হারিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের মাছ

হারিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের মাছ

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এই দেশের মতো এত অসংখ্য মিঠা পানির নদ-নদী, খালবিল, হাওর, বাওর, জলাশয়ের দেশ পৃথিবীর অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন কারণে বিগত কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশের নদ-নদীগুলোর নাব্যতা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় ও ব্যাপক পানি দূষণের কারণে জেলেদের জালে আগের মতো আর তেমন মাছ ধরা পড়ছে না। অসংখ্য প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে পড়েছে। বিলুপ্ত হতে চলেছে অনেক দেশীয় জাতের মাছ।

আমরা মাছে ভাতে বাঙালি। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশের মানুষের জন্য মাছের বাড়তি ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে তরুণ প্রজন্মের উদ্যোক্তা মৎস চাষিরা এখন ব্যাপকভাবে চাষের মাছের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আমাদের দেশে বর্তমানে পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, কই, শিং, মাগুর, পাবদা, রুই, কাতলা, সিলভার কার্প ইত্যাদি বেশির ভাগ মাছ চাষের পদ্ধতিতে মৎস চাষিরা বিগত দুই দশক ধরে জোরেসোরে আবাদ শুরু করেছে। চাষের মাছগুলো কখনোই নদী কিংবা প্রাকৃতিক জলাশয়ে বেড়ে উঠা মাছের মতো সুস্বাদু হয় না। দাম ও স্বাদের দিক থেকেও নদীর মাছের দাম চাষের মাছের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে থাকে। সবচেয়ে বড় সমস্যা বাহ্যিক দিক থেকে নদীর ও চাষের মাছের পার্থক্য নির্ণয় করা খুবই কঠিন কাজ। আমি কিছুদিন আগে ঢাকার এক নামিদামি রেস্টুরেন্টে দুপুরে কই মাছের ভুনা দিয়ে ভাত খেয়ে বুঝতে পেরেছিলাম মাছটি আসলে বিল কিংবা হাওরের নয়। ওটা চাষের মাছ ছিলো। ঢাকা শহরের অদূরে ফতুল্লায় একটি পুরোনো নামকরা হোটেল আছে, যেখানে আমি বহুবার দেশি জাতের বিলের কৈ মাছের ভাজি ও ভুনা তরকারি ময়মনসিংহের বিরোই চালের ভাতের সাথে খেয়েছি। বিলের কই মাছের স্বাদ নিতে প্রতিদিন সেই হোটেলে অসংখ্য মানুষ শখ করে খেতে আসে। ঢাকা শহরের পল্টনে অবস্থিত প্রসিদ্ধ কস্তুরি রেস্টুরেন্টে রান্নাকরা সকল মাছই নদী কিংবা প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে সরাসরি সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। আমি শখ করে বেশ কয়েকদিন কস্তুরি রেস্টুরেন্টে নদীর পাবদা মাছের সুস্বাদু ভুনা তরকারি দিয়ে ভাত খেয়েছি। সেই স্বাদ এখনো আমার মুখে লেগে আছে।

আমার জন্ম ও বেড়ে উঠা গ্রামে। গ্রামের সাথে আমার নিবিড় সম্পর্ক সেই ছোটো বেলা থেকে। আমাদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার ঘোনাপাড়া গ্রামে। আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শীতলক্ষ্যা নদী। ষাটের দশকে এই নদীর প্রশস্থতা ও গভীরতা বর্তমান অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি ছিল। নদীতে তখন প্রচুর মাছ জেলেদের জালে ধরা পড়ত। রুই, কাতল, বোয়াল, পাবদা, রিটা, চিতল, চিংড়িমাছ থেকে শুরু করে সবধরনের ছোটো বড় দেশীয় মাছ এই নদীতে পাওয়া যেত। পানি ও মাটির গুণে শীতলক্ষ্যা নদীর মাছের স্বাদ আমাকে সব সময়ই আকৃষ্ট করতো। বিশেষ করে এই নদীর কেচকী মাছের স্বাদ এতোটাই সুস্বাদু ছিলো যে, শুধু কেচকী মাছের ভাজি দিয়ে আমি পেটভরে ভাত খেতে পারতাম। বিগত ২০/২৫ বছর আগে পর্যন্ত নদীতে সুস্বাদু কেচকি মাছসহ অন্য সকল ধরনের প্রচুর মাছের দেখা মিলতো। আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম মূলগাওয়ে নদী তীরবর্তী একটি ছোটো বাজার ছিলো। সেই বাজারটি স্থানীয়দের কাছে ‘নাতাইনা বাজার’ নামে পরিচিত ছিলো। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে এই বাজারে সাপ্তাহিক হাট বসতো। জেলেদের কাছ থেকে মূলত কেচকী মাছ কিনতে আমরা সেই নাতাইনা বাজারে যেতাম। বিগত তিন দশকে শীতলক্ষ্যা নদী পাড় ঘেঁষে ছোটো-বড় অসংখ্য মিল-কলকারখানা গড়ে উঠায় কয়েক যুগ ধরে চলে আসা নাতাইনা বাজারটির সাপ্তাহিক হাট নদীর মাছের অভাবে এক যুগ আগে বন্ধ হয়ে গেছে। নদী পাড়ে গড়ে উঠা শিল্প-কলকারখানার অপরিশোধিত দূষিত বর্জের কারণে নদীর পানি মারাত্মক দূষণের শিকার হওয়ার কারণে নদীতে মাছের প্রাপ্যতা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। নদীতে জেলে নৌকা ঠিক আগের মতো দেখা যায় না। তীব্র নদী দূষণের কারণে নদীর মাছের স্বাদও ঠিক আগের মতো নাই। আশির দশক পর্যন্ত আমাদের গ্রামের আশেপাশে বেশ কয়েকটি ছোটোবড় বিল ও জলাশয় ছিলো। সেখানে বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন প্রজাতির প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো। বিশেষ করে শোল, টেংরা, কৈ, শিং, মাগুর, টাকি, পুটি, বাইন মাছের স্বর্গরাজ্য ছিলো এই বিল ও জলাশয়গুলো। কিশোর বয়সে শখের বশে বড়শি দিয়ে আমি নিজেও তালগাছের গোড়া দিয়ে তৈরি কোনডা নৌকায় করে বিলের মাঝে নির্জনে বসে মাছ ধরে বহুদিন বাড়িতে নিয়ে এসেছি। তা ছাড়া আমাদের বাড়ির পুকুরে ও নদীতে বড়শি দিয়ে ছোটো-বড় অনেক মাছ ধরার মধুর স্মৃতি আমাকে এখনো আবেগ তাড়িত করে তুলে। আমার মনে পড়ে একবার বৃষ্টির দিনে ধানখেতে বাঁশের চাই পেতে আমি ও আমার চেয়ে বয়সে বড় এক চাচাতো ভাই দুজনে মিলে অনেক পুটিমাছ ধরেছিলাম। সেই মাছ বাড়ির সবাই মিলে অনেক মজা করে খেয়েছি। এইসবই আমার উজ্জ্বল স্মৃতিতে আজীবন মনে থাকবে। 

আমার প্রয়াত দাদি বড় আকারের শোল ও কৈ মাছ খেতে খুব ভালোবাসতেন। শোল মাছ অবশ্য আমিও অনেক পছন্দ করে খেতাম।  সেইসব মাছ কিনতে বাড়ির কাছে রেললাইন ঘেঁষা বাঘাইরপাড়া নামক বাজারের সাপ্তাহিক হাটে যেতে হতো। সেই বাঘাইরপাড়া হাট এখনো আগের মতো আছে। তবে আশেপাশের বেশ কিছু জলাশয় ও একটি ছোটো বিল সাম্প্রতিক বছরে মাটি ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে উল্লেখিত বাঘাইরপাড়া হাটে আগের মতো এখন আর তেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশীয় জাতের মাছ পাওয়া যায় না।

একসময় এদেশের হাটেবাজারে প্রচুর দেশি জাতের মাছের দেখা মিলত। এখন সেইসব মাছ জেলেদের জালে ধরা পড়ে খুবই কম। দেশীয় এইসব মাছের মধ্যে শিং, মাগুর, পাবদা, কেচকী, মলা, ঢেলা, সোল, বাইন, টেংরা, পুটি, ডারকা, চেলা, শাল চোপড়া, বোয়াল, আইড়, ভ্যাদা, বুড়াল, খলিসা, ফলি, চিংড়ি, মালান্দা, খরকাটি, গজার, শবেদা, চেং, টাকি, চিতল, গতা, পোয়া, বালিয়া, উপর চকুয়া, কাকিলা, গুত্তুম, গজার, বৌরানীসহ প্রায় ৫০টিরও বেশি মিঠা পানির বিভিন্ন ধরনের মাছ। এসব মাছ কমে যাওয়ার পেছনে অন্তত ১৪টি কারণকে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। গ্রামবাংলায় পৌষ-মাঘ মাসে পুকুর, খাল, ডোবা, ঘেরের পানি কমতে থাকলে দেশি মাছ ধরার ধুম পড়ে যেতো। এখন সেসব দেখা যায় না। বর্ষাকালে ধানের জমিতে কইয়া জাল, বড়শি ও চাইড় পেতে মাছ ধরার রীতিও হারিয়ে গেছে অনেক এলাকা থেকে। যারা একসময় পুকুর, খাল-বিল, ডোবা, নালায় মাছ ধরে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতেন, তাদের অনেকেই এখন বাজার থেকে চাষের মাছ কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশিয় মাছ ক্রমশ হারিয়ে যাওয়ার জন্য অনেকগুলো কারণই দায়ী। এরমধ্যে মধ্যে জলবায়ুর প্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কারেন্ট জালের অবৈধ ব্যবহার, ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহার, জলাশয় দূষণ, নদ-নদীর নব্যতা হ্রাস, উজানে বাঁধ নির্মাণ, নদী সংশ্লিষ্ট খাল-বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, ডোবা ও জলাশয় ভরাট করা, মা মাছের আবাসস্থলের অভাব, ডিম ছাড়ার আগেই মা মাছ ধরে ফেলা, ডোবা-নালা-পুকুর-বিল ছেঁকে মাছ ধরা, বিদেশি রাক্ষুসে মাছের চাষ ও মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটানো। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই ১৪টি কারণে ৫০টির বেশি দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে।

মৎস্য অধিদফতরের সূত্র বলছে, হারিয়ে যাওয়া দেশি প্রজাতির মাছের সংখ্যা আড়াই শ-এর বেশি। হাটবাজার, পুকুর, খাল, বিল কোথাও এখন আর মিঠাপানির সুস্বাদু সেইসব মাছ মিলছে না। দেশি মাছের বদলে এখন বাজারে জায়গা দখল করে নিয়েছে চাষের পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, ক্রস ও কার্প জাতীয় মাছ।

রাজধানীর বাসাবো বাজারের মাছ ব্যবসায়ী ময়মনসিংহের বাসিন্দা আবদুল মজিদ বলেন, “১৫-১৬ বছর আগেও আমাদের এলাকায় মাছ কিনে খাওয়ার তেমন রেওয়াজ ছিল না। এখন নদী-বিল ও খালে মাছ নেই। মানুষ চাষের মাছের ওপর নির্ভরশীল।”

এ প্রসঙ্গে শেরপুরের বাদগৈড় গ্রামের মৎস্য খামারি ফারুক বলেন, “একসময় গ্রামের মানুষরা পারিবারিক প্রয়োজনে মাছ ধরত। শোল, গজার, টাকি, চিংড়ি, শিং, কই, টেংরা, পাবদা, ফলিসহ বিভিন্ন জাতের মাছ ধরা পড়ত। এখন সেইসব মাছ নেই। বাজারেও মিলে না।”

মৎস্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, “যে মাছগুলো হারিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে অনেক প্রজাতির মাছ রক্ষায় গবেষণা চলছে। পাবদা, টেংরা, বোয়াল, আইড় মাছ এখন চাষ হচ্ছে। পাঙ্গাসের চাষ হচ্ছে আগে থেকেই। কই মাছেরও চাষ হচ্ছে। দেশি প্রজাতির মাছ রক্ষায় মৎস্য অধিদফতর প্রতিবছরই মৎস্য মেলার আয়োজন করে। একই কর্মসূচি জেলা, উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।”

দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেনের ভাষ্য হচ্ছে, ‘বিভিন্ন কারণেই দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে মানুষের সচেতনতার অভাবও রয়েছে। হারিয়ে যাওয়া দেশি মাছ রক্ষায় ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। এখন পাবদা, টেংরা, বোয়াল, আইড়, পাঙ্গাস, কই ও শিং-মাগুর মাছের চাষ হচ্ছে।’

আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ মাছের প্রজনন মৌসুমে প্রতিবছর সরকারিভাবে ইলিশ মাছ ধরা ও বিপণন বন্ধ না করা হলে বহু আগেই আমাদের পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে ইলিশ মাছ বিলুপ্ত হয়ে যেতো।

বাংলাদেশে দেশীয় মাছের প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৩০০। এর মধ্যে ২০১৫ সালে আইইউসিএন-এর সর্বশেষ মূল্যায়নে ২৫৩ প্রজাতির মাছের ওপর জরিপ চালানো হয়েছিল। তাতে দেখা গেছে সময়ের বিবর্তনে যেসব মাছ বিলুপ্তপ্রায় তার বেশির ভাগই নদীর মাছ মানে স্বাদু পানির মাছ। তবে ৩০০ প্রজাতির মাছের মধ্যে অন্তত ৪০ প্রজাতির মাছের ব্যাপারে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার কাছে হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই। আইইউসিএন কয়েকটি ভাগে মাছের অবস্থা ব্যাখ্যা করেছিল।

এর মধ্যে কিছু মাছ ক্রিটিক্যালি এনডেঞ্জারড বা প্রায় বিলুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ এগুলো সন্ধান ও সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে সেগুলো অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এর বাইরে মহা বিপন্ন, বিপন্ন এবং সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে বহু প্রজাতি। বাংলাদেশে বিপন্ন মাছের মধ্যে রয়েছে¬, পাঙ্গাস, দারি, ককসা, টিলা বা হিরালু, টিলা ককসা, রানি বা বউ মাছ, বেতাঙ্গি, বেটি বা পুতুল মাছ, কালা বাটা, ঘর পোয়া, ঘর পইয়া, ঘোড়া মাছ, এলানগা, কচুয়া পুটি, বোল, চিতল, গজার, টেংরা, রিটা, গাঙ্গিনা বা চাকা মাছ, বট শিং, ঘাউড়া, সাল বাইম।

এছাড়া সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে বাও বাইম, চাপিলা, গুতুম, পুঁইয়া, পিয়াসি, জারুয়া বা উট্টি, ছেপ চেলা, গোফি চেলা, বাটা মাছ, নারু মাছ বা গনিয়া, কাচকি, ফলি, শিল বাইলা, বেলে, শিং, আইড়, বোয়াল, তেলি, কুইচ্চা মাছ, বামোস মাছ।

উপমহাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীতে এই বছর পূর্ণরূপে ডিম ছেড়েছে কার্প জাতীয় মা মাছ। আনুমানিক দেড় হাজার জেলে ও পোনা আহরণকারী প্রতিবছর এই সময়ের অপেক্ষায় থাকেন। জানা গেছে, মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি, নৌপুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে যৌথভাবে ডিম সংগ্রহ কার্যক্রমের তদারকি করা হয়। তারা জানান, মা মাছের ডিম ছাড়াকে কেন্দ্র করে হালদাপাড়ের মৎস্যজীবীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। এবার নদীপাড়ের প্রায় ৫৫০ জন ডিম সংগ্রহকারী প্রায় ২৫০টি নৌকা নিয়ে ডিম সংগ্রহ করছেন। জানা যায়, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার ৯৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হালদা নদীর অবস্থান। প্রতিবছর চৈত্র থেকে আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা অমাবস্যার তিথিতে বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের সঙ্গে পাহাড়ি ঢল নামলে নদীর মা মাছেরা ডিম ছাড়তে শুরু করে। এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষে একাধিকবারও ডিম ছাড়ে মা মাছ। বিশেষ ধরনের জাল দিয়ে এসব ডিম সংগ্রহ করা হয়। পরে সেগুলো থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে রেণু ফুটিয়ে সারা দেশে সরবরাহ করেন স্থানীয় জেলে ও পোনা ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিচার্স ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরিয়া জানান, এবারের মৌসুমে এর আগে দুই দফায় নমুনা ডিম ছাড়ে রুই, মৃগেল, কাতলা ও কালিবাউশ প্রজাতির মা মাছ। পরিবেশ অনুকূলে হওয়ায় গত ২৯ মে রাতে পূর্ণরূপে ডিম ছাড়ে। ২৯ মে’র রাত থেকে ৩০ মে দুপুর পর্যন্ত ১৪ হাজার কেজির মতো ডিম পাওয়া গেছে। কিছু জায়গায় প্রত্যাশার চেয়েও অধিক ডিম পাওয়া গেছে। আবার কিছু জায়গায় প্রত্যাশিত ডিম মেলে নি। নদীর পাড়ে স্থাপিত সরকারি-বেসরকারি হ্যাচারি ও ট্রেডিশনাল মাটির কুয়ায়-এসব ডিম পরিস্ফুটনে ব্যস্ত সময় পার করছেন মৎস্যজীবীরা।

কামাল উদ্দিন নামের একজন ডিম সংগ্রহকারী বলেন, “সারা বছর আমরা এই সময়টার অপেক্ষায় থাকি। এসব ডিম আমাদের কাছে স্বর্ণের চেয়েও দামি।”

বাংলাদেশ ২০০৯ সালে প্রায় ৬৭,০০০ টন ছোট মাছ উৎপাদন করেছিল, চাষ প্রসারের সুবাদে ২০২১ সালে তা বেড়ে ২,৬১,০০০ টন হয়েছে।

মাছ উচ্চমানের প্রোটিন, ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’, ‘ফসফরাস’, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম এবং আয়োডিনসহ বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন এবং খনিজ সরবরাহ করে। এগুলো অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিডের একটি মূল্যবান উৎস ও এই প্রোটিন সহজেই হজমযোগ্য।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত তিন দশকে বাংলাদেশের মাছের উৎপাদন ছয়গুণ বেড়েছে। ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে দেশে মাত্র ৭.৫৪ লাখ টন মাছ উৎপাদিত হয়েছিল, অন্যদিকে ২০২০-২১ সালে এই পরিমাণ ৪৬.২১ লাখ টন ছাড়িয়েছে।

২০২০-২১ সালে, বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদের দিক থেকে বিশ্বব্যাপী তৃতীয় অবস্থানে ছিল, প্রায় ২০ মিলিয়ন টন মাছ আহরণ করে এবং দেশের জিডিপিতে ৩.৫৭% অবদান রাখে।

বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী ৫০টিরও বেশি দেশে মাছ ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে আসছে, ২০২১-২২ সালে মোট ৫৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১%-এর বেশি।

দেশে প্রায় ২ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাছ চাষে সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশে মাছের চাহিদা প্রতি বছর প্রায় ৪২ লাখ টন। উপরোক্ত তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করলে সহজেই বুঝা যায় মৎস্য সম্পদ আমাদের জাতীয় জীবনে, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে কতো বড় ভুমিকা রাখছে। তাই জাতীয় স্বার্থে বিলুপ্তপ্রায় আমাদের সকল ধরনের দেশীয় প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন-সক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, কারেন্ট জালের ব্যবহার এবং মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করা বন্ধ করতে হবে।

অনেকে মনে করেন, বিদেশি মাছের চাষের কারণেও দেশি প্রজাতির মাছ কমে গেছে। এখানে তেলাপিয়া, কার্পজাতীয় মাছ আনা হয়েছে, আবার এক সময় আফ্রিকান মাগুর আনা হয়েছিল। কয়েক বছর আগে আনা হলো পিরানহা-এগুলো দেশি মাছের খাবার ও বাসস্থল দখল করত। অনেক সময় দেশি মাছ খেয়ে ফেলতো কোনো কোনো বিদেশি প্রজাতি।

তবে অনেকের ধারণা, যদি সরকার থেকে এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা দেশিয় মাছ সংরক্ষণে টেকশই উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং যারা মাছ চাষে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন তাদের যদি দেশিয় প্রজাতির মাছ চাষে আগ্রহী করে তোলা যায় তাহলে হয়তো-বা বিপন্ন এই মাছগুলোকে রক্ষা করা যাবে। প্রাকৃতিক উপায়ে দেশিয় মাছের সংরক্ষণ ও উৎপাদন বাড়াতে হলে আমাদের দেশের নদীনালা, খালবিল ও জলাশয়গুলোর পানি দূষণ সরকারকে কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিলুপ্তপ্রায় সকল দেশীয় জাতের মাছগুলোকে মৎস্য গবেষণাগারে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মাছের পোনাগুলো জরুরি ভিত্তিতে নদীসহ সকল প্রাকৃতিক জলাশয় লোতে অবমুক্ত করতে হবে। তাহলে হারিয়ে যাওয়া মাছগুলো আবার প্রকৃতিতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে অনেক মৎসবিজ্ঞানী অভিমত দিয়েছেন।

 

Leave a Reply

Your identity will not be published.