অন্যদিন-এর ‘শেকড়ের সন্ধানে’ বিভাগে তুলে ধরা হচ্ছে সাহিত্যস্রষ্টাদের ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবনের তথ্যসহ তাঁদের জন্মভিটার পরিচিতি। আজকের রচনা শহীদুল্লা কায়সারকে নিয়ে।
সাংবাদিক-সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারের পুরো নাম আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লা। তাঁর দুটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘সারেং বৌ’ (১৯৬২) ও ‘সংশপ্তক’ (১৯৬৫)। বাঙালি জীবনের আশা-আকাঙ্খা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও সংগ্রামী চেতনা তাঁর উপন্যাসে উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত। তিনি ভাষা আন্দোলনের বিশিষ্ট সৈনিক। এ দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল তথা গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এ দেশের প্রয়াত লেখকদের ‘শেকড় সন্ধান’-এ আবার পথে নেমেছি। যাচ্ছি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে। ওই গ্রামেই প্রয়াত সাংবাদিক-সাহিত্যিক, রাজনৈতিককর্মী শহীদুল্লা কায়সারের পৈতৃক ভিটা। সেখানেই তিনি জন্মেছিলেন ১৯২৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি।
ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল সংলগ্ন ‘স্টার লাইন’ বাস সার্ভিসের কাউন্টারে বসে আছি আমি। অন্যদিন-এর আলোকচিত্রী বিশ্বজিৎ সরকারের জন্যে অপেক্ষা করছি। আর হ্যাঁ, বাসের জন্যেও অপেক্ষা করছি। এখন সকাল আটটা দশ। সাড়ে আটটার গাড়ির যাত্রী আমরা।
কিছুক্ষণ পরে বাস এসে থামে কাউন্টারের সামনে। তারপরে বিশ্বজিৎ আসে। কাঁধে ব্যাগ। বলাই বাহুল্য, সেই ব্যাগে ক্যামেরা। আমার সঙ্গেও অবশ্য একটি ব্যাগ আছে। এই ব্যাগে নোট বুক, কলম এবং কাগজ।
বাসে উঠি আমরা। নির্দিষ্ট সিটে বসি। বাস কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে ছাড়ে না। পাঁচ মিনিট দেরি হয়।
আমি একটু ঘুমকাতর। ফেনীতে যাব বলে আজ ভোরে উঠেছি। কিন্তু চোখে নিশ্চয় ঘুম লেগে থেকেছিল। তাই বাসের দুলুনিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি। সেই ঘুম ভাঙে কুমিল্লাতে। যাত্রা বিরতিও হয় এখানে, একটি হাইওয়ে রেস্টুরেন্টের সামনে। বাস থেকে নামে যাত্রীরা। নামি আমরাও। রেস্টুরেন্টে ঢুকে ফ্রেশ হই। চা-বিস্কুট খাই।
কিছুক্ষণ পরে বাসের হর্ন শোনা যায়। হুড়মুড় করে যাত্রীরা গাড়িতে ওঠে। আমরা অবশ্য ধীরে-সুস্থেই গাড়িতে উঠি।
বাস আবার চলতে শুরু করে। আবার আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙে প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে। তাই এই পথে গাড়ি চলছে স্বাভাবিক গতির চেয়ে কম গতিতে, তার পরেও আমার অবস্থা কাহিল। এক সময় আবার সুন্দর, পীচঢালা মসৃণ পথের ওপর পড়ে গাড়িটি। আবার গাড়ির গতি বাড়ে। আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাই ফেনী শহরে।
যাত্রীরা বাস থেকে নামে। দু’ একজন অবশ্য রয়ে যায়। আমরাও নামতে শুরু করি। কিন্তু একজন যাত্রীর মুখে ‘সোনাগাজী’ শব্দটি শুনে থমকে যাই। গাড়ির চালককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, বাসটি ওখানেই যাবে। তখন আমরা নামি না, বসে পড়ি সিটে।
বাস সোনাগাজী উপজেলার দিকে যেতে থাকে। একজন যাত্রী নেমে যায় ‘বাংলা’ নামে এক জায়গায়। আমরা নামি না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই এক যাত্রীর সঙ্গে আলাপে বুঝতে পারি, ভুল করেছি বাংলাতে না নেমে। মজুপুর গ্রামে যেতে হলে ওখান থেকে যাওয়াই সুবিধাজনক। তখন বাস থেকে নেমে পড়ি আমরা। লোকাল একটি বাসে চড়ে পৌঁছি বাংলাতে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারি, মজুপুর যেতে হলে প্রথমে যেতে হবে ভোর বাজারে। ভোর বাজারে যাবার উপায় কী? রিকশা, সিএনজি কিংবা লোকাল বাস। রিকশা ও সিএনজিওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু তারা আকাশছোঁয়া ভাড়া হাঁকে। অগত্যা লোকাল বাসের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি।
বিশ মিনিট পর বাস এসে থামে। আমরা উঠে বসি। যাত্রী বোঝাই হলে এক সময় বাস ছাড়ে। গ্রামীণ জনপগের বিধ্বস্ত পথের ওপর দিয়ে বাস যেতে থাকে আর আনমনা আমি ভাবতে থাকি শহীদুল্লা কায়সারের কথা।
শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন ছোটখাটো মানুষ। কিন্তু এই মানুষটির কীর্তির দিকে চেয়ে মনে হয়, তাঁর মাথা যেন স্পর্শ করেছিল আকাশকে। সারাটা জীবন তিনি ব্যয় করেছে আদর্শ আর এদেশের শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে। ব্যক্তিগত স্বার্থ নয়, তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন সমষ্টিগত স্বার্থকে। তার বইগুলোর উসর্গপত্র—বিশেষত ‘রাজবন্দীর রোজনামচা’, ‘সারেং বৌ’ ও ‘সংশপ্তক’-এর উৎসর্গপত্রই হলো এর প্রমাণ। বইগুলো তিনি কোনো ব্যক্তিবিশেষকে উৎসর্গ করেন নি। বলা যায়, বইয়ের উৎসর্গপত্রের বৈশিষ্ট্য তাঁর চিন্তাধারা ও জীবনদৃষ্টির পরিচয়বহ। যেমন, ‘রাজবন্দীর রোজনামচা’র উৎসর্গপত্রের লেখা রয়েছে, ‘আট বছরের কারা জীবনে আশা আকাঙ্খা দুঃখ বেদনার যারা ছিল নিত্যদিনের সাথী, তাদের হাতে তুলে দিলাম বন্দী-জীবনের রোজনামচা’। ‘সারেং বৌ’-এর উৎসর্গপত্রে লেখা ‘তাদেরই উদ্দেশে/তালতমাল বনরাজিনীলা সাগর মেখলা বঙ্গভূমির পূর্ব উপকূলে যাদের/জন্ম, পৃথিবী যাদের দেশ, সমুদ্রে যাদের অন্ন, তরঙ্গ যাদের খেলার/সাথী, কণ্ঠে যাদের সাগরকল্লোল, ঝড় ওদের ঘর ভাঙ্গে, দরিয়ার বান ভাসিয়ে নেয় ওদের সবকিছু/তবু/সাগরের ডাকে মন ওদের আনচান, কেননা ধমনীতে ওদের সেই/নির্ভীক আদি নাবিকের রক্ত/’ ‘সংপ্তশক’—‘আগামী দিনের/ বংশধরদের হাতে উৎসর্গিত’।
শহীদুল্লা কায়সারের পুরো নাম আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লা। তিনি মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ এবং সৈয়দা সুফিয়া খাতুনের জ্যেষ্ঠ সন্তান। তাঁর অন্য ভাইবোনরা হলেন নাফিসা কবির, জহির রায়হান, জাকারিয়া হাবিব, সুরাইয়া বেগম, সাহানা বেগম, মোঃ ওবায়দুল্লাহ এবং সাইদুল্লাহ। ভাইবোনের মধ্যে প্রয়াত জহির রায়হান একজন প্রথিতযশা চলচ্চিত্রকার ও সাহিত্যিক। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সারের খোঁজে মিরপুর গিয়ে তিনি নিখোঁজ হন।
শহীদুল্লা কায়সারের পড়ালেখায় হাতেখড়ি মায়ের কাছে। একটু বড় হওয়ার পর তিনি বাবার সঙ্গে যান কলকাতায়। ভর্তি হন সরকারি মডেল স্কুলে। পরে বাবার কর্মস্থল মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার অ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগে। ১৯৪২ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষিায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে। এই কলেজ থেকেই তিনি অর্থনীতিতে বি এ পাশ করেন। তারপর এম এ পড়ার জন্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। একই সঙ্গে তিনি আইন পড়তে শুরু করেন রিপন কলেজে (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ)। কিন্তু দেশভাগের পরে ১৯৪৭ সালে অনেকের মতো শহীদুল্লা কায়সার ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এম এ ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার ফলে তাঁর ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত অর্থনীতিতে এম এ ডিগ্রি আর জোটে নি।
প্রেসিডেন্সী কলেজ পড়ার সময়ই বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে শহীদুল্লা কায়সারের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, ঢাকায় আসার পর তা আরও গভীর হয়। শহীদুল্লা কায়সার গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ৬ মার্চ কলকাতায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে যোগ দেন গণতান্ত্রিক যুবলীগের পক্ষে। তিনি এই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর শহীদুল্লা কায়সার নানাভাবে তৎকালীন ছাত্র-রাজনীতি ও ছাত্র-যুব আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করেন। কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে এ সময় বিশেষ দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। বলা যায়, সেই সময়ের রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন সংগ্রামী এক মানুষ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও ছিল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শহীদুল্লা কায়সার।
ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকায় কারণেই ১৯৫২ সালের ৩ জুন গ্রেফতার হন শহীদুল্লা কায়সার। এই গ্রেফতারই ছিল তাঁর কারা জীবনের সূত্রপাত। এই পর্যায়ে কারাবরণের পর ১৯৫৫ সালে মাস খানেকের জন্যে তিনি মুক্তি পান এবং গ্রেফতার হন। এবং অবশেষে ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় ক্ষমতায় এসে সরকার গঠনের পর তিনি ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু এ মুক্তি বেশি দিন স্থায়ী হয় নি। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক আইন জারি হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ১৪ অক্টোবর মধ্যরাতে গ্রেফতার হন শহীদুল্লা কায়সার—বেআইনি ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপে সহায়তা প্রদানের অভিযোগে। তিনি মুক্তি পান ১৯৬২ সালে—প্রবল ছাত্র আন্দোলনের ফলে।
সাংবাদিক হিসেবেও শহীদুল্লা কায়সারের অবদান অসামান্য। ১৯৫২ সালে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে তাঁর সাংবাদিক জীবনের সূত্রপাত হয়। তবে ১৯৫২ সালে সহকারী সম্পাদক হিসেবে সংবাদ-এর সম্পাদকীয় বিভাগে যোগদানের পর থেকেই এই ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা জোরালো হয়ে ওঠে।
সংবাদ-এর সম্পাদকীয় বিভাগের কর্মী হিসেবে নির্দিষ্ট সম্পাদকীয় ছাড়াও তিনি ‘রাজনৈতিক পরিক্রমা’ এবং ‘বিচিত্র কথা’ নামে দুটি নিয়মিত কলাম লিখতেন। যথাক্রমে ‘দেশপ্রেমিক’ এবং ‘বিশ্বকর্মা’ ছদ্মনামে, রাজনৈতিক ঘটনা ও বিষয়াবলী নিয়ে। অন্যদিকে ‘বিচিত্র কথা’-র বিষয়বস্তু ছিল সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষা-সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি। অবশ্য ‘সংবাদ’-এর সম্পাদকীয় বিভাগের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ শুধু নয়, বরং পত্রিকার সামগ্রিক পরিচালনার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন তিনি। শেষের দিকে পত্রিকার প্রায় সব দায়িত্বই এসে পড়ে তাঁর ওপর।
‘মোমিন ভাই, নামুন, আমরা এসে গেছি’—বিশ্বজিৎ-এর ডাকে সংবিত ফিরে পাই। দেখি ভোর বাজার পৌঁছেছে বাস। বিশ্বজিৎ বাস থেকে নামছে। আমি ওকে অনুসরণ করি।
বাস থেকে নেমে স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, মজুপুর গ্রাম কাছেই। দুই-তিন কিলোমিটার দূরে। তাই রিকশা না নিয়ে হেঁটেই রওনা দেই মজুপুর গ্রামের উদ্দেশে। দু’দিকে বাড়ি ঘর, শস্যক্ষেত্র, গাছপালা। একটা মুদি দোকানের সামনে দাঁড়াই। দোকানি শহীদুল্লা কায়সারকে চিনতে পারে না, তবে মুন্সী বাড়ির কথা বললে পথ বাতলে দেয়।
মুন্সী বাড়ি। আধা পাকা কয়েকটি দালান চারপাশে। মাঝে ফাঁকা জায়গা। হলুদ রঙের একটি দালানের সামনে এসে দাঁড়াই। কলিং বেলে চাপ দেই। মুহূর্তেই কলাপসিপল গেটের ওপারে সুশ্রী এত তরুণী এসে দাঁড়ায়। তাকিয়ে থাকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। আমরা নিজেদের পরিচয় দেই এবং আগমনের কারণ খুলে বলি। তখন গেট খুলে তরুণীটি ভেতরে আহ্বান জানায়। আমরা ভেতরে প্রবেশ করে একটি ঘরে ঢুকি এবং সোফায় বসি। কিছুক্ষণ পরে মধ্যবয়স্ক এক মহিলা প্রবেশ করেন। তার সঙ্গে আমাদের নানা কথা হয়। জানতে পারি, তিনি হলেন, শহীদুল্লা কায়সারের চাচাত ভাই প্রয়াত ডা সিরাজুল করিমের স্ত্রী ফিরোজা আক্তার আর তরুণীটি হলো তার পুত্রবধূ। জহির রায়হান-শহীদুল্লা কায়সারের প্রসঙ্গে ফিরোজা আক্তার জানালেন, তাঁরা সব শেষে এসেছিলেন ১৯৭০ সালে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগে। তাঁদের স্মৃতি বিজড়িত কোনো জিনিস কিছু আছে কি? হ্যাঁ, আছে। কোথায়? পাশের দালানে। আমরা বেরিয়ে আসি।
এক বয়স্ক মহিলা দরজার তালা খোলে। আমরা একটি ঘরে প্রবেশ করি। লক্ষ করি নানা রকম আসবাবপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা আছে— পালংক, ড্রেসিং টেবিল, চেয়ার, টেবিল, আরাম কেদারা, আলমারি...। পাশের ঘরে প্রবেশ করি। লক্ষ করি, এই ঘরেও আছে নানা আসবাবপত্র। দেয়ালে টাঙানো তৈলচিত্র, শহীদুল্লা কায়সার ও জহির রায়হানের আলোকচিত্র।
এক আলমারির ভেতরে লক্ষ করি, এক তরুণীর সঙ্গে সহাস্য মুখে চেয়ে আছে শমী কায়সার। এই দুটি ঘর হচ্ছে শহীদুল্লা কায়সারের এক ভাইয়ের ঘর। তাঁর ঘর-সংসারের নানা চিহ্ন দেখে মনে পড়ে যায় শহীদুল্লা কায়সারের সংসার-জীবনের কথা।
শহীদুল্লা কায়সারের প্রথম স্ত্রী ছিলেন জোহরা বেগম, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মন্ত্রী ডা. আর আহমেদের মেয়ে। বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১৯৫৮ সালের শেষের দিকে শহীদুল্লা সঙ্গে জোহরার বিয়ে হয়। হৃদয়ঘটিত সম্পর্কের সূত্রেই বিয়ে। কিন্তু তা বেশিদিন টেকে নি। ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে সামরিক আইন জারির পর শহীদুল্লা গ্রেফতার হয়ে জেলে গেলে জোহরা স্বামীর বিনানুমতিতে কলকাতায় ফিরে যান। পরে এক সময় জোহরা-শহীদুল্লার দাম্পত্যজীবনের অবসান ঘটে। তারপর শহীদুল্লা কায়সার বিয়ের ব্যাপারে অনাগ্রহী হয়ে পড়েন। দীর্ঘ এক দশক পর, ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি, দ্বিতীয়বারের মতো শহীদুল্লা কায়সার পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন কুমিল্লার বরুড়া নিবাসী জনাব মোসলেম উদ্দীন চৌধুরীর কন্যা পান্না চৌধুরীর সঙ্গে। তাদের এই দাম্পত্যজীবন অত্যন্ত সুখের হয়েছিল। শহীদুল্লা-পান্না’র দুই সন্তান— শমী কায়সার (জন্ম ১৫ জানুয়ারি, ১৯৭০) এবং অমিতাভ কায়সার (জন্ম ১০ অক্টোবর, ১৯৭১)।
শহীদুল্লা কায়সারের পৈতৃক ভিটা-মুন্সী বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছু দূরের মসজিদ পেরিয়ে একটি পুকুরের সামনে এসে দাঁড়াই। দেখি বিরাট একটি বোর্ডে লেখা— ‘ছিদ্দিকা খাতুন দাতব্য চিকিৎসালয়, মিঞা বাড়ি, মজুপুর ২০.০৯.২০০০। বদিউল আলম ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত।’ পুকুরের পেছনে দাতব্য চিকিৎসালয়, তার পেছনে বাড়ি। এই মিঞা বাড়ির এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মিয়ার ব্যাটাকে নিয়ে শহীদুল্লা কায়সার লিখেছেন ‘সংশপ্তক’। উপন্যাসের নায়ক জাহিদ এবং মালুর মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় শহীদুল্লা কায়সারকে। শহীদুল্লা কায়সারের আরেকটা উপন্যাস ‘সারেং বৌ’ হলো এ দেশের নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামের কাহিনি। উল্লেখযোগ্য আর দুটি গ্রন্থ হলো ‘রাজবন্দির রোজনামচা’ (১৯৬২) এবং ‘পেশোরার থেকে তাসখন্দ’(১৯৬৬)।
আবার পথে নামি। তবে আগের পথে নয়, যেতে থাকি লেমুয়ার দিকে। দূরের পথ, তাই রিকশা নিই। পেছনে পড়ে থাকে মজুপুর গ্রাম।
Leave a Reply
Your identity will not be published.