চিত্রা নদীর পারেঃ নেপথ্য গল্প

চিত্রা নদীর পারেঃ নেপথ্য গল্প

‘চিত্রা নদীর পারে’ তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত আলোচিত চলচ্চিত্র। ১৯৯৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ চলচ্চিত্রটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মানদণ্ডে সাতটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হয়েছিল। এ চলচ্চিত্রেই প্রথম পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের বিষয়টি বিশদভাবে উঠে এসেছে। এই সূত্রে বলা যায় যে, ‘চিত্রা নদীর পারে’ একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে। অন্য কথায়, ১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশের নড়াইলের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হিন্দু ধর্মালবম্বী মানুষদের যাপিত জীবন, আনন্দ-বেদনা, সমস্যা এ চলচ্চিত্রে মূর্ত হয়ে উঠেছে। এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণের নেপথ্য গল্প এখানে তুলে ধরা হলো। 

‌'অন্যদিন ঈদ ম্যাগাজিন ২০২১’ পড়তে এখানে ক্লিক করুন...

এ দেশের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘চিত্রা নদীর পারে’ অন্যতম। তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত এ চলচ্চিত্রে দেশের সংখ্যালঘু মানুষেরা কেন প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে যায়, শরণার্থী হয়, সেটি ডিটেইলসে ফুটে উঠেছে। আমরা জানি যে, এ দেশের এফডিসি-কেন্দ্রিক মূলধারার যে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র তা এতটাই ইতিহাস ভূগোলহীন যে, সেসব ছবিতে কোনো ইতিহাসবোধ বা সমাজবাস্তবতা থাকে না।  ফলে এ দেশের সংখ্যালঘুদের বেদনাটি তাদের ছবিতে কখনো আসে নি। হ্যাঁ, বিকল্পধারার ছবিতে সেটা আসতে পারত। কিন্তু সেরকমটি চোখে পড়ে নি। সেদিক থেকে বলা যায়, পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের বিষয়টি ‘চিত্রা নদীর পারে’ ছবিতেই প্রথম বিশদভাবে উঠে এসেছে।

চলচ্চিত্রটির কাহিনিধারায় দেখা যায়- ১৯৪৭ সালের কোনো এক শীত বিকেলে নদীর পারে কয়েকটি শিশু খেলা করছে। নাজমা, সালমা, বাদল, মিনতি, বিদ্যুৎ বিভিন্ন বয়সের বালক-বালিকা সব। নাজমা, সালমা ও বাদল ভাইবোন। ওদের পাশের বাড়িতে থাকে মিনতি ও বিদ্যুৎ। মিনতির বাবা মাঝবয়সী বিপত্নীক শশীকান্ত সেনগুপ্ত পেশায় উকিল। এদের সঙ্গে বাস করেন মিনতি-বিদ্যুতের  পিসিমা স্নেহময়ী বিধবা অনুপ্রভা দাসী। চিত্রা নদীর কিনারেই শশীকান্ত বাবুদের পুরোনো একতলা একটি বাড়ি। বাড়ির নাম পান্থনীড়। পাকিস্তান আমলের সাম্প্রদায়িকতার সেই বিকারের দিনগুলোতে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেরই নজর ওই বাড়িটির ওপর। কিন্তু শশীকান্ত বাবু এ দেশ ছেড়ে কখনোই যেতে চান নি।

সময় গড়িয়ে যেতে থাকে। বালকবালিকা বাদল ও মিনতি আজ তরুণ-তরুণী। মিনতি নড়াইল কলেজে পড়ে এবং বাদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়। ভিন্ন সম্প্রদায়ের হলেও শৈশবের খেলার সঙ্গী দুই তরুণ-তরুণীর মধ্যে একসময় জন্মায় প্রেমের অনুভূতি। তরুণ বাদল পড়তে আসে ষাট দশকের  ঢাকা বিশ্ববিদালয়ে। সারা দেশজুড়ে তখন গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের দাবিতে ছাত্রসমাজ উত্তাল। বাদলও ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে এবং সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্রমিছিলে একদিন গুলিতে নিহত হয়।

শশীকান্ত বাবুর বড়ভাই নিধুকান্ত বাবু গ্রামে থেকে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারি করেন। তার বিধবা মেয়ে বাসন্তী দুর্গাপূজার সময় ধর্ষিতা হয়। বাসন্তী চিত্রা নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করে। নিধুকান্ত বাবুর পরিবার দেশত্যাগ করে চলে যায়।

চারদিকের এতসব ঘটনা শশীকান্তবাবুর অসুস্থতা বাড়িয়ে তোলে। এক সন্ধ্যায় তিনি হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করেন। মিনতি ও পিসিমা  পান্থনীড় ত্যাগ করে কলকাতার উদ্দেশে পাড়ি জমায়। আর তার কিনারে বহমান এই মানবনাট্যের এক চিরন্তন সাক্ষী হিসেবে বয়ে চলে চিত্রা নদী...।

১১৪ মিনিট ব্যাপ্তির এই চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছিল ১৬ মি.মি. ফরম্যাটে। কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল। চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন। সম্পাদক মহাদেব শী। আবহসংগীতে সৈয়দ সাবাব আলী আরজু। শিল্পনিদের্শক উত্তম গুহ। পোশাক ডিজাইনার চিত্রলেখা গুহ। বিভিন্ন  চরিত্রে অভিনয় করেছেন তৌকীর আহমেদ, আফসানা মিমি, মমতাজউদ্দীন আহমেদ, সুমিতা দেবী, রওশন জামিল, রামেন্দু মজুমদার, আমিরুল হক চৌধুরী, নাজমুল হুদা, প্রতিভা, মৌসুমী, ইরা, অপি, তপু, বাবু প্রমুখ।

কী ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘চিত্রা নদীর পারে’ নির্মাণে তানভীর মোকাম্মেল হাত দেন ? এ প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, “সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে অনেক হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যেতে এবং ভারত থেকে অনেক মুসলমান পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তনে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল। প্রতিটা পরিবারের দেশত্যাগের পেছনেই রয়েছে কিছু করুণ কাহিনি, কিছু নীরব অশ্রু। আর একজন শিল্পী হিসেবে আমার দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের এসব নীরব বেদনার কাহিনিকে তুলে ধরা। তাই বেশ অল্প বয়সেই আমি ঠিক করি, পূর্ববঙ্গের  হিন্দুদের দেশত্যাগের বেদনা নিয়ে আমি একটা ছবি তৈরি করব এবং চলচ্চিত্রটির নাম হবে ‘চিত্রা নদীর পারে’।”

এই চলচ্চিত্রে যে চরিত্রসমূহ মূর্ত হয়ে উঠেছে, এর সঙ্গে বাস্তবের একটি  চরিত্রের ছায়া রয়েছে। বলা যায়, কাহিনিকার-চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেলের পরিচিত এক চরিত্র। তানভীরের ছোটবেলায় তার বাবা নড়াইলে কিছু দিন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তারা ভাইবোনেরা মাঝে মাঝে নড়াইলে বাবার কাছে বেড়াতে যেতেন। তখন তাদের বাবার সরকারি বাসার উল্টো দিকে এক হিন্দু উকিল ভদ্রলোক বাস করতেন। তিনি তানভীরের বাবার উদ্দেশে বলতেন, ‘মোকাম্মেল সাহেব, আমরা কোনো দিন নড়াইল ছেড়ে যাব না। চিত্রা নদীর পার ছেড়ে স্বর্গে গিয়েও সুখ নেই আমার।’ এই উকিল ভদ্রলোকের আদলেই  গড়ে উঠেছে ‘চিত্রা নদীর পারে’র শশীকান্ত বাবুর চরিত্রটি। বাকি চরিত্র ও ঘটনা সবই কাল্পনিক।

চলচ্চিত্রটির ঘটনাস্থল হিসেবে প্রধানত নড়াইলকেই কেন বেছে নিয়েছিলেন চিত্রনাট্যকার-চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল ? এ প্রসঙ্গে তার ভাষ্য হচ্ছে, “এই ঘটনা বাংলাদেশের যে-কোনো মফস্বল শহরে যে-কোনো নদীর পারেই ঘটতে পারত। আমরা সঠিক বাড়িটার জন্য অনেকগুলো মফস্বল শহর ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম। আমাদের প্রয়োজন ছিল নদীর পারে ওই রকম একটি বাড়ি। শেষমেশ আমাদের পছন্দ মতো একটি বাড়ি আমরা নড়াইলেই খুঁজে পাই। সে কারণেই নড়াইলকে লোকেশন হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তা ছাড়া নড়াইল জায়গাটা আমি কিছুটা চিনতাম। সেটাও একটা কারণ।’

যেহেতু এ দেশের সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের বিষয়টি চলচ্চিত্রে ফুটে উঠেছে সেহেতু কাহিনিকার-চলচ্চিত্রকার তানভীর এ বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেন, গবেষণা করেন। তিনি অবশ্য আগেই জানতেন যে, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এবং অব্যাহত আগে ও পরে যেসব দাঙ্গা হয়, তার ফলে ব্যাপক মানুষ দেশত্যাগ করে। এরপর একটা স্রোত দেশত্যাগ করে ১৯৫০ সালে  বরিশালের দাঙ্গার পর, যে দাঙ্গা দেশভাগের পরে ঢাকা, আশপাশের অঞ্চল এবং দেশের অন্যান্য অনেক জায়গাতে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে পাসপোর্ট চালু হতে যাচ্ছে জেনেও অনেকে দেশত্যাগ করে। তবে এদেশের কিছু পরিবার সবচেয়ে বড় ধাক্কা খায় ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দরুন। ফলে খুলনা, যশোর, নড়াইলসহ বিভিন্ন জেলা থেকে দলে দলে হিন্দু পরিবারগুলো এ দেশ ত্যাগ করে।...তানভীর মোকাম্মেল স্বয়ং চৌষট্টির দাঙ্গার দেখেছেন। সেই দাঙ্গার অনেক স্মৃতি, বলাই বাহুল্য, তার মনে দাগ কেটে আছে। এইসব স্মৃতিও ‘চিত্রা নদীর পারে’ নির্মাণ তানভীরকে তাড়িত করেছে।
নদী তানভীর মোকাম্মেলকে টানে। তাই তো তার চলচ্চিত্রে নদীর একটি ভূমিকা থাকে। এই চলচ্চিত্রে তা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তানভীরের ভাষ্য হলো, “আমাদের দেশটি তো নদীমাতৃক। প্রতি দশ কিলোমিটার গেলেই কোনো না কোনো নদী। নদীর পারেই আমাদের শহর-নগর-গঞ্জগুলো গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের যে-কোনো ঘটনাতে এই নদী আসতে প্রায় বাধ্য। তা ছাড়া নদীর একটি নান্দনিক সৌন্দর্য রয়েছে। যা একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবে আমাকে আকর্ষণ করে। নদীর আরেকটি দিকও আমাকে আকর্ষণ করে। তা হচ্ছে নদীর প্রবাহমনতা। দুপাশে যে এত কিছু ঘটে, কিন্তু নদী তবুও বয়ে চলে নিরত্তর।”

নড়াইলে ‘চিত্রা নদীর পারে’ চলচ্চিত্রটির শুটিং হয় ১৯৯৮-৯৯ সালে। এই সময়ের নড়াইল আর গত শতকের ষাট দশকের নড়াইল দুইয়ের মধ্যে বিরাট ব্যবধান। ষাট দশকের নড়াইলে একটা সাংস্কৃতিক আবহ ছিল। অন্যদিকে ১৯৯৮-৯৯ সালে নড়াইল আগের চেয়ে কিছুটা অসংস্কৃত হয়ে পড়েছিল। আর সাম্প্রদায়িক লোকজনের সংখ্যা ও প্রতিপত্তিও বেড়ে গিয়েছিল। তারা বিরোধিতা করলে একপর্যায়ে চলচ্চিত্রটির ইউনিটকে নড়াইল ত্যাগ করে চলে আসতে হয়েছিল। তাই ছবির শুটিং সেখানে শেষ করা যায় নি। তবে চিত্রা নদী আগের মতোই ছিল। আগের মতোই ভীষণ সুন্দর।
নড়াইল ছাড়া এই ছবির শুটিং হয়েছে ময়মনসিংহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মধুর ক্যান্টিন ও সলিমুল্লাহ হলে এবং সাভারের গ্রামাঞ্চলে। ছবির শেষ দৃশ্যটির শুটিং হয়েছিল যশোর-বেনাপোলের পথে।

‘চিত্রা নদীর পারে’ নির্মাণের সময় একটি ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটেছিল। ছবিটির জন্য তখন এমন একটি বাড়ি খোঁজা হচ্ছিল যেটা দেখে বোঝা যাবে যে বাড়িটা মফস্বল শহরের কোনো হিন্দু পরিবারের বাড়ি এবং যেটা হতে হবে নদীর পারে। এমন বাড়ি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল নড়াইলে। বাড়িটিতে তখন একটি মুসলমান পরিবার বাস করত। তো শুটিং চলছে। একদিন চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেল কৌতূহল নিয়ে বাড়ির কর্তাটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ বাড়িটা আগে কার ছিল ?’ জবাব এল ‘একজন হিন্দু উকিলের’। শুনে তানভীরের  কৌতূহল বেড়ে গেল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘মানুষটি কেমন ছিলেন ?’ বাড়ির কর্তা বললেন, ‘আর বলবেন না। একটু ক্ষ্যাপা কিসিমের লোক ছিলেন। সব হিন্দুরা চলে যাচ্ছে, কিন্তু উনি এ দেশ ছেড়ে যাবেন না। শেষে এখানেই মারা যান।’ কথাটি শুনে তানভীর মোকাম্মেলের মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শিরশির অনুভূতি বয়ে গিয়েছিল। তিনি তখন ভেবেছিলেন, গোটা বাংলাদেশজুড়েই আমরা একটা বাড়ি খুঁজেছিলাম আর শেষমেশ এমন একটা বাড়ি পেয়ে শুটিং করছি যেখানে ঠিক আমাদের ছবির গল্পের মতোই একটা চরিত্র ছিল এবং সেরকম ঘটনাই এখানে ঘটেছিল।

‘চিত্রা নদীর পারে’-তে গানের ব্যবহার প্রশংসনীয়। ‘পরের জায়গা পরের জমিন।’ তো মন্টাজ হিসেবেই কাজ করেছে। চলচ্চিত্রটির সাউন্ডট্রাক বেশ সমৃদ্ধ। একটু খেয়াল করে শুনতে পাওয়া যাবে যে, ছবিটির সাউন্ডট্রাকে সংলাপ ছাড়াও গান, ছড়া, কবিতা, আবৃত্তি, ক্রিকেটের ধারাবিবরণী, ষাট দশকের জনপ্রিয় গানের রেডিও অনুষ্ঠান, অনেক কিছুই আছে।

প্রিয় শট বা দৃশ্য প্রসঙ্গে চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেলের ভাষ্য হচ্ছে, “ছবিটির সব দৃশ্যই আমার প্রিয়। না হলে তো তা ছবিটিতে থাকত না। তবে বিশেষ কোনো শটের কথা যদি বলেন তো বলব যে পূজার দৃশ্যের পরে বাসন্তীকে ধর্ষণের দৃশ্যটির বেদনা আমরা যে মাত্র অল্প কয়েকটি শটে দেখাতে পেরেছি সেই শটগুলো আমার নিজের ভালো লাগে। ভালো লাগে চিত্রা নদীতে ডুবে বাসন্তীর আত্মহত্যার পর জলে ভাসা ওর মুখ ও ডুবন্ত দুর্গা প্রতিমার মুখের এপিক মন্টাজটা। চিত্রা নদীর পারের, শেষ শটটিও আমার প্রিয়, যখন মিনতি ও পিসিমা পুরোনো এক বাসে চেপে যশোর রোড দিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছে। সাউন্ডন্ট্রাকে ভেসে আসছে ওদের ছেলেবেলার ছড়াটি, ‘ওপেনটি বায়েস্কোপ../ছোট ছোট জাদু মনি/যেতে হবে অনেকখানি/ কলকাতা...’ ছবিতে পূর্ববঙ্গ ছেড়ে ওদের চিরতরে চলে যাওয়ার এই চিত্রকল্পটি অনেক আগে থেকেই আমার  মাথায় এসেছিল।’’
‘চিত্রা নদীর পারে’ মুক্তি পায় ১৯৯৯ সালে। প্রথম প্রদর্শিত হয় ঢাকার শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরির মিলনায়তনে, পরে এটি বাংলাদেশের সব জেলাতে, প্রায় সব উপজেলাতে। এমনকি অনেক গ্রামাঞ্চলে প্রদর্শিত হয়েছে। এ ছাড়া এ ছবিটি ভারত, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, কানাডা, ইউএসএ, হল্যান্ডসহ বিশ্বের অনেক দেশেই দেখানো হয়েছে। এখনো হয়ে থাকে। চলচ্চিত্রটির বাজেট ছিল বারো লাখ টাকা। মুক্তির পরে খরচ উঠে এসেছে।
‘চিত্রা নদীর পারে’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ পরিচালক, শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার, শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা, শ্রেষ্ঠ শিল্পনির্দেশক, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী (পার্শ্ব চরিত্র), শ্রেষ্ঠ  মেকাপম্যানসহ মোট সাতটি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে ১৯৯৯ সালে। এছাড়াও চলচ্চিত্রটি লন্ডন, ওসলো, ফ্রিবোর্গ (সুইজারল্যান্ড), সিঙ্গাপুর, দিল্লি, কলকাতা এবং ত্রিবান্দ্র আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে।

চিত্রনাট্য থেকে
দৃশ্য : ৬১
(মিনতি ও সালমা ছাদে। বিদায়ের আগে।)
[মিনতি ছাদ থেকে কাপড় তুলছে। সালমা আসে।]
সালমা    : তোরা সত্যি সত্যি চলে যাবি ?
মিনতি    : (কাপড় ভাঁজ করতে করতে) হুঁ।
সালমা    : ভাবতেই কেমন লাগছে। কালই যাচ্ছিস ?
মিনতি    : কাল।
সালম    : তোরা আর একেবারেই ফিরবি না ?
মিনতি    : কী জানি!
সালমা    :    চিঠি দিবি তো!
মিনতি    : দেব।
সালমা    : (নিচের উঠোনটার দিকে তাকিয়ে) তোদের বাড়িটার কী হবে রে ?
     [মিনতি নিশ্চুপ থাকে। ক্লোজআপ।]
সালমা    : চশমা পরলে তোকে অন্যরকম দেখায়। চশমা পরতে কেমন লাগে রে ?
মিনতি    : এখন সবকিছু অনেক পরিষ্কার দেখতে পাই।
সালমা    : জানিস...ছোটবেলায় একটা ব্যাপারে তোকে আর বিদ্যুৎকে আমি আর নাজমাবু আড়ালে ক্ষেপাতাম।....
মিনতি    : কী নিয়ে ?
সারমা    : তোরা কাইচিকে ‘কেচি’ বলতিস। আরও কী সব অদ্ভুত....না থাক...।
মিনতি    : বল না।
সালমা    : শুনলে হাসবি না তো ?....আমরা মনে করতাম কালো পিঁপড়াগুলো ভালো, ওগুলো কামড়ায় না, তাই মুসলমান...আর লাল পিঁপড়াগুলো হিন্দু...ওগুলো কামড়ায় তো...। আমরা কী ছেলেমানুষ ছিলাম রে!
মিনতি    : হয়তো এখনো আছি।

দৃশ্য : ৬২
(মিনতি ও পিসিমার বাড়ি থেকে বিদায়।)
[মিনতি ছাদ থেকে গান গাইতে 
গাইতে নামে। রবীন্দ্রসংগীত]
মিনতি    : পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়, কী আছে শেষে।
এত কামনা, এত সাধনা কোথায় মেশে, 
ঢেউ ওঠে পড়ে কাঁদার, সম্মুখে ঘর আঁধার,
পার আছে কোন্ দেশে...,
কী আছে শেষে
আজ ভাবি মনে মনে, মরীচিকা-অন্বেষণে
বুঝি তৃষ্ণার শেষ নেই। মনে ভয় লাগে সেই...
হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া ব্যথা চলেছে নিরুদ্দেশে..
[A series of Montage shots]     
[ শেষ সন্ধ্যায় তুলসিতলায় পিসিমা প্রদীপ জ্বালায়। শেষ বারের মতো প্রণাম করে। মিনতি দেয়াল থেকে প্রথমে মায়ের ও পরে বাবার বাঁধানো ছবি নামায়। বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার সময় পিসিমা দরজায় তালা দেয়। মিনতি ও পিসিমা জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ির বাইরে বের হয়। ট্রাকশট। বাড়ির নাম ‘পান্থনীড়’-য়ের উপর ক্যামেরা ধীরলয়ে জুম ইন করে। মিনতিদের বিদায়ের দৃশ্যে ওদের ওপর গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ে। পরিবারটির চলে যাওয়ার পর বাড়ির উঠোনে শুকনো পাতা বাতাসে পড়ে।


দৃশ্য : ৬৩
[বাস ছাড়ার দৃশ্য]

[নড়াইল বাসস্ট্যান্ড। বাসের কন্ডাক্টর চেঁচাচ্ছে, যশোর-বেনাপোল। মিনতি ও পিসিমা রিকশা থেকে নেমে বাসে উঠবে। বাদলের মামা হামিদ কন্ট্রাক্টর মোটরসাইকেলে করে বিদায় জানাতে আসবে।]
হামিদ    : মিনু ও মিনু। (মিনতি এগিয়ে আসে) বর্ডারে কোনো অসুবিধে হবে না। আমি এখলাসরে বলে রেহেছি।...কোনো সমস্যা হলি আমার নাম বলিস..।
[পুরোনো বাস। হেলপার হ্যান্ডেল মেরে বাস স্টার্ট দেবে। যশোর-বেনাপোল রোড ধরে বাসটি সীমান্ত অভিমুখে চলা শুরু করে।]
দৃশ্য : ৬৪
(বেনাপোল রোডে বাস)
[বেনাপোলের পথে বাস। বেনাপোল রোডের বিশাল বিশাল শিশু গাছগুলোর মধ্য দিয়ে বাসটি এগিয়ে চলে। বাসের ভেতরের শট। পিসিমা ও মিনতি বাসে বসে। মিনতির চোখ জানালার বাইরে।]
পিসি    : (চোখে জল) ও মিনু, এ কী হলো রে ?
মিনতি    : কেঁদো না পিসিমা। আস্তে আস্তে একদিন সব সয়ে যাবে।
[সাউন্ডট্রাকে মিনতির শিশু কণ্ঠে ভেসে আসবে ছেলেবেলার সেই ছড়াটি।]
শিশুরা (সমস্বরে আবৃত্তি করে)
ওপেনটি বায়েস্কোপ
নাইন টেন ট্রায়োস্কোপ
চুল টানা বিবিয়ানা
সাহেব বাবুর বৈঠকখানা
লাট বলেছে যেতে
পান সুপারি খেতে
পানের আগায় মরিচবাটা
ইস্কাবনের ছবি আঁকা
ছোট ছোট জাদুমণি
যেতে হবে অনেকখানি
কলকাতা...কলকাতা...কলকাতা
[‘কলকাতা’, ‘কলকাতা’ শব্দটি পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে। বাসটি ধীরে ধীরে গাছপালার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে।]

দৃশ্য : ৬৫
বাসটি যেতে যেতে এক সময় ফ্রিজ হবে। বাকি টাইটেল কার্ডগুলো স্ক্রোল শুরু করবে। নেপথ্যে আবহসংগীত...।)

বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার বায়ু বাংলার ফল...
... ... ... ...
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক
পূর্ণ হউক হে ভগবান... 

Leave a Reply

Your identity will not be published.