উতল হাওয়া (পর্ব ১০)

উতল হাওয়া (পর্ব ১০)

[শহিদ হোসেন খোকন দীর্ঘদিন ধরে গল্প লিখছেন। এই প্রথমবারের মতো তিনি উপন্যাস লিখলেন। এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে অগ্নিঝরা একাত্তর, সেই সময়ের রাজনৈতিক আবহাওয়ার উতল হাওয়া। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের পটভূমিতে এই উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের প্রধান জাতীয় নেতৃবৃন্দ, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টোসহ আরও অনেকে। আজ পড়ুন দশম পর্ব...]

রাতে শেখ মুজিবের ভালো ঘুম হয় নি। স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার জন্যে দলের যুব ও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড চাপ আছে। দেশের মানুষও মনে-প্রাণে চাইছে যেন কালই স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়। এটা তাদের প্রাণের দাবি। পাকিস্তানের শোষণের চক্রটি এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। দেশের আপামর মানুষ এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, চব্বিশ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম একটা পরিণত অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।

২ মার্চ থেকে দেশ যদিও মূলত মুজিবের নির্দেশেই চলেছে। তবু একটা সাংবিধানিক বৈধতার ব্যাপার আছে, আন্তর্জাতিক মহলের স্বীকৃতির ব্যাপার আছে। স্পেশালি আমেরিকা এবং আরব দেশগুলি সরাসরি মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা সহজে মেনে নেবে না। এটাকে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবেই দেখবে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বাইরে গিয়ে দেশ পরিচালনা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, দেশে এখন মার্শাল ল চলছে। সেনাবাহিনী ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে। সেনাবাহিনীর সাথে সরাসরি কোনো সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। বহু ধর-পাকড় আর নিরীহ মানুষের প্রাণহানী ঘটবে। শেষে পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তিনি চান একটা পরিণত সমাধান। কূলে এসে যেন তরি ডুবে না যায়।

মসজিদে আজান হচ্ছে, আজকে আজানের ধ্বনি কেমন করুণ শোনাল। মনে হয় অপার্থিব কোনো গানের সুর বুঝি আসমান ভেদ করে এই মাটির পৃথিবীর মানুষের কানে কানে এক বার্তা ছড়িয়ে দিতে চায়, জেগে ওঠার বার্তা... তোমরা আর ঘুমিয়ো না, জেগে ওঠো। মুজিব লক্ষ করলেন আজানের এই বার্তার সাথে রবীন্দ্রনাথের গানের খুব মিল... মেলো আঁখি জাগো জাগো থেকো নারে অচেতন, ওঠো ওঠো রে বিফলে প্রভাত বহে যায় যে...

মুজিব আস্তে আস্তে ছোট ছেলে রাসেলের হাত ছাড়িয়ে নিলেন। রাসেলের বয়স চার। রাতে সে বাবার গলা জড়িয়ে ঘুমাতে চায়। এ রকম সুযোগ অবশ্য সে খুব কমই পায়, কারণ সভা শেষ হতে হতে প্রায়ই মধ্যরাত হয়ে যায়। তখন সে হাসুর সঙ্গে ঘুমায়। ছেলেমেয়েদের মুজিব বিশেষ সময় দিতে পারেন নি। জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় জেলেই কেটেছে।

তাকে যখন ছেলেমেয়েরা জেলখানায় দেখতে যেত তখন ছোট রাসেলকেও সঙ্গে নেওয়া হতো, সারাক্ষণ সে বাবার কোলে বসে থাকত। বিদায়ের সময় দৃশ্যটা খুব করুণ হতো। কিছুতেই সে বাবাকে ছেড়ে যাবে না, বাবার সঙ্গে থাকার জন্যে খুব কান্নাকাটি করত। তখন  তাকে বোঝানো হতো জেলখানাটা হলো মুজিবের বাসা। সবাই সে বাসায় অল্প সময়ের জন্যে বেড়াতে এসেছে। রাসেল তখন পাল্টা প্রশ্ন করত, আব্বা কেন আমাদের বাসায় বেড়াতে আসে না? তখন উত্তর দেওয়া খুব মুশকিল হতো।

শেখ মুজিব অজু করে পোশাক বদলে নামাজে বসলেন। অন্য সময়ের চেয়ে অনেক সময় দিয়ে তিনি সূরা ফাতিহা পড়লেন, সুরার প্রতিটা শব্দ তিনি অন্তঃকরণে অনুভব করার চেষ্টা করলেন।

সূরা আল-ফাতিহা হলো পবিত্র কুরআন মাজীদের প্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি সূরা। এটিই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাযিলকৃত প্রথম পূর্ণাঙ্গ সূরা।

সুরা ফাতিহার ফজিলত অপরিসীম। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমরা সূরা ফাতিহা পড়ো। কোনো বান্দা যখন বলে, আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন, তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে। যখন বলে, আর-রহমা-নির রহীম, তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার গুণ বর্ণনা করেছে।

বান্দা যখন বলে, মালিকি ইয়াউমিদ্দীন। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার মর্যাদা বর্ণনা করেছেন। বান্দা যখন বলে, ইয়্যাকানা’বুদু ওয়া ইয়্যা কানাস্তাইন, আল্লাহ বলেন, এ হচ্ছে আমার ও আমার বান্দার মাঝের কথা। আমার বান্দার জন্য তাই রয়েছে, যা সে চায়।

নামাজ শেষে তিনি মোনাজাত ধরলেন। দু’হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ বললেন, হে পরোয়ারদিগার তুমি আমাদের পথ দেখাও। জালিমদের হাত থেকে তুমি আমাদের রক্ষা করো। তোমার অসাধ্য কিছু নাই। তোমার কাছে আমার নিজের জন্য কিছু চাওয়ার নাই। আজ যে বিপদে আমার দেশবাসী নিমজ্জমান সেইখান থেইকা তুমি আমাদের উদ্ধার করো। আমি তোমার এক নাদান বান্দা মাবুদ, এই দুর্ভাগা শোষিত বাঙালি জাতিটাকে আমি নিজের পায়ে দাঁড় করাতে চাই, তুমি আমাদের পাশে থাকো হে পরোয়ার দিগার। হে রহমানের রাহিম, আমাগ জন্য তুমি তোমার রহমতের দরজা খুলে দাও।

মোনাজাত শেষে তিনি অঝোরে কাঁদছেন, শব্দহীন কান্না। এ সময়  পেছনে থেকে একজোড়া কোমল হাত এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। রেণু মুজিবকে শিশুর মতো নিজের বুকে টেনে নিলেন, তারপর পরম যত্নে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুজিবের চোখের জল মুছিয়ে দিতে থাকেন। সেই ছেলেবেলা থেকেই রেণু তাকে এভাবে বুকে করে আগলে রেখেছে। মুজিব রেণুকে চুমু খেলেন, তার কান্না স্তিমিত হয়ে এল।

রেণু বলল, কিচ্ছু ভাববেন না আপনি, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তো আছি, দেশের মানুষ আপনার সাথে আছে।

শোন রেণু। ছাত্ররা বাংলাদেশের পতাকা উড়ায়ে দিয়েছে, জাতীয় সংগীত ঠিক করা হয়া গেছে। স্বাধীনতার চাইতে কম কিছু হলে তারা সেইটা মানব না। এদিকে ক্যান্টনমেন্ট থেইকা খবর আসছে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া মাত্রই ওরা ট্যাঙ্ক-কামান-মেশিনগান নিয়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ব। ওরা বলেছে যদি প্রয়োজন হয় ঢাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়া দিবে। কী করব আমি বল?

অনেকে অনেক কিছু বলব কিন্তু আপনার নিজের মনে যা আসে আপনে তাই বলবেন। মনে রাখবেন এই দেশ এই দেশের মানুষের দায়িত্ব আপনার। ভালো-মন্দ সব দায়িত্ব আপনার। ইতিহাস শুধু আপনারে চিনবে।

শেখ মুজিব আবেগে আবারও রেণুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন। তার মনের ভাব লাঘব হয়ে গেছে। রেণুর কথায় তিনি নিজের প্রতি আস্থা ফিরে পেলেন। অনেকেই অনেক কিছু বলবে, অনেক পরামর্শ, অনেক প্ররোচনা অনেক  ইন্ধন আসবে কিন্তু নিজের বিশ্বাসে তাকে অটল থাকতে হবে। বাঙালির স্বাধীনতা তাকে এনে দিতেই হবে। যত কম মূল্যে সেটি আনা যায় ততই ভালো। নিজের হৃদয় যে বার্তা পাঠায় রেসকোর্সের ভাষণে তাই বলেতে হবে।

(চলবে…)

Leave a Reply

Your identity will not be published.