সুরঞ্জনার ‘ব্যথাতুর সীবিত কোলাজ’

সুরঞ্জনার ‘ব্যথাতুর সীবিত কোলাজ’

সুই-সুতার বুনন আর কাপড়ের ফালি সহযোগে কোলাজ—এমন একটি একক প্রদর্শনী নিয়ে রাজধানীর শিল্প-সমঝদারদের সামনে হাজির হয়েছিলেন সুরঞ্জনা ভট্টাচার্য্য। ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ক্যাফেতে অনুষ্ঠিত নয় দিনব্যাপী (১৯-২৭ এপ্রিল) ছিল এ প্রদর্শনী। এখানে ঠাঁই পেয়েছিল চল্লিশের অধিক শিল্পকর্ম।

আমরা জানি, শিল্পকৌশল হিসেবে কোলাজের আর্বিভাব চীনে, দুই হাজার বছরেরও আগে। আর আধুনিক শিল্পকলার যুগে এই শিল্পটি পেয়েছে পিকাসো, জর্জ ব্রাক, অঁরি মাতিস এবং ভাসিলি কাঁদনিস্কির মতো মহান শিল্পীদের হাতের স্পর্শ। আর শেষোক্ত জনই সুরঞ্জনা ভট্টাচার্য্যরে অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস।

সুরঞ্জনার সীবিত কোলাজের সূচনা কীভাবে ঘটে? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘২০০৭ সালে, মন্ট্রিয়ল শহরে বসবাসকালীন আমি দুরারোগ্য ডিস্ট্রোফি রোগে আক্রান্ত হই, যার ফলে আমার বাম হাত প্রায় অকেজো হয়ে যায়। শরীরের নিম্নভাগ মাঝে মাঝেই অবশ হয়ে যেত, একবার যা বৎসরকাল স্থায়ী হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জে আমার জন্ম এবং চট্টগ্রাম ও নরসিংদীতে আমার বেড়ে ওঠা। সূচিকর্মের প্রতি আমার আশৈশব ঝোঁক ছিল। আশির দশকের শেষে নরসিংদীর সরকারি কারিগরি বিদ্যালয়ে সূচিকর্মের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণও নিয়েছিলাম। সেই আগ্রহ ও প্রশিক্ষণ কাজে লাগল প্রায় দুই দশক পর। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, বিশেষত তীব্র এবং বিরতিহীন ব্যথা ও যন্ত্রণার বিরুদ্ধে লড়াই করার অন্যতম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত কাপড়ের ফালি দিয়ে কোলাজ করতে শুরু করি বছর দশেক আগে, শয্যাশয়ী অবস্থায়। সীবিত কোলাজ। মাতিসের করা নীলনারীর কোলাজের একটি অনুলিপি টাঙানো ছিল আমার ঘরের দেয়ালে, মন্ট্রিয়লে। এই কোলাজ মাতিস যখন করেন, তখন তিনিও প্রায় অন্ধ— কাকতালীয় সমাপতন, বলা বাহুল্য।’

খুব একটা পরিকল্পনা করে সীবিত কোলাজ সৃষ্টি করেন না সুরঞ্জনা। তাঁর মাথায় একটা ফর্ম থাকে অবশ্যই। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে কাটা কাপড়ের ফালিগুলো সেই ফর্ম ভেঙে দেয়। অন্য কথায়, যে শিল্প সৃষ্টি হয় সুরঞ্জনার ‘হাতে’, এতে তাঁর অতটা ‘হাত’ নেই, যতটা আছে কাপড়ের ওই ফালিগুলোর। সচেতনভাবে শিল্প সৃষ্টি করার ইচ্ছে যে সুরঞ্জনার হয় না, তা নয়, এর জন্য তিনি কাপড়ের ফালিগুলোর সঙ্গে যুদ্ধও করেন, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তিনি আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হন। এবং কাপড়ের ফালিগুলোই তাকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে চলে এবং এভাবেই সৃষ্টি হয় সুরঞ্জনার একেকটি শিল্পকর্ম।

সুরঞ্জনার সীবিত কোলাজে নানা মেজাজের কাজই দেখা গেছে। এইসব কোলাজ দেখে দর্শকদের মধ্যে নানা অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। ‘ভূতের রাজায় দিল বর’ দেখে তারা মজা পেয়েছে। ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না! ৭ই মার্চ ১৯৭১’ দেখে আবেগে আপ্লুত হয়েছে। লাল ও সবুজ রঙের দুটি কাপড়ের ফালি তাদের নির্দেশ করেছে ‘বাংলাদেশ’কে। বঙ্গবন্ধুর সেই বিখ্যাত তর্জনীকেও তারা অবলীলায় চিনতে পেরেছে। আবার ’৭১-এর রক্তাক্ত স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে ‘ওরা এগারো জন: ৭১-এর বধ্যভূমিতে অবিস্মরণীয় যন্ত্রণাকাতর মৃত্যু’। কালো পটভূমিতে ১১টি বৃত্তাকৃতির কাপড়ের ফালি— এ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিহত মানুষের রক্তাক্ত অবয়বই যেন চেতনায় হানা দেয়। ‘গিলোটিনের ভয়াবহতা ১৯৭১’ও যন্ত্রণাকাতর করে দর্শকদের। কালো রঙের পটভূমির আরও তিনটি কোলাজও দর্শক-চেতনায় যন্ত্রণা ছড়ায়। সেগুলো হলো—সর্পিল যন্ত্রণা-১, ২ ও ৩। ‘বাউলিয়ানা’ শিরোনামের কোলাজগুলো আবার দর্শকদের আমোদ দেয়। ‘পুরুষ ও প্রকৃতিসঙ্গমে একটি নদীর জন্ম’ও কম আনন্দ প্রদান করে না। অন্যদিকে ‘বিহগ ও সিংহাবলোকনে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমচাষ’ দর্শকদের বিমোহিত করে। এখানে সবুজ-শ্যামল কাপড়ের ফালির প্রাধান্য বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলকেই নির্দেশ করে। আর সেই অঞ্চলের মানুষদের যে শক্তি, আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সমভাবে বিকশিত হওয়া—সেটিও এখানে পরিস্ফুটিত।

সুরঞ্জনার একক প্রদর্শনী উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত ছিলেন এদেশের শিল্প-সাহিত্যের প্রথিতযশারা। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন ঢাকা আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের পরিচালক ফ্রঁসোয়া গ্রোজঁ, প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম, শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, চিত্রশিল্পী ও কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য, শিল্প-সমালোচক মঈনুদ্দীন খালেদ এবং চিত্রশিল্পী ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ইকবাল। আর প্রদর্শনীটির শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম।

এর আগে প্রদর্শনী সম্পর্কে নানা জন বক্তব্য রাখেন। যেমন: ঢাকা আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের পরিচালক ফ্রঁসোয়া গ্রোজঁ বলেন, ‘সুরঞ্জনার চারুকৃতির রং, ফর্ম থেকে শুরু করে সবকিছুই চমৎকার হয়েছে। আলিয়ঁসে এই প্রদর্শনী করতে পেরে আমি গর্বিত। গর্বিত আমি সুরঞ্জনার জন্যেও। মাদাম, ইউ হ্যাভ ডান অ্যান এক্সেলেন্ট জব।’

মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘সুরঞ্জনার শিল্পকর্মগুলো আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। এমন কাজ আমাদের দেশে আগে হয় নি, এমন প্রদর্শনীও হয়তো এই প্রথম। সুরঞ্জনাকে আমি বলব, আপনি একটা স্কুল খোলেন এবং আমাদের বাচ্চাদের শেখান এই কাজটা কীভাবে করতে হয়।’

শিল্প-সমালোচক মঈনুদ্দীন খালেদ বলেন, ‘এই কাজগুলোতে রং, ফর্ম, আইডিয়ার অভিনবত্ব রয়েছে। সুরঞ্জনার কাজ দেখেই বোঝা যায়, এগুলো একান্তই বাংলাদেশের কাজ। বাংলাদেশের অস্তিত্ব, সমৃদ্ধি নির্ভর করে যে টেক্সটাইলের উপর সেই টেক্সটাইলকেই শিল্পের মাধ্যম করেছেন সুরঞ্জনা। নতুন, ব্যবহৃত, ফেলে দেওয়া কাপড়ের ফালিকে সে শিল্পে পুনরুজ্জীবিত করছে। এক ধরনের শিল্পিত জন্মান্তর বা দশান্তর। আমি চাইব, সুরঞ্জনা তার এই শিল্পসাধনা অব্যাহত রাখুক। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের পর বিদেশেও তার চারুকৃতির প্রদর্শনী হোক।

সৈয়দ ইকবাল বলেন, ‘আমাকে যখন সুরঞ্জনার শিল্পকর্ম দেখার জন্য ডাকা হয়েছিল, আমি ভাবতে পারি নি, কাজগুলো এত ভালো হবে। অনেকেই তো সময় কাটানোর জন্য টুকটাক শিল্পকর্ম করে। আমি ভেবেছিলাম, তেমন কিছুই হবে হয়তো। দেখার পর থেকে আমি ওকে উৎসাহ দিয়েই যাচ্ছি। ওর কাজগুলো একেবারেই আলাদা।’

শিশির ভট্টাচার্য বলেন, ‘এই প্রদর্শনীতে এসে আমার মানু পারেখ এবং তাঁর স্ত্রী মাধবী পারেখের কথা মনে পড়ছে। গর্ভবতী অবস্থায় মাধবী পারেখ ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন শ্রেফ সময় কাটানোর জন্যই। সেই ছবি মাধবী পারেখকে তাঁর স্বামী মানু পারেখের চেয়েও বিখ্যাত করে তুলেছিল। আর একটা কথা, আমরা যারা শিক্ষকতা করি, ভুল ধরার একটা বদভ্যাস কিংবা অভ্যাস যাই বলুন, আমাদের আছে। প্রথম যখন সুরঞ্জনার কাজগুলো দেখি, ওকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলাম, এটা এভাবে করুন, এটা এখানে একটু বদলে দিন...এই সব বলেছিলাম। এখন ভাবছি, তখন ওই কথাগুলো না বললেই বোধ হয় ভালো করতাম। ওতো চারুকলা বিদ্যালয়ে শিখে আর্ট করছে না। শিখে নি বলেই বোধ হয় এতটা ভালো করছে। এই কাজগুলো একেবারেই আলাদা ধরনের।’

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘রং, ফর্ম, পরিসর, গতি... একটা শিল্পকর্মে যা যা দরকার হয়, সবই আছে সুরঞ্জনার ছবিতে। এটাতো এক ধরনের প্ল্যাস্টিক আর্ট, ওর কাজের মধ্যে ‘প্ল্যাস্টিসিটি’ বা নমনীয়তা আছে। এই প্রদর্শনীর প্রতিটি কাজ দেখে মনে হয়, এতে কোনো ফাঁকি নেই। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ওর কাজে এক ধরনের সততা রয়েছে। শিল্পী তাঁর সর্বোচ্চ মনোযোগ আর সততা দিয়ে প্রতিটি কাজ করেছেন। সুরঞ্জনার সব কাজই চমৎকার, বিশেষ করে সাদা-কালো কাজগুলো আমার খুবই ভালো লেগেছে। আমি ওকে বলব, ‘ইতিমধ্যে নিজের একটা জগৎ তুমি তৈরি করেছো। এখন এই জগতটা সুন্দরভাবে সাজিয়ে তুলতে হবে তোমাকে’।

‘ব্যথাতুর সীবিত কোলাজ’ শীর্ষক প্রদর্শনী শিল্প-সমঝদার থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শক, সবাই উপভোগ করেছেন। আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, সেটি হলো, কেউ বলেন নি যে তারা কিছু বুঝতে পারছেন না। সবাই মুগ্ধ হয়েছেন। তাদের অভিমত ছিল, অসাধারণ সব কাজ হয়েছে।

Leave a Reply

Your identity will not be published.