একে একে নিভছে দেউটি। চিত্রনায়িকা কবরীর পরে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন চিত্রনায়ক ওয়াসিমও।
আসলে বেশ কিছুদিন ধরে নানা অসুখে ভুগছিলেন ওয়াসিম। অসুস্থ অবস্থায়ই শনিবার (১৭ এপ্রিল) রাজধানীর শাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁকে নেওয়া হয় এবং সেখানেই রাত সাড়ে বারোটায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ওয়াসিমের প্রকৃত নাম মেসবাহ উদ্দীন আহমেদ। ১৯৪৭ সালের ২৩ মার্চ তিনি চাঁদপুর জেলার আমিরাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক ভিটা কুমিল্লায় হলেও তিনি বড় হয়েছেন ঢাকাতেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক এই মানুষটির ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ ছিল। শরীরচর্চার প্রতি ঝোঁক ছিল। ১৯৬৪ সালে বডি বিল্ডার হিসেবে এক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তিনি ‘মি. ইস্ট পাকিস্তান’ খেতাব পান।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে ওয়াসিমের প্রবেশ পরিচালক এস এম শফির হাত ধরে। শফির ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’ চলচ্চিত্রে ওয়াসিম ছিলেন সহকারী পরিচালক। এই ছবিতে একটি ছোট্ট চরিত্রে তিনি অভিনয়ও করেছিলেন।
নায়ক হিসেবে রুপালি পর্দায় ওয়াসিম আবির্ভূত হন ১৯৭৩ সালে, মোহসীন পরিচালিত ‘রাতের পর দিন’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এই ছবির ভীতু থেকে সাহসীতে রূপান্তরিত গ্রাম্য এক যুবকের চরিত্রে ওয়াসিমের অভিনয় দর্শক-আনুকূল্য লাভ করে। ‘ডাকু মনসুর’ মুক্তি পাবার পর পোশাকি ছবির জগতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন ওয়াসিম। এক সময় পোশাকি ছবির ব্যবসায় ভাটা দেখা দিলে ওয়াসিম কিছুটা বেকায়দায় পড়ে যান। কিন্তু আশির দশকের শুরুতে ‘বিনি সুতোর মালা’ ব্যবসা সফল হলে সামাজিক ছবিতে আবার ব্যস্ততা বেড়ে যায় ওয়াসিমের। অবশ্য এই রমরমা অবস্থা বেশিদিন টেকসই হয় নি। ক্রমশ ওয়াসিম চলচ্চিত্র জগৎ থেকে নির্বাসিত হন।
ওয়াসিম অভিনীত চলচ্চিত্রের সংখ্যা শতাধিক। ‘দি রেইন’-এর ভাবুক শিল্পী, ‘বিনি সুতোর মালা’র প্রেমিক যুবক, ‘শিরি ফরহাদ’-এ ফরহাদ ওয়াসিমের অভিনয় সমৃদ্ধ কয়েকটি চরিত্র। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য চলচ্চিত্র হচ্ছে দোস্ত দুশমন, গুনাহগার, ঈমান, কুদরত, প্রাণ সজনী, কে আসল কে নকল, বাহাদুর, আসামী হাজির, জীবন সাথী, রাজমহল, মহেশখালীর বাঁকে, বারুদ, বেদ্বীন, লুটেরা, আবে হায়াত, সওদাগর, বানজারান, নরম গরম, লাল মেম সাহেব, তুফান, রাজনন্দিনী।
ওয়াসিমকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করে তোলে এস এম শফি পরিচালিত ‘দি রেইন’ বা ‘যখন বৃষ্টি এল’ চলচ্চিত্রটি। ছবিটি বাংলা ভাষায় নির্মিত হলেও পরে আরও ছয়টি ভাষায় ডাব করা হয়েছিল। মুক্তি পেয়েছিল ৪৬টি দেশে। এই ছবিতে ওয়াসিমের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন অলিভিয়া। এই নায়িকার সঙ্গে ওয়াসিম অভিনীত ‘বাহাদুর’, ‘লুটেরা’, ‘লাল মেম সাহেব’ ছবিগুলিও ব্যবসাসফল হয়েছিল। শাবানার সঙ্গেও ওয়াসিমকে দর্শকরা পছন্দ করেছিল। এছাড়া ববিতা, অঞ্জনা, কল্পনা, রোজিনা, সুচরিতাসহ সত্তর ও আশির দশকের প্রায় সব নায়িকার বিপরীতেই ওয়াসিম আভিনয় করেছিলেন। তবে অঞ্জু ঘোষের সঙ্গে একের পর এক চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সূত্রে একটি জুটি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি।
ওয়াসিমের ইতিবাচক দিক ছিল, উচ্চতা। তাঁর ফিগারও ছিল চমৎকার। পোশাকি-অ্যাকশন ঘরানার চলচ্চিত্রের জন্য বিশেষভাবে মানানসই। নেতিবাচক দিক হলো, সংলাপ প্রক্ষেপণে ত্রুটি। তাঁকে দক্ষ অভিনেতা বলা যাবে না। দূরদর্শিতা আর বিচক্ষণতার দিক থেকেও তিনি সুবিবেচনার পরিচয় দিতে পারেন নি।
ওয়াসিম প্রযোজক হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর প্রযোজিত ছবিগুলো হলো: হিসাব চাই, নয়া তুফান, মোহন বাঁশি। তবে এইসব ছবি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়লে ওয়াসিমের প্রযোজনা সংস্থা ডব্লিউ আর প্রোডাকশনে লাল বাতি জ্বলে ওঠে।
ওয়াসিম বিয়ে করেছিলেন নায়িকা রোজীর ছোট বোনকে। তার স্ত্রীর ২০০০ সালে আকস্মিক মৃত্যু হলে ওয়াসিম প্রচণ্ড আঘাত পান। আর ২০০৬ সালে স্কুল পড়ুয়া চৌদ্দ বছর বয়সী মেয়ে বুশরা আত্মহত্যা করলে তিনি একেবারে ভেঙে পড়ন। তাঁর একমাত্র পুত্র দেওয়ান ফারদিন অবশ্য সফল আইন ব্যবসায়ী।
বনানী কবরস্থানে ওয়াসিম চিরনিদ্রায় শায়িত। ব্যক্তিগত জীবনে দুঃখী এই মানুষটি অন্য ভুবনে শান্তি লাভ করুন, স্রষ্টার কাছে এই আমাদের প্রার্থনা।
Leave a Reply
Your identity will not be published.