স্বাধীনতা-উত্তরকালের কাহিনিচিত্রের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি চলচ্চিত্র ‘চাকা’। মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত এ চলচ্চিত্রটি স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল। বলা যায়, এ দেশের বিকল্পধারার চলচ্চিত্রে ‘চাকা’ একটি নতুন পথ দেখিয়েছে; এই ধারার প্রথম নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র। এখানে সেই অর্থে কোনো গল্প নেই। প্রধান চরিত্র হলো দুজন গাড়োয়ান, একটি লাশ এবং প্রকৃতি। ...চাকা নির্মাণের পেছনের গল্প এখানে তুলে ধরা হলো।
১৯৯৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল বিকল্প ধারার একটি চলচ্চিত্র ‘চাকা’। মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ৬৫ মিনিটের এই রঙিন চলচ্চিত্রটি কাহিনিচিত্রের ধারায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। নিরীক্ষাধর্মী এই চলচ্চিত্রটি শুধু দেশে নয় বিদেশেও বেশ প্রশংসিত হয়েছে। দুটি আন্তর্জাতিক উৎসবে ৫টি পুরস্কার অর্জন করেছিল। উল্লেখ্য, চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে প্রথিতযশা নাট্যকার প্রয়াত সেলিম আল দীনের ‘চাকা’ মঞ্চনাটকের মূল ভাবনা অবলম্বনে।
চাকা’র কাহিনিধারায় মূর্ত হয়ে উঠেছে- বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফসল কাটার মৌসুমে দুই গাড়োয়ান (একজন বয়স্ক, অন্যজন যুবক) গরুর গাড়ি নিয়ে যাত্রা করেছে। মহাজনের নির্দেশে তারা উজান গ্রাম থেকে ধান তুলে মিঠাখালিতে পৌঁছে দেবে। পথ চলতে চলতে তারা হঠাৎ এক গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে একটি ডাক পায়। গতরাতে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সদর থেকে একটি লাশ এসেছে। অপঘাতে মৃত্যুবরণ করা অপরিচিত এক যুবকের লাশ। মৃত্যুর আগে সে তার গ্রামের নাম ছাড়া আর কিছুই বলে যেতে পারে নি। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারের উপর ওই লাশটিকে নির্দিষ্ট গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার ভার পড়েছে। তিনি নির্জন গ্রামের পথে গরুর গাড়ি দেখে ডাক দেন এবং গাড়োয়ান দুজনকে বলেন নবগ্রামে লাশটিকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু দেখা গেল, গাড়োয়ান দুজন রাজি নয়। তাদের কথা হলো, এতে তাদের কাজের ক্ষতি হবে। কিন্তু যখন পঞ্চাশ টাকার লোভ দেখানো হয়, অনুরোধ করা হয় এবং সরকারি লাশ না নিয়ে গেলে তারা বিপদে পড়বে বলে ভয়-ভীতি দেখানো হয় তখন বয়স্ক গাড়োয়ান রাজি হয়। এ ছাড়া যুবক গাড়োয়ানও অনুরোধ করে বলে, এতে ছোয়াব হবে। যাহোক, প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে সারা দিন গাড়ি চালিয়ে গাড়োয়ান দুজন সন্ধ্যায় নবগ্রাম বাজারে এসে উপস্থিত হয় (যেহেতু তাদের বলা হয়েছে যে মৃত ব্যক্তির বাড়ি নবগ্রাম)। লাশ এসেছে শুনে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে নবগ্রামের লোকজন ছুটে আসে। তুলসীতলায় প্রণাম করছিলেন মাঝবয়সী বিধবা এক নারী। তিনি চমকে ওঠেন। এক তরুণী একটি ঘরের ভেতর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টিপ পরছিল। হঠাৎ সোরগোল শুনে সে ফিরে তাকায়। ‘লাশ’ কথাটি কানে যেতেই ফ্যাকাশে মুখে ঘরের হাওয়ায় এসে দাঁড়ায়। ব্লাউজের ভেতর থেকে বের করে ভাঁজ করা একটি চিঠি- সম্ভবত তার প্রেমিকের চিঠি। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, শঙ্কা আর অনিশ্চিতির পাশাপাশি দেখা যায় গ্রামের বাজার, সিনেমার বিজ্ঞাপন, জীবনের বৈপরীত্যের ছবি। লাশের চারপাশে জড়ো হওয়া মানুষ লাশ দেখে নিশ্চিত হয় যে, মৃত মানুষটি নবগ্রামের কেউ নয়।
নবগ্রামের মানুষ স্বস্তি পেল বটে কিন্তু অস্বস্তি বাড়ল গাড়োয়ানের। এক বৃদ্ধ তাদের বললেন যে, ওরা বোধহয় ভুল শুনেছে। দুই ক্রোশ দূরে আরেকটি গ্রাম আছে, নবীগ্রাম, লাশটি বোধহয় ওই গ্রামের কারুর। আবার গাড়োয়ানরা যাত্রা শুরু করে। ঝিঁঝির শব্দ শোনা যায়। গরুর গাড়ির চাকা তার বিচিত্র শব্দ তুলে এগিয়ে চলে উত্তরবঙ্গের রুক্ষ ধূলিধূসরিত পথ ভেঙে।... নবীগ্রামে ঘটে নবগ্রামেরই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। গ্রামবাসী উৎকণ্ঠিত হয়ে ছুটে আসে, কিন্তু না, এ লাশ তাদের গ্রামে কারও নয়। কিন্তু শোকে কাতর প্রায় এক প্রায়ান্ধ বৃদ্ধা লাশটি দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সে ভাবে এ তার হারিয়ে যাওয়া নাতির লাশ। শেষপর্যন্ত গ্রামের কিছু লোক বৃদ্ধাকে ধরাধরি করে সেখান থেকে সরিয়ে বাড়ি নিয়ে যায়। এখন এই লাশ নিয়ে কী করবে গাড়োয়ান দুজন? একজন পরামর্শ দেয় যে, মৃত লোকটির বাড়ি বাঘাবাড়ি হতে পারে। সেখান থেকে একজন লোক নিখোঁজ হয়েছে বলে শোনা গেছে। রাতটা নবী গ্রামে কাটিয়ে লাশ নিয়ে তারা বাঘাবাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রাতের অন্ধকারে হঠাৎ একসময় ঘন কুয়াশার মধ্য দিয়ে এক যুবক বড় গাড়োয়ানের সামনে এসে দাঁড়ায়, তার কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে নিয়ে খায়, তাকে মৃদু বিষণ্ন কণ্ঠে জানায় যে, তারা যে লাশ বহন করে চলেছে তার ঠিকানা কোনোদিন পাওয়া যাবে না। তারপর যুবক হাঁটতে হাঁটতে আবার কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যায়। বড় গাড়োয়ান কাপড় সরিয়ে লাশের মুখটা একটু দেখে।... বাঘাবাড়ি পৌঁছে লাশের কোনো সুরাহা হলো না। মৃত ব্যক্তির কোনো স্বজনকে তারা খুঁজে পেল না। পথে গাড়োয়ান দুজন এক বিয়ে বাড়ির দৃশ্য দেখে। মৃত্যুর বেদনার বিপরীতে জীবনের উৎসব মুখরতা। এ লাশ তাদের এলাকার কারও নয় জানার সঙ্গে সঙ্গে ফুটে উঠে লাশটির প্রতি সবার অবজ্ঞা ও ঔদাসীন্য। লাশটি নামিয়ে রাখার প্রস্তাব করা মাত্র বড় গাড়োয়ান ক্রুব্ধ রূঢ় কণ্ঠে বলে, ‘লাশে কেউ হাত দেবা না’।
চাকা আবার চলতে শুরু করে। বড় গাড়োয়ান পচনধরা লাশ আগলে বসে থাকে। তারা স্থির করে যে তারা নিজেরাই লাশকে সমাধিস্থ করবে। অন্য একটি গ্রামে পৌঁছে তারা গ্রামবাসীদের কাছে লাশটিকে কবর দেওয়ার জন্য সামান্য একটু জায়গা প্রার্থনা করে। কিন্তু গ্রামবাসীরা রাজি হয় না। বেওয়ারিশ লাশ, কত রকম ঝামেলা হতে পারে। শেষপর্যন্ত মসজিদের ধার্মিক মৌলভি সাহেবের কাছে দ্বারস্থ হয় বড় গাড়োয়ান- তিনি যদি দয়া করে লোকটির কবরের জন্য একটুখানি জায়গার ব্যবস্থা করে দেন তবে বড় ভালো হয়। কিন্তু সেই আবেদন মঞ্জুর হয় না। মৌলভি সাহেব জানান যে, কথাটা দয়ামায়ার না। লাশটা মুসলমানের কি না তা তো ওরা জানে না। লাশটি যদি বিধর্মীর হয় তাহলে মসজিদ সংলগ্ন স্থানে তাকে কবর দিলে আল্লাহ নারাজ হবেন।
গরুর গাড়ির চাকা আবার চলতে শুরু করে। আর মানুষের কাছে নয় এবার গাড়োয়ান দুজন লাশের সমস্যা সমাধানের জন্য সাহায্য খোঁজে প্রকৃতির কাছে। ইতিমধ্যে লাশে পচন ধরেছে, মাছি তাড়াতে হচ্ছে অনবরত বড় গাড়োয়ানকে, লাশ থেকে থেকে গন্ধ বেরোচ্ছে। লাশটিকে ওরা নির্জন এক নদীর পাড়ে নামিয়ে নদী তীরে বালি খুঁড়ে তাকে কবর দেয়। অতঃপর ক্লান্ত গাড়োয়ান দুজন নদীর পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে নদী তীরে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। হঠাৎ হু হু করে কেঁদে ওঠে বয়স্ক গাড়োয়ান। গামছা দিয়ে চোখ মুছে যুবক গাড়োয়ান। তখন সন্ধ্যা নেমে আসছে।
‘চাকা’ নির্মাণের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম জানান যে, মাহমুদুল হকের উপন্যাস ‘খেলাঘর’ অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছে জেগে উঠে তার গত শতকের আশির দশকের শেষ পর্যায়ে। আর এই চলচ্চিত্রের প্রধান দুই অভিনয়শিল্পী হিসেবে তিনি নির্বাচিত করেন আফজাল হোসেন ও সুবর্ণা মুস্তফাকে। যদিও তাদের নিয়ে শেষপর্যন্ত কাজ করা সম্ভব হয় নি। কিন্তু সেই সময় আফজালের কাছে ঘনঘন যাতায়াতের সূত্রে একদিন মহিলা সমিতি মঞ্চে উপভোগ করেন সেলিম আল দীনের চাকা নাটকটি। সেই সময় আফজাল তার মাথায় ঢুকিয়ে দেন এই ভাবনা যে নাটকটি অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র হতে পারে। কিন্তু প্রথম দিকে মোরশেদুল ইসলাম দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকেন। কেননা চাকা ছিল একটি সংলাপ নির্ভর মঞ্চনাটক। এখানে প্রচুর চরিত্র। এটি অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা কঠিন। একপর্যায়ে মোরশেদুল সিদ্ধান্ত নেন যে, মঞ্চনাটকটির মূলভাবনা গ্রহণ করে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। এই নাটকে রয়েছে একটি মানবিক দিক আর বিশ্বজনীন একটি বিষয়। এই ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে মোরশেদুল ইসলাম নিজের মনের মতো করে চিত্রনাট্য লেখেন। মঞ্চনাটকের অধিকাংশ চরিত্র বাদ দেন তিনি। বেছে নেন দুই গাড়োয়ান এবং লাশকে। আর প্রকৃতি হয়ে ওঠে তার চলচ্চিত্রের বড় একটি চরিত্র। কেননা মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যে সম্পর্ক, জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্ক- এটিই চলচ্চিত্রটির মূল প্রতিবাদ্য বিষয়। বলাই বাহুল্য, চিত্রনাট্যে সংলাপ ঠাঁই পায় অত্যন্ত কম। চিত্রনাট্য লিখেছেন মোরশেদুল ইসলাম স্বয়ং। আর শুটিং করতে গিয়ে মূল চিত্রনাট্য থেকে সরতে হয় নি তাকে। খুবই সামান্য পরিবর্তন করতে হয়েছে তাকে।
‘চাকা’র প্রযোজক রফিকুন রহিম। তিনি মোরশেদুল ইসলামের সহপাঠী বন্ধু। তিনিই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ ব্যয়ের অধিকাংশ বহন করেছেন। মোট নির্মাণ ব্যয় সাত লাখ টাকা। এটিকে স্বল্প ব্যয় বলেই অভিহিত করেন মোরশেদ। কেননা বাজেট আরেকটু বেশি হলে চলচ্চিত্রটি কারিগরি দিক থেকে আরও ভালো হতো। যেমন, ফিল্ম মোরশেদ কেনেন নি। নানাজনের কাছ থেকে পেয়েছেন। নানা ধরনের ফিল্ম- কোডাক, ফুজি, হাই কিংবা লো স্পিডের ফিল্ম। এতে চলচ্চিত্রটির টোনের ক্ষেত্রে একই মান বা ভারসাম্য রাখা সম্ভব হয় নি। কালার গ্রেডিংয়ের মাধ্যমে সংশোধনের মাধ্যমেও না। এই কারিগরি ত্র“টি চলচ্চিত্রটিতে রয়ে গেছে।
‘চাকা’র জন্য এমন লোকেশনের দরকার ছিল যেখানে লম্বা কাঁচা গ্রামের রাস্তা, দুই পাশে ধানখেত, অনেক পরে পরে গ্রাম। এমন কোথায় লোকেশন পাওয়া যেতে পারে?....চলচ্চিত্রটির প্রোডাকশন ম্যানেজার গোলাম রাব্বানী বিপ্লব একদিন মোরশেদকে জানালেন যে তার মামাবাড়ি হলো নওগাঁর মহাদেবপুরে। সেখানে এমন লোকেশন রয়েছে। শুনে বিপ্লবের সঙ্গে মোরশেদুল গেলেন নওগাঁর মহাদেবপুরে এবং দেখেন যে, তিনি যেমনটি চাইছেন তেমনই লোকেশন রয়েছে সেখানে। সুতরাং ওখানেই শুটিং করবেন বলে স্থির করেন এবং সেটাই বাস্তবায়িত করেন।...ঢাকার আশপাশেও কিছু শুটিং করেছেন। যেমন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মসজিদ, মসজিদের পেছনে কবরস্থান, এইসব জায়গার শুটিং করেছেন কেরানীগঞ্জ এবং তার আশপাশে।
নওগাঁর মহাদেবপুরে ‘চাকা’র শুটিং করা হয়েছে শীতকালে। অনেক কষ্ট করেছে এই ছবির ইউনিট। প্রত্যন্ত সেই গ্রামে থাকার মতো কোনো জায়গা ছিল না। ইউনিয়ন পরিষদের একটি অফিসে টিনের একটি ঘরে থেকেছে সবাই; মাটিতে বিছানা করে শুয়েছেও। প্রতিদিন শুটিং শেষে রাতে গরুর গাড়িতে ক্যামেরাসহ ক্যামেরাম্যানকে পাঠিয়ে দেওয়া হতো তারপর সবাই হেঁটে ফিরতেন। পুকুরে গোসল করে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। ঘুমাতেন মাত্র পাঁচ-ছয় ঘণ্টা। তারপর ভোরের আগেই উঠে আবার শুটিংয়ের উদ্দেশ্যে গরুর গাড়িতে করে যাত্রা।
‘চাকা’য় ব্যবহৃত হয়েছে দুটি গরু- লাল ও সাদা রঙের। চলচ্চিত্রটির প্রথম পর্যায়ের শুটিং করার সময় এই গরু দুটির মালিকের সঙ্গে মোরশেদুলের একটি চুক্তি হয়- প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ তাকে দেয়া হবে। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ের শুটিং করার সময় গরুর মালিক অতিরিক্ত টাকা দাবি করে- যা অত্যন্ত অযৌক্তিক। ফলে গ্রাম্যসালিশের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়।
‘চাকা’য় ব্যবহৃত হয়েছে একটি মাত্র গান। ‘খৈল বিচালি ততদিন পাবি চাকা যতদিন ঘুরাবি/প্রাণপাখি তোর দেহ ছাড়লে ভাগাড়ে যাবি।’ গানটি শুরুতে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গাড়োয়ানের কণ্ঠে এবং শেষে বিষণ্ন কণ্ঠে নেপথ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। এই গানটি লিখেছেন চলচ্চিত্রটির প্রধান সহকারী পরিচালক আকরাম হোসেন। তিনিই সুরোরাপ করছেন। আবহসংগীত পুলক গুপ্ত।
চলচ্চিত্রটি এ দেশের কাহিনিচিত্রের ক্ষেত্রে নতুন ধারার সূচনা করে যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে প্রথাগত অর্থে কোনো গল্প নেই। দ্বিতীয়ত এমনভাবে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছে যেন শুরুতে দর্শক বিরক্ত হয় এবং ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। বিষয়টি বলাই বাহুল্য, একেবারে নতুন এবং অভিনব ছিল।
বয়স্ক গাড়োয়ানের চরিত্রটি রূপায়ণ করেছেন আমিরুল হক চৌধুরী (মঞ্চনাটকে এ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ)। শক্তিমান এই অভিনেতা যথার্থভাবেই তার চরিত্রটি সেলুলয়েডে ফুটিয়ে তুলেছেন। অন্যদিকে আশীষ খন্দকার অভিনয় করেছেন যুবক গাড়োয়ানের চরিত্রে। তিনি তখন সদ্য দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা থেকে ফিরেছেন। তার মধ্যে নাটকীয় অভিনয় করার একটি প্রবণতা ছিল। চলচ্চিত্র বা মঞ্চনাটকের জন্য মানানসই হলেও চলচ্চিত্রে তা বেমানান। চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম অবশ্য দৃঢ়ভাবেই আশীষ খন্দকারকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং তার কাছ থেকে চলচ্চিত্র উপযোগী অভিনয় আদায় করে নিয়েছেন। এ ছাড়া আতাউর রহমান, দিলারা জামান, আবুল খায়েরের মতো প্রথিতযশা অভিনয়শিল্পী এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। স্বল্প পরিচিত ক’জন অভিনয় শিল্পী ছাড়া মঞ্চেকর্মী, তারাও কাজ করেছেন। অন্যদিকে নওগাঁর মহাদেবপুরের সাধারণ গ্রামবাসীও এখানে অভিনয় করেছেন।
‘চাকা’র ক্যামেরাম্যান আনোয়ার হোসেন। সম্পাদক নজরুল ইসলাম। উল্লেখ্য, কলাকুশলীরা এই স্বল্প বাজেটের চলচ্চিত্রে বিনা সম্মানীতে কাজ করেছেন।
‘চাকা’র প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয় শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে। ১৯৯৩ সালে। দর্শনীর বিনিময়ে প্রদর্শিত হয় পাবলিক লাইব্রেরীতে। পাশাপাশি কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে আমন্ত্রিত হয় এবং পুরস্কৃতও হয়। যেমন, ক্রিয়েটিক অ্যাওয়ার্ড, মানহাইম চলচ্চিত্র উৎসব, জার্মানি, ১৯৯৩; ইন্টারন্যাশনাল জুরি পুরস্কার, ম্যানহাইম চলচ্চিত্র উৎসব, জার্মানি, ১৯৯৩; শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার, ডানকার্ক চলচ্চিত্র উৎসব, ফ্রান্স, ১৯৯৪; শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার, ডানকার্ক চলচ্চিত্র উৎসব, ফ্রান্স। বলাই বাহুল্য, বিদেশের দর্শকদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়াও পেয়েছেন মোরশেদ। তবে দেশের দর্শকের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র।
চিত্রনাট্য থেকে-
দৃশ্য
শেষ বিকেল। বাজারের মাঝখানে এসে দাঁড়ায় গাড়িটা।
ছোট্ট বাজার। দোকান ইতস্তত ছড়ানো। কয়েকজন বৃদ্ধকে দেখা যাচ্ছে বসে চা খাচ্ছে একটি দোকানের সামনে। কয়েকজন তরুণ বসে আড্ডা মারছে একপাশে। কয়েকটি ছোট ছেলেমেয়ে ডাংগুলি খেলছে।
গাড়িটা এসে দাঁড়ায়। লোকজন একটু সচকিত হয়ে এদিকে তাকায়। গাড়ি থেকে নামতে নামতে বড় গাড়োয়ান কথা বলে।
গাড়োয়ান ১: একটা লাশ নিয়া আসছি ভাই। আপনাগো গেরামের। নাম জানি না।
সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে এদিকে তাকায়। একটা গুঞ্জন ওঠে।
একজন বৃদ্ধ: লাশ? এই গেরামের?
গাড়োয়ান ১: হ।
ছোট ছেলেমেয়ের দলটি খেলা বন্ধ রেখে এদিকে এগিয়ে আসতে থাকে ঔৎসুক্য নিয়ে। দলটি থেকে একটি ছেলে হঠাৎ ‘লাশ’ ‘লাশ’ বলে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে চলে যায় বিপরীত দিকে। ক্যামেরা দৌড়ে চলে যাওয়া ছেলেটির সঙ্গে প্যান করে।
একজন মহিলা পুকরে হাঁড়ি মাজছিলেন। ‘লাশ লাশ’ চিৎকার শুনে সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এদিকে তাকান।
ঘরের আঙিনায় তুলসী মণ্ডপে পূজা দিয়ে ফিরছিলেন মাঝবয়সী সাদা শাড়ি পরা এক মহিলা। চিৎকার শুনে থমকে দাঁড়ান। ফিরে তাকান। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে সারা মুখে।
মা ও ছেলের কথোপকথন শোনা যায়।
মা: সাবধানে থাকিস বাজান।
ছেলে: তুমি চিন্তা কইরো না মা, কলেজ ছুটি অইলেই আমি বাড়ি আমু।
একটি ঘরের ভেতর দেখা যাচ্ছে একজন তরুণী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কপালে টিপ পরছে। হঠাৎ সোরগোল শুনে ফিরে তাকায় মেয়েটি। লাশ কথাটি কানে যেতেই চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় মেয়েটির। ঘরের দাওয়ায় এসে দাঁড়ায় মেয়েটি। পাশ দিয়ে একদল চলে যাওয়া ছেলেমেয়ের চিৎকার শুনে সে। তারপর সব নিশ্চুপ হয়ে গেলে চারদিকে তাকায়, তারপর সাবধানে ব্লাউজের ভেতর থেকে ভাঁজ করা চিঠিটা বের করে চোখের সামনে মেলে ধরে। ছেলেটার কণ্ঠে শোনা যায় চিঠির অংশ।
Off voice: আর কয়ডা দিন মাত্র। বিস্যুদবার বিকালের গাড়িতেই আমি আইতাছি পারু। তুমি সুন্দর একখান শাড়ি পইরা কপালে টিপ পইরা আমার জন্য অপেক্ষা কইরো...
চিঠিটা পড়েই মেয়েটি ঠোঁট কামড়ে কান্না চাপে। চিঠিটা দুমড়ে যায় মেয়েটির হাতের মুঠোয়। ক্যামেরা ট্র্যাক করে মেয়েটির ক্লোজআপ-এ যায়।
একজন বৃদ্ধ এসে দাঁড়ায় ভিড়ের মধ্যে। ক্যামেরা বৃদ্ধকে ফলো করে ট্র্যাক ব্যাক করে এসে ভিড়সহ বৃদ্ধকে ধরে। ভিড়ের মধ্যে লোকজন পরস্পরের দিকে তাকায়।
নিহত লোকটির মুখে ক্লোজআপ।
লোকজন। একদল মাথা নেড়ে চলে যায় আর একদল আসে।
একপাশে দেখা যায় কয়েকজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। পেছনে ওই তরুণীটি দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে এসে দাঁড়ায়।
গাড়োয়ান দুজন একটু দূরে বসে বিড়ি টানছে।
ভিড় এখন একটু কমেছে। লোকজন লাশ দেখে সব বেরিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন রকম মন্তব্য করে। মহিলারা এবার এগিয়ে আসে। লাশ দেখার পর সবার চোখে-মুখে উদ্বেগ দূর হয়।
চারপাশে এখন লোকজন প্রায় নেই। লাশটা পড়ে আছে নিঃসঙ্গ, ইতস্তত ৩/৪ লোক ছড়িয়ে আছে, আগের জায়গাতেই গাড়োয়ান দুজন হতাশ ভঙ্গিতে বসে আছে। একজন বৃদ্ধের কথায় ফিরে তাকায় গাড়োয়ান দুজন।
বৃদ্ধ: তুমরা ভুল ঠিকানায় আইছো মিয়ারা। গেরামের নামডা আবার বালা কইরা দেহ। নবীগ্রাম লেখতে গিয়ে আবার নবগ্রাম অইয়া গেল নিহি। এই ভুলডা অনেকেই করে।
গাড়োয়ান দুজন পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।
বৃদ্ধ: নবীগ্রামে লইয়া গিয়া একবার দেহ। দুই ক্রোশ পথ।
গাড়োয়ান দুজন কী করবে বুঝে উঠতে পারে না সহসা।
একজন আরেকজনের দিকে তাকায়।
Leave a Reply
Your identity will not be published.