বাবা আমার বাবা

বাবা আমার বাবা

হৃদয়ে ধ্বনিত একটি শব্দ ‘বাবা’। পুরুষশাসিত সমাজে বাবাই সন্তানদের আশ্রয়; বটবৃক্ষের মতো ছায়া দেন তিনি। সমাজ-সংসারে কীভাবে চলতে হবে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, এ সব বিষয়ে দিকনির্দেশনাও দেন তিনি। সন্তানদের ভালোবাসেন, তাদের মঙ্গল কামনা করেন। বাবার এমন ভূমিকা বিশ্বজুড়েই দেখা যায়। ২০ জুন বিশ্ব বাবা দিবস। এ উপলক্ষে একটি বিশেষ রচনা পত্রস্থ করা হলো।

 

সন্তানের সঙ্গে পিতার সম্পর্ক
শুরুতেই আলোকপাত করা যাক পিতা-পুত্রের সম্পর্কের ওপর। পুত্র জীবনপথে চালিত হয় সাধারণত পিতার শাসনাধীনে। শৈশব-কৈশোরে পিতাই থাকে পুত্রের ফ্রেন্ড, ফিলোসফার এন্ড গাইড। অন্যদিকে পুত্রের মাঝে সাধারণত পিতা নিজের ছায়া দেখতে পান। নিজের অনেক অপ্রাপ্তি, ব্যর্থ স্বপ্ন বা সাধ তিনি পূরণ করতে চান পুত্রের মধ্য দিয়ে। যিনি ডাক্তার হতে পারেন নি তিনি মনের মধ্যে ইচ্ছে পোষণ করেন পুত্র ডাক্তার হোক।... পুত্রও অনেক সময় প্রভাবিত হয় পিতার ব্যক্তিত্বের দ্বারা। পিতাকে অনুকরণ করে সে পিতার মতো হতে চায়। এর ভালো-মন্দ দুটি দিকই রয়েছে। ভালো পিতার পুত্র পিতার প্রভাবে যোগ্য মানুষ হয়; অন্যদিকে মন্দ লোকের ছেলে সাধারণত মন্দ মানুষই হয়। চারদিকে তাকালেই এর প্রমাণ পাই।

এখনকার অস্থির সময়ে পিতা-পুত্রের সম্পর্কে অবনতি ঘটছে। এর বহু কারণ রয়েছে। তবে একে শুধু ‘কমিউনিকেশন গ্যাপ’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সম্পর্ক কীভাবে সুস্থ ও সুন্দর করা যায়, এ ব্যাপারে পিতা-পুত্র দুজনকেই উদ্যোগী হতে হবে। পিতাকে খলিল জিবরানের সেই অমৃত বাণী অনুসরণ করতে হবে, তিনি আশা করতে পারেন না পুত্র তার মতো হবে। কেননা সম্মুখে আগুয়ান ঢেউ কখনো পশ্চাতে ফেরে না। পুত্রেরও উচিত নয় পিতার কথায় রাগ করা। বরং সে ঠান্ডা মাথায় বিষয়টি বোঝাতে পারে পিতাকে। সমস্যার স্বরূপ উপলব্ধির পর পিতা যদি কোনো পরামর্শ দেয় এবং তা যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তবে সেটি পুত্রের গ্রহণ ও পালন করা উচিত। তবে আশার কথা, এ সময়ের শিক্ষিত ও সচেতন পিতারা বন্ধুর মতোই পুত্রের কথা শোনেন; তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। তিনি জানেন, পুত্রের জীবন একান্তই তার। তাই তার ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।

পিতা ও কন্যার সম্পর্কটি অত্যন্ত মধুর। এই সম্পর্ক প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক শংকর-এর ভাষ্য: ‘স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার পেছনে কামনা আছে, ছেলের প্রতি ভালোবাসার পেছনে উচ্চাশা আছে কিন্তু মেয়ের প্রতি ভালোবাসার পেছনে কিছুই নেই।’

পিতা-কন্যার সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে শ্রদ্ধা। ভালোবাসাও বটে। একটি মেয়ের জীবনে প্রথম পুরুষ হচ্ছে তার বাবা। বাবার কাছেই তার যত আবদার; অনেক সময় বাবাই তার আশ্রয়। জীবনে এমন কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয় সে, যখন তার মনে হয়, ‘মা নয় বাবাকেই এটা জানানো উচিত। বাবাই এই বিষয়ে আমাকে সাহায্য করবেন।’ সত্যি তাই। মেয়েদের নানা সমস্যার সমাধান মেলে বাবার কাছে। একটি মেয়ের মনে ভবিষ্যৎ স্বামীর যে ছবি আঁকা থাকে, তাতে তার পিতার ছায়াই মূর্ত হয়ে ওঠে। বলাই বাহুল্য, পিতার সঙ্গে কন্যার সম্পর্কটি এ ক্ষেত্রে থাকে বন্ধুর মতো। পিতার ভূমিকাও অত্যন্ত দায়িত্বশীল। যা হোক, বাবার প্রতি মেয়ের এই আকর্ষণকে মনোবিজ্ঞানীরা অভিহিত করেছেন ‘ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স’ বলে। এ প্রসঙ্গে বেশ কয়েক বছর আগে বলিউডের অভিনেত্রী রাবিনা ট্যান্ডন একটি মজার কথা বলেছিলেন। কেমন পুরুষকে তিনি স্বামী হিসেবে পেতে চান? তার চোখে মি.রাইট তথা সঠিক ব্যক্তিটির স্বরূপ কেমন? এ প্রশ্নের জবাবে রাবিনা ট্যান্ডন বলেছিলেন: ‘আমার দৃষ্টিতে মি. রাইট হচ্ছেন আমার বাবা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার মায়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে অনেক আগেই হয়ে গেছে।’ আবার এর উল্টোটিও দেখা যায়। মেয়ের মধ্যে কোনো পুরুষ স্ত্রীর ছায়া খুঁজে পায়। মেয়ের প্রতি তীব্র আকর্ষণে ক্ষতবিক্ষত হয়। এমনটি হতেই পারে। মনকে কেউ নিজের ইচ্ছেমতো চালিত করতে পারে না। রক্তমাংসের মানুষের ক্ষেত্রে এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। তবে পিতা-কন্যা সম্পর্কের অন্যদিকও আছে। এ দেশীয় বহু পিতাই তার কন্যা, বিশেষত প্রথম কন্যার মাঝে নিজের মা’র মুখ দেখতে পায়। নিজ কন্যাকে তাই তারা ‘মা’ হিসেবে সম্বোধন করে। সত্যি কথা বলতে কী, এ দেশে পাশ্চাত্যের মতো পিতা-কন্যার সম্পর্কে নেতিবাচক ব্যাপার-স্যাপার দেখা যায় না বললেই চলে। এখানে কন্যার সুখের জন্য পিতা অনেক সময় সর্বস্বান্ত হতেও দ্বিধা বোধ করেন না।

প্রথিতযশা পিতাদের কথা
একজন পিতা যে পুত্রের জীবনে কী তীব্র প্রভাব ফেলতে পারেন, তার চমৎকার উদাহরণ হলো দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পুত্র রবীন্দ্রনাথের ওপর তাঁর ভীষণ প্রভাব ছিল। তাই তো পিতার মতোই রবীন্দ্রনাথ বিপদে ধৈর্য হারাতেন না, অবিচল চিত্তে সব কাজ করে যেতেন।

স্বনামধন্য শিশুসাহিত্যিক ও ‘সন্দেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক উপেন্দ্রকিশোরও ছিলেন উত্তম পিতা। পিতার নানা গুণাবলীর সমাবেশ আমরা দেখতে পাই সুকুমার রায়ের ওপরও। বলা যায়, কিছু বিষয়ে তিনি পিতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। অন্যদিকে, সত্যজিৎ রায় অত্যন্ত অল্প বয়সে পিতা সুকুমার রায়কে হারান। তাই তিনি পিতার দিকনির্দেশনা পান নি জীবনে। কিন্তু তাঁর ছেলে সন্দীপ রায় কিন্তু বাবার ছায়াতেই বড় হয়েছে। তাই তো আজ তিনি ভারতের একজন গুণী চলচ্চিত্রকার।

বলিউডের কাপুর পরিবারের প্রাণপুরুষ পৃথ্বিরাজ কাপুর তিন ছেলেকে মানুষ করেছেন নীতি ও আদর্শের মাঝে। তিনি চেয়েছিলেন যে তার ছেলেরা পিতার পরিচয়ে নয়, নিজের চেষ্টা ও যোগ্যতায় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোক। তাই তো দেখা গেছে যে, পৃথ্বিরাজ গাড়িতে চড়ে স্টুডিওতে চলেছেন কাজ করার জন্যে। আর ছেলেরা চলেছেন পায়ে হেঁটে অথবা পাবলিক বাসে। এই কঠোর পরিশ্রমের ফল অবশ্য তারা পেয়েছিল। জীবনে তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অর্থ ও খ্যাতি দুটোই তারা লাভ করেছিল। তাদের নাম রাজকাপুর, শাম্মী কাপুর এবং শশী কাপুর।

এই সময়ের বলিউডের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, পিতা রাকেশ রোশনের দিকনির্দেশনায় পুত্র ঋত্বিক রোশন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তারকা-নায়ক হিসেবে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন তার পিতাকেও। অন্যদিকে, পিতা অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে তার পুত্র অভিষেক বচ্চনের সম্পর্কটি হলো বন্ধুর মতো। অভিষেকের ক্যারিয়ার উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে তিনি সবসময় পাশে পেয়েছেন বাবাকে। বাবার প্রতি তার অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। পিতার সম্মান ও সাফল্যে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হন। একই কথা প্রযোজ্য অমিতাভের ক্ষেত্রেও। ‘পা’ চলচ্চিত্রে যখন তিনি অভিষেকের পুত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেন, তখন তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন।

নায়ক শাহরুখ খানও ছেলেমেয়েদের অত্যন্ত ভালোবাসেন। নানা সময়েই সেই প্রমাণ তিনি দিয়েছেন।...আমির খানও একজন আদর্শ পিতা। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তার ডিভোর্স হয়েছে ঠিকই কিন্তু সন্তানদের তিনি ঠিকই দেখাশোনা করেন। উল্লেখ্য, তার এক ছেলে প্রতিবন্ধী। ছেলের সমস্যা তিনি দরদ ও হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘তারা জামিন পার’-এ এমনই সমস্যাগ্রস্ত শিশুকে দেখা যায়।

স্বদেশে দৃষ্টিপাত করা যাক। চিত্রনায়ক রাজ্জাক তার ছেলেমেয়েদের অত্যন্ত নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে মানুষ করেছেন। তার এক কন্যা অকালে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু সেই কন্যাকে বাঁচানোর জন্য কী যে প্রাণান্তর চেষ্টা করেছিলেন, তা দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। আরেক মেয়ে ময়নাকে তিনি চলচ্চিত্রে এনেছিলেন, যদিও সে এই জগতে থাকে নি। তবে তার দুই সন্তান বাপ্পারাজ ও সম্রাট এ দেশের চলচ্চিত্র জগতে বিচরণ করেছেন এবং বাবার দিকনির্দেশনায় পথ চলেছেন।

এমনি চমৎকার সম্পর্ক আমরা দেখতে পাই আবুল হায়াত এবং তার দুই কন্যা বিপাশা হায়াত ও নাতাশার মাঝেও। একই কথা প্রযোজ্য ড. ইনামুল হক এবং তাঁর দুই কন্যার ক্ষেত্রেও।

সাহিত্যে পিতা ও সন্তান
পিতা ও পুত্রের বিচিত্র সম্পর্ক সাহিত্যে দেখা যায়। যেমন, রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাসের নায়ক দারুণ পিতৃভক্ত। পিতার মতোই সে গোড়া হিন্দু। সে যখন আবিষ্কার করে, যাকে সে পিতা হিসেবে জানে তিনি তার পিতা নন এবং সে বিধর্মী ও বিদেশির সন্তান- তখন তার সারা জীবনের মূল্যবোধ ও ধ্যান-ধারণা নড়ে ওঠে।... বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’তে দেখা যায় যে, পিতা হরিহরের সঙ্গে ছেলে অপুর মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান। শিশু অবস্থায়ই পুত্র বাবার মন হরণ করে নেয়। ঘুমন্ত অপুর মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকে হরিহর। পরে যখন অপু একটু বড় হয়, হরিহর বুঝতে পারে তার বালক পুত্র অন্য সবার মতো নয়। ছেলের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি অনুসন্ধিৎসা, সাহিত্য সাধনা, সবই তার পিতাকে আকর্ষণ করে। তাই তো অভাব-অনটনের মাঝেও সংবাদপত্রের গ্রাহক হন তিনি, যেন অপু সেই সংবাদপত্র পড়ে নানা বিষয়ে জানতে পারে। আবার স্কুল-ম্যাগাজিনে ছেলের লেখা প্রকাশের জন্য অর্থ যোগান দেন হরিহরই।...শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘যাও পাখি’ উপন্যাসের নায়ক যাপিত জীবনে পিতাকে অনুসরণ করে বলে মনে-মনে সে-ও পিতার মতোই নির্লোভ ও মুক্ত মনের অধিকারী হয়। মানুষের প্রতি তার অপরিসীম মমতা পিতার মতোই।...সমরেশ মজুমদারের ‘কালপুরুষ’ উপন্যাসে পিতা অনিমেষ ও পুত্র অর্কর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। একসময় পিতা ও পুত্রের আদর্শের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পুত্র পিতার মূল্যবোধকে ধারণ করেও স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দেয়। পুত্রের কাছ থেকে পিতা অনিমেষ জীবনের পাঠ যেন নতুন করে নেয়।

পিতা-কন্যার বিচিত্র সম্পর্কও দেখা যায় সাহিত্যে। পিতা যে কন্যার চোখে নায়ক, এমনকি পৃথিবীর সেরা মানুষ, তা রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পের নায়িকার মাঝে আমরা লক্ষ্য করি। বাবা সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক কথা সে শুনতে রাজি নয়। বিরাট পর্বতের মতোই পিতার ভাবমূর্তি হৈমন্তীর মানসপটে খোদাই হয়ে আছে। কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের এক উপন্যাসেও দেখা যায় পিতার প্রতি কন্যার তীব্র আকর্ষণ। জন্মের পরেই মাতৃহারা এক মেয়ে বাবার স্নেহ-আদরে লালিত-পালিত হয়। বড় হয়ে সেই মেয়ে দেখতে তখনো যুবকের মতো বাবার প্রতি বোধ করে কামজ বাসনা।...আবার এর উল্টোটিও দেখা যায়। মেয়ের প্রতি তীব্র আকর্ষণে তাড়িত হয় বাবা। এমনি ব্যাপার-স্যাপার আমরা দেখতে পাই বিমল করের ‘আত্মজা’ গল্পে।... বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’ উপন্যাসে লক্ষ্য করি পিতা-কন্যার দারুণ সম্পর্ক। কন্যা সন্তানের প্রতি বাবা রাজেন বাবুর এমনই টান যে, পরপর পাঁচ মেয়ের আবির্ভাব তাদের সংসারে হলেও তিনি বিরক্ত হন না। বরং মেয়েদের আকর্ষণীয় নাম রাখার ব্যাপারে তিনি খুবই উৎসাহী। এটা যে ভান নয়, তার প্রমাণ হচ্ছে কনিষ্ঠা কন্যার নামটি সবচেয়ে সুন্দর।

চলচ্চিত্রে বাবা
বাংলা চলচ্চিত্রে বাবা-সন্তানের সম্পর্কটা কীভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে, এবার সেটা দেখা যাক। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’তে দেখা যায়, পিতা হরিহর ছেলে অপুকে যেমন ভালোবাসে মেয়ে দুর্গাকেও তেমনি ভালোবাসে। তাই দুর্গার আকস্মিক মৃত্যুতে শোকাভিভূত হরিহর উঠানে বসে উঠতে গিয়ে আবার বসে পড়ে। তার মুখ থেকে অস্ফুট আর্তনাদ উচ্চারিত হয়, ‘দু-গ্-গা’।... মেয়ের বিচ্ছেদ সহ্য করতে না পেরে হরিহর সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামত্যাগের, গ্রামের মুরুব্বিদের অনুরোধেও সে কান দেয় না।

‘অপুর সংসার’-এ স্ত্রী অপর্ণার মৃত্যুর জন্য নবজাত সন্তান কাজলকে দায়ী মনে করে অপু সন্তানকে দেখতে যায় না। পরে তার মধ্যে উপলব্ধি ঘটে যে, ‘কাজলের মধ্যেই অপর্ণা বেঁচে আছে’। তাই শেষপর্যন্ত মিলন ঘটে বাবা-সন্তানের।

সত্যজিৎ রায়ের আরেক চলচ্চিত্র ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় বাবার সঙ্গে সন্তানদের দূরত্ব রয়েছে। শেষপর্যন্ত কুয়াশা সরে গিয়ে যখন কাঞ্চনজঙ্ঘা ঝলমল করে ওঠে, তখন সন্তানদের সঙ্গে বাবার সম্পর্কও সহজ ও স্বাভাবিক হয়।...‘জনঅরণ্য’ চলচ্চিত্রে বেকার ছেলে সোমনাথের জন্য অবসরপ্রাপ্ত বাবার গভীর উৎকণ্ঠা। সে যখন একপর্যায়ে মিডলম্যানের কাজে যুক্ত হয়, তখনো তার উৎকণ্ঠা দূর হয় না।

তপন সিংহের ‘কাবুলিওয়ালা’য় দেখা যায়, বালিকা মিনিকে দেখে আফগানিস্তানে রেখে আসা নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে কাবুলিয়ালা রহমতের। তাই কিসমিস-পেস্তাবাদামের বিনিময়ে সে কোনো অর্থ নেয় না।...‘সবার উপরে’তে এক হীন ষড়যন্ত্রের জালে বন্দি পিতাকে (ছবি বিশ্বাস) জেল থেকে উদ্ধার করে ছেলে (উত্তমকুমার)। মুক্ত-স্বাধীন পিতা তখন বিচারকের দিকে চেয়ে বলে: ‘ফিরিয়ে দাও আমার বারোটি বছর’।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আমজাদ হোসেনের ‘নয়নের মণি’তে পিতাকে (আনোয়ার হোসেন) ঘৃণা করে পুত্র (নয়ন)। কেননা তার মাকে (সুলতানা জামান) বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন তিনি।... ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’তেও পিতা-পুত্রের এমন সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে ঘৃণার কারণ যতটা না ব্যক্তিগত ততটাই সমষ্টিগত। কেননা পিতা (এটিএম শামসুজ্জামান) এখানে অত্যাচারী মোড়ল।

এমনিভাবে ‘সাতপাকে বাঁধা’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘নদী ও নারী’, ‘আবির্ভাব’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘সারেং বউ’, ‘দি ফাদার’সহ বিভিন্ন চলচ্চিত্রে বাবা ও সন্তানের বিচিত্র সম্পর্ক মূর্ত হয়ে উঠেছে।

গানে বাবা
‘আয় খুকু আয়’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর মেয়ের গাওয়া এই গান শোনেন নি, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দায়। এমনিভাবে বাবা-বিষয়ক নানা গানে মূর্ত হয়ে উঠেছে বাবা-সন্তানের সম্পর্ক। যেমন, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’ (এন্ড্রু কিশোর), ‘বাবা বলে ছেলে নাম করবে’ (আগুন), ‘বাবা’ (জেমস), ‘বাবা তোমার ছেলে আজ’ (মনির খান), ‘বাবা তোমার কথা মনে পড়ে’ (আইয়ুব বাচ্চু), ‘আজ তুমি কোন সুদূরে’ (ফাহমিদা নবী), ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার’ (নচিকেতা) ইত্যাদি।

‌'অন্যদিন ঈদ ম্যাগাজিন ২০২১’ পড়তে এখানে ক্লিক করুন...

Leave a Reply

Your identity will not be published.