[আজ ১৪ মে, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী। এই উপলক্ষে এই নিবন্ধটি প্রকাশিত হলো।]
সারা দেশ যখন অতিমারির আঘাত সামলাতে ঘরের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছে, বাইওে বেরুনোটা যেহেতু অনিরাপদ, তখনই অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। সেই ঘোর দুর্দিনে সভা-সম্মেলন-আলোচনা হয় না—এক অনলাইনের অবাস্তব পরিসর ছাড়া—এবং সেগুলোতেই তাঁকে মাঝে মাঝে পাওয়া যেত, তাঁর সঙ্গে দেখা হতো, কথা হতো। তিনি চলে গেলে তাঁর অনুপস্থিতি, তাঁর অভাব খুব বড় হয়ে দেখা দিল, কারণ তিনি শুধু সপ্রাণ একজন মানুষই ছিলেন না, যার সঙ্গ আমাদের আনন্দ দিত, আমাদের সমৃদ্ধ করত, তিনি ছিলেন একজন পথিকৃৎ এবং শিক্ষক, যার কাছ থেকে আমরা নতুন চিন্তার উৎসাহ পেতাম। এই উৎসাহ জোগানোর কাজটি তিনি করেছেন তাঁর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে, তাঁর লেখালেখি ও বক্তৃতা বিবৃতির মধ্য দিয়ে, এবং তাঁর ঘরোয়া আলোচনা ও কথাবার্তার ভেতর দিয়েও। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না, এবং তাঁর সঙ্গে আমার যখন পরিচয় হয়, আমি নিজেই একজন শিক্ষক, যদিও তরুণ, কিন্তু তাঁকে আমি প্রথম দিন থেকেই ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেছি। এই স্মৃতিচারণেও তা-ই করব। তাঁকে দেখে আমার মনে হয়েছে, একজন শিক্ষক শুধু শেখান না, শুধু জ্ঞান বিতরণ করেন না, বরং জ্ঞানটা যাতে সামাজিক শক্তিতে পরিণত হয়, আলোর উৎস হয়ে দাঁড়ায়, তাও তাঁকে নিশ্চিত করতে হয়। শিক্ষক শুধু পাঠ দেন না, তিনি শিক্ষার্থীর রুচি গড়ে দেন, তাকে স্বাধীনভাবে ভাবতে শেখান, তার পরিপার্শ্বকে নিজের অণুবিশ্বের অন্তর্গত করার উদ্দীপনা দেন। প্রাচীন পৃথিবীতে গুরুরা সেই কাজটি করতেন। স্যারের সান্নিধ্যে যারা যেতে পেরেছেন, তারা বলবেন, কতভাবে তিনি মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারতেন, তাদের মনের জানালাগুলি খুলে দিতে পারতেন।
আমার অনেক চিন্তাকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সক্রিয় হতে সাহায্য করেছেন, আমার জানাশোনার পরিধিটাকে প্রসারিত করেছেন এবং একই সঙ্গে আধুনিকতা যে পশ্চিম থেকে আমদানি করা কোনো পরিচিতি-মোড়ক নয়, বরং নিজ ভূমিতে শক্ত একটি পা রেখে চলমান সময়কে ছোঁয়া এবং তাতে উৎপাদিত চিন্তা-ভাবনা ও বিশ্বদর্শন থেকে নিয়ে প্রযুক্তি, তত্ত্ব ও জীবনকলাতেও একটা অধিকার প্রতিষ্ঠা করার বৌদ্ধিক শক্তি, তা নির্ণয়ে সাহায্য করেছেন। এই আধুনিকতা তাঁর জীবনে ছিল, তাঁর কাজে ছিল, তাঁর আচরণে তো বটেই; কিন্তু তাঁর প্রধান অনুপ্রেরণার জোগান দিত বাঙালির ঐতিহ্য। মুসলমান বাঙালির মনকে তিনি বোঝার চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, মধ্যযুগের অনেক মুসলমান কবির আধুনিকতা আমাদের সময়ের শিক্ষিত অনেক মানুষের মধ্যে নেই। কেন নেই ? কারণ এরা মনকে সংকীর্ণ করেছেন জাত্যাভিমান, গোত্র, ধর্ম, রাজনীতি এসবের মাপে ফেলে, সংস্কৃতির উদার উত্তরাধিকার থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে। স্যার দেখিয়েছেন, সংস্কৃতির একটা বহুমাত্রিকতা আছে, বহু সংস্কৃতির মিলনে সংস্কৃতির পরিচয়টি স্থান-জাত-গোত্র থেকে বিযুক্ত হয়ে বহুজনের অধিকারে যায় এবং তখন আধুনিকতার সূত্রগুলি সে ধারণ করতে থাকে। সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদে স্যারের আস্থা তাঁকে মধ্যযুগের, আঠারো-উনিশ শতকের এবং আমাদের সময়ের বাঙালি মুসলমানদের শক্তি ও দুর্বলতাকে চিহ্নিত করার বিষয়টি সহজ করে দিয়েছিল।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের একটা সহজাত প্রতিভা ছিল আলাদা আলাদা অনেক বিষয়কে এক সামূহিক দৃষ্টিতে দেখতে পারার। তিনি কখনো রাজনীতির মাঠে নামেন নি, কিন্তু বায়ান্নোর ভাষা-আন্দোলনে যখন সক্রিয় অংশ নিলেন, তিনি তো প্রতিরোধের রাজনীতিই করলেন। সেই রাজনীতিকে স্যার কোনো ছাপমারা বাক্সে ফেলে বিচার করেন নি, বরং এক সামূহিক দায় হিসেবে দেখেছেন, বিশ্বাস করেছেন এর বিকাশ হবে সংস্কৃতি ও শিক্ষার দর্শনের মধ্য দিয়ে, লোকহিত এবং মানবকল্যাণ হবে এর উদ্দেশ্য এবং যাতে যুক্ত হবেন অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, আইন এবং এরকম অনেক বিশেষজ্ঞতার অঞ্চল থেকে আসা চিন্তাবিদ ও চর্চাকারীরা। বলা বাহুল্য, এই রাজনীতির প্রয়োগ আমাদের দেশে, অথবা ভূভারতে দেখা যায় না। কিন্তু এই রাজনীতিকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান একটি আদর্শ হিসেবেই দেখেছেন। একবার কথাপ্রসঙ্গে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আদর্শ বিষয়টা বিমূর্ত হতে হতে অপ্রয়োগযোগ্য কোনো কিছু হয়ে দাঁড়াচ্ছে কি না। তিনি বলেছিলেন, আদর্শবাদের ক্ষেত্রে সেটি হতে পারে, কিন্তু আদর্শের একটা শক্তি হলো এর প্রয়োগযোগ্যতা। কোনো আদর্শই বিমূর্ত হতে পারে না এবং কোনো সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে এর প্রয়োগ হতে পারে না। যারা এটিকে বুলির অঞ্চলেই শুধু রাখে, কাজে ফলাতে সাহস পায় না, অথবা চায় না, তাদের হাতে আদর্শ অস্বচ্ছ একটি বিমূর্তে পরিণত হয়।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যে-রাজনীতিতে আদর্শ মানতেন তাতে ঐতিহ্য থেকে সংস্কৃতিসাধনাও যুক্ত হয়েছিল। সেজন্যে কেউ কেউ তাঁর রাজনীতি নিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিত। যেমন ‘বিপুলা পৃথিবী’তে তিনি তাঁর এক শিক্ষকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন, ১৯৭৫-এর শেষ দিকে তিনি তাঁকে সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেন, তাঁকে শিক্ষা সচিব হওয়ার জন্য অনুরোধ এসেছিল, কিন্তু শিক্ষকতাটা তাঁর কাছে সরকারি কাজ থেকেও মূল্যবান ছিল বলে তিনি সেই প্রস্তাবে রাজি হতে পারেন নি, তাঁর শিক্ষকের প্রস্তাবও তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছুকাল শিক্ষকতা করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তখনো এর শিক্ষকরা দলীয় রাজনীতির চর্চা শুরু করেন নি। সেটি দুঃখজনকভাবে শুরু হয় নব্বই-এর দশকে দেশটি গণতন্ত্রে ফিরলে। এই দলীয় রাজনীতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবক্ষয়ের জন্য অনেকাংশে দায়ী। স্যার এই রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন। তবে জাতীয় প্রয়োজনে তিনি নানা বিষয়ে সক্রিয় হয়েছেন, যেমন সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ‘বাংলাদেশ রুখে দাড়াও’ আন্দোলনের তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই রাজনীতি ছিল দেশের জন্য, মানুষের জন্য।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নিজের জবানিতে, রাজনীতি, সমাজ, মানুষ ও সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর চিন্তাগুলি গড়ে দিয়েছিল তাঁর জীবন শুরুর কিছু ঘটনা ও সিদ্ধান্ত। তাঁর বয়স যখন নয় তিনি কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখেছেন, মানুষকে মানুষের হাতে শুধু ধর্ম ভিন্ন হওয়ার কারণে খুন হতে দেখেছেন। এক বছর পর দেশবিভাগ হলে পরিবারের সঙ্গে খুলনা হয়ে ঢাকা এসে তিনি নতুন জীবন শুরু করেছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশবিভাগ এবং দেশান্তর তাঁর মনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। সেই থেকে তিনি ধর্ম-বর্ণের মাপে মানুষকে বিচার করাকে মানবসমাজের একটা ভয়ানক রোগ হিসেবে দেখেছেন। আর দেশভাগের পেছনে যে একটা উপনিবেশী কারসাজি ছিল, ধর্ম ও সম্প্রদায়গত বিভেদরেখা টেনে দুটি স্বাধীন দেশের ওপর উপনিবেশী কর্তৃত্ব বজায় রাখার পশ্চিমা একটা পরিকল্পনা ছিল তাও তিনি পরিষ্কার উপলব্ধি করেছিলেন। স্যারকে আমি যেটুকু দেখেছি, তিনি যে-কোনো বিষয়ের গভীরে পৌঁছে এমন কিছু অঞ্চলে আলো ফেলতে পারতেন, যা অনেকেরই দৃষ্টি বা উপলব্ধি এড়িয়ে যেত। দেশবিভাগ এবং নব্য-ঔপনিবেশিকতাকেও তিনি নানান দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। ১৯৪৮ সাল থেকেই যখন পাকিস্তানি উপনিবেশী দৃষ্টিভঙ্গিটি প্রকট হতে শুরু করল, এবং ইংরেজদের মতো ভাষাদখল দিয়ে এর প্রতিফলন ঘটতে থাকল (ইংরেজরা অবশ্য এ-কাজটি করতে কয়েক দশক সময় নিয়েছিল), তিনি এই অপচেষ্টাটি সংস্কৃতি দিয়েই প্রতিরোধ করার উপায় খুঁজতে লাগলেন। মাত্র পনেরো বছর বয়সের এক স্কুলছাত্র যে ভাষা-আন্দোলনে যোগ দিলেন, তার পেছনে আবেগ থেকেও বেশি ছিল যুক্তি।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের রাজনীতিমনস্কতার একটি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটও ছিল, এবং তা ছিল তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের মানুষের মুক্তির আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসের । ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত সক্রিয় আফ্রিকান-এশিয়ান রাইটার্স কনফারেন্সের উদ্দেশ্যের প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল। তিনিও বিশ্বাস করতেন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শাসনে—যা চলেছে পুঁজির দুর্মর প্রভাবে—এই দেশগুলির যে পতনদশা তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রতিরোধের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ। ১৯৯০ সালে তিনি আফ্রো-এশীয় সংহতি পরিষদের এক সম্মেলনে যোগ দিতে এডেন গিয়েছিলেন। এ দুই সংগঠন ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাদের পাশে ছিল। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সক্রিয় সমর্থন না দেওয়ায় পশ্চিমের এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির প্রতি তাঁর ক্ষোভ ছিল, তবে তিনি বিশ্বাস করতেন ফিলিস্তিনিদের মতো একটি সংগ্রামী জাতি একদিন সফল হবেই।
যে-রাজনীতির চলৎশক্তি জোগায় সংস্কৃতি—অথবা ভিন্নভাবে বললে—যে-সংস্কৃতি রাজনীতিকে যে-কোনো অচলায়তনের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়, তাতে স্যারের যে-আস্থা ওই অল্পবয়সে জন্মেছিল, জীবনের শেষে এসেও তাতে কোনো চিড় ধরে নি। তাঁর চারটি স্মৃতিকথামূলক বই ‘আমার একাত্তর’ (১৯৯৭), ‘কাল নিরবধি’ (২০০৩), ‘চেনা মানুষের মুখ’ (২০১৩) ও ‘বিপুলা পৃথিবী’ (২০১৫) সাক্ষ্য দেয়, তিনি রাজনীতিতে সংস্কৃতির প্রতিফলন অনুপস্থিত হতে থাকলে সংস্কৃতির ওপরই আস্থা স্থাপন করেছিলেন। এবং সংস্কৃতি বলতে, আবারও বলি, সেই চর্চা যা বহুজনের, যাতে বিত্ত বা শ্রেণির বিষয়টি মোটেও বিবেচ্য নয় এবং এর প্রভাব শুধু নান্দনিক চর্চা বা কাজে নয়, বরং যা কিছু সৃষ্টিশীল, মানবমুখী, কল্যাণকর এবং ন্যায় ও বিচারের পক্ষে প্রতিবাদী, তাতে ব্যাপকভাবে অনুভূত। স্যার যে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের প্রতি অল্পবয়সেই ঝুঁকে পড়েছিলেন, তার কারণ তাঁর এই বোধ যে, কোনো সংস্কৃতিই একক বিশিষ্ট নয়, সংস্কৃতি মানেই মিলন, বহুপথ একটা জায়গায় এসে মেশা, বহু মন একে অপরের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া। কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনে তাঁর সম্পৃক্ততার একটা বড় উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষাকে সংস্কৃতির বাহন করা, যে-সংস্কৃতি একজন শিক্ষার্থীর ভেতর থেকে তৈরি হবে, একটা বীজ যেমন একসময় একটা বৃক্ষে পরিণত হয় তেমনি। যারা শিক্ষাকে সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে গ্রহণ করেছে, পরিশ্রুত হয়েছে, রুচিটা উন্নত করেছে, তাদের প্রতি তাঁর একটা দুর্বলতা আমি সব সময় লক্ষ করেছি। অন্যদিকে, যাদের মধ্যে রুচির অভাব ছিল, তারা যতই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকুন না কেন, তাদের তিনি এড়িয়ে চলতেন। একবার এক আলাপচারিতায় এক কবি স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কি তরুণদের রুচি অশুদ্ধ করে দিতে পারে ? স্যার হেসে বলেছিলেন, যেহেতু এই মাধ্যমে সক্রিয় চিন্তার জায়গাটা কম, ফলে এটি সক্রিয়ভাবে কারও রুচি নষ্ট করতে পারে না, তবে রুচির ঘরে যেখানে যেখানে অন্ধকার আছে, তাকে আরও গাঢ় করে দিতে, রুচির অভাব থাকলে তাকে বাড়িয়ে একসময় একটা দুর্বিপাক তৈরি করে।।
স্যারের সঙ্গে দেশের বাইরে সভা-সেমিনারে অংশ নেওয়ার সুযোগ আমার কয়েকবারই হয়েছে এবং প্রতিবারই দেখেছি, অল্প কথায় অনেক মৌলিক বিষয়ে তিনি তাঁর চিন্তাগুলি সাজিয়ে পরিবেশন করতেন। ২০১১ সালের মে মাসে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতজন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয় এবং এটি অনুষ্ঠিত হয় মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে। ওই সেমিনারে স্যার যে-ভাষণ দেন, তার বিষয় ছিল ‘রবীন্দ্রনাথের দর্শন’। চমৎকার এবং প্রাঞ্জল ইংরেজিতে স্যার যে-কথাগুলি বলেছিলেন, তার মধ্যে ছিল রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা এবং জাতীয়তাবাদ বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা যা পশ্চিমের প্রচলিত বয়ানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নতুন এক পাঠ উপহার দিয়েছিল। বক্তৃতাটি শুনতে শুনতে আমার মনে হয়েছিল, স্যার নিজে যে-আধুনিকতার চর্চা করতেন, তাতে সময়ের নির্যাসকে ধারণ করে এবং বাঙালিয়ানার নিরিখে তাকে ফেলে নিজস্ব একটি চরিত্র ও প্রকৃতি নির্মাণের ঐকান্তিকতাটাই ছিল মূল লক্ষ্য। এটিকে তিনি সমন্বয়বাদীও বলতেন, তবে তাতে নিজস্বতাটা যেন হারাতে না হয় সেদিকে নজর দেওয়ার ওপর জোর দিতেন। রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদের চিন্তায় কেন্দ্রের পরিবর্তে প্রান্তের ওপর যে প্রাধান্য, দেওয়া-নেওয়া, মিলন ও মেলানোর যে-উদ্দেশ্য, তাতে বহুসংস্কৃতির বিষয়টি নিশ্চিত হয়।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পঠন-পাঠন ও আগ্রহের অঞ্চলগুলিতে শিল্পকলা যে অগ্রাধিকার পেত, সেটি যখন একসময় বুঝতে পারলাম, এ-বিষয়ে তাঁর মৌলিক চিন্তাভাবনা জানতে আগ্রহী হলাম। যারা স্যারের বাসায় গিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় অথবা গুলশানে, তারা জানেন পেইন্টিং ও ড্রয়িংয়ের একটি ছোটখাটো, কিন্তু সমৃদ্ধ সংগ্রহ তাঁর ছিল। কামরুল হাসান এবং সফিউদ্দীন আহমেদ থেকে নিয়ে তরুণ অনেক শিল্পীর সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা ছিল। তবে শিল্পকলা নিয়ে লেখালেখিতে তাঁর সক্রিয়তা আমার চোখে পড়ে নি । অনেক পরে কবি ও কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত আমাকে বলেছিলেন, শিল্পকলা নিয়ে স্যারের ন’টার মতো লেখা তিনি সংগ্রহ করেছেন। শিল্পকলার একটি দিক নিয়ে স্যারের সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে আলাপ হতো এবং তা ছিল এতে উপনিবেশবাদের প্রভাব এবং উত্তর-উপনিবেশী চিন্তা। পশ্চিমা শিল্পকলা নিয়ে স্যারের চিন্তাভাবনা আমার কখনো জানা হয় নি, যেহেতু আমরা কথা বলেছি বেঙ্গল স্কুল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চিত্রকলা নিয়ে। ২০০৪ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের ‘যামিনী’ নামে একটি আন্তর্জাতিক আর্ট ম্যাগাজিন প্রকাশনা শুরু করেন এবং অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হন। সম্পাদকমণ্ডলীতে আমিও ছিলাম। ফলে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের গুলশানের একটি অফিসে মাঝেমধ্যেই স্যারের সঙ্গে দেখা হতো। তাঁর এক বড় গুণ ছিল, যে-কাজই তিনি করতেন আন্তরিকতার সঙ্গে, নিখুঁতভাবে, তা করতেন। তাঁর আরেক গুণ ছিল নিয়মানুবর্তিতা। ‘যামিনী’র জন্য তিনি সপ্তাহে একদিন বরাদ্দ রেখেছিলেন। ম্যাগাজিনটি বেরুত ইংরেজিতে, প্রথমে এটি ছিল ত্রৈমাসিক, পরে ষাণ¥াসিক, এরপর অনিয়মিত, একসময় এটি পাতা মুড়ে ইতিহাসে চলে গেল। ছাপা হওয়ার জন্য জমা নেওয়া প্রবন্ধগুলি স্যারকে আমরা দেখাতাম, তাঁর মন্তব্যের জন্য। তিনি এই উপমহাদেশ এবং আমাদের চিত্রকলা নিয়েই বেশি আগ্রহী ছিলেন। আমাদের বলতেন, আমাদের শিল্পীদের পশ্চিমা শিল্পীদের অনুকরণ করা উচিত নয়, এতে মনের উপনিবেশমুক্তি ঘটবে না। বরং নিজেদের ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টি দিলে, যেমন দিয়েছিলেন জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান, একটা নিজস্ব শিল্পধারা তৈরি করা সম্ভব।
মনের উপনিবেশমুক্তি কথাটা অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বিশ্বাসে একটা বড় জায়গা নিয়ে ছিল। যেসব শিল্পী আধুনিকতার ঢেউটি গায়ে লাগিয়েও মূল ভূমিতে দাঁড়াতে পারতেন, তাঁদের তিনি প্রশংসা করতেন। তবে এই বিচারটি তিনি নিজের মধ্যেই রাখতেন, অথবা আমাদের মতো যারা একটা অ্যাকাডেমিক আগ্রহ থেকে তাঁর সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করতাম, তাদের সঙ্গে ভাগ করতেন। নান্দনিক-নৈতিক কারণে নেহাত প্রয়োজন না হলে তিনি কারও মূল্যবিচারে যেতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, এতে কোনো ব্যক্তির কাজের নিরপেক্ষ একটি মূল্যায়ন যতটা না হয় তার থেকে বেশি হয় বিচারকারীর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের অথবা কোনো পক্ষ গ্রহণের প্রতিফলন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মনেপ্রাণে একজন আধুনিক মানুষ ছিলেন—আধুনিক অর্থাৎ আলোকপ্রাপ্ত, যুক্তিবাদী, ইহজাগতিকতার কাঠামোয় সমাজ ও সময়কে দেখতে আগ্রহী, পরিমিতিবোধসম্পন্ন, আবেগকে বুদ্ধির শাসনে রাখতে বিশ্বাসী এবং যুক্তির অভ্যস্ত এবং পরিশীলত চর্চা ও রুচির নান্দনিকতায় একনিষ্ঠ একজন মানুষ। একই সঙ্গে আধুনিকতার যে কিছু পক্ষাবলম্বন থাকে, কিছু কাঠামোকে যে তা মহিমা দেয় এবং অনাধুনিক বিবেচনা করে ঐতিহ্যের অনেক অঞ্চলে বেড়া তুলে দেয়, সেসব নিজে তিনি যেমন পরিহার করতেন অন্যদেরও তা করতে উৎসাহ দিতেন। তিনি শ্রেণি, বর্ণ ও বিত্তকে মূল্য দিতেন না, পুরুষতান্ত্রিকতার অনেক দাবিকে অস্বীকার করতেন এবং কোনো কাঠামোকে মানুষের ওপরে স্থান দিতেন না। এজন্য তাঁর সান্নিধ্যটা সকলের জন্য এত কাক্সিক্ষত ছিল। তিরাশি বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণকে তাই অকালপ্রয়াণই বলতে হয়। তাঁকে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল। মহামারি-উত্তর বাংলাদেশের সংস্কৃতি, সমাজ ও শিক্ষার নতুন বিকাশের জন্য তাঁর দিকনির্দেশনার প্রয়োজন ছিল।
তবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যা রেখে গেছেন তা কাজে লাগাতে পারলে শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সমাজনির্মাণের পথে বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়ে যাবে।
Leave a Reply
Your identity will not be published.