শাফিন, বিদায়!

শাফিন, বিদায়!

শাফিন আহমেদ। মাইলস ব্যান্ডের প্রাণপুরুষ। এ দেশের এক প্রথিতযশা রকস্টার। ২৫ জুলাই সকালে আমেরিকার ভার্জিনিয়ার সেন্টার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৩০ জুলাই তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়, বাবার কবরে।

শাফিনের বাবা কমল দাশগুপ্ত (কামাল উদ্দিন আহমেদ), ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক। মা প্রথিতযশা নজরুলসংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগম। তাঁরা পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন ১৯৫৫ সালে। তাঁদের তিন সন্তান তাহসীন আহমেদ, হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদ। 

শাফিনের জন্ম কলকাতায়, ১৯৬১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। তাঁর শৈশব কেটেছে কলকাতার অ্যান্টনিবাগান লেনে। বাবার কাছে শিখেছেন উচ্চাঙ্গ সংগীত ও তবলা, মায়ের কাছে নজরুলসংগীত। নয় বছর বয়সে তিনি নজরুলের শিশুতোষ গান ‘প্রজাপতি প্রজাপতি’ রেকর্ড করেন। কিন্তু পারিবারিক এই সুরধারায় নিজেকে বেশিদিন বন্দি রাখেন নি শাফিন। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ঝুঁকে পড়েন পাশ্চাত্য সংগীতের প্রতি। হাতে তুলে নেন গিটার। এ প্রসঙ্গে ১৯৯৭ সালে অন্যদিন-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে শাফিন বলেছিলেন, “আমি কী করতে চাই, কোন ধরনের শ্রোতাদের কাছে আমার গান ছড়িয়ে দিতে চাই, শিল্পী হিসেবে এটা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আমার থাকা উচিত। আমি আসলে আমার মতো করে কিছু সৃষ্টি করতে চেয়েছি প্রচলিত ধারার বাইরে কিছু। এ জন্যই ওয়েস্টার্ন মিউজিকের দিকে ঝুঁকে পড়া। এই ধারার মধ্যে আমার সৃষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে। নতুন এই ধারার সঙ্গে এ দেশের মানুষকে পরিচিত করতে পেরেছি।...এটাকে জয় বলতেই হবে।”

মনোজিৎ দাশগুপ্ত থেকে শাফিন
ছেলেবেলায় শাফিনের নাম ছিল মনোজিৎ দাশগুপ্ত। এরপর স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় তার নামের পরিবর্তন ঘটে। মনোজিৎ দাশগুপ্ত থেকে তিনি হয়ে যান শাফিন আহমেদ। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “জন্ম যেহেতু কলকাতায়, আমরা জানি যে, ভারতবর্ষ যখন স্বাধীন হলো, তখন হিন্দু-মুসলিমের মাঝে যে দূরত্ব বা বিবাদ, সেই সময়ে তা প্রবল ছিল। সেখান থেকেই কিন্তু দুটো দেশের জন্ম ভারত ও পাকিস্তানের। তো ভারতে থাকালীন অবস্থায় কমল দাশগুপ্তের মতো একজন সংগীত ব্যক্তিত্বের সন্তান তো দাশগুপ্ত নামেই পরিচিত হবে। এটাই স্বাভাবিক। এটা দাশগুপ্তের কথা বললাম, আর প্রথম অংশ এসেছে বাবা-মায়ের দেয়া নাম থেকেই। সেভাবেই মনোজিৎ দাশগুপ্ত।”

এক সময় শাফিনদের পরিবার এদেশে চলে আসেন।

প্রসঙ্গ মাইলস
শাফিনের পাশ্চাত্য সংগীতের প্রতি ভালোবাসার কথা তো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সত্তর দশকের শেষ পর্যায়ে তিনি ইংরেজি গানের চর্চা করতেন বন্ধুদের সঙ্গে, ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোডের একটি রেস্তোঁরায়। ১৯৭৭ সালে শাফিন ‘ব্যারক’ নামের একটি ব্যান্ডও গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু সেটি দাঁড়াতে পারে নি। 

১৯৭৯ সালের আগস্টে ফরিদ রশিদ গড়ে তোলেন মাইলস। মাইলস বলতে সীমাহীন বা অসীম একটি অবস্থা বোঝায়। সংগীতের যেহেতু শেষ নেই সেহেতু ব্যান্ডের নাম মাইলস রাখাই ঠিক মনে করেছিলেন ফরিদ রশিদসহ মাইলসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা। 

আশির দশকের শুরুতে মাইলসে যোগ দেন শাফিন ও তাঁর ভাই হামিন আহমেদ। সেই সময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালসহ বিভিন্ন কনসার্টে ইংরেজি গানই করতেন তারা। তখন মাইলসের দুটি ইংরেজি অ্যালবামও প্রকাশিত হয়েছিল মাইলস (সেল্ফ টাইটেলড, ১৯৮২) এবং আ স্টেপ ফারদার (১৯৮৬)। এক সময় মাইলস বাংলা গানের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। আর সেটি দুটি কারণে। এক, মাইলসের গান ব্যাপকভাবে শ্রোতাদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া এবং শ্রোতাদের অনুরোধের প্রতি সম্মান জানানো। কেননা তারা ক্রমাগতই মাইলসের সদস্যদের বলছিলেন, ‘আপনারা বাংলা গান করছেন না কেন?’ ফলে বিভিন্ন কনসার্টে বাংলা গান পরিবেশনের পাশাপাশি একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে মাইলসের অ্যালবাম প্রতিশ্রতি (১৯৯১), প্রত্যাশা (১৯৯৩), প্রত্যয় (১৯৯৬), প্রয়াস (১৯৯৭), প্রবাহ (২০০০)...। 

মাইলসের হয়ে ভাই হামিনসহ শাফিন উপহার দিয়েছেন বাংলা ব্যান্ডের বেশ কয়েকটি কালজয়ী গান। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চাঁদ তারা সূর্য নও তুমি, গুঞ্জন শুনি, সে কোন দরদিয়া, ধিকি ধিকি, পাহাড়ি মেয়ে, নীলা, প্রথম প্রেমের মতো, কতকাল খুঁজবো তোমায়, হৃদয়হীনা, স্বপ্নভঙ্গ, শেষ ঠিকানা, পিয়াসী মন, বলবো না তোমাকে, প্রিয়তমা মেঘ...। এসব গানে শাফিনের গায়কি অসাধারণ। বেশ মাপা। কোন জায়গাটা ছাড়তে হবে, কোন জায়গাটা ধরতে হবে, তা তিনি ভালোভাবে বুঝতেন। তা ছাড়া গান গাওয়াটা শুধু সুর ও ছন্দ নয়, এর বাইরেও কিছু বিষয় রয়েছে সেটিও শাফিনের কণ্ঠে রয়েছে। যেমন, কোন জায়গায় কোন অভিব্যক্তি দিতে হবে, এ ব্যাপারেও  শাফিন ছিলেন অসাধারণ।  বলা যায়, সেই সময়ের ব্যান্ড মিউজিকে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন তিনি। 

মাইলসে শাফিন আহমেদ আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলেন। প্রথমবার ২০১০ সালে মাইলস ছাড়েন তিনি। কয়েক মাস পর ফিরে আসেন। আবার ২০১৭ সালে মাইলস ছাড়েন। পরে আবার ফিরে আসেন। ২০২১ সালে শেষবারের মতো শাফিন মাইলস ত্যাগ করেন। 

২০১০ সালে ‘রিদম অব লাইফ’ নামে একটি ব্যান্ড গড়ে তুলেছিলেন শাফিন আহমেদ। সেটি অবশ্য বেশিদূর এগোয় নি। জীবনের শেষ পর্যায়ে ‘ভয়েস অব মাইলস’ গঠন করে কনসার্ট করে আসছিলেন তিনি। 

কয়েকটি একক অ্যালবামও শাফিন আহমেদ বের করেন, যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ‘আজ জন্মদিন তোমার’. ‘কী করে সব ভুলে যাই’সহ তার এ রকম বেশ কয়েকটি স্মরণীয় গান  রয়েছে।  এ ছাড়া বাবা কমল দাশগুপ্তের কয়েকটি গান নিয়েও একক অ্যালবাম প্রকাশ করেছিলেন শাফিন।

প্রথম একক অ্যালবাম ‘তোমাকে’ (১৯৯৭) প্রকাশের পর এক সাক্ষাৎকারে অন্যদিনকে তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “এমন পরিকল্পনা আমার অনেক আগে থেকেই ছিল। শিল্পী হিসেবে আমি সব ধরনের গান করতেই সক্ষম, সলো অ্যালবাম করে সেটাই প্রকাশ করতে চেয়েছি।” শাফিনের এই একক অ্যালবামে মাইলস তথা ব্যান্ডের ফ্লেভার ছিল না। 

লোকসংগীত ও চিরায়ত গানে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার
দেশের অনেক ব্যান্ডই লোকসংগীত নিয়ে কাজ করেছে। কিন্তু মাইলসকে কখনো এ ধরনের কাজ করতে দেখা যায় নি। এ প্রসঙ্গে ২০০২ সালে এক সাক্ষাৎকারে অন্যদিন-এর কাছে নিজের মতামত জানিয়েছিলেন শাফিন আহমেদ। তিনি বলেছিলেন, “এখানে একটা অনেস্টির ব্যাপার আছে। মিউজিকের মধ্যে অনেক ধারা আছে, স্টাইল আছে। এখন যে যেটা বেছে নেবে সেটা অনেস্টলি করতে হবে। কারণ আমাদের লাইফস্টাইলের সঙ্গে যদি গানের সাবজেক্ট না মেলে, তাহলে তা কিছুতেই ন্যাচারাল হবে না। এটা নিয়ে একবার-দুবার এক্সপেরিমেন্ট করা যায়, কিন্তু এটা নিয়ে বড় ধরনের কাজ করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে আমার মনে হয় না।”

অন্যদিকে চিরায়ত গানে আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার প্রসঙ্গে শাফিনের ভাষ্য ছিল, “মিউজিক নিয়ে যদি এক্সপেরিমেন্ট করা না হতো তাহলে সংগীত একটা জায়গায় স্থির হয়ে পড়ত। মাইলস সব সময় এক্সপেরিমেন্টে বিশ্বাসী। কিছুদিন আগে আমাদের বাবা কমল দাশগুপ্তের কিছু গান আমরা কম্পোজ করেছিলাম। যা বেশ প্রশংসিত হয়েছিল।...রবীন্দ্র বা নজরুলসংগীতে মডার্ন ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার করা যেতেই পারে। তবে এক্ষেত্রে মূল সুর ঠিক রাখতে হবে। এই ধরনের মিক্সিংয়ের কাজটি তাদেরই করা উচিত, যারা মূল সুরটি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন।”

ক্রিকেট ও রাজনীতি
গানের বাইরে শাফিন আহমেদের ক্রিকেটের প্রতি অনুরাগ ছিল। ক্লাব পর্যায়ে তিনি ক্রিকেট খেলেছেনও। মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করতেন, অফ স্পিনার ছিলেন।
রাজনীতির সঙ্গেও শাফিনের সম্পৃক্ততা ছিল। ২০১৭ সালে তিনি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যোগ দেন। ২০১৮ সালে যুক্ত হন জাতীয় পার্টির সঙ্গে। দুই দলেই গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন শাফিন। 

সতীর্থদের মূল্যায়ন:
শাফিনকে নিয়ে সংগীত জগতের অনেকেই নানা মন্তব্য করেছেন। তাঁদের কয়েকজনের কথা এখানে তুলে ধরা হলো।

হামিন আহমেদ
কোনো শর্টকাট পদ্ধতি নয়, সব সময় একদম ঠিকমতো ডিটেইলস কাজে বিশ্বাসী ছিল শাফিন। গায়ক, গীতিকার এবং বেজ প্লেয়ার হিসেবে সে পৃথিবীর যে কেউ, যে বা যারা ভালো কাজ করেছে তাদের সমান। এখানে দ্বিতীয় কোনো কথা নেই।

মাকসুদুল হক
শাফিন  আহমেদের প্রাণশক্তি সাংঘাতিক, অবাক করার মতো। মঞ্চে পরিবেশনায় সেটার ছাপ দেখা যায়। ব্যান্ড সংগীতে ওকে কিংবদন্তি হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

জেমস
‘চাঁদ তারা সূর্য নও তুমি, নও পাহাড়ি ঝরনা/ যদি বলি ফুল তবুও হবে ভুল, তোমার তুলনা হয় না।’

শুভ্র দেব
যত দিন বাংলা গান থাকবে, এই বাংলাদেশ বা বিশ্বের মানুষ বাংলা গান শুনবেন, ততদিন শাফিন আহমেদ বেঁচে থাকবেন। গানে গানে তিনি তাঁর অস্তিত্বের জানান দেবেন।

মিলু আমান
একই সঙ্গে বেজ বাজানো ও গান গাওয়া কঠিন বিষয়। সেটা উনি (শাফিন) স্বচ্ছন্দে করে গেছেন। গান যেমন তাল ধরে চলে, বেজ গিটারও তা-ই।

হাসান
শাফিন ভাইকে অনুসরণ করেই সুর করা শুরু করি। আমার ভালোলাগার একজন মানুষ ছিলেন তিনি। শাফিন ভাই ছিলেন অনুকরণীয় সংগীত ব্যক্তিত্ব। আইয়ুব বাচ্চু আমার কাছে যেমন ছিলেন, শাফিন ভাইও তেমন। মিউিজিশিয়ান হিসেবে ছিলেন মাস্টার। শিল্পী হিসেবে স্টাইলিস্ট। তাঁর গাওয়ার ধরন একেবারেই ইউনিক।

শওকত আলী ইমন
বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে অসাধারণ কিছু অবদান তিনি দিয়ে গিয়েছেন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তাঁর গান শুনবে, মাইলসের গান শুনবে। 

ঘাসের নিচে শাফিন 
এখন শাফিন বনানী কবরস্থানের ঘাসের নিচে শুয়ে আছেন, বাবার কবরে। পাশেই মায়ের কবর। গতকাল ৩০ জুলাই, বিকেলে, জীবনের এই শেষ ঠিকানায় আশ্রয় নেন শাফিন।

Leave a Reply

Your identity will not be published.