শম্পা কী চায়? (অষ্টম পর্ব)

শম্পা কী চায়? (অষ্টম পর্ব)

[থ্রিলার উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রতি পদে রহস্য ও রোমাঞ্চের হাতছানি। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার জাহিদ আহমেদ। ঢাকার রেডিসন হোটেলে শম্পা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানের একটি রুমে শম্পার সঙ্গে যাওয়ার পর কী ঘটে, তা জাহিদের মনে নেই। এরপর শম্পা জাহিদের ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজির ছাত্রী সেজে তার পিছু নেয়, অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওর ভয় দেখিয়ে  ব্ল্যাকমেইলিং করতে থাকে...। এক সময় শম্পা খুন হয়। কে খুন করল শম্পাকে? জাহিদ আহমেদ নাকি অন্য কেউ? নাকি অন্য রহস্য জড়িয়ে আছে এখানে? আজ পড়ুন অষ্টম পর্ব।]

শম্পার সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ ভিডিও লিক হয়ে গেছে। আমার ছাত্রছাত্রী আর কলিগরা নিশ্চয় এখন ছি ছি করছে। আমার আর কোনো মানসম্মান রইল না।

আমি মেঘনা ব্রিজের রেলিংয়ের ওপর ইলেক্ট্রিক পিলার ধরে দাঁড়িয়ে আছি। যে-কোনো মুহূর্তে নিচে ঝাঁপ দেব।

ব্রিজের নিচে একটা ছোট লঞ্চ ঢেউ ভেঙে এগোচ্ছে। লঞ্চের ভেতর থেকে ব্যান্ডপার্টির আওয়াজ আসছে। বোধহয় বিয়ে শেষে বউ নিয়ে ঘরে ফিরছে বরযাত্রী। আমার কাছে এসব মিলনোৎসব এখন অর্থহীন। আমি শুধু শেষবারের মতো প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি।

এই প্রথম টের পাচ্ছি কেবল সাফল্যই না, পাপও মানুষকে নিঃসঙ্গ করে।

হঠাৎ মিলির ফোন এল। মিলির জন্য মনটা খুব আনচান করছিল। আহারে আমার মেয়েটা! ছোটবেলা থেকে নিজের হাতে মিলিকে বড় করেছি। সবাই বলে বাবার মেয়ে, ড্যাডিজ গার্ল। সেই মিলিকে রেখে আমাকে পাড়ি জমাতে হবে অসীম, অনন্তে। আমি না থাকলে ও শোক সামলাতে পারবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু আমার মতো কদর্য বাবা যে ওর জীবনে লজ্জা আর কালিমা বয়ে আনবে। আমি ফোন উঠিয়ে বললাম, কী ব্যাপার মা?

বাবা তুমি কোথায়? মা ফোন করতে করতে হয়রান হয়ে গেছে।

আমার চোখ ভিজে গেল, গলা দিয়ে কান্না বেরিয়ে এল। কোনোরকমে নিজেকে সংযত করে বললাম, আমি একটু ব্যস্ত মা, অনেকগুলো ক্লাস টেস্টের মার্ক আজকের ভেতর জমা দিতে হবে।

তাহলে তুমি কোনো খবরই পাও নি?

আমি চুপ করে থাকলাম। যেই কঠিন সত্য এড়ানোর জন্য ব্রিজে এসে দাঁড়িয়েছি এখন সেই সত্যের মুখোমুখি হলাম। নিজের মেয়ের মুখে শুনতে হবে নিজের অধঃপতনের কাহিনি। মনে হচ্ছে আর কথা না বাড়াই, এখনই মেঘনায় ঝাঁপ দিই। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে মিলি বলল, বাবা, তুমি তো বিরাট সেলেব্রেটি হয়ে গেছ। চারদিকে সবাই তোমার প্রশংসা করছে।

মিলির কথা শুনে আমি থ হয়ে গেলাম। মিলি তো নিষ্ঠুর মশকরা করবার মেয়ে না। সে তার মায়ের মতো হয়েছে। বললাম, তোর কথা বুঝলাম না মা।

তুমি যে এক সাংবাদিকের কাছে প্রোভাইস চ্যান্সেলরের চুরিচামারির কাহিনি ফাঁস করেছ, সেই ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে। আমার বান্ধবীরা পর্যন্ত আমাকে ফোন করেছে। তুমি যে এত বোল্ডলি তথ্য প্রমাণসহ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলবে ভাবাই যায় না বাবা। আই অ্যাম সো প্রাউড অফ ইউ। তুমি দ্যাখো নি ভিডিও?

না, সারা দিন ব্যস্ত ছিলাম, মা। খাতা থেকে চোখ সরাতে পারি নি।

দাঁড়াও তোমাকে লিংক পাঠাচ্ছি।

মাসখানেক আগে বিখ্যাত অনুসন্ধানী সাংবাদিক নুজহাত ফারহানা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। ওনাকে বোধহয় কেউ বলেছিল আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক হাঁড়ির খবর জানি। ওনাকে আমি নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটা দীর্ঘ অডিও সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, ছাত্রভর্তি এবং যে-কোনো নির্মাণ কাজের ঠিকাদারিতে যে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয় তার খোলামেলা আলাপ করেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে ওই মহিলা পুরো সাক্ষাৎকারের গোপনে ভিডিও রেকর্ড করে পাবলিক ডোমেইনে ছেড়ে দিয়েছেন। এই মুহূর্তে সেটাই মন্দের ভালো। আমি কম্পিত কণ্ঠে মিলিকে বললাম, মিলি, আমি তোকে একটু পর ফোন দিচ্ছি। ভিডিওটা দেখে নিই। তোর মাকে বলিস আমার ফিরতে আরও ঘণ্টা দেড়েক লাগবে।

আমি ফোন রেখে ভিডিও লিঙ্ক ওপেন করলাম। আমার আর নুজহাতের কথোপকথন ভেসে এল, আপনি বলতে চাচ্ছেন দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠের প্রোভাইস চ্যান্সেলর এসব চুরি সম্পর্কে অবগত কিন্তু উনি অপরাধ থামানোর ব্যবস্থা নেন নি?

আমি যে ডকুমেন্টস আপনাকে দিয়েছি সেগুলো পড়লে বুঝবেন প্রোভিসি হলেন চোরের রাজা। এদের জন্যই জামাল নজরুল ইসলামের মতো বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিভেন হকিংসের সাথে কাজ করেও এখানে চাকুরি পান নাই।

লম্বা ভিডিও, আমি জানি আমি কী বলেছি। পুরো না দেখেই আমি ভিডিওটা বন্ধ করলাম। বুঝলাম কেন ভিসি সাহেব আমাকে হন্য হয়ে খুঁজছিলেন। কেন তিনি ভাবছিলেন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপিউটেশন ড্যামেজ করেছি।

আমার মারুতি গাড়িটা ব্রিজের ফুটপাথের ওপর একদিকে খানিকটা উঠিয়ে রেখেছিলাম। অন্য গাড়িগুলো অনেক কষ্টে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে, কেউ রেগে হর্ন দিচ্ছে, কেউ আবার আমার ভাও বোঝার চেষ্টা করছে।

আমি রেলিং থেকে নেমে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠলাম। এখন গাড়ি ঘুরাতে হলে মেঘনা ব্রিজ অতিক্রম করতে হবে। আর কোনো উপায় নাই। ভাগ্য ভালো যে এখন ব্রিজে খুব বেশি ট্রাফিক নেই। জোরে টান মেরে ব্রিজের শেষ মাথা ঘুরে এলাম। ফেরার পথে মেঘনা বাজারের কাছে একটা টংয়ের দোকানের পাশে গাড়ি থামালাম। নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার আগে খুব ইচ্ছে করছিল রাস্তার ডালপুরি আর বাদাম দেওয়া সিঙাড়া খেতে। টংয়ের দোকান বড় কড়াইয়ে ডালপুরি ভাজছিল। আমি মনের সাধ মিটিয়ে বিশটা ডালপুরি কিনলাম। সিঙাড়া কোথাও পেলাম না।

এক কাপ চা খেয়ে আবার গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি কিছুদূর যাওয়ার পর কাগজের ঠোঙা থেকে একটা ডালপুরি বের করে কামড় বসালাম। মনে হলো আহা কী অমৃত! এর মাঝে টুং করে শম্পার মেসেজ এল। শম্পা লিখেছে, ‘ওএমজি চান্দু, ইউ হ্যাভ বিকাম অ্যা সেলেব্রিটি ফর অল দা রঙ রিজনস।’

এক ঘণ্টা পর বাড়ি ফিরতেই বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকরা আমাকে ঘিরে ধরল। ববকাট চুলের বিখ্যাত সাংবাদিক তিন্নি সাহা মাইক্রোফোন এগিয়ে দিয়ে বললেন, প্রফেসর সাহেব, এখনকার দিনে বেশির ভাগ শিক্ষক লোভী, চতুর এবং কাপুরুষ। সেখানে এমন নির্ভীক সত্য প্রকাশের সৎ সাহস আপনি কোথায় পেলেন?

আমি হেসে বললাম, ইংরেজি সাহিত্য।

তিন্নি সাহা অবাক হয়ে বললেন, ইংরেজি সাহিত্য?

টু বি মোর প্রিসাইস, কবি কিটস।

কবি কিটস আপনাকে সত্যবাদী হতে শিখিয়েছেন?

জি, যখন কিটস বললেন,

Beauty is truth, truth beauty,—that is all

Ye know on earth, and all ye need to know.

‘সুন্দরই সত্য, আর সত্য বাজে মধুর সংগীতে

এই কথা জেনে রেখো এ ধরিত্রিতে’

উপস্থিত সাংবাদিকেরা আনন্দে উত্তেজনায় হাততালি দেওয়া আরম্ভ করল। জাতি বোধহয় নতুন ধরনের হিরো পেল যে আবার ইংরেজি সাহিত্য পড়ায়। আমি ভিড় আর করতালি কাটিয়ে ঘরে ঢুকতেই রোকসানা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, জাহিদ, কী যে ভালো লাগছে আমার! মাইন্ড কোরো না প্লিজ, তোমাকে একটা কথা বলি?

কী কথা?

বেশ কদিন ধরে তোমাক কেমন চোর চোর লাগছিল। মনে হচ্ছিল কী একটা লুকোচ্ছ। এখন আমি বুঝলাম তুমি একটা সততা লুকানোর ছুপা রুস্তম। কেউ কি নিজের মহৎ কাজ এভাবে লুকোয়?

রোকসানার কথার মাঝে শম্পার টেক্সট এল। আমি আড় চোখে ফোনের ডিসপ্লেতে দেখলাম শম্পা লিখেছে, চান্দু, আসল ভিডিওটা ছেড়ে দিলে এখন হেভভি জমবে।

আমি ফোনটা সুইচ অফ করে রোকসানার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, থ্যাঙ্কিউ রুকিমণি। আই জাস্ট ট্রাই মাই বেস্ট টু বি অ্যা গুড পারসন।

আসলে কী জানো, সব স্ত্রীই চায় এরকম একজন সৎ, সাহসী আর নির্ভীক স্বামী। আই ফিল সো প্রাউড অফ ইউ জাহিদ।

সেদিনের তারাভরা রাতটা কাটল অতিরিক্ত আদর, সোহাগ আর দুষ্টু আহ্লাদে।

পরদিন ভোরে টিপটপ জামাকাপড় পরে লেকচার হলে এসে দেখলাম স্টুডেন্টরা ভীষণ উত্তেজিত। ক্লাসের ভেতরে গমগমে ভাব। আমার ভিডিওর কারণে একটু আগে দুর্নীতিবাজ প্রোভিসি পদত্যাগ করেছেন। সেই নিউজ চারিদিকে চাউর হয়ে গেছে। তাদের কুলেস্ট প্রফেসর যে এখন একজন ন্যাশনাল সেলেব্রেটি, এটা যেন তাদেরই গৌরব।

আমি আড়চোখে মেয়েগুলোর দিকে তাকালাম। ওমা ওরা দেখি আজ অতিরিক্ত সাজুগুজু করে এসেছে। কারও ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, কারও গালে গোলাপি ব্লাশন, কারও কাজল টানা চোখ যেন দিঘির টলমলে জল, কেউ আবার রিভিলিং জামা পরে ভিন্ন ইঙ্গিত করছে নাকি? কারও কারও মুখ এত মসৃণ মনে হয় ওরা সকালে উপটান মাখিয়ে মুখ ধুয়েছে, এ কারণেই ওদের রূপ এত টানছে। আমি প্রসন্ন চিত্তে জলদমন্দ্র কণ্ঠে বললাম, তোমরা কি জানো শেক্সপিয়ারের অনেক সনেটের বিষয় ছিল মধ্যবয়সী পুরুষের সাথে নবযৌবনা মেয়েদের প্রেম?

মেয়েগুলো দেখলাম মুখ টিপে হাসছে। সেদিকে না তাকানোর ভাব করে বললাম, এই যেমন বাইশ নম্বর সনেটটি শোন, মডার্ন ইংলিশ ভার্সনে,

As long as you appear eternally young,

my mirror will not persuade me that I am old.

‘যতদিন তোমরা থাকবে উদ্ভিন্নযৌবনা,

আয়না যা’ই বলুক, আমিও বুড়ো হব না।’

মেয়েগুলোর মুগ্ধ দৃষ্টিসুধা মাত্র চোখের পাত্র দিয়ে পান করব এমন সময় ধুনধুনা শম্পার টেক্সট এল, হ্যালো ভেজা বেড়াল, আই আম ওয়াচিং ইউ। কাল সন্ধ্যায় অফিস শেষে আমার অ্যাপার্টমেন্টে আসবা। বাথরুমের কল সারাতে হবে। আপু জানে।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.