সাঁতারু রাসেল, বাংলা চ্যানেল অথবা জীবনের গল্প

সাঁতারু রাসেল, বাংলা চ্যানেল অথবা জীবনের গল্প

বরগুনা জেলার বিষখালী নদী থেকে যিনি জয় করেছেন ‘বাংলা চ্যানেল’ গড়েছেন রেকর্ড, যার চোখে মুখে বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন। এমনই এক স্বপ্নবাজ তরুণ সাইফুল ইসলাম রাসেল। যিনি ২০২১ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বাংলা চ্যানেল দুবার পাড়ি দিয়ে (ডাবল ক্রস) রেকর্ড করেন। 

সাঁতার খুব ছোটবেলায় রপ্ত করে ফেলেন তিনি। তারপর সময়ের সাথে সাথে নিজেকে ঝালাই করে পরিণত হয়েছেন পুরোদস্তুর সাঁতারু হিসেবে। আর সাঁতারুদের কাছে ‘বাংলা চ্যানেল’ পারি দেওয়া একটি স্বপ্নজয়ের মতো ব্যাপার। বঙ্গোপসাগরের বুকে টেকনাফের শাহপরী দ্বীপ থেকে ১৬ দশমিক ১ কিলোমিটার বিস্তৃত জলপথ পাড়ি দিয়ে সাঁতারুরা পৌঁছান বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে। দীর্ঘ এই পথটাকে বলা হয় ‘বাংলা চ্যানেল’।

ডাবল ক্রস বা যেতে আসতে একজন সাঁতারুকে ৩২ দশমিক ২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। প্রথম সাঁতারু হিসেবে ১০ ঘণ্টা ২০ মিনিট সময় নিয়ে সাইফুল ইসলাম রাসেল বাংলা চ্যানেল (ডাবল ক্রস) পাড়ি দিয়ে রেকর্ড করেন। বাংলা চ্যানেলের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম রাসেল একটু মৃদু হেসে বলেন, ‘খুব একটা সহজ ছিল না, কঠিন চেষ্টা, মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রম আর অনেক অনেক চর্চা। তবে তীরের কাছাকাছি এসে যেন সকল কষ্ট নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেল।’ তিনি আরও বলেন, ‘মূলত বাংলা চ্যানেল ক্রস করার উদ্যোগ নেয়া হয় প্রথম ২০০৮ সালে, সেটা সফল হয় নি। তারপর ২০১৩ সালে আবার উদ্যোগ নেয়া হয়, সেটিও সফলতার মুখ দেখে নি। ২০২১ সালে সফল হই। তবে আমার বদলে অন্য কেউ সফলভাবে বাংলা চ্যানেল শেষ করতে পারলে তাতেও আমি খুশি হতাম। কারণ, দেশের জন্য এটি একটা অর্জন।’

শুধু বাংলা চ্যানেলেই থেমে নেই এই সাঁতারু। জানালেন তাঁর পরবর্তী পরিকল্পনা ‘আল্ট্রা ওশেন ম্যান’ কম্পিটিশন করা। যদিও এর আগে তিনি ‘ওশেন ম্যান’ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এ ছাড়া বাংলা চ্যানেল ত্রিপল ক্রস করার স্বপ্ন দেখছেন এই সাঁতারু।  

কথায় কথায়, জানা যায় সাঁতারের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। সকাল, বিকাল, রাত উপেক্ষা করেই নিয়মিত নিজেকে ঝালাই করে নিতে হয়। সাঁতারুদের জীবন মোটেও সহজ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‌'সুইমিং একদিন মিস হলে সেই ঘাটতি পূরণ করতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে যায়। যার জন্য নিয়মিত সাঁতারের মধ্যে থাকতে হয় একজন সাঁতারুকে এবং এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।'

সাঁতারে আইডল কাকে মনে করেন? এমন প্রশ্নের জবাবে রাসেল বলেন, ‌'অনেকে আছেন। যদি শর্ট ডিসটেন্স সাঁতারু ধরি তাহলে মাইকেল ফেলপস আর লং ডিসটেন্স সাঁতারুর চিন্তা করলে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রজেন দাস। এর বাইরে বিশ্বব্যাপী সাঁতারুদের মধ্যে অ্যাডাম ওয়াকারকে আমি অনুসরণ করি। শুধু আমিই নয় যে-কোনো সাঁতারুর তাদের থেকে শেখার আছে।'

মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার কৌশল ছড়িয়ে দিচ্ছেন সাইফুল ইসলাম রাসেল। নিয়মিত সাঁতারের কলাকৌশল শেখান তিনি সবাইকে, এমনকি কেউ বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখলে সেই স্বপ্নের সারথি হিসেবে পাশে পাওয়া যাবে সাইফুল ইসলাম রাসেলকে। এ ছাড়া তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সুইমিং ও ওয়াটার পোলো টিমের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করছেন।

সুকুমার রায়ের একটি কবিতার পঙ্ক্তি ‘বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে, তোমার দেখি জীবনখানা ষোল আনাই মিছে!’ কবিতার লাইনটি স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য খেলা আমরা আনন্দের জন্য খেলি কিন্তু সাঁতার আমাদের বেঁচে থাকার মাধ্যম এবং সাঁতার সকলের শেখা উচিত। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী পানিতে ডুবে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় চৌদ্দ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, যার একটি বড় অংশ শিশু ও অল্পবয়স্ক। তাই সাঁতার আমাদের জীবনের জন্য প্রয়োজন।’

চেষ্টা করলে নারীদের পক্ষেও বাংলা চ্যানেল জয় করা সম্ভব। সঠিক চর্চা ও অনুশীলনে কোনো বয়সের ভেদাভেদ নেই, যে কেউ চাইলেই সাঁতারে অংশগ্রহণ করতে পারবে ও বাংলাদেশের হয়ে অনেক নারী ‘বাংলা চ্যানেল’ জয় করেছে বলে জানান সাইফুল ইসলাম রাসেল।

তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে মানুষের জীবনে একটা বিশাল পরিবর্তন এসেছে। করোনা আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে, অর্থের থেকেও আমাদের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। যে কোনো প্রফেশনে থেকেও নিজেকে সুস্থ রাখা যায়, তা রাখতে হবে। স্পোর্টস মানুষকে প্রফুল্ল রাখে। শুরু সাঁতার নয়, একজন তরুণ সুস্থ থাকার জন্য রানিং ও সাইক্লিংও করতে পারে।’

Leave a Reply

Your identity will not be published.