অন্যদিন-এর ‘শেকড়ের সন্ধানে’ বিভাগে তুলে ধরা হচ্ছে সাহিত্যস্রষ্টাদের ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবনের তথ্যসহ তাঁদের জন্মভিটার পরিচিতি। আজ থাকছেন ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন।
বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের গ্রামের নাম কয়া। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর গড়াই নদীর তীরবর্তী লাহিনীপাড়ায় কথাশিল্পী মীর মশাররফ হোসেনের বসতভিটা দর্শন শেষে আমাদের গন্তব্য শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রাম।
কয়া গ্রামটি কুষ্টিয়া জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। ব্রিটিশ সরকারের মন্ত্রী নিমাই ব্যারিস্টার, স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন) এবং প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম এই গ্রামে। আর জন্ম এমন একজন আলোকিত মানুষের, যিনি আপন কর্মের আলোয় আরও উদ্ভাসিত করেছেন নিজ গ্রামের ইতিহাসকে। তিনি কথাসাহিত্যিক আকবর হোসেন। ১৯১৫ সালের ৩১ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
রিকশায় পরিচিত পথে যেতে থাকি আমরা। লাহিনীপাড়া পার হওয়ার পরে পথে পড়ল একটি অসমাপ্ত ব্রিজ। রিকশা ছেড়ে দিয়ে আমরা ব্রিজের নিচের দিকে হাঁটতে থাকি। কিছুক্ষণ পরে পৌঁছে যাই গড়াই নদীর ধারে। ফেরিতে নদীটি পার হই। লক্ষ করি একটি যাত্রীবাহী বাসও রয়েছে। জানতে পারি, বাসটি আমাদের গন্তব্যপথেই যাচ্ছে। এক সময় আমরা পৌঁছে যাই শিলাইদহ মহকুমায়। তারপর ভ্যানগাড়িতে যেতে থাকি কয়া গ্রামের দিকে।
গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগোচ্ছে আমাদের ভ্যানগাড়িটি। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে ঘরবাড়িও চোখে পড়ে। এইসব স্থূলভাবে লক্ষ করলেই বোঝা যায় যে, এই অঞ্চলে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের জীবনধারায়ও এ সময়ের ছোঁয়া লেগেছে।
এক সময় আমাদের ভ্যানগাড়িটি প্রবেশ করে কয়া বাজারে। চারদিকে ছোট ছোট দোকান। পথ বড়ই সংকীর্ণ। ভ্যানগাড়ির চালক একটি দোকানের সামনে ভ্যানগাড়িটি রেখে, চেইনে তালা লাগিয়ে সামনে চাকাটি আবদ্ধ করে আমাদের সঙ্গে চলে।...স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞেস করে আমরা জানতে পারি যে, অদূরেই প্রয়াত আকবর হোসেনের পিতৃপুরুষের বসতভিটা। তার নির্দেশিত পথে অগ্রসর হতেই আমাদের চোখের সামনে পড়ে গড়াই নদী। লক্ষ করি, নদীর দুই পারে ধু-ধু বালির প্রান্তর ঝিকমিক করছে।...আমাদের চেতনায় একটি বিষয় রেখাপাত করে। সেটি হচ্ছে, এই পর্যন্ত যেসব লেখকের জন্মভূমিতে আমরা গিয়েছি— সেখানেই লক্ষ করেছি পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদ-নদী। মধুসূদনের জন্মভূমি সাগরদাঁড়িতে কপোতাক্ষ নদ, জসীমউদ্দীনের অম্বিকাপুরে পদ্মানদী, গোলাম মোস্তফার মনোহরপুরে কুমার নদী, মীর মশাররফ হোসেনর লাহিনীপাড়াতে গড়াই নদী। আর এখানে, আকবর হোসেনের কয়া গ্রামেও সেই গড়াই নদী।
গড়াই বা গৌরী নদীটি এই অঞ্চলের স্বনামধন্য বহু সাহিত্যিকের চিন্তা-চেতনায় বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। উল্লেখ্য, এই নদীটির জন্মকাহিনিই এক অসামান্য কিংবদন্তির উৎস। সেটি হচ্ছে, এক ব্রাক্ষণ গঙ্গা পূজার জন্যে রওয়ানা হলেন, তাঁর বাড়িতে কাজ করত গৌরী দাসী। ব্রাহ্মণের যাত্রাকালে গৌরী দাসী গঙ্গাকে স্তব করার জন্যে তার পক্ষ থেকে কিছু ফুল দেয়। গঙ্গ-পূজা সেরে ফেরার পথে ব্রাক্ষণের মনে হলো, গৌরী দাসীর দেয়া ফুল গঙ্গাকে নিবেদন করা হয় নি। অপরাধবোধে আক্রান্ত ব্রাহ্মণ পুনরায় ফিরলেন গঙ্গার দিকে। সামনে পড়ল এক গোস্পদ। গোস্পদে ছিল সামান্য জল। ব্রাহ্মণ নিবেদিত চিত্তে ওই জলেই বিসর্জন দিলেন ফুলগুলি। সঙ্গে সঙ্গে ঘটল বিস্ময়কর ঘটনা। গঙ্গাদেবী স্বয়ং আবির্ভূত হয়ে গ্রহণ করলেন ফুলগুলি! গঙ্গাদেবীর মুখের দিকে চেয়ে ব্রাহ্মণ দেখলেন, এ যে তারই বাড়ির গৌরী দাসী। অভিভূত ব্রাহ্মণ দ্রুত ছুটলেন বাড়ির পথে। বাড়ি পৌঁছে কর্মরতা গৌরী দাসীর পায়ে গড়িয়ে পড়লেন ব্রাহ্মণ। গৌরী দাসী সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন ব্রাহ্মণের বাড়ি ছেড়ে। ব্রাহ্মণও ছুটলেন গৌরী দাসীর পেছনে পেছনে। কিন্তু ব্রাহ্মণ জীবন দিয়েও গৌরীর নাগাল পেলেন না। গৌরীর পায়ে পায়ে উত্থিত হতে থাকল জলরাশি। সৃষ্টি হলো জলস্রোত। সেই জলস্রোতই আজকের গৌরী বা গড়াই নদী। গড়াই নদী সম্পর্কে এই কিংবদন্তি এই অঞ্চলের অনেক সাহিত্যিকই বিশ্বাস করতেন। এই নদী পুণ্যতোয়া, জলপানে সেরে যায় নানা দুরারোগ্য ব্যাধি—এই প্রচলিত লোকবিশ্বাসেও ছিল তাদের আস্থা।
গড়াই নদীকে ডানে রেখে আমরা উপস্থিত হই একটি বাড়ির সামনে। মাটি, বাঁশ, বেড়া ও টিন দিয়ে তৈরি বাড়িটির এক একটি ঘর। এই বাড়িটিই কথাসাহিত্যিক আকবর হোসেনের পৈতৃক ভিটা। যদিও প্রকৃতপক্ষে এখানে, এই কয়া গ্রামে আকবর হোসেনের পূর্বপুরুষদের আদি বাসস্থান ছিল না, তাদের বসবাস ছিল কুমারখালির কল্যাণপুর গ্রামে। আকবর হোসেনের দাদা পতন উদ্দিন ছিলেন শতাধিক বিঘা সম্পত্তির মালিক। নদীর ভাঙনে তাঁরা সর্বহারা হয়ে যান। আশ্রয় লাভের জন্য পতন উদ্দিন সপরিবারে পার্শ্ববর্তী কালোয়া গ্রামে চলে আসেন শূন্য হাতে। কিন্তু সেখানেও আশ্রয় না জোটায় তাঁরা চলে আসেন কয়া গ্রামে। এই গ্রামের মানুষ সাদরে তাঁদের বরণ করে নেয়, নেয় একান্ত আপন করে। এখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই জোটায় পতন উদ্দিন নতুন প্রত্যাশায় ঘর তোলেন এখানে বাড়ি নির্মাণ করেন। সেই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমি ও বিশ্বজিৎ—পাক্ষিক অন্যদিন পত্রিকার প্রতিবেদক ও ফটোগ্রাফার।
কথাসাহিত্যিক আকবর হোসেন ও তাঁর পূর্বপুরুষদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিতে প্রবেশ করি। আমরা মুখোমুখি হই একজন মহিলার। তাঁর কাছে খুলে বলি আমাদের আগমনের কারণ। তিনি পাশের বাড়ির এক তরুণের মাধ্যমে তাঁর স্বামীর কাছে খবর পাঠালেন। জরুরি খবর পেয়ে কয়া বাজার থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হলেন এক ত্রিশোর্ধ্ব ভদ্রলোক। তাঁর সঙ্গে বিস্তারিত কথা হলো আমাদের। জানতে পারলাম যে, তিনি মো. আসাদুজ্জামান সুমন। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক আকবর হোসেনের চাচাত ভাইয়ের ছেলে। আকবর হোসেনরা বহু আগেই এখানকার পাট চুকিয়ে চলে গেছেন। আকবর হোসেন বাড়ি করেছেন ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনের কাছে—কবি জসিমউদ্দীন রোডে। তাঁর সম্পর্কে বিশদ বলতেও পারবেন না আসাদুজ্জামান সুমন। তিনি আমাদের পরামর্শ দিলেন আমরা যেন ঢাকায় প্রয়াত আকবর হোসেনের ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁরা থাকেন কোথায়? এ বিষয়েও সঠিক তথ্য সরবরাহের অপারগতা জানালেন সুমন। তবে হ্যাঁ, আমরা কুষ্টিয়া শহরে যেখানে উঠেছি—সেখানকার জুবলী হোটেলের নিচতলায় যে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর দোকানটি রয়েছে সেখানে যেন যোগাযোগ করি। কেননা, ওই দোকানটির মালিক আকবর হোসেনের সেজভাই নূরউদ্দীন আহমেদ। তিনিই আকবর হোসেনের ঢাকার বাড়ির সন্ধান দিতে পারবেন। ....আসাদুজ্জামান সুমনের এই কথার সূত্রে আমাদের মনে পড়ে যায় যে, আকবর হোসেনের দাদা পতন উদ্দিনের ছিল দুই স্ত্রী। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে পতন উদ্দিনের কোনো সন্তান জন্মে নি। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে জন্মায় তিন ছেলে—সদর উদ্দীন, হাজী আবদুল আলী বিশ্বাস এবং আব্বাস উদ্দীন। এর মধ্যে হাজী আবদুল আলী বিশ্বাস ছিলেন আকবর হোসেনের পিতা। তাঁর চার সন্তান— আকবর হোসেন, মৌলানা আবেদ আলী, নুরউদ্দীন আহমেদ ও আজিজুল ইসলাম। উল্লেখ্য, আবেদ আলীও লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। মূলত কবি হিসেবেই তাঁর ছিল পরিচিতি।...১৯৪১ সালে আকবর হোসেন কুষ্টিয়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান হাসনা বানুকে বিয়ে করেন। হাসনা বানুর পিতা কামাল উদ্দীন মুন্সি ছিলেন কোর্টের নাজির।....হাসনা বানুর গর্ভে আকবর হোসেনের দশ সন্তান জন্মগ্রহণ করে—সাহেরা বানু, জাহাঙ্গীর আলম, আক্তার পারভীন, আলমগীর খসরু, সুলতানা পারভীন, নাসির হাসান, আফরোজা সরকার, ওয়াজির হাসান, ফেরদৌস হাসান ও রুনা পারভীন। পাঁচ ছেলে ও পাঁচ মেয়ে।
আসাদুজ্জামান সুমন তাদের বাড়ির একটি ঘরের সামনে আমাদের নিয়ে যান। বলেন যে, এই ঘরেই আকবর হোসেন থাকতেন। আকবর হোসেনের ব্যবহৃত কোনো জিনিসপত্র কি এখানে রয়েছে? আমরা জানতে চাই সুমনের কাছে। এই প্রশ্নের নেতিবাচক উত্তরই আমাদের শুনতে হয়। তবে হ্যাঁ, ঢাকার কবি জসীমউদ্দীন রোডে অবস্থিত বাড়িতে রয়েছে আকবর হোসেন ব্যবহৃত চশমা, খাট ইত্যাদি।
‘যখন পড়বে না মোর পায়েরা চিহ্ন এই বাটে/আমি বাইব না মোর খেয়া তরী এই ঘাটে...’ আসাদুজ্জামান সুমনের ঘর থেকে ঢাকা বেতারে প্রচারিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে মনে পড়ে যায় যে, আকবর হোসেন ছোটবেলায় আকস্মিকভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। তখন রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ থেকে কলকাতা যাবার পথে তরী ভিড়িয়েছিলেন এই কয়া গ্রামে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার বাসনায় উঠেছিলেন নদীঘাট সংলগ্ন আকবর হোসেনের বাড়িতে। অতঃপর ঘটনাক্রমে গুরুজনদের অনুরোধে কবিগুরুর সামনে একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন শিশু আকবর হোসেন। এই আবৃত্তি, বলাই বাহুল্য, খুবই মনোগ্রাহী হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ স্নেহের পরশ বুলিয়েছিলেন শিশু আকবর হোসেনের গায়ে আর আশীর্বাদ করেছিলেন এই বলে—‘তুমি একদিন বড় কবি হবে’। রবীন্দ্রনাথের এই আশীর্বাদ একেবারে বিফলে যায় নি— বড় কবি না হতে পারলেও আকবর হোসেন বড় মাপের ঔপন্যাসিক হতে পেরেছিলেন।
‘অবাঞ্ছিত’ (১৯৫০) আকবর হোসেনের প্রথম উপন্যাস। বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠক-মহলে আলোড়ন তোলে। পরে এটির চলচ্চিত্ররূপ দেন পরিচালক কামাল হোসেন। চলচ্চিত্রটিও দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে।...‘অবাঞ্ছিত’ উপন্যাসে আকবর হোসেন নর-নারী কীভাবে লাঞ্ছিত হয় তার বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এই প্রথম উপন্যাসেই আকবর হোসেন সফল। ড. কাজী মোতাহার হোসেনের মূল্যায়ন, ‘লেখকের ভাষা স্বচ্ছ ও জোরালো, মনোবৃত্তি আধুনিক এবং উদার আর ঘটনা সমাবেশ স্থানে স্থানে অস্বাভাবিক মনে হলেও মোটের উপর বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। ঘটনা সংঘাতের ভিতর দিয়ে লেখক সামাজিক সমস্যা এবং মানসিক দ্বন্দ্ব বেশ সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।’...আকবর হোসেনের অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে কি পাইনি (১৯৫২), মোহমুক্তি (১৯৫৩), ঢেউ জাগে (১৯৬১), দুদিনের খেলাঘরে (১৯৬৫), মেঘ বিজলী বাদল (১৯৬৮), নতুন পৃথিবী (১৯৭৪) এবং দুষ্টক্ষত। এ ছাড়া ‘আলোছায়া (১৯৬৪) নামে তাঁর একটি গল্পগ্রন্থ রয়েছে।
আকবর হোসেনের ভাইপো, আসাদুজ্জামান সুমনের কাছ থেকে আমরা বিদায় নিয়ে আবার পথে নামি।
কয়া গ্রাম থেকে ফেরার পথে স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি যে, তাদের অন্তরে রয়েছে ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের স্থান। তারা অনেকেই হয়তো আকবর হোসেনের রচনাবলি পড়েন নি, কিন্তু তাঁর কীর্তি সম্পর্কে অবগত। আকবর হোসেন যে কয়া গ্রামের সন্তান— এ নিয়ে প্রচ্ছন্ন গর্ববোধও তাদের মাঝে রয়েছে।
দেশবিভাগের পরে পঞ্চাশের দশকে এ দেশে হাতে গোনা যে কয়জন ঔপন্যাসিক মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পেরেছিলেন তাদের মধ্যে আকবর হোসেন অন্যতম। এর কারণ হচ্ছে, লেখার ভাষা ও রচনারীতির ক্ষেত্রে একটা নিজস্ব স্টাইল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন আকবর হোসেন। প্রতিটি উপন্যাসের প্রাণবন্ত ও হৃদয়স্পর্শী আবেদনের মূলে রয়েছে তাঁর স্বচ্ছ, জোরালো ও কাব্যময় ভাষা। অন্যদিকে, উপন্যাসের বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রেও আকবর হোসেন নিরন্তর বৈচিত্র্যসন্ধানী। কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের মধ্যে তিনি আবদ্ধ থাকেন নি। আমরা তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য হিসেবে পাই—দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুক্ত এবং সামাজিক অবক্ষয় ও অস্থিরতাকে। নর-নারীর অবৈধ প্রেমের সন্তানের আগমনে সমাজজীবনে নারী কীভাবে লাঞ্ছিত হয় তার বাস্তবচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন ‘অবাঞ্ছিত’ উপন্যাসে। গ্রামের প্রভাবশালী, অসৎ ও অত্যাচারী মানুষদের কারণে আদর্শবান মানুষরা যে কীভাবে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত ও কলঙ্কিত হয়—সেটি মূর্ত হয়ে উঠেছে ‘কি পাই নি’ উপন্যাসে। ‘ঢেউ জাগে’ উপন্যাসে ধর্ম ব্যবসায়ীদের ভণ্ডামি, ক্ষুধার্ত মানুষের নৈতিক পদঙ্খলন পরিস্ফুটিত। আর একটি ব্যাপার হচ্ছে প্রেম। আকবর হোসেনের প্রতিটি উপন্যাসেই এই বিষয়টি বিশেষভাবে স্পষ্ট। তবে এই প্রেম কখনোই কোনো গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকে নি, দেহকে অতিক্রম করে আদর্শের প্রতি নিবেদিত থেকেছে ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের সৃষ্ট চরিত্ররা। আর একটি বিষয় হচ্ছে, একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে আকবর হোসেনের অতৃপ্তি। তিনি তাই বারবার উপন্যাসের সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজন করেছেন।
কয়া গ্রাম ও বাজার পেরিয়ে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের সামনে এখন আমরা। হয়তো চোখের সামনে একটি স্কুল দেখেই আমার মনে পড়ে যায় যে, আকবর হোসেন ছেলেবেলায় পড়াশোনা শুরু করেন কয়া মডেল স্কুলে। সেখান থেকে তিনি বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হন কুষ্টিয়া হাই স্কুলে। সেখান থেকে ১৯৩৫ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে আইএ পাস করেন; বিএ পাস করেন তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে। উল্লেখ্য, সাহিত্যচর্চার প্রতি আকবর হোসেন এমনই নিবেদিত ছিলেন যে, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটেছে বারবার।... প্রথম চাকরি ছিল সামরিক বিভাগে অফিসার পদে। তবে এই চাকরি তাঁর করা সম্ভব হয় নি। এরপর অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে করণিক পদের চাকরিও বেশিদিন করা সম্ভব হয় নি। অতঃপর কলকাতায় ও পরে ঢাকায় ‘সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট অব ফুড’-এ কাজ করেন। তবে তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘অডিট অফিসার’ হিসেবে।
শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের সামনে থেকে রিকশায় চড়ে আমরা পথ পাড়ি দিচ্ছি। কয়া গ্রামের মানুষদের আকবর হোসেনের প্রতি যে আন্তরিক টান ও শ্রদ্ধাবোধ দেখলাম— তা সত্যিই চমৎকার। কিন্তু আবার এটাও সত্যি যে, আকবর হোসেনও তাঁর গ্রামের মানুষ ও এই দেশের সাধারণ মানুষকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন, তাদের মাঝে একাত্ম হয়ে মিশে থাকতে চাইতেন। তাঁর লেখায় যেমন সাধারণ মানুষের জয়গান রয়েছে ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণে চাকরি-জীবনে প্রমোশন নিতে আগ্রহী ছিলেন না। ব্যাপারটি কি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে না? হ্যাঁ, এই সময়ে এই যুগে মানুষের প্রতি এমন ভালোবাসা সত্যিই দুর্লভ।
Leave a Reply
Your identity will not be published.