যেমন দেখলাম ‘ছায়াবন্দনা’: মোমিন রহমান

যেমন দেখলাম ‘ছায়াবন্দনা’: মোমিন রহমান

বাংলাদেশের আলোকচিত্রের জগতে একটি উজ্জ্বল নাম নাসির আলী মামুন। গত ১০ মে তাঁকে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘ছায়াবন্দনা’র প্রিমিয়ার শো হয়েছে শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালা মিলনায়তনে। মকবুল চৌধুরী এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক ও পরিচালক। ‘ছায়াবন্দনা’ ও এর প্রিমিয়ার শো নিয়ে লিখেছেন মোমিন রহমান

 

নাসির আলী মামুন প্রতিকৃতি আলোকচিত্র তথা পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির জন্য বিখ্যাত। দেশ-বিদেশের বহু স্বনামধন্য মানুষের ছবি তিনি তুলেছেন। সেইসব ছবির জন্য প্রশংসিতও হয়েছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বহু পুরস্কার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, শিল্পকলা একাডেমি পদক, বাংলা একাডেমি অনারারি ফেলোশিপ, আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফি উৎসব ‘ছবিমেলা’য় প্রাপ্ত আজীবন সম্মাননা এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এবং দ্য ডেইলি স্টারের ‘সেলিব্রেটিং লাইফ’ অ্যাওয়ার্ড (২০১৭)। অন্যদিকে মকবুল চৌধুরী নব্বই দশক থেকে বিকল্পধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘নট এ পেনি নট এ গান’ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রদত্ত পুরস্কার লাভ করেছে ২০১৬ সালে। তিনি ২০২৩ সালে কমনওয়েলথ ক্রিয়েটিভ সিটি ট্যালেন্ট অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন ‘কফি বিনস গ্রোউ ইন মাই হেড’ চলচ্চিত্রের জন্য। তাঁর নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্র হলো : এ সন অব দ্যা ইম্পায়্যার (২০০৩), দ্যা রেড ফ্লাওয়ার (২০০৫), মায়া (২০০৭), ব্ল্যাক লিফ (২০০৯), পার্পেল থ্রেড (২০১৪)।

‘ছায়াবন্দনা’র প্রিমিয়ার শো উদ্বোধন করেন প্রাবন্ধিক ও ইতিহাসবিদ বদরুদ্দীন উমর। প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম।

‘ছায়াবন্দনা’র ব্যবচ্ছেদ

৬২ মিনিট ব্যাপ্তির প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘ছায়াবন্দনা’য় বাংলাদেশের পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির উন্নয়নে নাসির আলী মামুনের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি তোলারও সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর তোলা মওলানা ভাসানী, কবি জসীম উদ্দীন, শিল্পী এস এম সুলতান, শিল্পী কামরুল হাসান, মাদার তেরেসা, লেচ ওয়ালেসা, মিখাইল গরবাচেভ, ডেসমন্ড টুটু, বিল ক্লিনটনসহ অসংখ্য বিশ্ববরেণ্য মানুষের ছবি প্রশংসিত হয়েছে। প্রামাণ্যচিত্রে নাসির আলী মামুনের বর্ণাঢ্য দিনগুলোর কথা বিশদভাবে উঠে এসেছে, তবে তা পূর্ণাঙ্গ বলা যাবে না কিছুতেই।

প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটির আঙ্গিক বেশ অভিনব। ছবিটি শুরু হওয়ার একপর্যায়ে নাসির আলী মামুন যখন হাতে একটি বক্স ক্যামেরা নিয়ে বলেন, ওই বক্স ক্যামেরা ব্যবহার করেই তিনি বিভিন্ন স্বনামধন্য মানুষের মুখের ছবি তুলেছেন, যেখানে একটি রিলে বারোটি ছবি তোলা যায়। এরপর থেকেই বারোটি পর্বে নাসির আলী মামুনের জীবন ও পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি মূর্ত হয়ে ওঠে। প্রত্যেকটি পর্ব শুরুর আগে পর্বটির সংখ্যা এবং শিরোনাম ফুটে ওঠে পর্দায়। সাউন্ডট্র্যাকে শোনা যায়, ক্যামেরার ক্লিক। প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটির এমন আঙ্গিক দেখে চলচ্চিত্রমনস্ক দর্শকদের মনে পড়ে যেতে পারে প্রয়াত জহির রায়হানের বিখ্যাত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’-এর কথা, সেখানে ছিল টাইপরাইটার, এখানে ক্যামেরা।

প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটির ক্যামেরা ঘোরাফেরা করেছে দেশ-বিদেশের চারটি শহরে। এগুলো হলো, ঢাকা, কলকাতা, প্যারিস ও নিউইয়র্ক। সঙ্গত কারণেই ঢাকার ফুটেজ বেশি। কেননা নাসির আলী মামুনের কাজের প্রধান ক্ষেত্র ঢাকা। ক্যামেরার কাজ নান্দনিক। ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলও কিছু জায়গায় ভিন্নধর্মী। যেমন, নাসির আলী মামুনের বক্তব্য দেওয়ার একটি শটে তাঁকে মুখোমুখি না দেখিয়ে তাঁর বাম প্রোফাইল দেখানো হয়েছে।...সম্পাদনাও ভালো। গতি রয়েছে। জ্যাক ব্লোর-এর সংগীত ইমেজের মেজাজকে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে।

প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটিতে পুনরাবৃত্তি রয়েছে। ‘সম্পর্ক’ পর্বে নাসির আলী মামুনের সঙ্গে দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য মানুষের সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে, যাদের ছবি তিনি ক্যামেরায় ধারণ করেছেন। কিন্তু এই পর্বের আগেই এই বিষয়টি অন্য পর্বে কিছুটা ব্যক্ত করা হয়েছে। আলোকচিত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পুনরাবৃত্তি রয়েছে। যেমন, প্যারিসপ্রবাসী স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে নাসির আলী মামুনের আলোকচিত্র। এটি দু’বার ব্যবহৃত হয়েছে। তথ্যগত ক্রটিও রয়েছে। শিল্পী শাহাবুদ্দিনকে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের নাগরিক হিসেবে দেখানো হয়েছে। তথ্যটি ঠিক নয়। শাহাবুদ্দিন ফ্রান্সের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন নি।

তথ্যের অপ্রতুলতাও সচেতন দর্শকদের নজর এড়াবে না। তাদের মনে হবে নাসির আলী মামুনকে নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা করা হয় নি। যেমন, প্যারিস অংশে প্রসঙ্গক্রমে নাসির আলী মামুনের দাদার কথা এসেছে। এমনিভাবে ‘অভিবাসন’ পর্বে নাসির আলী মামুনের দুজন পূর্বপুরুষের কথা তুলে ধরা যেত। ওই দুজন ছিলেন মোঘল সৈনিক। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের সময় তারা পালিয়ে এসে ফরিদপুরের মাদারীপুরের শিবচরে আশ্রয় নেন।...প্রামাণ্যচিত্রটি আন্তর্জাতিক দর্শকদের একটি ভুল বার্তা দেবে। সেটি হলো, নাসির আলী মামুন শুধু বাংলাদেশের এমন মানুষদের ছবি তুলেছেন, যাদের রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু মামুন সমাজের নিচুতলার মানুষদেরও তাঁর ক্যামেরায় বন্দি করেছেন। এইসব মানুষের ছবি ও তাদের কথা নিয়ে মামুনের একটি বইও রয়েছে, ‘ঘর নাই’ শিরোনামে। হ্যাঁ, মকবুল চৌধুরী ওই পথে হাঁটেন নি। প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটির শিরোনামেই সেটি স্পষ্ট। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘ছায়াবন্দনা’ নামটি তিনি এ কারণে নির্বাচিত করেছেন যে, নাসির আলী মামুন সেইসব মানুষের মুখকে ক্যামেরায় ধারণ করেছেন যারা সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। যারা ছায়ার মতো। অন্যরা সেই ছায়ার নিচে আশ্রয় বা শান্তি পায়। তাই মকবুলের প্রামাণ্যচিত্রে নাসির আলী মামুনের তোলা দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের ছবি এবং ছবিসংক্রান্ত তথ্য উঠে এসেছে। কিন্তু কয়েকটি শট ও নেপথ্যকথনে যদি মামুনের তোলা বাংলাদেশের ফুটপাতের মানুষেরাও ঠাঁই পেত, তাহলে আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনের পূর্ণাঙ্গচিত্র ফুটে উঠত। উল্লেখ্য, প্রামাণ্যচিত্রে মামুনের দাদার প্রসঙ্গটি এলেও তাঁর বাবা-মা’র কথা নেই। বিষয়টি সবার কাছে অদ্ভুত লেগেছে।

আরেকটি কথা, নাসির আলী মামুন কোনো কোনো বিখ্যাত মানুষের ওপর দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কাজী মোতাহার হোসেন, শামসুর রাহমান, এস এম সুলতান, মুহাম্মদ ইউনূস ও হুমায়ূন আহমেদ। মকবুল চৌধুরী তাঁর প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে একটি পর্বই রেখেছেন এস এম সুলতানের ওপর। তা তিনি রাখতেই পারেন ও কাঙ্খিতও। কাজী মোতাহার হোসেন ও শামসুর রাহমানের ছবি তিনি ব্যবহার করেছেন কিন্তু গুরুত্বারোপ করা হয় নি। মুহাম্মদ ইউনূসের প্রসঙ্গ তো দূরের কথা, তিনি তাঁর ছবিই ব্যবহার করেন নি। অথচ মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তির মাহেন্দ্রক্ষণসহ দেশে দেশে তাঁর সংর্বধনা ভ্রমণে সঙ্গী হয়েছিলেন নাসির আলী মামুন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইউনূসের ছবি প্রামাণ্যচিত্রে থাকা দরকার ছিল। মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়টি নিয়ে অনেকে হয়তো নানারকম ব্যাখ্যা দেবেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদকে কেন হেলাফেলাভাবে এখানে উপস্থাপন করা হলো?

‘অভিবাসন’ পর্বে নিউইয়র্কে ট্রেনের মাঝে হুমায়ূন আহমেদের ছবি এক ঝলক দেখা যায়— যা অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে। বিষয়টি দুঃখজনক। কেননা নাসির আলী মামুন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন— আশির দশক থেকে হুমায়ূনের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। মামুনকে ক্যামেরা ধার দিয়ে সাহায্যও করেছিলেন হুমায়ূন। ‘কীর্তিমানদের মুখচ্ছবি’ এবং ‘হুমায়ূন আহমেদ: অনন্ত জীবন যদি’ শিরোনামের দুটি ফটো অ্যালবামও আছে নাসির আলী মামুনের।...এটা বড় ধরনের একটি ঘাটতি। এ প্রসঙ্গে টেলিফোনে এই প্রতিবেদকের কাছে মকবুল চৌধুরী জানান, নাসির আলী মামুন তাঁকে হুমায়ূন আহমেদের মাত্র একটি ছবি সরবরাহ করেছিলেন আর তিনি সেটিই ব্যবহার করেছেন। আরও ছবির জন্য তিনি অপেক্ষাও করতে পারেন নি। কেননা গত পাঁচ বছর ধরে এই ছবিটি নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি। মামুনের কাছ থেকে যখন যে উপাদান পেয়েছেন সেটিই ছবিতে ব্যবহার করেছেন। তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘একজন ক্ষুধার্ত মানুষ যখন মাংস রান্না করে, তখন আদা-রসুনের মধ্যে রসুন না পেলে সেটা ছাড়াই সে মাংস রান্নার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে। আমিও তা-ই করেছি।’

‘ছায়াবন্দনা’র প্রিমিয়ার শো’র উদ্বোধক বদরুদ্দীন উমর উল্লেখ করেছিলেন একটি বিষয়। মানুষের মুখ দেখে তার চরিত্র বোঝা যায় না। আর নাসির আলী মামুনের তোলা পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, আলো-ছায়ার বন্টনের মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের অন্তরাত্মাটিকে ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন। এই বিষয়টি প্রামাণ্যচিত্রে স্পষ্ট নয়। এই প্রসঙ্গে নাসির আলী মামুনের বক্তব্য প্রয়োজন ছিল।

সবশেষে এ কথা বলা যায়, নানা সীমাবদ্ধতার পরও বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্রের ধারায় ‘ছায়াবন্দনা’ একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.