অলখ প্রাণ।। মনোয়ার হোসেন

অলখ প্রাণ।। মনোয়ার হোসেন

ড্রাইভার সাহেব, তুমার নাম কী?

রহিম মিয়া!

পেছনে না তাকিয়ে ছোট করে জবাব দিল মোটরে চালানো ভ্যান গাড়ির ড্রাইভার। বিশ-পঁচিশ বছরের জোয়ান ছেলে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে সারা শরীর পলিথিনে মুড়িয়ে রেখেছে। প্রশ্নটা করে শেখ আফজাল বোকার মতো এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল। শেখ আফজালের বয়স পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হবে। একমাথা সাদা চুলে তাকে অবশ্য আরও বেশি বয়স্ক দেখায়। গলাখাঁকারি দিল।

ও রহিম মিয়া, তুমার কাছে ছাতা আছে নি? আমার পুলাটা ভিইজ্যা যাইতেছে।

বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। শীতলক্ষ্যার পাড় ঘেঁষে খোয়া বিছানো এবড়োখেবড়ো রাস্তা। ঝড়-বৃষ্টিতে খোয়া সরে গিয়ে কাদায় ভরে আছে। নদীতে বানের পানি নেমে যাওয়ার সরসর শব্দ শোনা যাচ্ছে। পুরো আকাশ মেঘে ঢাকা। বিকেলের পড়ন্ত আলো কেমন মিইয়ে এসেছে। থেকে থেকে কাদায় ভ্যান গাড়ির চাকা দেবে যাচ্ছে। রহিম মিয়া খুব মনোযোগ দিয়ে ব্রেক চাপা আর ছাড়ার কাজ করছে। একটু এদিক-সেদিক হলেই কাদায় চাকা গেড়ে উল্টে যেতে পারে ভ্যান গাড়ি। কোনো জবাব দিল না রহিম মিয়া।

আপনে চুপ করবেন আব্বা?

ধমকে ওঠে শেখ আফজালের ছেলে শফিক। মেজাজটা ধরে রাখতে পারছে না। আপনে সত্যি কইরা কন তো আব্বা, সালাম গাড়িটা বেইচা দিছে ক্যান? এক মাসের উপ্রে হইছে, ও আমার ফোন ধরে না।

একটা মোটা জ্যাকেট গায়ে দেওয়া শফিকের। পেছনের থেকে হুডি বের করে মাথা ঢেকে নিল। সুফিয়া ওর ছোটবোন। এগারো বছর বয়স। অনেক দিন পরে ভাইকে দেখে লজ্জা পাচ্ছে। গুটিসুটি মেরে বসে আছে। অন্যান্য ভাইবোনের মতো দেখতে হয় নি, উজ্জ্বল গায়ের রং। সবুজ জমিনে লাল ফুল আঁকা ফ্রক পরেছে। তেল দেওয়া মাথার চুল লেপ্টে আছে কপালে আর গালে। মাথা বেয়ে বৃষ্টির পানি নেমে যাচ্ছে, অথচ কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।

শেখ আফজাল বোকামতো হাসিটা মুখে ধরে রেখেছে। একবার মাথা তুলে ছেলের দিকে তাকাল, কিন্তু উত্তর দিল না। ঢোলা প্যান্ট আর সাদা জামা, পায়ে ছেঁড়া কেডস পরা। সেদিকে তাকিয়ে আবার মেজাজ হারাল শফিক।

আমারে এয়ারপোর্টে আনতে গেছেন এই ড্রেস পইরা? এত টাকা পাঠাইছি এই কয় বছরে। টাকা ছিঁড়্যা টুকরা টুকরা কইরা খাইয়া ফেলাইছেন নাকি?

চারটি লাগেজ এনেছিল শফিক সাথে করে। চার বছরের সমস্ত সঞ্চয়। চারটির মধ্যে তিনটি পাওয়া যায় নি। যেটি পাওয়া গেছে, সেটির কোণা ছুরি দিয়ে নিখুঁত করে কাটা। এই লাগেজে দুটি ফোন ছিল। কুলসুমের জন্য একটি আর কুলসুমের ছোটবোন ফুলির জন্য একটি। হাতব্যাগে আনে নি। শুনেছিল এয়ারপোর্টে কাস্টমস আটকে দিতে পারে। লাগেজ হারিয়ে এমনিতেই উতলা হয়ে ছিল। বুঝতে পারছিল না কার কাছে নালিশ জানাবে। প্রায় চার ঘণ্টা অপচয় করে অবশেষে লস্ট লাগেজ ক্লেইমের কাগজপত্র পূরণ করে বাইরে এসেছে। ভেবেছিল ছোটভাই সালাম গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে।

সালাম উত্তরায় ব্যক্তিগত গাড়ি চালাত। ফোন করলেই একটা গাড়ি কিনে দেওয়ার বায়না করত। উবার চালাবে। মাসে মাসে টাকা শোধ করে দেবে। অবশেষে আব্বা-আম্মার পীড়াপীড়িতে এক বছর টাকা জমিয়ে আট লাখ টাকা পাঠিয়েছিল। সেই টাকা দিয়ে সালাম সেকেন্ড হ্যান্ড টয়োটা করোলা কিনেছিল। তাও প্রায় সাত-আট মাস হবে। এই কয়েক মাসে একটা টাকাও দেয় নি সংসারে। ওর টাকা শোধ করা তো অনেক পরের কথা। এয়ারপোর্টে ওকে না দেখে আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিল, সালাম আইল না ক্যান আব্বা?

শেখ আফজালের চেহারা এমনিতেই বোকা বোকা। সেই বোকা চেহারা আরও বোকা দেখাতে লাগল। মাথা নিচু করে বলল, কী নাকি এক ঝামেলায় পড়ছিল সালাম। গাড়িটা বেইচা দিছে।

আকাশ থেকে পড়ার মতো অবস্থা। বেইচা দিছে মানে? কবে বেচল? টাকা কই গাড়ি বেচার?

শেখ আফজালের বোকা চেহারায় কোনো ভাবান্তর হলো না। শুধু বলল, বাইত যাইয়া কমু নে সব খুইলা।

মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। বাসের চিন্তা বাদ দিয়ে ট্যাক্সি নিল শফিক। ট্যাক্সি ড্রাইভার শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটু আগে থামিয়ে দিল গাড়ি। কাপাসিয়ার তরগাঁও উত্তরপাড়ায় ওদের বাড়ি। এখান থেকেই নদীপাড়ের খোয়া বিছানো রাস্তায় নামতে হবে। রাস্তার অবস্থা দেখে ড্রাইভার কোনোমতেই রাজি হলো না। বাধ্য হয়ে ভ্যান গাড়িতে উঠে বসেছে। ঢাকায় নামতে একের পর এক ঘটনায় এমনিতে ক্ষিপ্ত ছিল মেজাজ। বৃষ্টিটাও ঠিক পছন্দ হচ্ছে না শফিকের। চড়া মেজাজ আরও চড়ে যাচ্ছে।

আইজ বাঙলা মাসের কয় তারিখ আব্বা?

আষাঢ় মাসের আইজ একুশ তারিখ বাজান। যে গরম পড়ছিল! আল্লাহপাক এহন রহমতের বিষ্টি দিতেছেন। জমির ফসল সব জ্বইলা যাইতেছিল। 

আমার এই মরার সময়েই দেশে আসতে হইল! চারিদিক ডুইব্বা যাওন দেখনের লাইগা?

কিছু কইলা আব্বাজান?

না। মরার কপাল! কী আর কমু?

বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করল শফিক। আর কয়েকটা মাস থেকে আসতে পারলে হয়তো কাগজ হয়ে যেত। চার বছরের সাধনা এই অসময়ে দেশে এসে শেষ হয়ে গেছে। আব্বা-আম্মা কিছুতেই আসতে দিতে চাচ্ছিলেন না। বলছিলেন, আমরা সব সামলাইয়া নিমু। তুমি কষ্ট কইরা ওই দেশে থাইকা যাও। যে উদ্দেশ্যে গেছ, হেই উদ্দেশ্য পূরণ না কইরা দেশে আইসো না।

তারপরেও সব ছেড়েছুঁড়ে দেশে ফিরে আসতে হলো। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সামনে। ভারী বর্ষায় দেশ ডুবে যাচ্ছে, সাথে নিজের ডোবাটাও যেন দেখতে পেল। জানে না সামনে কী অপেক্ষা করে আছে। ফোনের রিংটোনে ভাবনা থেমে গেল।

তুমরা আর কত দূর? আম্মা চিন্তা করতেছে।

কুলসুমের জন্যই আজ দেশে ফেরত আসতে হয়েছে। ছেলের নাকি এখন তখন অবস্থা। ভাবতেই মেজাজ আবার চড়ে যাচ্ছে। ছেলের এত খারাপ অবস্থা, মাসখানেক ধরে ঘ্যানঘ্যান করছিল কুলসুম। অথচ এর আগে ছেলের সাথে, আব্বা-আম্মা-ভাইদের সাথে কথা হয়েছে প্রতিদিন। কেউ ছেলের অসুস্থতার কথা বলে নি। কুলসুম ছেলের অসুস্থতা নিয়ে কান ঝালাপালা করতেই লাগল। অন্য সবাই বলছে রফিকের কিচ্ছু হয় নি। কয়েকদিন ধরে অল্প জ্বর। গাজীপুর সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দেখানো হয়েছে। ওষুধ খাচ্ছে। ঠিক হয়ে যাবে। অথচ কুলসুমের সাথে কথা বললেই কান্নাকাটি করতে থাকে। ভালো করে বলেও না রফিকের ঠিক কী হয়েছে। ফোন করলেই বলে, শেষ দেখাটা দেখতে চাইলে চইলা আসো। ছেলেটাকে ভিডিও কলে দেখলে মনটা অবশ্য অস্থির হয়ে ওঠে। বিছানার সাথে লেপ্টে থাকে ইদানীং। এক-দুই মাসেই ছেলের এমন অবস্থা কী করে হলো ভেবে কূল করতে পারে নি।

কুলসুমের কান্নাকাটিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে দেশে ফিরে যাবে। ইতালির কাগজপত্রের আশা ছেড়ে দিতে হলো। এত অল্প সময়ে সবকিছু ভালোমতো গুছিয়ে আনতে পারে নি। মেজাজ না হারিয়ে ফেলার কোনো কারণ নেই।

আম্মারে কও চইলা আইছি। আর আধা ঘণ্টার মতো লাগব।

ভেবেছিল একবার জিজ্ঞেস করবে, তুমি দুশ্চিন্তা করতেছ না? আব্বার সামনে বলা যায় না। ফোনের স্পিকারের সাথে মুখ লাগিয়ে জিজ্ঞেস করল, রফিক কী করতেছে?

হেয় সারা রাইত ঘুমায় নাই। বাপেরে দেখার লাইগা উতলা হইয়া আছে। খালি বারেবারে জিগায়, আব্বায় কই মা? এই যে পুলায়। কথা কইবা?

সম্ভবত রফিকের তর সইছিল না। কুলসুমের কথা শেষ হয় নি, সাথে সাথেই চিকন গলা শোনা গেল।

আব্বা, আমার লাইগা যে লাল রংগা বন্দুক কিনছিলা, ওইটা নিয়া আইছ না?

চড়া মেজাজ মুহূর্তেই কষ্টে ভেঙে পড়ল। ছেলের খেলনা, কাপড় সবকিছু হারিয়ে যাওয়া লাগেজগুলোর একটিতে ছিল। গলার কাছে কিছু একটা আটকে থাকার অনুভূতি টের পেল। বুকটা চাপা ব্যথায় ভেঙে যাচ্ছে। ভাগ্যিস বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির পানির সাথে ওর চোখের পানি মিলেমিশে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। 

হ বাজান। নিয়া আইছি। তুমার শইলডা ভালা লাগতেছে আইজ?

দুই

শফিকরা চার ভাই এক বোন। ভাইদের মধ্যে ও তিন নম্বর, ওর ছোট এক ভাই, এক বোন। অন্যের জমিতে হাল চাষ দেওয়া হতদরিদ্র বাবার ঘরে জন্ম। বড় দুই ভাই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে অপারেটর হিসেবে ঢুকে পড়েছিল অল্প বয়সেই। শফিক পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়েছিল। শেখ আফজালের পড়াশোনার বিষয়ে কোনো ধারণা নেই। সে চাইছিল শফিকও বড় দুই ভাইয়ের মতো গার্মেন্টসে চাকরি করুক। কিন্তু হেডস্যার কোনোক্রমেই সেটা মানলেন না। এসএসসি পর্যন্ত খাতা কলম আর টিউশনের খরচ হেডস্যার নিজেই বহন করেছিলেন। এসএসসিতেও খুব ভালো রেজাল্ট করে বসল শফিক।  

হেডমাস্টারের পীড়াপীড়িতে টংগী সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছিল শফিক। ও কলেজে থাকতেই বড় দুই ভাই বিয়ে করে গাজীপুর শহরে চলে যায়। ভাইয়েরা সংসারের খরচ দেওয়া বন্ধ করে দেয় একসময়। ও যখন দ্বিতীয় বর্ষে, সেই সময়ে ওর ছোট বোন সুফিয়ার জন্ম হলো। সুফিয়ার জন্মের পরে ওর আম্মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন। কয়েকবার অপারেশন করতে হয়েছে। কী যেন কঠিন এক মেয়েলি রোগ। ভিটে ছাড়া তিন শতাংশ চাষের জমি ছিল, সেই জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করতে হলো। এই অবস্থায় শফিকের মনে হলো, পড়াশোনার পালা শেষ। সংসারের হাল ধরতে হবে। বাড়ি ফিরে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে চাকরিতে ঢুকে পড়ে। এখানেই কুলসুমের সাথে পরিচয়।

ভালোবাসাবাসি বেশি দূর গড়াবার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। আম্মার শারীরিক অবস্থায় সংসার সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। সুফিয়া জন্ম থেকেই রোগ কাতুরে। ওকে দেখার জন্যও একজন নারীর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কুলসুম এসে চমৎকার হাল ধরে ফেলেছিল সংসারের। ছোট ননদকে নিজের সন্তানের মতোই আদর দিয়েছে।

শফিক আর কুলসুমের চাকরির টাকায় সংসার যখন মোটামুটি চলছিল, সেই সময়ে রফিকের জন্ম। রফিকও অনেকটা ওর ফুপির মতো রোগা হয়েছে। জন্মের পর থেকে এমন কোনো অসুখ নেই ওর হয় নি। নিউমোনিয়া, টাইফয়েডের মতো কঠিন সব রোগে ভুগেছে। একটা সময়ে আশপাশের সবাই বলাবলি করা শুরু করল, সারা দিন জামাই-বউ দুজনে গার্মেন্টসে পড়ে থাকে। এই কারণেই এত রোগে ভোগে ছেলেটি। মিথ্যে নয়, রফিকের দাদিও সারা বছর অসুস্থ থাকেন। নিজের ছোট মেয়েকেই দেখাশুনা করতে পারেন না। অবশেষে অনেক চিন্তাভাবনার পরে কুলসুম চাকরি ছেড়ে দিল।

অভাবের সংসারে যেটা হয়, ঝগড়াটা খুব বেড়ে গেল। শফিকের একার আয়ে এত বড় সংসার চালান সম্ভব হচ্ছিল না। আব্বা, আম্মা আর কুলসুমের ঝগড়ায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়ল ও। অনেকবার ভেবেছে তালাক দিয়ে দেবে কুলসুমকে। কিন্তু অসুস্থ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সেই চিন্তা থেকে সরে এসেছে প্রতিবার।

শফিকের বন্ধু আজম বেশ কয়েক বছর হয়েছে ইতালি প্রবাসী। বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করল, কোনোভাবে ইটালি নিয়ে যাওয়া সম্ভব কি না। আজম দালালের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সব মিলিয়ে ছয় লাখ টাকা খরচ করতে পারলেই ইতালির ভিসা জোগাড় করা যাবে।

অস্থির সময় যাচ্ছিল। শফিক পাগলের মতো করত টাকার ব্যবস্থা করতে। মনেপ্রাণে চাইছিল সংসারের এই অত্যাচার থেকে পালাতে। কুলসুম এক রাতে সুসংবাদ দিল। রফিকের নানার কাছে টাকা ধার চেয়েছিল। জমি বিক্রি করে টাকা দিতে রাজি হয়েছেন উনি।

তিন

ওদের ভ্যান গাড়ি যখন বাড়ির দুয়ারে পৌঁছে, চারিদিক অন্ধকার করে আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে। বৃষ্টির তেজও বেড়েছে। সন্ধ্যা নামার আগেই রাত নেমে এসেছে ধুপ করে। পাশাপাশি দুটি মাটির ঘর। আব্বা-আম্মাকে অনেকবার বলেছে ইটের দেয়াল তুলে ঘর বানাতে। অনেক টাকা নষ্ট হবে বলে তারা মানা করতেন।

ভেবেছিল বাড়িভর্তি লোক দেখবে। কুলসুমকে দেখা গেল বামদিকের ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্যান থামতে দৌড়ে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করল। এই কুলসুমকে খুব অচেনা লাগছে শফিকের। প্রতিদিন ভিডিও কলে যাকে দেখে, মনে হলো এই কুলসুম সেই কুলসুম নয়। যৌবনের রং যেন উথাল-পাথাল করে ঘিরে রেখেছে এই কুলসুমকে। চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলেছে কুলসুম।

কেমন আছে আমার বাপজান?

ভ্যান গাড়ি থেকে নিচে নেমে দাঁড়াল শফিক।

আম্মারে সালাম কইরা আসো আগে। খাবার বাইরা রাখছি। রফিক ঘুমাইতেছে, ডাকি নাই। সারা রাইত ছটফট করছে বাপেরে দেহনের লাইগা। এক ফোঁটা ঘুমায় নাই। আমারেও ঘুমাইতে দেয় নাই।

শেখ আফজাল ‘বাজারে একটু কাম আছে’ বলে সেই ভ্যান গাড়িতেই উঠে বসেছে। শফিক মনে মনে খুশি হলো। ভেতরে ভেতরে পুড়ে যাচ্ছে গরম তাপে। কিসের তাপ, বুঝে উঠতে পারল না।

বাপধন আমার! আইছো বাজান আমার?

রোকেয়া বেগম একাকী চলাফেরা করতে পারেন না। কুলসুম ধরে ধরে এদিক-সেদিক নিয়ে যায়। চৌকির সাথে প্রায় লেপ্টে ছিলেন। কুলসুম গিয়ে শাশুড়িকে ধরে উঠিয়ে বসাল। দুই চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। শফিক মাথা নিচু করে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে পাশে গিয়ে বসল।

ভালো আছি আম্মা। তুমি এমন শুকাইয়া গেছ কেমনে?

বাবা, মরার সময় চইলা আসছে। তোমার চেহারাটা দেখবার পারলাম মরার আগে। শান্তি পাইতেছি বাজান।

এই আম্মার সাথে কদিন আগের আম্মাকে মেলাতে পারছে না শফিক। ফোন করলেই ঘ্যানঘ্যান করত বাংলাদেশে না ফেরার জন্য। ‘এই পোড়ার দেশে ফিরত আইসা কী করবি বাজান? রফিকের কিচ্ছু হয় নাই। কুলসুম বেশি বেশি কথা কয়। জ্বর ভালো হইয়া গেছে নাতির।’ এই ছিল আম্মার ভাষ্য।

সত্যি কইরা কও তো আম্মা, আমারে দেইখা তুমি খুশি হইছ? আমি কইলাম আর ফেরত যাবার পারুম না।

কুলসুম শাশুড়িকে ধরে বসে ছিল। ‘আম্মা, শফিকের ভুখ লাগছে কইতেছিল।’ মাথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল কুলসুম। হয়তো স্বামীকে বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে চাইছে।

আম্মা। আমি রফিকরে দেখবার যাই। তুমি আরাম করো।

হাত-মুখ ধুয়ে মুছে মায়ের কাছে উঠে বসেছে সুফিয়া। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল ভাইয়ের মুখে। জিন্স প্যান্টের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছোট একটা গয়নার বাক্স বের করল শফিক। দুটি সোনার চেইন। বাক্স খুলে একটা মায়ের হাতে দিয়ে অন্যটি সুফিয়ার গলায় পরিয়ে দিল। শফিকের মা ‘ওরে আমার সোনার টুকরা বাজান রে’ বলে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

চার

শফিক কুলসুমের হাত ধরে রেখেছে। হ্যাংলা পাতলা রফিক খাটের এক কোণে গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। বাইরে বৃষ্টি হলেও ঘরের ভেতরে কেমন একটা গুমোট গরম। হয়তো সারা দিনে দরজা-জানালা খোলা হয় না। রফিকের গায়ের ওপর মোটা কম্বল পেতে দেওয়া। 

‘হাত ছাড়ো। শরম করতেছে!’ বলেই দরজা ভিজিয়ে দিল কুলসুম। তারপর শফিককে দুই হাতে জড়িয়ে মেঝেতে ছুড়ে ফেলল। সাপের মতো হিসহিস করছে। খুব সম্ভবত পাগল হয়ে গেছে। এক টানে শাড়ি খুলে ফেলে শফিকের উপরে চড়ে বসল। শফিক একবার বলেছিল, আগে খাইয়া নেই। রাইতে আদর দিমুনে। কিন্তু কুলসুমের তর সইছিল না যেন। দীর্ঘ দিবস-রজনীর হিসেব যেন এক লহমায় শেষ করতে চাইছে।

তোমার জন্য কী আনছি শুনবা না বউ?

রোমশ বুকের ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল কুলসুম। হয়তো গভীর ক্লান্তি ওকে ঘিরে ধরেছিল। শফিকের কথায় ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল। তারপর উঠে বসে পেটিকোট ঠিকঠাক করে শাড়ি টেনে এনে দ্রুত হাতে নিজেকে পেঁচিয়ে নিল। শফিক তখনো মেঝেতে শুয়ে। দুই হাত বাড়িয়ে কুলসুমকে আবার বুকে টেনে নিল। বুকে শুয়েই চিৎকার করে কান্না শুরু করে দিল কুলসুম। ‘এইডা আমি কী করলাম? এইডা আমি ক্যাম্নে করবার পারলাম? আমি না মা? এইডা আমি ক্যাম্নে করবার পারলাম!’

শফিক হকচকিয়ে গেছে। বুঝে উঠতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। কুলসুমকে আরও গভীর করে বুকে চেপে ধরল।

কিচ্ছু হয় নাই। এত বছর পরে। এইটা তো হইবারই কথা, নাকি?

সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল শফিক। কিন্তু কুলসুম কান্না থামাল না। শফিকের বুকের থেকে মাথা তুলে ধরল।

আমারে ছাইড়া দেও তুমি। ধইরা রাইখো না। আমি কালসাপ। আমি কালসাপ! পুলাডা মইরা যাইতেছে। আর আমি তোমার লগে শরীর নিয়া খেলা করবার গেলাম। আমি পাপী। আমি মা না। আমি পিচাইশ!

হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল কুলসুম। খাটের কোণা ধরে মেঝেতে বসে আছে। শফিক উঠে প্যান্ট পরে নিল। চিৎকার আর কান্নার শব্দে রফিক উঠে বসেছে। আব্বাকে ওর মনে নেই। দুই বছর বয়সে আব্বা দেশান্তরী। ভিডিও কলে যা কথা হয়। ওর কাছে আবেগের চেয়ে বেশি মূল্য আব্বার পাঠানো চকলেট আর খেলনা। কেউ দেশে এলে শফিক তাদের হাতে ছেলের জন্য চকলেট আর খেলনা পাঠিয়ে দিত। ঘুম থেকে উঠে চুপচাপ বসে রইল। কুলসুম আঁচল দিয়ে মুখ মুছে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরল ছেলেকে।

দেহো চাইয়া। কে আইছে! কও তো বাজান। উনি তোমার কী হয়?

আব্বা!

বলেই মাথা নিচু করে ফেলেছে রফিক। বয়সের তুলনায় গলার আওয়াজ খুব চিকন। হয়তো অসুস্থ বলে এমন গলার আওয়াজ।

তোমারে এতদিন বাদে দেইখা শরম পাইতেছে।

‘আব্বা’ ডাক শুনে শফিকের কেমন জানি অনুভূতি হচ্ছিল। একটু দ্বিধা হয়তো মনের ভেতরে কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে। মুখে হাসি ফুটিয়ে খাটে উঠে বসে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরল। আগুনের তাপে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। দুই চোখ কোটরে বসে গেছে। ভিডিও কলে ছেলেকে এত ম্রিয়মাণ দেখাত না। বুকের ভেতরে ছ্যাঁত করে উঠেছে।

রফিক এতক্ষণ চুপ করে ছিল। অপরিচিত এই লোকটির গায়ের ঘ্রাণ হঠাৎ পরিচিত মনে হলো হয়তো। তারপর, ‘আব্বা আইছ? ও আব্বা, তুমি সত্য সত্যই আইছ?’ বলে শফিককে জড়িয়ে ধরল।

পাঁচ

রাত কয়টা হবে শফিকের জানতে ইচ্ছে করছিল না। কেমন একটা ঘোরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে ও। প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসেব মিলাতে চাইছিল। কিছুই মিলছে না। রফিক ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে। কুলসুম ওকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ওর হাতের স্পর্শ না পেলে একটু পরে ঘুম থেকে জেগে উঠবে। সারা রাত বুকের মধ্যে চেপে ধরে রেখে ঘুমোতে হয়। কিছুক্ষণ ধরে শফিকের বুকের বাম পাশে খুব ব্যথা করছে। বাম হাতটাও কেমন জানি অবশ অবশ লাগছিল। ব্যথাটাকে পাত্তা দিল না।

আমি এই চাইর বছরে ছাব্বিশ লাখ বাষট্টি হাজার টাকা পাঠাইছি বাড়িতে। সালামরে আলাদা কইরা গাড়ি কিনবার পাঠাইলাম আট লাখ টাকা। কুনো টাকার হিসাবই তো মিলতেছে না রফিকের আম্মা!

টাকা-পয়সার হিসেব যত করছে, বুকের ব্যথাটা ততই বাড়ছে।

আবার কইতেছ তোমার আব্বারে মাত্র দুই লাখ টাকা ফেরত দিছ। কিন্তু আমারে তো অনেক আগেই কইছ ছয় লাখ টাকা শোধ দিয়া দিছ!

নীরবে কাঁদছিল কুলসুম। আপ্রাণ চেষ্টা করছে কান্না আটকে রাখতে।

উত্তর দেও। এমুন চুপ কইরা আছ ক্যান?

আব্বা আর আম্মায় জানে টাকা-পয়সার হিসাব। জিগাইলেও আমারে কেউ কিছু কয় না। তোমার নামে ব্যাংক একাউন্ট কইরা গেলা যাইবার সময়ে। কিন্তু একটা টাকাও সেইখানে পাঠাও নাই। টাকা পাঠাইতা হুন্ডি কইরা। আরজ আলি মেম্বার আইসা আব্বা আম্মার হাতে টাকা দিয়া যাইত। আমারে কেউ হিসাব দেয় নাই। তুমি আরজ আলিরে জিগাও, আব্বারে জিগাও। সব জানতে পারবা।

আরজ আলির গুষ্ঠি মারি। ভাইজানেরা টাকা সরাইছে কি না সত্য কইরা কও। আব্বা যে কইত তোমার একাউন্টে টাকা জমা করে? তুমি তো কোনোদিন কও নাই তোমার একাউন্টে টাকা দিত না? আমার এত টাকা গেল কই?

বড় ভাইজান আর মেজ ভাইজান দুজনে আলাদা ব্যবসা দিছে তোমার টাকা নিয়া। আব্বা-আম্মার লগে ঝগড়াও করছি। হেরা কয়, বড় দুই ভাই তো কামাই সুদে নাই। ইতালিতে এত টাকা কামাই করে তোর জামাই। কয়টা টাকা বড় ভাইদের দিলে কী ক্ষতি! তুমি কষ্ট পাইবা ভাইবা কিছু কইতাম না। আর আমি কি জানি তুমারে ফেরত আইতে হইব? রফিকের এই অসুখে অনেক টাকা লাগব। ভাইগো কাছে হাত পাতছিলাম হেইদিন। মুখের উপ্রে কইয়া দিল, হেরা টাকা ফেরত দিব না।

নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল কুলসুম। হতবিহ্বল শফিকের বুকের ব্যথাটা ভালোই বেড়েছে। শ্বাস নিতেও একটু কষ্ট হচ্ছে এখন।

সত্য কইরা কও রফিকের আম্মা। রফিকের কী অসুখ হইছে? আমারে জোর কইরা নিয়া আসলা দেশে। সত্য কইরা কও ওর কী হইছে!

আমি কইবার পারতাম না।

এলোমেলো আচরণ করছে কুলসুম। শফিকের বুকের ব্যথাটা তীব্র আকার ধারণ করেছে।

তুমারে কইতেই হইব রফিকের আম্মা। কও আমারে! আমার পুলার কী হইছে?

মুখে আঁচল চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল কুলসুম। শফিকের হতবিহ্বল অবস্থা দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারল না।

পুলাডার পেটের ভিত্রে ক্যানসার হইছে। ডাক্তার কইছে সময় শ্যাষ। বেশিদিন আর বাঁচত না গো! ওরে আমার রফিক রে!

এবার চিৎকার করে মাতম শুরু করল কুলসুম।

শফিক রীতিমতো হতবাক হয়ে গেছে। এগুলো কী শুনছে সে? আগুনের গোলার মতো টকটকে লাল হয়ে আছে দুই চোখ। উঠে বসল। তারপর কুলসুমের দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে লাগল।

কী কইলা? কী কইলা তুমি জানো? আল্লাহ আমারে এত বিপদে ফেলতে পারেন না!

কুলসুমকে ছেড়ে এবার পাগলের মতো দুই হাতে নিজের মাথার চুল টানতে লাগল শফিক।

কী পরিশ্রম কইরা টাকা কামাইছি হেই কথা তোমাগো কোনোদিন কই নাই। টাকা খরচ হইব বইলা ডাক্তার দেখাই নাই। তোমাগো টাকা পাঠাইছি। সেই টাকা সবাই মিল্যা খাইয়া ফেললা। আমার পুলার চিকিৎসা করাও নাই!

কুলসুম হতবাক হয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চিৎকার করে ওঠে, কী হইছিল তুমার?

রফিকের ঘুম ভেঙে গেছে হট্টগোলে। অবাক চোখে আব্বা-আম্মাকে দেখছে। এই দৃশ্য ওর পরিচিত নয়। খুব ভয় পেয়েছে। আব্বা-আম্মার কান্না দেখে ছেলেটাও হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছে।

শুয়োরের বাচ্চারা! আমার সব টাকা খাইয়া ফেলছে। আমার সব টাকা খাইয়া ফেলছে কুত্তার বাচ্চারা!

বুকের চাপ ব্যথাটা তীব্র আকার ধারণ করেছে। দুই হাতে বুক চেপে চিৎকার করতে করতে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল শফিক। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। থেকে থেকে দূরে কোথাও বজ্রপাত হচ্ছে। দরজা খুলে পিচ্ছিল উঠানে পা দিতেই ধপাস করে আছড়ে পড়ল। কুলসুমও পেছনে পেছনে বাইরে চলে এসেছে। শফিক চার হাত পা ছুড়ে কাদা মাটিতে তড়পাতে তড়পাতে হঠাৎ চিৎকার দিয়েই নিথর হয়ে গেল। কুলসুম ‘ওরে আমার রফিকের আব্বা রে! কী হইছে তুমার রফিকের আব্বা!’ বলে চিৎকার দিয়ে শফিকের পাশে এসে বসে পড়েছে। তারপর দুই হাতে সমানে ধাক্কাতে লাগল। ‘উঠো রফিকের আব্বা। ও রফিকের আব্বা। কী হইছে তুমার? উঠো কইতাছি!’

কুলসুম আহাজারি করতে করতে শফিকের বুকে দুই হাতে চাপড়াতে লাগল। হামাগুড়ি দিয়ে রফিক দরজার কাছে এসে বসেছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আব্বা-আম্মার দিকে। কাছে কোথাও বজ্রপাত হয়েছে। দুরুম দুরুম শব্দে চারিদিক প্রকম্পিত হয়ে উঠল। কাছে কোথাও বজ্রপাত হয়েছে। দুরুম দুরুম শব্দে চারিদিক প্রকম্পিত হয়ে উঠল। 

Leave a Reply

Your identity will not be published.