্র বাহন সাইকেল আর ঘোড়াগাড়ি। তবে চাইলে প্রাচীন যুগের মানুষের মতো পায়ে হেঁটেও প্রায় চার বর্গমাইল আয়তনের দ্বীপটিতে চলাফেরার কাজটি সেরে ফেলা যায়।

আকাশের যা চেহারা দেখা যাচ্ছে, তাতে প্রথমেই ম্যাকিনেক দুর্গ থেকে ঘুরে আসা উচিত। বৃষ্টির নখরা পুরোপুরি শুরু হয়ে গেলে বিশেষ সুবিধে হবে না। ছোট্ট শহরটির একমাত্র ঝকঝকে মেইন রোডের দুপাশে নানান ধরনের দোকানপাট, তার মধ্যে কাপড়চোপড়, গিফট শপ, রেস্তোরাঁ-বারই বেশি। আর আছে আবাসিক হোটেল। সেসবের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেলে দুর্গে ঢোকার  রাস্তার পাশে এস্কিমোদের ইগলুর মতো লম্বাটে আকৃতির ছোট একটা চ্যাপেল, পুরোটাই গাছের বাকল দিয়ে তৈরি করা। ওটা এতই ছোট যে তিন-চারজনের বেশি একসঙ্গে নড়াচড়া করা যায় না। বাইরে মাথার দিকে দুটো গাছের খুঁটি দিয়ে তৈরি সাদামাটা ক্রুশ। ষোড়শ শতাব্দীতে বাকলের এই ভজনালয় তৈরি করেছিলেন জেসুইট মিশনারিরা। আদিবাসী ইন্ডিয়ানরা এদের ‘ব্ল্যাক রোব’ বা কালো আলখাল্লা বলে ডাকত। তেমনি এক কালো আলখাল্লা পাদরি ছিলেন ফাদার চার্লস ডাবলন, প্রায় চার শ বছর আগে যিনি আদিম আদিবাসীদের মধ্যে খ্রিষ্টধর্মের আলো জ্বালাবার জন্য প্রথম চ্যাপেলটি তৈরি করেছিলেন এখানে। এখন ম্যাকিনেক দ্বীপের চ্যাপেলটি তারই প্রতিরূপ। ওটার ভেতরে কাচের ঘেরার ওপাশে অতি সাদামাটা প্রার্থনাবেদির সামনে এক কালো আলখাল্লা পাদরি আর এক উপাসনাকারীর মূর্তি।

ওখান থেকে বের হলে হালকা ঢাল বেয়ে ম্যাকিনেক দুর্গে ঢোকার পথ, সেখানে টিকিটঘরের গুমটি থেকে ধাপেধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে মূল দুর্গের দিকে। চড়াই হলেও সিঁড়িগুলো এমন যে উঠতে গেলে হাঁপ ধরে না। সিঁড়ির মাথায় উঠে বাইরের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে ম্যাকিনেক প্রণালির উন্মুক্ত জলরাশি, তার ওপর ভেসে আছে কয়েকটা ছোট ইয়ট, মাঝারি জাহাজ ইত্যাদি। অন্য পাড়ে অনুচ্চ টিলা। দুর্গটি এই প্রণালির সংকীর্ণ জলপথে শত্রুর গতিবিধির ওপর নজর রাখার উপযুক্ত স্থান। আজ এই দুর্গের নজরদারির প্রয়োজন ফুরিয়েছে, সে সময় নির্মিত আদি ভবনগুলো নিয়ে এটা এখন কেবলই এক জাদুঘর।

দুর্গে ঢোকার মুখে যে গার্ডহাউসটি পড়ে, তার নিচে রয়েছে ভূগর্ভস্থ গারদ, ব্ল্যাক হোল। বিভিন্ন অপরাধে  অপরাধী সৈনিকদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হতো এটি। নিচে নামার চৌকো দরজাটি কাচের ঢাকনা দিয়ে বন্ধ। তার ওপর সাঁটা বর্ণনায় মজার তথ্য জানা যায় যে ১৯৩৩ সালে দুর্গের মেরামতি কাজের সময় ১০৫ বছরের পুরোনো এই চোরকুঠরিটি আবিষ্কৃত হয়। এখান থেকে বের হয়ে হাতের বাঁয়ে গেলে পাওয়া যায় সেনা অফিসারদের উড হাউস, স্টোন হাউস, টি রুম, শেষ মাথায় হাসপাতাল। ওটার একটাতে অফিসারদের বার আর লাঞ্চরুম। বারে উঁকি দিতেই চমকে উঠি। সেকেলে কাঠের কাউন্টারের পেছনে টাকমাথা গোঁফওয়ালা এক লোক দাঁড়ানো, তার সামনে বিয়ারের আধখাওয়া গ্লাস, কাউন্টারের ওপর কিছু প্লেট, দুটো আপেল, দুটো বোতল, সামনে খদ্দেরের টেবিলেও বিয়ারের মগ—আধখানা খালি, হয়তো উঠে টয়লেটে গিয়েছে। ভালো করে লক্ষ করতে বোঝা গেল বারটা এভাবেই সাজিয়ে রাখা, কাউন্টারের পেছনের লোকটা আসলে মূর্তি।

১৮৮৯ সালের এক অফিসারের ডায়েরিতে পাওয়া যায় তখনকার সময়ের চমৎকার তথ্য, ‘সবচেয়ে ভালো বিয়ার (সর্বোচ্চ দামে) আমরা পেতাম। শিলজ, মিলওয়াকি ইত্যাদি বিক্রি হতো বড় মগ ৫ সেন্ট করে। বারের মুনাফার মূল উৎস ছিল এটাই’। 

এখানে ট্যাপে বিয়ার পাওয়া যেত, সঙ্গে হালকা ওয়াইন, ফ্রেঞ্চ মাস্টার্ডসহ স্যান্ডউইচ, সুইস চিজ। এসব সুবিধা দিয়ে  সেনা অফিসারদের শহরের বারে যাওয়া এবং সালোঁগুলোতে ওদের বাড়াবাড়ি ঠেকানোর চেষ্টা করা হতো। পাশের ঘরে গিয়ে বিলিয়ার্ড টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়া খেলোয়াড়কে দেখে আরেক দফা ভিরমি খাওয়ার জোগাড় আমার। যা-ই হোক, এসবই যে মূর্তি, সেটা ততক্ষণে বুঝে নিয়েছি। সেনা-অফিসারদের সে সময়কার জীবনযাত্রা প্রণালি বুঝে নেওয়ার পর বের হয়ে এলে তোড়ে নেমে আসে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টির তাণ্ডবে ততক্ষণে ভিজে জবুথবু হয়ে গেছি, আসার সময় মেজভাই প্রায় জোর করে গছিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর জ্যাকেট, আমি খাটো মানুষ বলে সেই জ্যাকেট আমাকে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত সুরক্ষা দেয়। এই সুযোগে বুঝতে পারলাম, বেঁটে মানুষেরও কিছু সুবিধা ঈশ্বর দিয়েছেন।     

বের হয়ে এলে সামনে দুর্গের সবকিছু ঝাপসা লাগে। বৃষ্টির ফাঁকে একটু জিরিয়ে নিতে চেয়ে দুই বিশাল বৃক্ষের নিচে দাঁড়িয়ে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করছিলাম যখন, তখন দুই সেনাসদস্য বন্দুক হাতে সামনের মাঠে এসে দাঁড়ান, ততক্ষণে উল্টোপাশের ব্যারাকের বারান্দায় বেশ কিছুসংখ্যক দর্শক জড়ো হয়ে গেছে। আমরা তড়িঘড়ি ব্যারাকের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। দুই সৈনিক খোলা মাঠে বৃষ্টির তীব্র ছাট উপেক্ষা করে বলে যাচ্ছেন তাঁদের দায়িত্ব এবং কঠিন সামরিক জীবনে তাঁদের করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে। তারপর, নিজেদের বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করতে সামনের দিকে নিশানা তাক করে উদ্যত বন্দুকের বাঁট বুকের উপরিভাগে ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপে দেন। বন্দুকের নলের মুখে ধোঁয়ার ঘন কুয়াশা ছড়িয়ে গুলি ছুটে গেলে শব্দের আকস্মিকতায় ওঁদের দিকে ক্যামেরা তাক করে রাখা হাত কেঁপে যায় আমার। বন্দুকের নলের মুখ থেকে বের হওয়া ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখে বুঝতে পারি লোকজন এটিকে নিছক গুলির শব্দ হিসেবে চেনে। অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় কাছে এ রকম গুলির শব্দ যে কী ভয়ের ও প্রিয় ছিল, বলে বোঝানো যাবে না। প্রায় দুই শ বছরের পুরোনো এসব ঘটনা যেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের এ রকম ডিজিটাল ছবি দিয়ে তখনকার ভয়াবহতার ছবি ফুটিয়ে তোলা যেত।

সেনা ব্যারাকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুই সৈনিকের মহড়া দেখার সময় আমার কন্যাটি আচমকা কোথাও থেকে উপস্থিত হয়। এতক্ষণ গুলির শব্দে ভয়ে কোথায় ঘাপটি মেরে বসে ছিল কে জানে! বৃষ্টির তীব্রতা থেকে মাথা বাঁচানোর জন্য এতক্ষণ সামনের মাঠে যে দুজন সৈনিক নানান কেরদানি দেখাচ্ছিল, সেই দুজন দৌড়ে এসে ব্যারাকের বারান্দায় আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। আমার মেয়েটি আমাদের কাতারে ওদের দেখতে পেয়ে খুব নির্দোষ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, আমাকে গুলি করবেন না তো?

ওরা দুজন অবিশ্বাসে ওর দিকে তাকায়, তারপর বলে, না না, কেন গুলি করব?

এবার আমার মেয়ে বলে, আপনাদের সাথে একটা ছবি তুলতে পারি?

গুলি করবে বলে আমার মেয়ের আশঙ্কা দূর করার জন্য ওরা এমন ভাব করে যেন পারলে শহরের সেরা ফটোগ্রাফারটিকে ডেকে নিয়ে আসে। বলে, অবশ্যই, নিশ্চয়ই।

এই জীবন্ত মহড়া দেখার পর দুর্গটির প্রতি আমাদের আর বিশেষ আগ্রহ থাকে না। বৃষ্টি ততক্ষণে থেমে গেছে, অতএব নেমে যাওয়া যায়।

দুর্গটি থেকে নেমে আসতে আসতে দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে যায়। বৃষ্টি ততক্ষণে ঝেঁপে এসেছে, অতএব অজুহাত হিসেবে আমরা একটা রেস্তোরাঁর ভেতর ঢুকে যাই। আশা করি আমাদের খাওয়া শেষ হতে হতে বৃষ্টি ধরে যাবে। আনুষ্ঠানিক ফুল কোর্স লাঞ্চ নয় বলে আইটেমগুলোর নাম মনে রাখি নি। লাঞ্চ শেষ হলে আমরা দ্বীপের বাকি অংশ যখন ঘুরতে বের হই, ততক্ষণে বৃষ্টি ধরে এলেও থামে নি পুরোটা। শহরের মূল সড়কে রাজকীয় চালে এগিয়ে যাচ্ছে অবিশ্বাস্য ভারী পায়ের বিশাল শরীরের ঘোড়ায় টানা গাড়িগুলো। আমাদের দেশে মাউন্টেড পুলিশের উঁচু যে ঘোড়াগুলো দেখে আমরা অভ্যস্ত, তারা এই ঘোড়াগুলোকে দেখে লজ্জায় মুখ লুকাবে। বৃষ্টি থেমে গেলে সাইকেলওয়ালারা নেমে এসেছে, আমরাও পদব্রজে। শহর প্রদক্ষিণ করতে করতে অন্য প্রান্তের দিকে হেঁটে যাই, এবারের গন্তব্য বিখ্যাত গ্র্যান্ড হোটেল। পথে যেতে যেতে দূর থেকে দেখা যায় আইসক্রিমের তিন চাকা গাড়ি। আমেরিকানদের হালচাল বুঝি না, এই বৃষ্টির মধ্যে আইসক্রিমের গাড়ি! কাছে আসার পর গাড়িটার কাজ দেখে ভুল ভাঙে। রাস্তায় চলতে চলতে ঘোড়াগুলো যে বর্জ্য ছেড়ে যায়, সেসব তুলে নেওয়াই এই গাড়ির কাজ।

আমরা সেই বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে যাই, বৃষ্টি কখনো বাড়ে, কখনো মন্দলয়ে ঝরতে থাকে। গ্র্যান্ড হোটেলের বিশাল চেহারা দূর থেকে দেখে থেমে পড়ি। ওটার মধ্যে কেবল ঢোকার জন্যই দশ ডলার করে টাকা গুনতে হবে! ক্রমাগত ঝরতে থাকা বৃষ্টি সবকিছু যখন পণ্ড করে দিয়েছে, দশ ডলার দিয়ে হোটেলটিতে ঢোকার আগ্রহ আর অবশিষ্ট থাকে না।

আমাদের ম্যাকিনেক ভ্রমণের মাত্র অল্প কয়েক দিন আগে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে হেলিকপ্টার বাহনে দ্বীপটিতে পৌঁছে আটটি গাড়ির বহর হাঁকিয়ে হেলিপ্যাড থেকে গ্র্যান্ড হোটেলে রিপাবলিকানদের সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ২০২০ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করার জন্য মিশিগানের রিপাবলিকানদের কাছে ওকালতি করা। জরুরি কাজে ফায়ার ব্রিগেড ও অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া দ্বীপে অন্য কোনো যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ হলেও পেন্সের এই গাড়িবিলাস পরিবেশবাদী ও দ্বীপটির বাসিন্দাদের ক্ষুব্ধ করেছিল। ১৯৭৫ সালে এই দ্বীপে সস্ত্রীক প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের ভ্রমণের সময়ও আমেরিকান সিক্রেট সার্ভিস একখানা গাড়ি গোপন জায়গায় মজুত রেখেছিল বটে, কিন্তু ফোর্ড দম্পতি দ্বীপে পৌঁছে ব্যবহার করেছিলেন ঘোড়ায় টানা গাড়ি। মজুত রাখা সেই গাড়ি আদৌ ব্যবহার করা হয় নি। এ ছাড়া ট্রুম্যান, কেনেডি, জর্জ বুশ, ক্লিনটন—সবাই ম্যাকিনেক দ্বীপে গিয়েছিলেন, তাঁদের কেউই শতবছরের পুরোনো রীতি ভঙ্গ করেন নি। পেন্সের গাড়িবহরকে বহনকারী শেপলার ফেরি কোম্পানি পেন্সের এই প্রথাভঙ্গকারী কাজটিতে সহায়তা করার জন্য মোটেই অনুতপ্ত নয়। তারা বলছে, আমেরিকান সিক্রেট সার্ভিসের সদস্যদের এ কাজে সহায়তা করার জন্য ওদের নাবিক-খালাসিরা বরং গর্বিত। তারা তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের জবাব দিয়েই যাচ্ছে নির্বিকারভাবে। তবে শহরের মেয়র, পুলিশপ্রধান, এমনকি সিক্রেট সার্ভিসের কেউই মুখ খুলছেন না এ ব্যাপারে। 

মিশিগান থেকে হাউস অভ রিপ্রেজেন্টেটিভ সদস্য ডেমোক্র্যাট পার্টির রাশিদা তালিব ম্যাকিনেকে পেন্সের এই গাড়িভ্রমণ সম্পর্কে এক বার্তায় বলেছেন, শতাব্দীভর যা জনগণের জন্য নিষিদ্ধ, ট্রাম্প প্রশাসন সেসব পদদলিত করে এল, যেভাবে তারা পদানত করেছে আমেরিকার সংবিধানকে। আমাদের চমৎকার দ্বীপটিতে গাড়ি চালিয়ে আসার ভিডিও দেখে আমার বমি এসে গিয়েছিল।

ডেট্রয়েটে প্যালেস্টাইনি উদ্বাস্তু পরিবারের একজন রাশিদার মতো খতরনাক সমালোচক না হয়েও সেদিন আমাদের আর গ্র্যান্ড হোটেলে যাওয়া হয়ে ওঠে না। অগত্যা ফিরতি রাস্তা ধরে ফেরিঘাটে এসে বসে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এখানে ফেরিঘাট একটি নয়, আরনল্ড ফেরি, শেপলারস ফেরি, স্টারলাইন ফেরির প্রতিটির জন্য আলাদা ঘাট। আমাদের স্টার লাইন ফেরিঘাট একেবারে শেষ মাথায়। বিকেলের ফেরি পৌঁছাতে দেরি আছে দেখে ম্যাকিনেক স্টেট হারবারে ঘুরেফিরে কিছু সময় কাটাই। সেখানে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে ‘ভিক্টরি’ নামের বিশাল ক্রুজ শিপ। হারবারের ছোট ছোট জেটিগুলো ফাঁকা, এই দুর্যোগে জেটিগুলো ভর্তি দেখব ধারণা করেছিলাম। স্টার লাইন ফেরি এলে আমরা সবার  সঙ্গে সার বেঁধে জাহাজে উঠি। জাহাজটি যখন রাউন্ড আইল্যান্ড বাতিঘরের পাশ দিয়ে লেক হিউরনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, শতবর্ষী বাতিঘরটিকে খুব নিঃসঙ্গ একাকী মনে হয়। 

চলবে...

Leave a Reply

Your identity will not be published.