এখন হজের মৌসুম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হজ যাত্রীরা মুসলিম বিশ্বের পুণ্যভূমি সৌদি আরবের মক্কা-মদিনায় উপস্থিত হতে শুরু করেছেন। ত্রিশ লক্ষাধিক হজ পুণ্যার্থীদের বরণ করে নিতে পবিত্র ক্বাবা শরিফসহ মিনা, আরাফা, মুজদালিফা ও জামারায় চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। এখন মিনা-আরাফার মাঠগুলোতে প্রস্তুতির কাজ চলছে।
পবিত্র জিলহজ্জ মাস আসার আগেই এই মাঠগুলো হাজার হাজার তাঁবুতে ছেয়ে যাবে। এই বছর সৌদি আরব সরকার সমস্ত ওমরাহ হজ্জ পালনকারীদের ১৪ মে’র মধ্যে সৌদি আরব ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন। শোনা যাচ্ছে, সৌদি আরব সরকার এ বছর হজের সময় পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবারের মতো উড়ন্ত গাড়ির ব্যবহার শুরু করবে। আশা করা যাচ্ছে, এ বছর হাজি সাহেবরা এক নতুন প্রযুক্তি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাচ্ছেন।
গত বছর হজের সময় আরাফার ময়দান থেকে মুজদালিফা যাওয়ার সময় রাস্তায় তীব্র জ্যামের কারণে অসংখ্য হাজি সাহেবরা সারা রাত পথে আটকা পড়েছিলেন। অনেকে ফজরের নামাজের সময় মুজদালিফায় পৌঁছেছেন। অথচ ১০ জিলহজ্জ রাতে খোলা আকাশের নিচে মুজদালিফায় রাত্রি যাপন সুন্নতে মুয়াক্কাদা। সেখানে রাতে মাগরিব ও এশার নামাজ জামাতে দলগতভাবে একসাথে আদায় করতে হবে। ফজরের নামাজের ওয়াক্ত হলে নামাজ আদায় করতে হবে জামাতে দলগতভাবে। মুজদালিফায় বড় সমস্যা হচ্ছে, টয়লেট ও ওজুর ব্যবস্থার অপ্রতুলতা। এই একই সমস্যা মিনা ও আরাফাতের ময়দানেও। প্রায় ২০/২৫ জনের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টয়লেটের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এই ব্যাপারে হাজি সাহেবদের মানসিক প্রস্তুতি থাকা একান্ত আবশ্যক।
মুজদালিফায় হাজি সাহেবদের দলগতভাবে খোলা আকাশের নিচে বিছানা পাততে হবে, নিকটস্থ কোনো টয়লেট ও অজুখানাগুলোর কাছাকাছি জায়গায়। এখানে রাত্রি যাপনের জন্য সাথে করে পর্যাপ্ত খাবার পানি ও কিছু শুকনো খাবার সাথে করে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে কোনো খাবার পানি কিংবা পানীয় পাওয়া যায় না। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মাথায় রেখে হাজী সাহেবদের মুজদালিফায় যেতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, হজের সময় পবিত্র মক্কার হেরেম শরীফ ও মদিনা শরীফের মসজিদে নববীতে প্রতি ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পরে জানাযা নামাজের ঘোষণা আসে। এই ঘোষণা আসতে মাঝেমধ্যে একটু দেরি হয়ে থাকে। সম্মানিত হাজী সাহেবরা জানাযা নামাজের ঘোষণা না আসা পর্যন্ত সুন্নত নামাজের নিয়ত বাঁধবেন না। নতুবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে বাধ্য। এখানে উল্লেখ্য যে আমরা অনেকেই জানাযার নামাজ পড়ার সঠিক নিয়ম জানি না। তাই আমার বিশেষ অনুরোধ, হাজী সাহেবরা হজে যাওয়ার আগে দেশ থেকে শুদ্ধভাবে জানাযা নামাজ পড়ার নিয়মগুলো ভালোমতো শিখে যাবেন। কারণ হজের সময় প্রতি বছর অসংখ্য হাজী অসুস্থ হয়ে কিংবা বিভিন্ন কারণে ইন্তেকাল করেন। এইসব হাজী সাহেবের জানাযা পড়ার সুযোগ পাওয়া অনেক বড় সৌভাগ্যের বিষয়। শুনেছি দাফনের সময় হজ করতে আসা মৃত্যু বরণকারী হাজী সাহেবদের মুখম-ল কাফনের কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয় না। কারণ কিয়ামতের দিনে হজ করতে আসা মৃত্যুবরণকারী হাজী সাহেবরা তালবিয়া পাঠ করতে করতে কবর থেকে বের হয়ে আসবেন।
৯ জিলহজ্জ আরাফাত দিবস। এই বিশেষ দিনে যথাযথ নিয়ম মেনে আরাফাতের ময়দানে সূর্যাস্তের কিছু সময় পর পর্যন্ত হাজী সাহেবদের সেখানে উপস্থিত থাকা হজের অন্যতম ফরজের একটি অংশ। এই দিনে আল্লাহ পাক এই ময়দানে উপস্থিত সকল হাজী সাহেবদের দোয়া কবুল করেন। আমাদের দয়াল নবিজি রাসুল পাক (স.) বলেছেন আরাফাতই হজ। হাজী সাহেবরা এইদিনে সবাই যেন বেশি বেশি করে আরাফাত দিবসের দোয়া পাঠ করেন। (লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মূলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাই’ইন কাদীর)। আল্লাহ তায়ালার দরবারে জীবনের কৃত গুনাহসমূহের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা চান। অন্তর থেকে তওবা করেন।
আপনারা হজের সময় কারোর সাথে অসৎ আচরণ কিংবা ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হবেন না। পার্থিব বিষয় থেকে দূরে থাকবেন। মদিনা শরীফে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর রওজা মোবারক অত্যন্ত আদবের সাথে জিয়ারত করবেন। সব সময় আল্লাহ তায়ালার ইয়াদে মসগুল থাকবেন। রাসুল পাক (স.)-এর শানে বেশি বেশি করে দূরুদ শরীফ পাঠ করবেন।
পবিত্র মক্কা ও মদিনা শরীফে অবস্থিত রাসুল পাক (স.)-এর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান সমূহগুলো যথাসম্ভব পরিদর্শন করবেন। মক্কা-মদিনার জান্নাতুল মাওয়া ও জান্নাতুল বাকী কবরস্থান দুটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে জিয়ারত করবেন।
বর্তমান হজ মৌসুমের সময় মরুভূমি ও পাথরের পাহাড় বেষ্টিত মক্কা ও মদিনায় দিনের বেলায় তাপমাত্রা থাকে গড়ে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের প্রখর উত্তাপ থেকে বাঁচতে সব সময় ছাতা ও সানগ্লাস সাথে রাখবেন। মক্কা ও মদিনার খাবার হোটেলগুলোতে রান্না করা খাবারে লবণ ও ঝাল কম দেওয়া হয়। তাই বাংলাদেশ থেকে আপনার ব্যাগে করে কিছু লবণ নিয়ে গেলে আপনার খাবার খেতে সুবিধা হবে।
হজের সময় হাজী সাহেবরা প্রিয়জনদের উপহার দেওয়ার জন্য ব্যাগভরে কেনাকাটা করে থাকেন। এই ব্যাপারে আমার পরামর্শ, কেনাকাটার জন্য মক্কা থেকে মদিনায় জিনিসপত্রের দাম তুলনামূলকভাবে অনেক সস্তা। কেননা মক্কা থেকে মদিনা শরীফের মানুষজন তুলনামূলকভাবে নরম স্বভাবের ও অতিথিপরায়ণ। তাই মদিনা থেকে কেনাকাটা করুন।
মহান আল্লাহ পাক আপনাদের হজ কবুল করুন। হজ পালন শেষে আপনারা নিরাপদে নিজভূমে ফিরে আসুন! আপনাদের হজ পরবর্তী জীবন সুন্দর হোক। আপনাদের সবার মঙ্গল কামনা করছি। আমাদের জন্য, দেশের জন্য দোয়া করবেন।
Leave a Reply
Your identity will not be published.