মৃত্যুঞ্জয়ী হুমায়ুন আজাদ

মৃত্যুঞ্জয়ী হুমায়ুন আজাদ

এ দেশের একটি সোনালি অতীত রয়েছে। স্বর্ণালী সেই অধ্যায়ে আলোকিত মানুষেরা বিচরণ করতেন। তাঁরা আপন প্রতিভার দ্যুতিতে নিজেদের জীবনকে যেমন উদ্ভাসিত করেছেন, তেমনি এদেশের মানুষকেও আলোকিত করার মহান ব্রতে থেকেছেন সচেষ্ট। এইসব মানুষের শেকড় অন্বেষণে অন্যদিন কাজ করে যাচ্ছে।

এখানে তুলে ধরা হলো কবি-ঔপন্যাসিক-ভাষাবিজ্ঞানী-প্রথাবিরোধী, বহুমাত্রিক লেখক-অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের জীবন ও জন্মভূমিকে। ১২ আগস্ট তাঁর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী।

আসন্ন শরৎকাল। এই সময় আমার মন উধাও হয়ে যাচ্ছে অতীতে। কয়েক বছর আগের শরৎকালের ছবি ভেসে উঠছে—আকাশে যখন নানা রঙের মেঘের খেলা।

সেই শরতে একদিন আমি ও অন্যদিন-এর আলোকচিত্রী ফজলে এলাহী ইমন গুলিস্থান থেকে ‘বাংলালিংক’-এ চড়ে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি।

বংশাল-নয়াবাজার পেরিয়ে বাস সেতুতে ওঠে। চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় বুড়িগঙ্গা। নদীর কালো পানি, দুই পাড়ের কিছু কিছু জায়গায় নানা স্থাপনা- যা অবৈধ দখলদারিত্বের ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠেছে। ভেসে আসে বিশ্রী গন্ধ। নাকে রুমাল চেপে ধরি।

মনটা খারাপ হয়ে যায়। কী নদী কী হয়েছে! দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক থেকে। কিছুক্ষণ পর অবশ্য মন ভালো হয়ে যায় আদিগন্ত বিস্তৃত মাঠে কাশবন দেখে। যদিও বাস তখনো কেরানীগঞ্জ পার হয় নি। আরও ভালো লাগে কাশবনের মাঝে দুই বালক-বালিকাকে দেখে। বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’র কথা মনে পড়ে; মনে পড়ে অপু-দুর্গার কথা।

এমনিভাবে কাশবন, নদী, গাছ, নানা শ্রেণির মানুষ দেখতে-দেখতে একসময় পৌঁছে যাই রাঢ়িখাল, মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার একটি বিখ্যাত গ্রামে। কেননা এই মাটিরই সন্তান জগদীশচন্দ্র বসু এবং হুমায়ুন আজাদ।

‘ভাই, হুমায়ুন আজাদের বাড়িটা কোথায়?’ বাস থেকে নেমে রাঢ়িখালের এক বাসিন্দাকে জিজ্ঞেস করি। তিনি বাড়ির ঠিকানা বাতলে দেন। সেই ঠিকানায় পৌঁছতে আমাদের কোনো অসুবিধাই হয় না।

হুমায়ুন আজাদের পৈতৃক ভিটার চারপাশে লক্ষ করি পুকুর। আমার চেতনায় ভিড় করে আজাদের ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ গ্রন্থের দুটি বাক্য: ‘আমাদের বাড়িটি পুকুর দিয়ে ঘেরা। তার পায়ের নিচে সারাক্ষণ ঝুমঝুম করে বাজে পানির নূপুর।’ এখানেই ১৪ বৈশাখ ১৩৫৪: ২৮ এপ্রিল ১৯৪৭-এ পৃথিবীর আলো প্রথম দেখেন হুমায়ুন আজাদ। এ অবশ্য তাঁর আসল নাম নয়। আসল নাম হুমায়ুন কবীর। লেখার জন্য নাম বদল করেন। পরে শপথপত্রের মাধ্যমে স্থায়ী করে নেন।

হুমায়ুন আজাদরা ছিলেন তিন ভাই দু’বোন। তিনি অবশ্য বাবা (আবদুর রাশেদ) ও মা’র (জোবেদা খাতুন) তৃতীয় সন্তান। আজাদের চেয়ে সাড়ে চার বছরের বড় বোন, পানু। পানুর বড় এক ভাই, তাঁদের বাবা-মার প্রথম সন্তান, সে জন্মের পরেই মারা গিয়েছিল। তাই আজাদই প্রথম পুত্ররূপে গণ্য হয়েছেন। ওহ হ্যাঁ, আজাদের বয়স যখন সাড়ে তের বছর, তখন কলেরায় মারা যান তাঁর ছোটভাই কালাম, আবুল কালাম আজাদ। এই ভাইকে খুবই ভালোবাসতেন হুমায়ুন আজাদ, যাকে হারিয়ে তাঁর সবকিছু শূন্য লেগেছিল। তাই তো সেই ছোটভাইয়ের নামের অংশকে তিনি নিজের নামের অংশ করে নিয়েছিলেন। হুমায়ুন আজাদ ভালোবাসতেন বাংলাদেশকে, ভালোবাসতেন রাঢ়িখালকে। তাঁর ইচ্ছা ছিল অবসর জীবনে তিনি রাঢ়িখালেই থাকবেন। তাই তো অলৌকিক ইস্টিমারে চড়ে আজ তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী এখন শুয়ে আছেন প্রিয় রাঢ়িখালেই।

এই তো নিজের বাড়ির সামনের অংশে হুমায়ুন আজাদের কবর। টাইলসের মনোরম কবরটির উপরের অংশ দুটি বই। যিনি আজীবন বইয়ের সঙ্গে করেছেন বসবাস, তাঁর কবরের ডিজাইন তো এমন হওয়াই স্বাভাবিক। এর পরিকল্পনা, ডিজাইন ও অলংকরণ সিরাজুল ইসলাম সোহেলের। কারা অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন, সেটিরও উল্লেখ রয়েছে। আজাদের খুবই সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং জন্ম-মৃত্যুর তারিখও উল্লেখ আছে। কবিতার পঙ্ক্তিমালাও বাদ পড়ে নি- ‘কিন্তু না, পৃথিবীতে আর কোনো নেকড়ে থাকবে না,/ কিন্তু না, পৃথিবীতে আর একটিও বন্দুক থাকবে না...।’

‘আপনারা কে? কোথা থেকে এসেছেন?’ কে যেন চড়া গলায় জিজ্ঞেস করে। দেখি চল্লিশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি আমাদের দিকে চেয়ে আছেন।

পরিচয় দেই। আগমনের উদ্দেশ্য বলি। অপরিচিত সেই ভদ্রলোকও তখন নিজের পরিচয় দেন। জানান, তিনি হুমায়ুন আজাদের চাচাতো ভাই শেখ কাউসার হোসেন। বাবার নাম শেখ সোবহান উদ্দিন।

কাউসার আমাদের বাড়ির ভেতর নিয়ে যান। তালাবদ্ধ ঘর খুলে দেন। হুমায়ুন আজাদের উত্তর ভিটের টিনের ঘর। এটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ, এখন তাঁর ছেলেমেয়েদের সম্পত্তি। জানা গেল, দক্ষিণ ভিটের ঘরটি আজাদের ছোটভাইয়ের।

কায়সারের সঙ্গে কথা বলি আর জানালার বাইরে গ্রাম্য প্রকৃতি দেখি। একসময় লক্ষ করি, ব্যাগ কাঁধে এক বালক যাচ্ছে। পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম। মানসচোখে তখন ভেসে ওঠে বালক হুমায়ুন আজাদ, যাঁর পড়াশোনা শুরু হয়েছিল বাড়িতেই। পরে তিনি ভর্তি হন রাঢ়িখাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এই বিদ্যালয়টি ছিল অদ্ভুত- জঙ্গল আর কবরে ভরা। সেখানে পড়াতেন আবদুর রাশেদ, আজাদের বাবা। আরও একজন শিক্ষকও অবশ্য ছিলেন- চান্দু মাস্টার। এখানে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত আজাদ পড়েন। মজার বিষয় হলো, তৃতীয় শ্রেণিতে তিনি আর পড়েন নি। চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন রাঢ়িখাল স্যার জে সি বোস ইনস্টিটিউশনে। সেখানে পড়াশোনায় পর্যায়ক্রমে উন্নতি করেন আজাদ, দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন প্রথম হয়ে। স্কুলের দুজন প্রিয় শিক্ষক ছিলেন শামসুল ইসলাম এবং শ্রীবিষ্ণুপদ সেন। তখন একটিই বোর্ড ছিল- ইস্ট পাকিস্তান সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ড। ওই বোর্ডের অধীনে মেট্রিক পরীক্ষায় আজাদ দখল করেন ২১তম স্থান, অতিরিক্ত বিষয় ছাড়া ১৮তম স্থান। ছেলে প্রকৌশলী হবে বাবার এই ইচ্ছের দ্বারা চালিত হয়ে আজাদ ভর্তি হন ঢাকা কলেজে, বিজ্ঞান বিভাগে। ফলে দ্বিতীয় বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন এবং নানা পারিবারিক প্রতিকূলতা পেরিয়ে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাঙলায় বিএ (অনার্স) শ্রেণিতে। সম্মান এবং স্নাতকোত্তর দুই পরীক্ষায়ই হন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। ১৯৭৬ সালে আজাদ এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।... সারা জীবন ছিলেন শিক্ষক। এমএ পাস করার পরে ১৯৬৯ সালের আগস্ট যোগ দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম সরকারি মহাবিদ্যালয়ে, প্রভাষক হিসেবে। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রভাষক ছিলেন। ১৯৭০ সালের ১২ ডিসেম্বর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭৮ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগে এবং সেখানেই ১৯৯৪ সালে তিনি সভাপতি বা চেয়ারম্যান হন।... অল্প বয়স থেকে বই-ই ছিল আজাদের ধ্যান-জ্ঞান। সব বিষয়ের বই-ই পড়তেন তিনি। কৈশোরে রবীন্দ্রনাথের কবিতা প্রিয় ছিল। এমনকি ‘পুরাতন ভৃত্য’-এর মতো দীর্ঘ কবিতাও মুখস্থ ছিল। প্রথম পড়া উপন্যাস আনোয়ারা যদিও তা শেষ করতে পারেন নি। অবশ্য মনে দাগ কটেছিল শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ ও দত্তা। এ ছাড়া মোহাম্মদী, সওগাত, বসুমতী, বঙ্গবাসী প্রভৃতি পত্রিকা পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। আরও পড়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত মেট্রিকের জন্য সংকলিত বাঙলা কবিতার সংকলন। তবে সেই সময় সত্যিকার অর্থে আজাদের চেতনায় গভীর ছাপ ফেলেছিলেন একজনই- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এই প্রথাবিদ্রোহী লেখক এবং মানুষটিই আজাদের মানস গঠনে জোরালো প্রভাব ফেলেছিলেন।

আমরা হুমায়ুন আজাদের পৈতৃক ভিটার উত্তরের ঘরে বসে আছি। কাওসারের সঙ্গে কথা বলছি। এক কিশোরী ঘরে ঢোকে ট্রে হাতে। পাকা পেঁপে, আপেল, চানাচুর...। সেগুলো আমরা গলাধঃকরণ করি।

হঠাৎ বৃষ্টি নামে। রোদের মাঝেই। মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় পড়া একটি লোকজ ছড়া: ‘রোদ হচ্ছে, পানি পড়ছে/ খেঁকশেয়ালের বিয়ে হচ্ছে।’ শরতের বৃষ্টি এমনই। মনে পড়ে যায় হুমায়ুন আজাদের কথাও। তিনি এই উত্তর ভিটের টিনের ঘরে শুয়ে টিনের চালের ওপর বৃষ্টিপাতের শব্দ শুনতে বড়োই ভালোবাসতেন। যখন তিনি শহরবাসী হয়েছিলেন, তখন তাঁর ঘুমহীন চোখে ঘুম নেমে আসত মনে মনে উত্তর ভিটের ঘরে শুয়ে টিনের চালে বৃষ্টি পতনের শব্দ শোনার বিষয়টি কল্পনা করলেই। আজাদের ভাষ্য হচ্ছে: ‘এখন আর আমার ঘুমোতে কষ্ট হয় না। প্রতিরাতে বিছানায় গা এলিয়েই আমি কল্পনায় ঢুকি আমাদের উত্তর ভিটের টিনের ঘরে। আর অমনি শুরু হয়ে যায় শ্রাবণের বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ। ডানা ঝাপটাতে থাকে আম আর খেজুর গাছ। আমি ঘুমিয়ে পড়ি এ-শুকনো শহরের দালানের ভেতরে। কিন্তু আসলে প্রতিরাতে আমি ঘুমোই একটি টিনের ঘরের ভেতরে। তার চালে বৃষ্টির শব্দ। আম আর খেজুর গাছের ডানা ঝাপটানো।’

হ্যাঁ হুমায়ুন আজাদ প্রকৃতিকে খুবই ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায়ও তা মূর্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু শুধু ফুল-পাখি-আকাশকে নিয়েই তিনি লিখেন নি। তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, সব কিছুই তিনি সমালোচকের দৃষ্টিতে দেখেছেন। এ প্রসঙ্গে জার্মানির তৎকালীন চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোয়েডাবে’র একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে-যা তিনি বিখ্যাত লেখক গুন্টারগ্রাসের নোবেল প্রাপ্তিতে করেছিলেন। মন্তব্যটি হলো: ‘গ্রাসের নোবেল প্রাইজ পাওয়ার ব্যাপারটি আনন্দের, যে-কোনো বিষয়ের একজন যোগ্য সমালোচক তিনি।’ একই কথা আমরা বলতে পারি হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কেও। তিনিও চমৎকার সমালোচক ছিলেন। এ দেশ এ সমাজের মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা, ভণ্ডামো, মূর্খতা, পুরুষতান্ত্রিকতার তিনি ছিলেন তীব্র, তীক্ষè ও কঠোর সমালোচক। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহ : কাব্যগ্রন্থ-অলৌকিক ইস্টিমার (১৯৭৩), জ্বলো চিতাবাঘ (১৯৮০), সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৫), যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল (১৯৮৭), আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০); প্রবন্ধ ও সমালোচনাগ্রন্থ- শামসুর রাহমান/নিঃসঙ্গ শেরপা (১৯৮৩), প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে (১৯৯২); মাতাল তরণী (১৯৯২), নারী (১৯৯২), আমার অবিশ্বাস (১৯৯৭), আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম (২০০৩), বাঙলা ভাষার শত্র“-মিত্র (১৯৮৩), বাক্যতত্ত্ব (১৯৮৪), তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান (১৯৮৮), অর্থবিজ্ঞান; কিশোরসাহিত্য লাল নীল দীপাবলী বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী (১৯৭৬), ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না (১৯৮৫), কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী (১৯৮৭); উপন্যাস-ছাপান্নো হাজার বর্গমাইল (১৯৯৪), সবকিছু ভেঙে পড়ে (১৯৯৫), মানুষ হিসেবে আমার অপরাধসমূহ (১৯৯৬), শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার (১৯৯৭), রাজনীতিবিদগণ (১৯৯৮), পাকসার জমিন সাদ বাদ (২০০৪)।...‘পাকসার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসে হুমায়ুন আজাদ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষাক্তরূপ তুলে ধরেছেন। যার ফলে ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ বইমেলা শেষে বাড়ি ফেরার পথে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তাঁর উপর সন্ত্রাসী হামলা করে।

বৃষ্টি থামে। আমি আর ইমন উঠে দাঁড়াই। হুমায়ুন আজাদের গ্রামের বাড়ি ঘুরেফিরে দেখি। লক্ষ করি, তালাবদ্ধ একটি ঘর। জানালা দিয়ে উঁকি দেই। খাট, আলমিরা, শো-কেস, এইসব দেখি। বারান্দায় টাঙানো হুমায়ুন আজাদের কয়েকটি প্রতিকৃতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

কাঠের সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠি। নিচতলার মতো এখানেও দুটি ঘর। ওপাশের ঘরে একটি চৌকি। তোষক বিছানো। পাশেই দণ্ডায়মান একটি স্ট্যান্ড ফ্যান। এপাশের ঘরে পুরোনো দিনের দুটি টিনের বাক্স; হাঁড়ি-পাতিল ইত্যাদি। ঘরসংলগ্ন ব্যালকনি। সেখানে দাঁড়িয়ে হুমায়ুন আজাদের বাড়ির সামনের অংশ লক্ষ করি। তাঁর কবর দেখি। মনে পড়ে, ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার পর মারাত্মক আহত অবস্থায় তাঁকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে দ্রুত স্থানান্তরিত করা হয়। অতঃপর আরও উন্নতর চিকিৎসার জন্যে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ব্যাংককে বুমরুনগ্রাদ হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে মাসাধিককাল চিকিৎসা শেষে হুমায়ুন আজাদ দেশে ফিরেন। ৭ আগস্ট আজাদ জার্মানি যান, লেখকদের আন্তর্জাতিক এক সংস্থার আমন্ত্রণে কবি হাইনরিশ হাইনের ওপর গবেষণাবৃত্তি নিয়ে। কিন্তু মাত্র চারদিন পরেই, ১২ আগস্ট সকালে, মিউনিখস্থ ফ্ল্যাটে আজাদকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। জার্মান চিকিৎসকরা আজাদের মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে অভিহিত করেন। কিন্তু বিষয়টি হুমায়ুন আজাদের স্বজনরা মেনে নিতে পারেন নি।

কাঠের সিঁড়ি ভেঙে নিচে আসি আমরা। কাওসারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পথে নামি। পেছনে পড়ে থাকে হুমায়ুন আজাদের পৈতৃক ভিটা, গ্রামের বাড়ি।

Leave a Reply

Your identity will not be published.