পদ্মা নদীর মাঝি/ ছবি তৈরির গল্প

পদ্মা নদীর মাঝি/ ছবি তৈরির গল্প

গৌতম ঘোষের একটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজিত এই চলচ্চিত্রটি এদেশে সেন্সর সনদ পেয়েছিল ১৯৯২-এর ১৪ জুলাই এবং মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। চলচ্চিত্রটি দুটি দেশেই দর্শক-সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করে। জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত হয়।

চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষের নদীর প্রতি গভীর ভালোবাসা রয়েছে। তাঁর নির্মিত বিভিন্ন চলচ্চিত্রে নদী নানাভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে। বলাই বাহুল্য, নদীকে ঘিরে মানুষের জীবন, সংগ্রাম—এইসব উঠে এসেছে। এ প্রসঙ্গে গৌতম নির্মিত পার (হিন্দি ১৯৮৪), অন্তর্জলি যাত্রা (১৯৮৭), পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯৩), মনের মানুষ (২০১০) প্রভৃতি চলচ্চিত্রের কথা বলা যেতে পারে। তবে এখানে আমরা শুধু ‘পদ্মা নদীর মাঝি’-র ওপরই আলো ফেলব।
‘পদ্মা নদীর মাঝি’-র নায়ক কুবের মাঝি। চলচ্চিত্রটির সূচনাতে দেখা যায়, কুবের পদ্মার বুকে মাছ ধরছে। তার সঙ্গী ধনঞ্জয় ও গণেশ। সারারাত মাছ ধরে তাদের নৌকা যখন আড়তদারের ঘাটে ভিড়ে, তখন সূর্যের সোনালি আলোয় ঝকমক করে ওঠে পদ্মার রুপালি ইলিশগুলো। ওই সময় অন্য নৌকার মাঝিদের উদ্দেশে কুবের চিৎকার করে বলে, কেমন মাছ পড়ছে ? জবাব আসে, জবর।


পদ্মা যে এপার ভাঙে ওপার গড়ে—সেটিও দর্শক চেতনায় গেঁথে দেন চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষ। এরই মধ্যে সাউন্ডট্রাকে শোনা যায় নবজাত শিশুর কান্না।
আড়তে মাছ দিয়ে কুবের গ্রামে (কেতুপুর) ফিরে। নিজের বাড়িতে ঢোকার আগে সে জানতে পারে তার পুত্র জন্মের বার্তা। তখন তার মুখটি মলিন মনে হয়।


ষড়ঋতুর আবর্তনে আসে বর্ষা। কুবেরের ঘরের চাল দিয়ে পড়ে পানি। কুবেরের বউ মালা স্বামীর উদ্দেশে বলে, হোসেন মিয়ার কাছ থিকা ছন আনলে হতো না ? ... হোসেন মিয়া একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি, সামান্য অবস্থা থেকে বড় হয়েছে। এখন তার নানা ধরনের ব্যবসা। বড় পানসি নৌকায় যাতায়াত করে। নিজের পত্তনি নেওয়া ময়না দ্বীপে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন নিয়ে বসত গড়ায় মগ্ন সে। এক্ষেত্রে সে থাকা-খাওয়াসহ মানুষের কাজের ব্যবস্থাও করে। এমনকি প্রতিটি পরিবারের জন্য জমির ব্যবস্থা করে।


হোসেন মিয়ার ময়না দ্বীপে বউ-বাচ্চাসহ বসতি গড়েছিল কেতুপুরের রাসু। একদিন সোনাখালির মেলার উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় রাসুকে দেখতে পেয়ে নৌকায় তোলে কুবের মাঝি। রাসু হাউমাউ করে কেঁদে জানায় সে বউ-বাচ্চা সব হারিয়েছে। কেতুপুরে পা দিয়ে রাসু গ্রামের মানুষের সামনে ময়না দ্বীপের ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরে—যেখানে বাঘ-সিংহ-সাপ আর কুমিরের আস্তানা। ফলে হোসেন মিয়ার বিচার বসে। বিচার শেষে হোসেন মিয়া শুধু বলে, ‘জান দিয়া তোমাগো দরদ করি, অ্যানে আইজ তোমরা ঘা দিলা, এই দিলের মধ্যি’। সবাই চুপ। কেউ কোনো কথা বলে না।
বৃষ্টিমুখর দিন বলে রাতে কুবেরের বাড়িতে থাকে হোসেন মিয়া। আরামে ঘুমায়। সকালে যখন সে বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল কুবেরের সঙ্গে, তখন সে জানতে চায় কুবের গান বাঁধতে পারে কি না। কুবের নিরুত্তর থাকলে হোসেন মিয়া নিজেই গান বেঁধে গাইতে থাকে—‘আঁধার রাইতে আসমান জমিন ফারাক কইরা থোও/বোনধু কত ঘুমাইবা।/বাঁয়ে বিবি ডাইনে পোলা অকাল ফসল রোও / মিয়া কত ঘুমাইবা।’
কুবেরের বউ মালা নিজের মা-বাবার কথা বলে। তারা এই বর্ষায় সবাই মাচায় থাকছে করুণ অবস্থায়। বউয়ের কান্নাকাটিতে কুবের তাদের আনতে যায়। কিন্তু আসে শুধু বাড়ির সব ছোট বাচ্চারা এবং কুবেরের শ্যালিকা কপিলা।


কপিলার সঙ্গে কুবেরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এদিকে গোপী (কুবেরের বড় মেয়ে) আহত হয়। তাকে নিয়ে গঞ্জের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যায় কুবের ও কপিলা। সঙ্গী হয় রাসু ও গণেশ। ... রাসু বিয়ে করতে চায় গোপীকে। কুবের কিছুই বলে না। ... গ্রামে ফিরে যায় রাসু ও গণেশ। কুবের ও কপিলা রাত কাটায় এক আবাসিক হোটেলে। তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হয়।
কুবের ও কপিলা গ্রামে পৌঁছালে তাদের হাব-ভাব দেখে খটকা লাগে মালার। ... কপিলার স্বামী এসে তাকে নিয়ে যায়। মালা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ... একদিন বিনা কারণে কপিলার স্বামীর বাড়িতে হাজির হয় কুবের। কিন্তু যে আশায় কুবের নিয়েছিল তা পূরণ হয় না। ভগ্ন হৃদয়ে সে ফিরে আসে কেতুপুরে।


ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে গোপী। ওকে বিয়ে করার প্রস্তাব এবার ভালোভাবেই দেয় রাসু। জানায়, এর জন্য কুবের যা চাইবে তাই সে দিবে। কথাটি শুনে খটকা লাগে কুবেরের। ভাবে, এত  টাকা রাসু পেল কোথায় ? ... কয়েক দিন আগে রাসুর মামা পীতম মাঝির সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ চুরি হয়ে গেছে। তদন্ত করতে দারোগা এসেছিল ঠিকই, কিন্তু সেই অর্থ আর পাওয়া যায় নি। অপরাধীরাও চিহ্নিত হয় নি।
হোসেন মিয়ার সঙ্গে ময়না দ্বীপে যায় কুবের। দেখে সেখানে বসতি করা মানুষজনের জীবন। অন্যপাত্রের সঙ্গে গোপীর বিয়ে হয়। রাসু শাসায়—কুবিরদা, তুমি কথা দিয়া রাখলা না... মনে রাইখ্যো, আমি তোমার সব্বোনাশ কইরা ছাড়–ম।
সর্বনাশ ঠিকই করে রাসু। দারোগা এসে কুবেরের বাড়ি থেকে প্রীতম মাঝির কলস খুঁজে পায়। সে কুবেরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বসে থাকে। এ খবর নিয়ে আসে কপিলা।


কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হোসেন মিয়ার প্রস্তাবে ময়না দ্বীপে যেতে রাজি হয় কুবের। কপিলা বলে, আমারে নিবা মাঝি লগে।... সবকিছু পেছনে ফেলে হোসেন মিয়ার নৌকা ময়না দ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা করে। আস্তে আস্তে নৌকাটি দিগন্তে মিলিয়ে যায়। দেখা যায় জনশূন্য নদী ও নদীর পাড়।


ওপরে যে গল্প তুলে ধরা হয়েছে তা চলচ্চিত্রে ফুটে উঠেছে। বলাই বাহুল্য, এক্ষেত্রে গ্রহণ-বর্জন-সংযোজন রয়েছে। চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষের ভাষায়, ‘চিত্রনাট্য রচনার সময়ে উপন্যাসের কিছু অংশ বাদ পড়েছে আবার কিছু নতুন দৃশ্যের সংযোজনও ঘটেছে।’ সংলাপও পরিমার্জন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে গৌতম ঘোষকে সাহায্যে করেছিলেন প্রয়াত প্রথিতযশা সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ এবং চলচ্চিত্রটির প্রধান সহকারী পরিচালক শাহ আলম কিরণ।


‘অন্তর্জলী যাত্রা’ নির্মাণের পর তিনজন প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বকে নিয়ে তিনটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করছিলেন গৌতম ঘোষ। সেই সময়ই তিনি ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ নির্মাণের কথা ভাবেন। কিন্তু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে জানান, উপন্যাসের চিত্রস্বত্ব দেওয়া আছে বোম্বাই (মুম্বাই) নিবাসী হিতেন চৌধুরীর কাছে। হিতেন চৌধুরী প্রথমে ভেবেছিলেন ব্রিটিশ পরিচালক ডেভিড লীনকে দিয়ে ছবিটি নির্মাণ করবেন। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে একবার ঋত্বিক ঘটক এবং আরেকবার সত্যজিৎ রায়ের কথা ভাবেন। ... হিতেন চৌধুরী উপন্যাসের চিত্রস্বত্ব বিক্রি করতে চান নি। তিনি প্রযোজক বা উপদেষ্টা হিসেবে এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত থাকতে চেয়েছিলেন। তিনি ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাস অবলম্বনে রচিত একটি চিত্রনাট্য গৌতম ঘোষকে পড়তে দেন। সেটি পড়ে গৌতম নিরাশ হন। কেননা সেটি ছিল স্টুডিও’র ভেতরে নির্মাণের জন্য মঞ্চ ঘেঁষা একটি খসড়া। তিনি হিতেন চৌধুরীকে জানান, নতুন করে চিত্রনাট্য লিখতে হবে এবং ছবির শুটিং বাংলাদেশ ছাড়া সম্ভব নয়। ... হিতেন চৌধুরী রাজি হন এবং কয়েকবার এসে পশ্চিমবঙ্গে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন এই প্রকল্প নিয়ে। এরপর বাংলাদেশের প্রযোজক হাবিবুর রহমান খানের সঙ্গে আলাপ হয় গৌতমের এবং তিনি সাগ্রহে সহ-প্রযোজক হন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে।


সবকিছু ঠিক হওয়ার পরে চিত্রনাট্য লিখেন গৌতম ঘোষ। এক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসটি ছাড়াও তিনি গবেষণা করেন বাংলাদেশের নদ-নদী, ভূমি-ব্যবস্থা, আর্থ-সামাজিক পটভূমি, লোকজ সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে। যেহেতু মূল উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৬ সালে সেহেতু গৌতম ধরে নেন ত্রিশ দশকের গোড়া এটির পটভূমি। তবে গৌতম ছবিটির পটভূমিকে নিয়ে যান ত্রিশ দশকের শেষে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরুর প্রাক মুহূর্তে।


চিত্রনাট্য লেখার পর ঢাকায় আসেন গৌতম ঘোষ। চলচ্চিত্রকার সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকির বাড়িতে প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান, তাঁর বিশ্বস্ত কয়েকজন বন্ধু এবং চিত্রশিল্পী এবং নির্মাতা মুস্তাফা মনোয়ারের সামনে সেই চিত্রনাট্য পড়ে শোনান। তখন গৌতমকে কিছু উপদেশ দেন মুস্তাফা মনোয়ার। সেই উপদেশ কাজে লেগেছিল।


ছবিটির শুটিং হয়েছিল বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায়। নদীসংলগ্ন সমস্ত দৃশ্য তোলা হয়েছিল মানিকগঞ্জের পদ্মা পাড়ে, মেঘনার চরে, চাঁদপুরে এবং মেঘনার মোহনায়। জেলেবসতির সেট নির্মাণ করা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের কাকদ্বীপের কাছে গঙ্গার ধারে এবং সুন্দরবন সংলগ্ন চকখালিতে। এক্ষেত্রে শিল্পনির্দেশক অশোক বসু ও মহিউদ্দিন ফারুকের অবদানও অনস্বীকার্য। তাই তো চলচ্চিত্রের পর্যায় গঙ্গা আর পদ্মাকে ফারাক করা যায় নি। গৌতম ঘোষের স্ত্রী নীলাঞ্জনা ঘোষ স্থানীয় লোকদের সাহায্যে চল্লিশ দশকের পটভূমিতে নির্মিত ছবির যথাযোগ্য পোশাক পরিকল্পনা ও সংগ্রহ করেছিলেন বহু চরিত্রের জন্য। প্রচুর পরিমাণে জেলে নৌকা সংগ্রহ করেছিলেন বাংলাদেশের প্রযোজক হাবিবুর রহমান।
‘পদ্মা নদীর মাঝি’-তে কুবের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাইসুল ইসলাম আসাদ। তবে এ কথা বোধহয় অনেকে জানেন না যে হুমায়ূন ফরীদি এই চরিত্রে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে সিলেক্ট করেন নি গৌতম ঘোষ। এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্রকার সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকি, যার বাসায় এই ছবির উপন্যাস প্রথম পাঠ করেছিলেন গৌতম ঘোষ, তিনি বলছেন, “গৌতম খুব খুঁতখুঁতে স্বভাবের। চরিত্র নিয়ে সে কোনো কম্পোমাইজ করে না। ফরীদি অসামান্য অভিনেতা কিন্তু ‘পদ্মা নদীর মাঝি’-র কুবেরের সঙ্গে তার শরীরটা মেলে না বলে তাকে নেওয়া হয় নি।” ... রাইসুল ইসলাম আসাদ কিন্তু এ ছবিতে অভিনেতা হিসেবে না হোক একজন সহকারী অথবা একজন অবজারভার হিসেবে হলেও থাকতে চেয়েছিলেন। পরে অবশ্য তিনি নানাভাবে গৌতম ঘোষকে সাহায্য করেছেন—লোকেশন, শিল্পী নির্বাচন থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রে। ... কুবের মাঝি হওয়ার জন্য আসাদ নিজেকে প্রস্তুতও করেছেন। যেমন কীভাবে ইলিশ মাছ ধরতে হয়, জেলেদের জীবন, জেলেদের পাড়ায় গিয়ে থাকা, জেলেদের মতো শরীরকে তৈরি করা, ঠিকমতো নৌকা চালানো ইত্যাদি। এমনকি অভিনয়ের সময়ও নানা কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। এ প্রসঙ্গে রাইসুল ইসলাম আসাদের ভাষ্য হচ্ছে : ‘চলচ্চিত্রে কুবের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে নিজের চরিত্রের অবয়ব ঠিক রাখতে গিয়ে আমাকে মেকআপ ছাড়াও অনেক কিছু করতে হতো। যেমন—জেলেরা জালে গাব দেয়, তাতে করে আঙুলে, নখে সেই আঠার দাগ থাকে। সেই দাগগুলো দিতে হতো প্রতিদিন সকালবেলা। দাড়ি একটা একটা করে কাটতে হতো ভোরবেলা নিজেকেই কাঁচি দিয়ে। কন্টিনিউ ঠিক রাখার জন্য। দাগ দেওয়া আঙুল দিয়ে তো আমি খেতে পারতাম না। আমার মনে আছে, সকালবেলা নাস্তা খাইয়ে দিত প্রোডাকশনের ছেলে আলাউদ্দীন আর দুপুরবেলা মাছ বেছে খাওয়াত রূপা ও চম্পা। একদিকে রূপা বসত আরেক দিকে বসত চম্পা। ওরা দুজনে ভাত খাইয়ে দিত।’


মালা চরিত্রে অভিনয় করেছেন চম্পা। গুলশান আরা চম্পা। তিনি তখন এদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রের শীর্ষ নায়িকা। প্রচ- ব্যস্ত শিল্পী। সেই তাকে মালা হিসেবে নির্বাচিত করেন গৌতম। সেই সময় ফোনে তিনি কয়েকটি টিপস দিয়েছিলেন চম্পাকে, যেন তিনি মালা হয়ে উঠতে পারেন। যেমন, মোটা হওয়ার জন্য রোজ পান্তাভাত খাওয়া, কালো হওয়ার জন্য গায়ে সরিষার তেল মাখা, আই ব্রু তোলা বন্ধ করা। মালা যেহেতু পঙ্গু, এক পা অবশ, সেহেতু বাসায় চম্পা চলাফেরা করেন ল্যাংড়িয়ে ল্যাংড়িয়ে, এক পা অবশ করে। এই ছবির একটি দৃশ্য অভিনয় প্রসঙ্গে চম্পা বলছেন, যা এক টেকে ওকে হয়েছিল : ‘সেই দৃশ্য আজও ভুলতে পারি না। আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এলাম, আসাদ আমাকে দুটো কথা বলল। আমি ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম তার গায়ের ওপরে। একটা ল্যাংড়া এভাবে ঝাঁপাতে পারে এবং অবাক কথা আমার ল্যাংড়া পাটা একটুও পড়ে নি। যেভাবে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমার কাছে মনে হলো একটি ভৌতিক কিছু, বারান্দায় থেকে নিচে পড়ে যাওয়া অব্দি আমার কিছু জ্ঞান নেই। মনে হলো সেন্সলেস অবস্থায় কাজটি করেছি।’ উল্লেখ্য, এই ছবিটিতে অভিনয়ের সূত্রে চম্পার কেরিয়ারের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। তিনি তারকা থেকে অভিনেত্রী-তে পরিণত হয়েছিলেন। পরে তিনি সন্দীপ রায়ের ‘টার্গেট’, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘লাল দরজা’সহ কয়েকটি ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। বহু পুরস্কারও লাভ করেন।


রূপা গাঙ্গুলী করেছেন কপিলার চরিত্র। তিনি ব্রাহ্মণ কন্যা। ফর্সা। কপিলা হওয়ার জন্য ভীষণ কষ্ট করেছেন। ছবির শুটিং শুরু হওয়ার এক মাস আগেই এসেছিলেন বাংলাদেশে, উঠেছিলেন অন্যতম প্রযোজক হাবিবুর রহমানের গাঁয়ের বাড়ি বিক্রমপুরে। সেখানে সারা দিন রোদের মাঝে কাটিয়েছেন, নৌকা নিয়ে খালে বিলে ঘুরে বেড়িয়েছেন। জেলেদের বাড়ি গিয়ে তাদের স্ত্রী-কন্যাদের সঙ্গে কাটিয়েছেন। দেখেছেন কীভাবে তারা পোশাক পরে, চলাফেরা করে, কথা বলে ইত্যাদি। আবার ঢাকায় ফিরে অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদের বাড়ির ছাদে ট্যানিং লোশন লাগিয়ে সারা দিন বসে থাকতেন। এই করে করে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর এসে গিয়েছিল তার। মজার ব্যাপার হলো, রূপা গাঙ্গুলীর সারা হাত-পা-মুখ রোদে পুড়লেও ঠোঁট তার রোদে পোড়ে নি। তাই একটি দৃশ্যের শুটিং-এর সময় গৌতম ভেবেছিলেন, রূপা ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়েছেন। রূপা যে লিপস্টিক লাগান নি তিনি তা বিশ্বাস করতে পারেন নি। ঠোঁট ঘষার ফলেও তা লাল থেকে যাওয়ায় শেষে কালো রঙ রূপার ঠোঁটে লাগিয়ে শুটিং করা হয়েছিল।


অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন উৎপল দত্ত, রবি ঘোষ, আবুল খায়ের, সুনীল মুখোপাধ্যায়, আহসানুল হক মিনু, কেরামত মাওলা, মৃণাল কান্তি ঘোষ, সৈয়দ হাসান ইমাম, কে এস ফিরোজ, আফজাল শরীফ, বলাই সরকার, শোভা সেন, কমলিকা গুহ ঠাকুরতা, রোজী আরেফিন, তন্দ্র ইসলাম, মায়া ঘোষ, দীবা নার্গিস, অরুণ মুখোপাধ্যায়, আমিরুল হক চৌধুরী, এম এ সামাদ, বিমল দেব, দেবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, গোড়া সর্বাধিকারী, আজিজুল হাকিম, রামকৃষ্ণ সিনহা, সীমান্ত চট্টোপাধ্যায়, এ বি সিদ্দিক, মুক্তি, আনন্দি ঘোষ, ইশান ঘোষ, অঙ্কন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।


ছবিটি পরিচালনা ছাড়াও চিত্রনাট্য রচনা ও চিত্রগ্রহণের দায়িত্ব পালন করেছিলেন গৌতম ঘোষ। সম্পাদনা মলয় বন্দ্যোপাধ্যায়। সংগীত গৌতম ঘোষ ও আলাউদ্দিন আলী।


‘পদ্মা নদীর মাঝি’ বাংলাদেশে মুক্তি পেয়েছিল, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৯৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি—ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামের সাতটি সিনেমা হলে : মধুমিতা, শ্যামলী, পূর্ণিমা, পদ্মা, বিডিআর, ডায়মন্ড (না.গঞ্জ), বনানী কমপ্লেক্স (চট্টগ্রাম)।


মুক্তির পর চলচ্চিত্রটি দর্শক ও সমালোচক মহলে সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়। প্রবীণ সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার ওবায়েদ উল হক ছবিটিকে ‘কালোত্তীর্ণ চিত্রকর্ম’ হিসেবে অভিহিত করেন। চলচ্চিত্র সমালোচক মো. মাহতাব উদ্দীনের ভাষায়, ‘পদ্মা নদীর মাঝি বাংলাদশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি মাইলফলক’।
 

Leave a Reply

Your identity will not be published.