জামশেদ চৌধুরী ছেলেকে বললেন, টিপু যা তো এক দৌড়ে, তরফদারকে ডেকে আন। আমার নাম করে বলবি যেন এক্ষুনি আসে—টিপু বলল, যদি জিজ্ঞেস করে কেন, কী বলব?
তোর মাথা বলবি, গবেট কোথাকার! খিঁচিয়ে উঠে জামশেদ চৌধুরী বললেন, বলবি আমি জানি না।
টিপু বেরিয়ে যেতেই ডাকলেন ঝুনুকে। বললেন, একাডেমিতে যাচ্ছিস নাকি আজ?
ঝুনু বলল, আজ আমাদের পরীক্ষা।
কী হবে ওসবে ? গানফান না শিখলে কী হয়?
সব জিনিসের একটা সময়-অসময় আছে।
কোনো দরকার নেই আজ কোথাও বেরোনোর। ঘরে থাক—
ঝুনু বলল, তাই বলে পরীক্ষা দেব না?
জামশেদ চৌধুরী খেপে উঠে বললেন, একটা কিছু কাণ্ড না বাধিয়ে তোরা ছাড়বি না। এটা গান-বাজনার সময় ? আজ থেকে ওসব বন্ধ। এসব আমি বরদাশত করব না। বড় বাড় বেড়ে গেছে তোদের—
মরিয়ম এসে বাগড়া দিলেন। বললেন, ওকে নিয়ে আবার টানাহেঁচড়া শুরু করলে কেন? ও যাবে—
যাবে না—
এত হুলস্থূল কাণ্ড বাধাচ্ছ কেন? কোনোকিছু ঘটে গেলে ঠেকাতে পারবে তুমি? সে মুরোদ আছে তোমার? ঘরের ভেতর বসে বসে কেবল লেজ নাড়বে! ও যাবে—
জামশেদ চৌধুরী বললেন, আদর দিয়ে দিয়ে তুমি ওদের মাথা নষ্ট করেছ, সব কটা বেয়াড়া। আমি কি ওদের মন্দের জন্য বলছি?
মরিয়ম বললেন, কার না কার একটা লাশ পড়ে আছে, এই নিয়ে ভয়ে তুমি একেবারে দাপাদাপি জুড়ে দিয়েছ। কেন, আশপাশে আর মানুষজন নেই ? সবাই কি তোমার মতো ভয়ে ভিরমি খাচ্ছে?
একটা কিছু হয়ে গেলে তখন বুঝবে।
কপালে থাকলে হবে—মরিয়ম বললেন, আমরা কোনো সাতেপাঁচে নেই সকলেই জানে। টিপু তো ঘর থেকে বেরই হয় না তোমার ভয়ে। মেয়েটাকেও জুজুবুড়ি বানিয়ে রেখেছ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তরফদার এসে হাজির হলেন।
বললেন, কী ব্যাপার?
শুনেছ ঘটনা?
লাশ পড়ে আছে, তাই—?
সকালে উঠে এসে দেখি এই কাণ্ড, ঠিক একেবারে জানালা বরাবর, কী মুশকিল দ্যাখ তো!
তরফদার বসে এক গ্লাস পানি খেলেন। বললেন, লাশ যে কার কিছু বোঝা গেল না। ছোকরা বয়সের গেরিলা-টেরিলা একটা হবে, তোমার কী মনে হয় ?
জামশেদ চৌধুরী বললেন, এ পাড়ার কোনো ছেলে নিশ্চয়ই ?
তা-ই বা কী করে বলি! কেউ তো চিনতে পেরেছে বলে শুনি নি। রহস্যটা তো এখানেই। কোথাকার কে মরে পড়ে রইছে এইখানে—
আমার মনে হয় এ পাড়ারই কোনো ছেলে, রাত্রে আর্মিরা মেরে গেছে। যাদের ছেলে তারা জেনেশুনে হাতপা গুটিয়ে বসে আছে, ভয়ে ধরা দিচ্ছে না।
তরফদার বললেন, তা হয় না। চোখে দেখে কেউ চুপ করে বসে থাকতে পারে না। তোমার হলে পারতে ?
অবস্থা গতিকে অনেক কিছুই হয়।
বাইরের কোনো ছেলে, মারা পড়েছে এখানে।
জামশেদ চৌধুরী বললেন, কী রকম একটা ল্যাঠা, দ্যাখ, এখন এই নিয়ে যদি টানাহেঁচড়া শুরু করে তখন কী হবে ? ইচ্ছা করলে আমাদের জড়াতেও পারে। আচ্ছা ধরো লাশটা অন্য কোথাও পড়ে ছিল, রাতের অন্ধকারে টেনে এনে জানালার পাশে রেখে গেছে পাড়ার কোনো শত্রু—
তেমন শত্রু কেউ আছে নাকি তোমাদের ?
থাকলেও থাকতে পারে। ভেতরে ভেতরে কার মনে কী আছে কী করে বলব বলো। কাউকে আমি তেমন ভালো লোক মনে করি না। বাড়িঘর তুলে বসবাস শুরু করার পর সেই প্রথম দিকে কী আর কম জ্বালিয়েছে। কোনো লোকই এখানকার ভালো নয়, সে তো তুমি নিজেই জানো, তোমার নিজের ভোগান্তি তো আর কম হয় নি। এখনো তো কোর্টকাছারিতে ছুটোছুটি করছ—
তরফদার বললেন, সেটা অন্য ব্যাপার। এখন কী করবে ঠিক করেছ ?
ছেলেমেয়েদের ঘরের বাইরে যেতে বারণ করে দিয়েছি।
এতে কী লাভ ?
উটকো ঝকতিতে জড়িয়ে পড়তে পারে।
তোমার এমন বুদ্ধি। আমি তো কাণ্ডটা দেখেই উল্টো সবাইকে শান্তিনগরে ওদের মামার বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি, এখানে থাকলেই বরং ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে পারে—
কীভাবে?
ধরো যদি এই অজুহাতে আর্মিরা এসে হাজির হয়, থানা-পুলিশ হয়, তখন? সাক্ষী মানতে চাইলে তো আর না করানো যাবে না। আমি নিজেও অফিসে বেরিয়ে পড়ব কিছুক্ষণের মধ্যে—
জামশেদ চৌধুরী বললেন, বলো তো এখন কী করি? কী ঝামেলায় পড়লাম—
থানায় একটা খবর দাও না।
তার মানে আরেকটা ফেরে জড়িয়ে পড়া ।
এখন কী করবে ঠিক করেছ?
আমাকে উঠতে হবে—
এক কাজ করলে কী হয়? পাড়ার রাজাকার ক্যাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কেমন হয়? কিছু টাকা-পয়সা ওদের দিলে ওরা হয়তো লাশটাকে অন্য দিকে সরিয়ে নিতে পারে।
তা পারে, তবে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ না করাই ভালো, এক বান্দাও তো ভালো ঘরের কেউ নয়, রাস্তা থেকে কুড়োনো। আমি ওদের দেখলে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেই। সব সময় দেড় হাত দূরে থাকা ভালো।
জামশেদ চৌধুরীর মনে হলো তরফদার ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা তেমন গায়ে মাখতে চাচ্ছে না।
তরফদারকে বিদায় দিয়ে ঘরের ভেতরে গেলেন।
ঝুনুকে বললেন, যা পরীক্ষা দিতে যা, দেরি না করে বেরিয়ে পড়।
মরিয়ম রেগে গিয়ে বললেন, নিজের ঘটে তো আর কিছু নেই, এতক্ষণ এত তোড়াবড়ি করলে কেন?
টিপুকে পাঠালেন কমলাপুরে ভায়ের বাড়িতে। ঝুনু বেরিয়ে যাওয়ার পর জানালার ফাঁকে একটা চোখ লাগিয়ে বললেন, এক কাজ করলে হয় না?
মরিয়ম বললেন, কী?
থানায় একটা উড়ো টেলিফোন করলে কী হয়?
কেন সোজাসুজিই তো বলে আসতে পারো। পরে যদি ওরা বলে, ঘরের পাশে একটা লাশ আছে, আপনাদের কি উচিত ছিল না পুলিশে খবর দেওয়ার—
তাহলে?
জামশেদ চৌধুরী বললেন, আমার মাথায় কিছু আসে না। আচ্ছা, আবদুল গিয়েও তো এক ফাঁকে লাশটাকে একটু অন্য দিকে সরিয়ে দিতে পারে—
তারপর ওকে নিয়ে যদি টানাহেঁচড়া হয়?
ধরো ও চলে গেল। ঘুরেই আসুক না দেশ থেকে কিছুদিনের জন্যে—
মরিয়ম বললেন, তারপর ঘরের কাজ
চলবে কীভাবে। দেশে পাঠাও না বললেই তো আর পাঠানো যায় না। অন্য একটা কাজের লোক পাচ্ছ কোথায় !
জামশেদ চৌধুরী বললেন, তোমাদের নিয়েও হয়েছে এক জ্বালা। চাকর-বাকর ছাড়া একটা দিনও তোমাদের চলে না। বিদেশে হলে হাড়ে হাড়ে টের পেতে, কোথায় যেত এসব বাবুয়ানা—
একটু পরেই দুজন খাকি পোশাকের রাজাকারকে আসতে দেখা গেল। তারা এসে লাশটাকে উল্টেপাল্টে দেখল। তারপর কড়া নাড়ল জামশেদ চৌধুরীর দরজায়।
জামশেদ চৌধুরী মরিয়মের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, যে ভয় করেছিলাম তাই হলো শেষ পর্যন্ত।
মরিয়ম বললেন, ঘরের ভেতরে ঘোমটা দিয়ে না থেকে ওদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলো—
জামশেদ চৌধুরী বললেন, তোমার মাথায় মুরগির মগজ। এই জন্যেই বলে মেয়েলোক। হুট করে একটা ডিসিশন নিলেই হলো আর কী?
মরিয়ম মাথায় কাপড় টেনে দিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালেন। রাজাকারদের একজন বলল, পুরুষমানুষ কেউ নেই?
মরিয়ম বললেন, অফিসে বেরিয়ে গেছে, কী, চাই কী?
আপনাদের ঘরের পাশে একটা লাশ পড়ে আছে।
সে তো সকাল থেকেই দেখছি—
থানায় খবর দেওয়া হয়েছে?
কে খবর দেবে, আমাদের তেমন লোকজন নেই।
রাজাকারদের একজন ছিল ছোকরা বয়সের। সে বলল, কখন থেকে দেখছেন লাশটা?
সকালে জানালা খোলার পর থেকেই।
এতক্ষণ ধরে পড়ে আছে, অথচ কোথাও একটা খবর দিলেন না আপনারা?
মরিয়ম চটে গিয়ে বললেন, সে দায়িত্ব তো বাবা তোমাদের। বাড়ির মানুষজনদের তো আরও কাজ আছে, অফিস-আদালত আছে। এসব করার সময় কোথায়?
মাঝবয়সের রাজাকারটি এতক্ষণ অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, সে এবার মুখ খুলল। বলল, আপনাদের ঘরের পাশে, আপনাদের কিন্তু মুশকিল হবে—
মরিয়ম বললেন, সে তখন দেখা যাবে, পরে কী হয় সে আমাদের ভালো করেই জানা আছে—
মরিয়মের মারমুখী ভাবসাবে একটু দমে যায় রাজাকারটি। সে ঘাবড়ে গিয়ে বলল, না, একটা আইনের ব্যাপার তো
আইনের তুমি জানটা কী, করো তো রাজাকারগিরি—মরিয়ম খেঁকিয়ে উঠে বললেন, আমাদের সাহেব অফিস থেকে আর্মিকে টেলিফোন করবে। নাকের ডগায় একটা রাজাকারক্যাম্প রয়েছে, অথচ ভদ্রলোকের বাড়ির পাশে একটা বেওয়ারিশ লাশ পড়ে, স্রেফ তারা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ফতোয়া দিয়ে বেড়াচ্ছে। কেন, টেনে নিয়ে গিয়ে নদীতে ঢেলে দেওয়া যায় না? ছোকরা রাজাকারটি বলল, আমরা তো খবর পেয়েই এলাম।
সারারাত তোমরা কী করছিলে?
পুলিশ-আর্মি তো আর ডিউটি মারে না ?
আর্মি এলে জবাবদিহি করতে পারবে তাদের সামনে ? খুব ভালো করে চিনি তোমাদের। কান ধরে উঠবস করেও রেহাই পাবে না তখন—
কিছু একটা ভেবে ছোকরা রাজাকারটি এগিয়ে এল। তারপর চাপা গলায় বলল, মুরাদ বক্স কাজটা করেছে। লাশটা পড়ে ছিল রাস্তার ধারে, লোক ভাড়া করে শেষরাতে আপনাদের ঘরের পেছনে ফেলে গেছে।
এই রায়েরবাজারের জমি কেনার পর থেকে মুরাদ বক্সের সঙ্গে গোলমাল শুরু। বহুবার বহুভাবে চেষ্টা করেছে মুরাদ বক্স জামশেদ চৌধুরীকে জব্দ করতে, কিন্তু পারে নি। বাড়ি তৈরির সময়ও লোক লাগিয়ে রাতের অন্ধকারে একবার এক পাশের একটা পাঁচিল ফেলে দিয়েছিল।
মরিয়ম ডাঁটো গলায় বললেন, সেও আমরা জানি—
তাহলে এখন কী করা ?
তোমরা বুঝবে। তোমরা যখন ডিউটিতে তখন কতগুলো বদমাশ একটা লাশ টানাহেঁচড়া করে অন্য বাড়ির সামনে ফেলে গেল, আর্মি এলে দেখো তোমাদের কী হয়!
ছেলেটি খুব অসহায়ের মতো বলল, আমরা তো তখন জানতে পারি নি। তখন জানলে, এ রকম হতো না—
এখনো সময় আছে—মরিয়ম বললেন, দু-চারজন লোক দিয়ে ইটখোলার দিকে ফেলে দিয়ে এসো। ঝুক্কি চুকে যাক। পয়সা লাগলে নিয়ে যেয়ো আমার কাছ থেকে।
মরিয়ম দরজা বন্ধ করে দিলেন এরপরই। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল রাজাকার দুজন সঙ্গে কিছু লোক নিয়ে। আবার কড়া নাড়ল দরজায় সেই ছোকরা বয়সের রাজাকারটি। বললে, বিশ টাকা দেন খালাম্মা। লাশটাকে বুড়িগঙ্গায় নামিয়ে দিয়ে আসি। টাকা দিয়ে মরিয়ম হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।
জামশেদ চৌধুরী জানালার ফুটোয় চোখ লাগিয়ে তন্ময় হয়ে লাশ সরানো দেখছিলেন। উঠানোর সময় দেখলেন শিয়াল কিংবা কুকুরে খুবলে-খাবলে লাশটার মুখ এমনভাবে নষ্ট করে দিয়েছে যে, কারও সাধ্যি নেই তাকে শনাক্ত করে। এটা একটা ভালো লক্ষণ। শনাক্ত করতে পারলে আর একদফা ঝামেলা বাঁধবে। ফুটোয় চোখ লাগিয়ে বসে থাকতে থাকতে তরফদারের ওপর তিনি ভীষণ খাপ্পা হয়ে উঠলেন, একটা নম্বুরে আহম্মক স্বার্থপর। পড়ে থাকত লাশটা নিজের ঘরের পাশে তো দেখা যেত কত গয়ং গচ্ছভাবে তুমি চলো। এই মুহূর্তে শিয়াল-কুকুর কিংবা রাজাকারগুলোর কাছে বরং নিজেকে কৃতজ্ঞ মনে হয়, ওই লোকটা একেবারে বিবেকহীন। দেশ, দেশের লোক, সবকিছুর ওপরেই তিনি বীতশ্রদ্ধ, কোনোকিছুর ওপরই তার এখন ভক্তি নেই।
লাশটা সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি জানালা ছেড়ে উঠে এলেন, ডাকলেন আবদুলকে, বিছানার তলা থেকে টাকা বের করে বললেন, থলে নিয়ে বাজারে যা, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি আমি ঘরে নেই, অফিসে।
আবদুল বাজারে বেরিয়ে যাবার পর মরিয়ম বললেন, এর মানে কী?
মানে তুমি, রসিকতা করে স্বচ্ছন্দ গলায় জামশেদ বললেন, তুমি তো রটিয়েছ আমি অফিসে। এখন যদি বেরোতে যাই কেউ দেখে ফেলবে না?
লোক বটে তুমি!
জামশেদ চৌধুরী হেসে বললেন, ভালোই হলো, ফাও মেরে দিলাম একটা দিন—
কিছুক্ষণ পর মরিয়ম দেখলেন জামশেদ চৌধুরী ড্রেসিং টেবিলের আয়না খুলে খাটের মাথার দিকে বসাচ্ছেন খুব মনোযোগ দিয়ে।
বললেন, কী ব্যাপার?
ব্যাপার ভালো—
ভালো মানে!
ভালো মানে ভালো—এই বলে জামশেদ চৌধুরী হামাগুড়ি দিয়ে খাট থেকে নামলেন, তারপর এক দৌড়ে দরজার সামনে গিয়ে ছিটকিনি তুলে দিলেন।
মরিয়ম বললেন, বেশ লোক তুমি—
জামশেদ চৌধুরী মরিয়মকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, কতদিন পর আজ ফাঁকা ঘর পেলাম। উহ্ ভেবে দ্যাখো তো। মরিয়ম নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, দিন দিন ছোকরা হচ্ছ তুমি, ছিঃ!
Leave a Reply
Your identity will not be published.